- ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
- এপ্রিল ২৮, ২০২৪
মাটি ব্রতের আখ্যান। পর্ব ২৪

অলঙ্করণ: দেব সরকার
।। কাদাকান্ড ।।
নিভু অন্ধকার, ঝলকে তারাবাতি
চরগাঙপুরে আজকের সভাটির চরিত্র আলাদা। বাছাই করা আটজন ডাক পেয়েছে।গোপন সভা, সভার খবরও গোপনে রাখতে হবে। সেটা বসছে মজাবিলের ধারে পোড়ো শিবমন্দিরের ভাঙা চাতালে।
কেন এত চুপিসাড় সাধন বুঝে উঠতে পারে না। বদহজম হলে যেমন হয়, উসখুশানি তাকে ধাক্কা দেয়। কুঞ্জ বলেছে সোজা মন্দিরে চলে যেতে। তেল ভরা ডিবেকুপিটা যেন নিয়ে যায়। আবার সাবধান করেছিল, কেউ যেন টের না পায়।কে কে যাচ্ছে সাধন জানে না। ও যাবে। কর্মী সে, দলের নির্দেশ মানতেই হবে।
তার উপর অনেক দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছেন সতীন দা। কলোনির মানুষেরা, অধিকাংশই, ওই নামে ডাকছে। সতীন্দ্রনাথ খুশি হয়েছেন। কলেজ প্রফেসরির আলখাল্লাটা এখানকার মানুষের কাছে দূর ঘোচাতে বাধা হয়ে ছিল। বিশেষ করে এই সময়। নতুন কাজের চাপ আসছে। আরও লোক দরকার, আরও দরদী। শুধু কথায় আপনজন হওয়া, এটা যেমন সত্যি তেমনই কথা দিয়েই যে মানুষে মানুষে আপনবোধের সেতুটি বানাতে হয়। সতীন টের পাচ্ছেন সাঁকোটি বেশ মজবুত হয়েছে। সাধন ভাবছে অন্য কথা। গন্ডগোল কিছু ঘটেছে! স্কুল তৈরির ব্যাপারটা সাধন দেখছে না। যারা দেখছে তারা ব্যস্ত, সেটা সে দেখেছে। বাঁশ কেটে জোগাড়, মাঠে ফেলে কাঁচারস শুকোনো, সবই। ওকাজে নতুন কয়েকজন ভিড়েছে, তার মধ্যে যোগেশের ভাই নরেশ ও তার বন্ধুরা। নরেশ প্রতিদিন সন্ধে হলে জমা বাঁশগুলি গোনে। বলা যায় না, চরের লোকেদের যে অভাব আছেই। হয়তো দেওয়ার খোঁটাটা উই ঝুরো করে দিয়েছে, একটা বাঁশ পেলেই মেরামত হবে যায়। বাঁশের দাম যে চড়া বাজারে। একটা ছটাকা চায়, পঁচিশ কিলো চালের দাম। একটি পরিবারের নিশ্চিন্ত গ্রাসাচ্ছাদন। সকলেই যে যুধিষ্ঠির হয় না। দু একটা বাঁশ রাতের অন্ধকারে বিক্রি করে মুফতে টাকা কামিয়ে নিল। সাধন মনে করলো ইস্কুলের সমস্যা মনে হয় না। তবে কিসের! স্কুলের চাঁদা! হিসাব নিকাশে ঝামেলা! সাধন ছোটমাথায় তল পেল না।
বউয়ের দিকে তাকাতে দ্বিধা জাগছে সাধনের। রমা আঁচ পেয়ে যাবে। বউ তো না, চতুরির শাউড়ি! অস্বস্তিবোধ হচ্ছে কেমন। সময়টাও ঘনিয়ে আসছে।
রমা দরজায় ছিল, হঠাৎ জিগ্যেস করে, — কী গো, দুকান খোলবা না?
