Advertisement
  • ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
  • এপ্রিল ২১, ২০২৪

মাটি ব্রতের আখ্যান। পর্ব ২৩

সুধীরকুমার শর্মা
মাটি ব্রতের আখ্যান। পর্ব ২৩

অলঙ্করণ: দেব সরকার

।। কাদাকান্ড ।। 

দেবলোক হইতে পুনর্লেফাফা 

 

মুক্তোকান্দি,
যশোহর,পূর্ব-পাকিস্তান
২৬ শে মার্চ, ১৯৫৬

 

নীলুদাদা, 

            আমাকে তোমার মনে পড়ে কিনা জানি না। নসিবের ফেরে মানুষে মানুষে শত্রু হয়ে গেছি। আমার বিরুদ্ধে হয়তো তোমার নালিশ থাকতে পারে।
 
 দেশ ছেড়ে যাওয়ার সময় জ্যাঠামশাই (তোমার বাবা) শ্রী চন্দ্রমোহন আচার্য তাঁর একান্ত আত্মীয়সম বন্ধু আমার আব্বাজান (জনাব জয়েনউদ্দিন নস্কর) ও আম্মিজান (কুলসুম বেগম) — এই দুইজনের কাছে বেশ কিছু দরকারী বিষয়দ্রব্য জিম্মায় রেখে গেছেন। সেগুলি অল্প হলেও কম না। তার মধ্যে আছে তোমাদের কুঠিজমির দলিল, জেঠিমার সোনার একাধিক জেবর। জ্যাঠামশাই ছিলেন আমাদের গ্রামের সকলের শ্রদ্ধাভাজন। একথা নিশ্চয়ই তোমাকে বলে বোঝাতে হবে না। 
 
    তোমার সন্দেহ হতে পারে। সন্দেহ কেন, বিশ্বাসই করো হয়তো যে ওই সম্পদ জয়েনউদ্দিন নস্কর ও তাঁর পরিবারের জনেরা আত্মসাত করে নিয়েছেন। পরস্পরের যোগ নাই। মোলাকাত নাই। সত্যের রাস্তার সংযোগ রেখাটা তালাস করে পাওয়া যাবে না। মিথ্যা বড়ো হয়ে ওই ফাঁক ভরে দেবে। রাজত্ব করবেই। কাজেই তুমি যদি এইরকমই নিশ্চয় সিদ্ধান্ত করে থাকো, আশ্চর্যান্বিত হবো না। রাগও করবো না। তুমি নিকটে নাই। সত্যি হোক, মিথ্যা হোক, কলহকাজিয়া করবো কার সাথে ? বড়োজোর তোমার ছায়াপুতুল বানিয়ে অন্ধকারে একা একা তকরার করতে পারি।
 
      যা হোক, তোমাকে অনেক কথা বলার প্রয়োজন। তোমার জানা দরকার আছে। আব্বার এন্তেকাল হয়েছে। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তাঁর অবিচল বিশ্বাস ছিল যে তাঁর আচাজ্জি আর ভাবিজান ফিরে আসবেন মুক্তোকান্দিতে। যদি পার্মানেন্ট বসবাস নাও করেন, শুধু বন্ধুর সঙ্গে মোলাকাত করতে আসবেনই। একটা পাসপোর্ট হলেই যথেষ্ট। ভিসার জন্য নস্কর বাড়ির লোকজন আছে। এখানে জ্যাঠামশাইয়ের বাড়িটি আছে স্বজন আছে, আছে ছাত্রগনও। এতলোক এলোগেল। জ্যাঠামশাই জেঠিমা এলেন না। তোমরাও আসলে না। 
 