সেই অসোয়াস্তি ! বউয়ের জিভে গোলমরিচের দানার রস। বিষ্যুদবার নয় তবু দোকানটা বন্ধ রাখতে হবে। ব্যাপারটা চাপা যাবে না। রমা খর চোখ মেলেই আছে। সাধন ইতিউতি ভাবে, সামাল দিতে বললো, — এট্টু কাম পড়িছে, তাই…।
— ও। — রমা ঘরের কোনের দিকে যাচ্ছিল, চোখ না ফিরিয়েই বলে, কী কাম?
এই যে, এবার দারোগাই জেরা শুরু করবে। নাড়ীনক্ষত্র টেনে বের করবে। সাধন কি বাচ্চা ছেলে! নিজের ইচ্ছেমত কাজ করার অধিকার নেই ? বিয়ে করেছে বলে বউয়ের শ্রীচরণে দাসখত লিখে দিয়েছে নাকি? রাগটা হেমশশীর উপর ধেয়ে যায়। রমার জন্য নিজের হৃদয়ের ভাব উথলে ওঠেনি, একথা সাধন হলফ করে বলতে পারে। খুড়িমা যে কী ভাবলেন কে জানে! তাঁর কথার উপর কথা চলে না। নইলে ওকে নিকে করতো কোন চাঁড়ালের পো! এমন একটা ঝগড়াঝাটির মেঘ যখন জমছে তখন ভাগ্যিস, গোপাল বাইরে, ছেলেপুলেদের সঙ্গে সামনের ফাঁকা মাঠটায় খেলছে। বাপমায়ের কলহে ওর মুখটা কেমন কাদা হয়ে যায়। রমা এসব বোঝে না। সাধন বুঝিয়েছে। বুঝবে না। ছেলের চোখে জল এলে রমা ওকে জড়িয়ে ধরে খিলখিল করে হাসে, — না, সুনা, তর বাপেরে কিছু কই নাই, আদর করতাছিলাম। আয়, একখান ফেণি বাতসা মুখে দে। তর লিগাই যে আইন্যা রাখছে তর বাবায়। মোখভত্তি অমেত্তরস ভইরা যাইবো। আমি একখান, তুই একখান। — ন্যাকামো ! সাধনের রাগ আরও চড়ে। ইচ্ছা হয় বউকে ফেলে বিবাগী হয়ে যাবে। কিন্তু গোপাল! ওকে ফেলে অমানুষের কাজ কী করে করবে সে ! যাবে যে, উপায়ও নেই রমা তাকে গোরুর দড়িতে পাকে পাকে বেঁধেছে। দোকানের রেডিমেড পোষাক থান কেটে ওই বানিয়ে দেয়। নিজের পা-সেলাই-মেশিন তো আছেই, আরও দুটো হাতমেশিন কিনেছে। পাড়ারই দুজন বউ ঝিকে কাজে নিয়েছে। রমা কাটিং করে দেয়, ওরা সেলাই করে। দুপুরময় ঘরে ঘড়ড় ঘড়ড় শব্দ। দোকানটাই যেন রমার। সাধন কর্মচারী মাত্র। কেপিটেলের জোরেই রমার এত চোপা, এত বাড়বাড়ন্ত।
ল্যাম্পোর সামনেটায় হলদেটে আলোর গন্ডি, চাতালের সবটা দেখা যায় না। বসানো রয়েছে আবার আড়পাঁচিলটায়। মনে হয় ধোঁয়ায় যাতে কারো অসুবিধ না হয়, সেটাই উদ্দেশ্য। অন্ধকারে প্রায় কাউকেই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না
— কামটা কুনস্থানে? আমাগো এইখানে?
সাধন হুঁ না কিছু একটা আওয়াজ করলো নাকে।
— নইয়িটি যাইতাছো না তো? শুনছি ওইখানে তিননম্বুর গলি রইছে। বেবুইশ্যারা থাকে। কওন যায় না। কাচাপয়সা পকেটে আইতাছে, ফোত্তির আউশ জাগতেই পারে। বউ পুরান হইয়া গেছে, আর কি তারে মনে ধরে!
— কী আবুল তাবুল বকতিছো, কওতো! কলাম, একখান ব্যাক্তিগত কাম আছে।
— ব্যাক্তিগত কাম আবার কি ! নিতাইদা কী কইছিলেন মনে করো। সেই মিটিনে তুমি জিগাইছিলা। মনে পড়ছে?
সাধন অনেকক্ষন ধরে স্মৃতি হাতড়ায়। রানাঘাটে কোন সভায় এ নিয়ে কথা হয়েছিল! অবশেষে একটু একটু যেন ভেসে এলো।
সেদিন নিতাই সরকার বলেছিলেন, খাঁটি অর্থে মানুষের ব্যাক্তিগত কাজ মাত্র তিনটে— পায়খানা যাওয়া, পেচ্ছাপ করা, আর বউ বা স্বামী থাকলে তার সঙ্গে একটু গোপন খেলা করা। মানুষের বাকি সব কাজ সমষ্টিগত। এমনকি খাওয়া ঘুমোনোটাও। যেটা আমার কাজ বলে ভাবি আমরা সেটাও অন্যের সঙ্গে জড়ানো।
সাধন ভাবছে, রমা হঠাৎ নিতাইদার কথা তুললো কেন? বহুদিন নিতাইদা বউদির সঙ্গে দেখা হয়নি। আসছে বিষ্যুদবারেই যাবে। রমা গোপালকেও নিয়ে যাবে।
— পাট্টির কাজে যাইতেছ বুঝি? আমারে গোপ্ত কইরা লাভ নাই, বিপদে পড়বা। — রমা গজরাতে গজরাতে ভিতরে গেল। ভেসে আসে— পাট্টিতেই খাইলো।
সাধন গুম হয়ে বসে থাকে। আজকের সভাটা গুরুত্বপূর্ণ। যাওয়ার আগেই এমন ঝামেলা!
একটু পরেই রমা ফিরলো, হাতে কলাইয়ের জামবাটি ধরা মুড়ি, উপরে গোটাবারো ফেণিবাতাসা ছড়ানো। সাধনের হাতে দিল, — যেখানেই যাও প্যাট পুইরা খাইয়া যাইবা। কত দের হইবো কওন যায় না। মায় তো প্রথম দিনই কইয়া দিছে , হ্যার পুলায় ক্ষুদা সইঝঝো করতে পারে না।
— একঘটি জল দেও, ভিজোয়ে নেচ্ছি।
— এমনি কইরা বাতসা মুড়ি নি খায়? ধীরজে খাও। সুমায় তো বইয়া যায় নাই। — রমা পাশেই বসে, সাধনের পিঠে হাতে বিলি কাটে। খোলা দাওয়া, বিকেলের নেভা রোদ, লোকজন কাজে অকাজে পথে বেরুতে শুরু করেছে। সাধন বউয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে, অবশ লাগে শরীর। তারপরই চমক ভাঙে, — কী করতিছো! লোকে দ্যাখবে।
— দেখুক, আমি আমার নাদান সুয়ামিটারে কেমনে বশে রাখি।
মনে হল সকলেই এসে গেছে। বিলম্বের জন্য লজ্জা লাগে সাধনের। একটা কুপি জ্বলছে, দেখলো। আলোটা ভালো হলেও হ্যাচাকের মতো বিস্তারী নয়। ওটা নিয়ে আসবে ভেবেছিল, দলের তরফে নিষেধ হয়েছে। ল্যাম্পোর সামনেটায় হলদেটে আলোর গন্ডি, চাতালের সবটা দেখা যায় না। বসানো রয়েছে আবার আড়পাঁচিলটায়। মনে হয় ধোঁয়ায় যাতে কারো অসুবিধ না হয়, সেটাই উদ্দেশ্য। অন্ধকারে প্রায় কাউকেই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। অনুমান করলো, মাঝখানে সতীন্দ্রনাথ, তার দুপাশে কুঞ্জ ও অনিমেষ। একমাত্র ভোলানাথকে তার ভারী শরীরের জন্য পুরোপুরি চেনা যায়। তবে ওদের কথা শুনতে পেলেই অপরিচয়ের আড়াল থাকবে না। সাধন একজনকে ঠেলা দিয়ে ভাঙা মেঝেতে বসলো।
— এত দেরি করলি ক্যান ?