শাদি করেছি। বিবির নাম শানাজ। একটা ফুটফুটা মেয়ে হয়েছে। নাম  সোনালী। চমকে উঠলে? আরবী নাম না কেন ! যথেষ্ট ভাবনাচিন্তা করেই স্থির করলাম। আচ্ছা, আরব দেশটা যদি বাংলাদেশ হতো, যদি ওখানকার মানুষগুলা আমাদের বাংলা ভাষায় কথা কইতো, তবে হজরতের নাম কি হজরত মহম্মদ রাখতেন ? না, সাধু শ্রীমহৎ নামে পরিচিত হতেন? পাগলামো যুক্তি মনে করতে পারো। এইরকম ভাঙাচুরার কাজ ইষ্ট পাকিস্তান জুড়েই আরম্ভ হয়েছে

 
      তোমাকে জানিয়ে রাখি, নীলুদাদা। আব্বু জীবন দিয়ে আচার্য বাড়ির সহায় সম্পদ রক্ষা করেছেন। এজন্য আঘাত আক্রমণ কম সইতে হয়নি তাঁকে। তুমি কি মনে কর, মুসলমান মুসলমানের শত্রুতা করে না ? বৈরিতার জন্য কোনও ধর্মভেদ আছে নাকি? আব্বা বেহেশতে গেলে আম্মিজান কেমন জানি হয়ে গেলেন। তিনমাস লাগলো না, তিনিও এন্তেকালের পথে রওনা দিলেন। কোথায় আমি পড়ে আছি। একা ঠিক না। শাদি করেছি। বিবির নাম শানাজ। একটা ফুটফুটা মেয়ে হয়েছে। নাম রেখেছি সোনালী। ওইটা ভালো নাম। আমরা ডাকি সনাই বলে। তুমি চমকে উঠলে? আরবী নাম না কেন ! খেয়ালখুশিতে না, যথেষ্ট ভাবনাচিন্তা করেই স্থির করলাম। আচ্ছা, আরব দেশটা যদি বাংলাদেশ হতো, যদি ওখানকার মানুষগুলা আমাদের বাংলা ভাষায় কথা কইতো, তবে হজরতের নাম কি হজরত মহম্মদ রাখতেন ? না, সাধু শ্রীমহৎ নামে পরিচিত হতেন? পাগলামো যুক্তি মনে করতে পারো। এইরকম ভাঙাচুরার কাজ ইষ্টপাকিস্তান জুড়েই আরম্ভ হয়েছে। ঢাকা,রঙ্গপুর,পাবনা,বরিশাল শহরগুলাতে মুসলমান ঘরের শিক্ষিতা বিবিরা হাতে শাঁখার চুড়ি পরছেন। কপালে সিন্দুরের টিপ দিচ্ছেন। মোল্লাদের ফতোয়ার ভয়ে সিঁথাটা এখনো রাঙ্গান নাই। মনে হয় আর কিছুদিন পর সেটাও চলিত হবে। ঢাকা শহরের খবর আরও ভয়ানক। সেখানে উর্দু গজল গান গাইলে লোকেরা ঠাট্টা করছে। আচ্ছা, বলোতো, গীতবাদ্যের কি পূর্ব পশ্চিম, বাঙ্গালী বিহারী ইসলামী সনাতনী হয়! ভয় লাগে, এ নিয়া জিহাদিরা আবার না ক্রুসেডের ফরমান জারী করে বসে। সামনেই, শুনছি ইলেকশন হবে। অনেকদিন ধরেই আজ হবে কাল হবে হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত সত্যি যদি হয়, মুসলীম লীগ হেরে জিন ভূত হয়ে যাবে। 
 

তোমাদের মধ্যে একজন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এসেছিলেন। আব্বু তাঁকে নবি কইতেন। বলতেন আল্লার আঙ্গুলের ভুলে উনি নাকি হিন্দু জাতের মধ্যে পড়ে গেছিলেন। বড়ো দুঃখে বলতেন হাসির মোড়কে। আমি কঠিন কইবো উনি দয়ার সাগর। তা উনার দয়ার নজর ত্যারচা হয়েও একবারের জন্যও মুসলমান জাতির উপর পড়লো না ! তিনি বিরোধী হিন্দুদের মধ্য থেকেই যদি সহায় পেয়ে থাকেন, মুসলমান ঘর থেকেও নিশ্চয়ই পেতেন। তিনিও হয়তো কুসংস্কার বশে আমাদের আরব দেশাগত বিদেশীই ভাবতেন