— আরে দয়াল, তুই! কান্ডখান দ্যাখ। আন্ধারে চেনতিই পারি নাই । হয়্যা গেল বেলম্ব।
— যেদিন আন্ধারে চ্যানাচেনি হইবো, সেদিন সব চ্যানার চেপটার অন্ত হইয়া যাইবো রে।— এরকম কথার মানে বোঝা সহজ নয়। দয়াল মাঝে মাঝে এরকম ভাবের কথা বলে। আউলি বাউলি গান বাঁধে। চরগাঙপুরে তার খাতির — দয়াল ফকির।
সাধন অনুমান করে কয়েকজন মেয়ে এসেছে। একজনকে চিনলো— পুতুল দিদি। সতীনদাদের সঙ্গে থাকেন সব কাজে। গোরাসাহেবদের সঙ্গে লড়াই করেছিলেন বলে শুনেছে। স্বামীর সঙ্গে কতবার জেলে গেছেন। এখন বিধবা, চুলে সামান্য সাদা পাড় একপাশ জুড়ে। আর কেউ থাকলে ভুতের মতো আবছায়া। কুপির আলোটা যে পিছনেই। শিখাটাও নিভু নিভু।
কুঞ্জ বললো, — সকলে এসে পড়েছেন তো? সাধনদা…।
— আসিছি।
এবার সতীনের গলা, — তাহলে, কুঞ্জ, শুরু করে দাও। আর একটা কথা, দিদি বউদিরা ও ল্যাম্পোটা নিবিয়ে দিন। আপনাদের একজনের ডিবেটা জ্বালিয়ে দিন। ওটার তেল ফুরিয়ে এসেছে।
খড়খড় করে একটা কন্ঠস্বর বেজে উঠলো, — আমার ডিব্বাখান আমার কত্তায় লইয়া আইছে। তারে কন, আইয়া পিছনে কুপিখান ধরাইয়া দেউক।
আশ্চর্য! সাধনের মাথা ঝনঝন করে, রমাও এসেছে! বউকে এতক্ষণ দেখেও চিনতে পারেনি! ইচ্ছে হয়, ওর সঙ্গে সব সম্পর্কই শেষ করে দেবে। এখানে আসবে, কই, বলেনি তো! স্বামীকেও বিশ্বাস করে না! ফিরুক বাড়িতে। ঝামেলা হলে হবে। গোপালকে একা রেখে আসা! রমা এত অগোছালো! তারপরই সাধনের মনে হল, খুড়িমা নিশ্চয়ই ফিরে এসেছেন ঘরে। সে কুপিটা নিয়ে দেয়ালের কাছে যায়।
আজ তর্কাতর্কি বাদ বিসংবাদ হলই না। প্রথাভাঙা। একেবারে শান্ত সমাবেশ। শোনা গেল এমন সব কথা, হতভম্ব হতে হয়। আবার এমন খবরও, যেখানে সাফল্যের সন্ধানে আনন্দে মাতোয়ারা হতেই হবে।আসছে সপ্তাহেই স্কুলবাড়ি তৈরির কাজ সম্পূর্ণ হবে। কুঞ্জরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের নাম সংগ্রহ করে ফেলেছে। আপাতত তিনটে ক্লাস খোলা হচ্ছে— ইনফিন, ওয়ান আর টু। এখন সরকারি সাহায্য মিলবে না। ক্ষতি নেই। স্বেচ্ছাশ্রমে চলবে। স্কুলটা এ জমিতে জবরদখলের মতোই একটা বড়ো লড়াই। ভবিষ্যতের ঘন অন্ধকার দূর করে আলো ফোটাবার অসম সাহসী যুদ্ধ। একবছর দেড়বছরের মধ্যেই সরকারি মান্যতা আনতে হবে। কাজেই স্কুলের লড়াইটা এখনই থামছে না। কলোনি থেকে প্রাইভেটে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিচ্ছে কয়েকজন। পাশ নিশ্চয়ই করবে। ওদের মাষ্টারির চাকরিটা পাকা হবে। সরকারি মাইনে। চরগাঙপুরে নতুন দিনের সূচনা হবে।
দ্বিতীয় বিষয়টি আরও গুরুত্বপূর্ণ। ভোট এসে পড়লো প্রায়। নির্বাচন কমিশন এখনও তারিখ জানায়নি, কিংবা দলগুলিও প্রার্থীদের নাম ঘোষনা করেনি। কিন্তু দামামা বেজে গেছে। কানাঘুষোয় শোনা যাচ্ছে স্টেশনের পুব পাড়ে যে বিশাল জমিদারী প্রাসাদ পেট-অভাবী মানুষকে লজ্জা দেয়, সে ঘরের বউরানি অরুন্ধতী রায়চৌধুরী জোড়া বলদ চিহ্নের টিকিট নিয়ে দাঁড়াচ্ছেন দরিয়াদহ বিধানসভায়। চরগাঙপুর ওই আসনকেন্দ্রের মধ্যে পড়ে। একুশ বছর বয়স হলেই ভোট দেবে সকলে। তাদেরই হাতের ছাপে দুনিয়ার বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশে শাসক তৈরি হবে। শুনে গায়ে জ্বরতাপ অনুভব করলো যেন সকলে। অনেক অনেক দিন দেশ ছেড়ে এদেশে অনিকেতী ভেসে ভেসে বেড়ানোর হুতাশী অস্থিতি যেন কেটে যাচ্ছে, এইবার বুকবাজিয়ে তারা বলে উঠবে, — আমরা রিফুজি না, এটা কলোনি না, আমাদের গ্রাম চরগাঙপুর।
শেষ আলোচ্যের মূল্য সর্বাধিক। সতীনদারা অনেকদিন ধরে চেষ্টা করছিল। সেটার সমাধা হয়েছে। কুন্ডুবাবুরা আদালতে যে মামলা করেছিল, তার রায় ঘোষিত হয়েছে। হেরে গেছে কুন্ডুরা। সরকার আগামিমাস থেকে এ চরের বাসিন্দাদের হাতে পাট্টা তুলে দেবে। হাততালিতে ফেটে পড়ছিল সভাস্থল।
— দলিল দিবো তো, কুঞ্জবাবু? আমাগো হাতে?
— অবশ্যই।
— হায় জমি, — অন্ধকারে কে কেঁদে উঠলো।
— কুঞ্জদা, এবার আমাদের কথাটা বলো, — বললো অনিমেষ।
— হ্যাঁ।
গতবার নির্বাচনের আগে পার্টি বেআইনি ছিল। ভোটের মুখে এসে সরকার নিষেধ তুলে নিলেও পার্টি প্রার্থী দিতে পারেনি। এবারে সংগঠন বেড়েছে।
— আপনাদের মত মানুষেরাই আমাদের শক্তি।
এবারে পার্টি ইলেকশনে নামবে।দরিয়াদহ বিধানসভা আসনে সতীন্দ্রনাথ ও নবদ্বীপ লোকসভা কেন্দ্রে প্রার্থী হচ্ছেন নিতাই সরকার।
— একজন আপনাদের আপনজন মাষ্টারমশাই, অন্যজন আপনাদের জনপদ প্রতিষ্ঠার জনক। প্রথম জনকে কলকাতা, দ্বিতীয় জনকে জিতিয়ে দিল্লি পাঠাবো আমরা। নেহেরুর, বিধান রায়ের চোখে চোখ রেখে আমরা বলতে পারবো, আমাদের কথা শুনতে হবে।
— আস্তে, আস্তে, — বলে কুঞ্জ, — কতকগুলি বিষয়ে আপনাদের সকলের সাবধান হওয়া দরকার আছে।
গোপন শলা শুরু হয়ে যায়। বিপক্ষে ধনিক শ্রেনীর দল। পয়সার অভাব নেই। বড়ো বড়ো বেণেরা, কলমালিকেরা ওদের দেদার ঢেলে দেয়। বেআইনি আইনি দুপথেই। ওই দল তাদের শ্রেণিস্বার্থ রক্ষার দারোয়ান। ওরা কলোনির মানুষদের দুর্দশার কথা জানে, বুঝেছে, এই মানুষেরা এখন একটু থিতিয়ে পড়েছে, জঙ্গিপনার তেজটি স্তিমিত। এই দুই মিলে ওদের কাছে বড়ো সুযোগ। চেষ্টা করবে টাকা ছড়িয়ে, লোভ দেখিয়ে চরগাঙপুরকে কিনে নিতে। তাই সজাগ থাকতে হবে সবসময়। এবারের লড়াইটা যে অত্যন্ত কঠিন।