 
       এত কথা লিখছি, নিজের কথাটা বেশি বলা হয় নাই। আমি নলিনবিহারী উচ্চ বিদ্যালয়ে মাষ্টারীতে যোগ দিয়েছি। অন্য মাষ্টারমশাইয়েরা বলছেন, আবার পাঠদান পদ্ধতি নাকি আচার্য স্যারের মতো লাগে। লজ্জা পাই, অহংকারও পাই, আবার ভয়ও পাই। ইস্কুলের খবর শুনো। নতুন দালান হয়েছে। ছাত্রদের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। হিন্দু শিক্ষকেরা প্রায় সকলেই ইন্ডিয়ায় চলে গেছেন। কেবল দুজনকে আমরা জোর আরে আটকে রেখেছি। তুমি তাদের চেনো— শ্রী দেবেন্দ্র মজুমদার ও শ্রী সত্যভূষণ গুহঠাকুরতা। প্রথমটায় তাঁরা বুঝতে পারছিলেন না কী করবেন। এখন তাদের শিকড় আবার এ মাটিতে বসে গেছে। তাঁরা ভালো আছেন। গ্রামের হিন্দু নীচ জাতীয় লোকেরা অধিকাংশই দেশ ছাড়ে নাই। তাদের ছেলেবেলা পড়াশোনায় ভিড় করেছে। ফার্স্ট জেনেরেশন। দেশে ফিরলে দেখতে পেতে সে মুক্তোকান্দি আর নাই। জিলাবোর্ডের সুড়কিমোরাম রাস্তাটি পাকা হয়েছে। সদরের কয়েকটা বাস মুক্তোকান্দি হয়ে যায়। রাস্তা থেকে স্কুল পর্যন্ত কাঁচা রাস্তাটিও এখন পিচের। নাম দিয়েছে স্কুল রোড। জ্যাঠামশাইয়ের ছাত্র রুকনুর ইসলাম ঢাকা আর্ট কলেজের প্রফেসর হয়েছেন। তিনি নিজের প্রণোদনে পোড়ামাটি দিয়া জ্যাঠামশাইয়ের আবক্ষ মূর্তি বানিয়ে দিয়েছেন। গেটের পরে একটা ছোটো আঙিনা করা হয়েছে। সেখানে বেদির উপরে স্থাপন করা হয়েছে মূর্তিটা। সরকারী হুকুমে ড্রেস চালু হয়েছে— নীল রঙের ফুল ইজার ও সাদা কুর্তা। মেয়েদের জন্যও একটা স্কুল খোলার কথা হচ্ছে গ্রামে। তবু দিদিমনির অভাব। হিন্দু শিক্ষিতেরা নাই, আর মুসলমান জাতের নারীসমাজে মোল্লাহুকুমে শিক্ষা নিষিদ্ধ ফল। হাদিসের নিয়মকানুন, হাদিসের ভুল বিচার, হাজার বছরের কুনাস্বভাব, এসবই কারণ। জ্যাঠামশাই বলতেন যে কোদালে চাক তুলে জমা করলেই ধান ফলান যায় না। লাঙ্গল মই দিতে হয়, সার গোবর লাগে, আগাছা নিড়ানি, জলসেচ, কত পরিশ্রম লাগে।কোনও বদলই যে একদিনে হয় না। তোমাদের মধ্যে একজন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এসেছিলেন। আব্বু তাঁকে নবি কইতেন। বলতেন আল্লার আঙ্গুলের ভুলে উনি নাকি হিন্দু জাতের মধ্যে পড়ে গেছিলেন। বড়ো দুঃখে বলতেন হাসির মোড়কে। আমি কঠিন কইবো উনি দয়ার সাগর। তা উনার দয়ার নজর ত্যারচা হয়েও একবারের জন্যও মুসলমান জাতির উপর পড়লো না ! তিনি বিরোধী হিন্দুদের মধ্য থেকেই যদি সহায় পেয়ে থাকেন, মুসলমান ঘর থেকেও নিশ্চয়ই পেতেন। তিনিও হয়তো কুসংস্কার বশে আমাদের আরব দেশাগত বিদেশীই ভাবতেন। বিপরীত হলে হয়তো তোমার আমার স্বজন হারানো দেশের মানচিত্র অন্যরকম হতো।
 