— যারা এইরকম করতে আইবো, তাগো যমাটিত ফেলাইয়া, গায়ের চাম চিরোইয়া, কুইঠ্যা রুগি বানিয়ে ছাড়ুম, — হুংকার ওঠে সভায়।
— না, না, ওসব করবেন না, ভাইয়েরা, — এতক্ষন পরে সতীন্দ্রনাথ কথা বললেন, — টাকাপয়সা যদি পাওয়া যায়, যাক না। যারা পাবে, তাদের কাজে লাগবে। আপনারা শুধু চোখ খোলা রাখবেন, যেন আপনাদের ক্ষতি করতে না পারে। অনিমেষ, আর কিছু বলার আছে? থাকলে চটপট সেরে ফেলো। ডিবেগুলোতে কেরোসিনের ভান্ডার বোধহয় ফুরিয়ে এসেছে।
অনিমেষ একটা ভাঁজ করা বড়ো কাগজ খুলে উঁচু করে ধরলো, নেভা নেভা আলোয় তার আঁকিবুকি স্পষ্ট হয় না, কেমন মায়াময় লাগে, বললো, — এইটা আমাদের দলের নির্বাচনী প্রতীক। এতেই ছাপ দেবেন, এই নিয়ে ভোটের প্রচার করবেন। দেখুন, এই হল ধানের শিস, আর নিচে গোছাবাঁধার ঠিক উপরে কাস্তে।
অনিমেষের কথা আর সাধন শুনতে পেল না। নাকে গন্ধ পেল। মুক্তোকান্দিতে, অঘ্রান মাসে ভরা ক্ষেতের শুকনো মাটি থেকে ওই গন্ধটা, রমার বুকে যে গন্ধটা থাকে, সেই গন্ধটা, এখন যেন এই সন্ধ্যায়, এই ছাপমারা কাগজটা থেকে, প্রায় মুমুর্ষু বিলের গা থেকে উঠে আসছে। সুড়সুড় করে উঠলো নাকটা। হাঁচি হবে না। নেশার মধুর আবেশ। যা তার কখনোই হয় না, সেটাই হল, অকস্মাৎ চোখ গলে অজান্তে গাল লেপে জল এসেছে। আচ্ছা, সাধন ভাবে বয়স হলে কি মানুষ দুর্বল হয়ে যায়! চোখে জল এলো কেন! খুড়েমশাই তো কত কষ্টের মধ্যে পড়েছেন, কই একদিনের জন্যও তাঁকে বিলাপ করতে দেখেনি সাধন। জন্মদাতা নয়, গর্ভধারিনী নয়,সহোদর সহোদরা নয়, কেবল চন্দ্রমোহনের স্মৃতি সাধনকে মন্থন করতে থাকে। গালটা যে এখানে অন্তত মুছে ফেলা দরকার সে বিস্মৃত হয়েছে।
অনিমেষ বলে যাচ্ছিল। এবারের নির্বাচনী যুদ্ধে মেয়েদের অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। ঘরে ঘরে, একেবারে রান্নাঘরের ভিতর দুর্গ গড়ে তুলতে হবে, — হুইসকারিং ক্যাম্পেন করবেন। কেউ টের পাবে না। জানবে না। এমনভাবে। রমা বউদি, আপনাকে যে একটু গুরুদায়িত্ব নিতে হবে।
— ওনিমেষদাদা, সারাদিন ঘরসোংসারের কাম। দুকানের পুশাক সিয়াইয়ের কাম। পুলাটারে দেখাশুনা। শাউড়ি ঠাইরেন নামে বাইরান। তার লিগা দোশ্চিন্তা।আপনের দাদার খালি হম্বিতম্বি। মাথা গরম হইয়াই থাকে। এতগুলা সামলাইয়া…। আমি পারুম?