             যাক গে, এতকথা বললাম, আসল কথায় আসি। তুমি যদি বলো যে তোমাদের ধনসম্পত্তি আমি আত্মসাত করেছি, বলতে পারো। আমার যায় আসে না। কারণ সেটাই করেছি। মুসলমানেরা বিশ্বাসঘাতকতা করেই থাকে। মীর জাফরের উদাহরণ তোমাদের হাতে গরম। মীর মদনের নমুনাটা মনে আসে না। কেন? দুজনায় তো একই যুদ্ধক্ষেত্রে ছিলেন! আব্বাজানের মতো আমার দেহেমনে সাহস নাই কিংবা অনির্দিষ্ট ইনসানিয়াৎ কবুলের জন্য তিল তিল করে গড়ে যাবার বাসনা নাই। 
 
             তুমি জানো, মালদা টাউনে আমাদের ছোটোমামু থাকতেন, তোমাকে ভাবীজানকে নিয়ে ঐ বাড়িতে উঠেছিলাম। তার নিকট থেকে তোমার সংবাদ আব্বু কিছু পেয়েছিলেন। মামুরা ওদেশের পাট তুলে চলে এসেছেন ফরিদপুরে। কাজেই আর কোন খবরই নেই। এদিকে নতুন মোল্লারা, তাদের চেলারা, এসে ধমকাচ্ছে, বাড়িটা দখল নেবে। পুলিশ এসে ভয় দেখাচ্ছে, ঐ সম্পত্তি শত্রুসম্পত্তি। তখন দেখলাম, এই সুযোগ সম্পদ গ্রাস করা।
 
             গ্রামের কয়েকজন মিলে তৈরি করেছি চন্দ্রমোহন সংসদ। বাড়ি জমির দলিল দান করেছি ওই সংঘে। গতবছর থেকে মিলনমেলা বসছে সামনের উঠোনে বাগানে। বাউল ফকিরেরা কোথা থেকে এসে ভিড় করে। দোকানপাট, হৈ হুল্লোড়। গ্রামের মানুষেরা আগের মতোই মিলেমিশে যায়। জেঠিমার গহনাগুলা নিলাম ডেকে বিক্রয় করেছি। সোনার দাম দিন দিন বাড়ছে এদেশে। জমান নগদও ছিল। দুই মিলিয়ে তিরিশ হাজার টাকারও বেশি হয়েছে। সমস্ত অর্থ নলিনবিহারী উচ্চ বিদ্যালয়ে দান করা হয়েছে। স্কুলে একটা হলঘর বানান হয়েছে, নামরাখা হয়েছে চন্দ্রমোহন হল। ঘরটা সরকারি টাকায়। আমার কোনও অপরাধবোধ নাই, নীলুদাদা। সন্তানের অধিকার থাকে পিতৃপুরুষ প্রদত্ত সহায় সম্পদ নিয়ে যা খুশি করার। আমি জানি, আমি চন্দ্রমোহন আচার্যের সন্তান স্বরূপই ছিলাম। সুতরাং কসুর নাই। 
 
           হয়তো এই চিঠি তোমার সঙ্গে আমার শেষ পত্রালাপ। ভিন্ন দেশে ভালো থেকো তোমরা দুজনা। রহমৎ আল্লা নিশ্চয়ই তোমাদের ভালো রাখবেন।
 
ইতি,
একরাম উদ্দিন নস্কর  

 

♦—♦♦—♦♦—♦♦—♦

ক্রমশ…
 
আগের পর্ব পড়ুন: পর্ব ২২

মাটি ব্রতের আখ্যান। পর্ব ২২


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!