— পারতেই হবে, বউদি। রানাঘাট থেকে আমাদের বউদি কমরেড সবিতা সরকার আপনাকে দায়িত্ব দিতে বলেছেন। সতীনদাও চাইছেন। আপনিই এই অঞ্চলে আমাদের নারীবাহিনীর সেনাপতি।
করতালিমুখর হলো।
— আস্তে, আস্তে, — কুঞ্জ বলে, — এটা গোপন সভা।
রমা লজ্জায় মাটিতে চোখ নামিয়েছে।
সভা ভেঙে গেছে। সকলে ফেরার পথে। একটু একটু করে লোক কমে যাচ্ছে। শেষে ভোলানাথ ও কুঞ্জ ঘরে ঢুকে গেলে রাস্তায় দুজন ছাড়া কেউ নেই। এতক্ষণ তাকে তোলা সাধনের রাগটা এইসুযোগে আবার ফিরে আসছে টুকটুক পায়ে। আনমনা ছিল বলেই হয়তো উষ্টা খেলো। আঘাত সামান্যই, তবু উঃ বলেছে। অন্ধকারে রমাকে দেখা যাচ্ছে না। ও কি আর তার জন্য অপেক্ষা করবে! আজ থেকে আবার মেয়ি নেতা!
— একটু ধীরে চলবা তো। কিষনোর পোকখো চলতাছে। এইখানে আবার ওই বড়ো তেনতোল গাছখান। ছায়া পড়ছে।
— হু।
— একটু খাড়াইবা?
— কী কবা, কও।
— কইতাছি, নিতাইদায় ভুটে খাড়ইতাছে। তেনায় খাড়ন নাই।
— মানি!
— কেন্ডিডেট আসলে তুমি আমি। বোঝলা, জিতাইতেই লাগবো।
— চিষ্টা করতি লাগবে। পেরাণপনে। — সাধনের গলা এখন বড়ো নেতার।
— পারুম। তুমি আমার সাথে থাকো। আমি সব পারুম। স-অ-ব।— রমা অন্ধকারেই ঠিক সাধনের হাতটিকে দেখতে পায়, ধরলো মুঠি ভরে, তুলে নিলো বুকের কাছে, দুবার চাপ দিল মুঠো আটকা পুরুষের হাতে, তারপর কী যে হল! চকিত বিদ্যুৎহানার মতো সাধনের বুকে মুখ রাখলো, ঘসছে সে তেঁতুলবীথির ছায়ায় স্বামীকে জড়িয়ে।
— কী করতিছো? পাগলি কোথাকার! ছাড়ো। এই দেখো! কেউ আসি পড়বে। কুকথা কবে।
— কী কইবো? ইস্তিরি সুয়ামীর বুকে মাথা রাখছে! এইয়া না কইরা সে কি পরপুরুষে পিরিত করতো? ডঙ্গের কথা।
— তোমার মাথাখান না পাগুলের ছাতা।
রমা জলতরঙ্গ বাজিয়ে হাসে, — ওই দেখো, তেনতোল গাছের নিচে জুনিপুকারা ভিড় জমাইয়া আলো ফেলতাছে। চলো, ওইগুলা ধইরা বেলাউজে ভরুম, শাড়িতে জড়িয়ে নিমু। তোমারেও জুনিতে ভইরা দিম। চলো …ও। — রমা যেন ষোড়শী বালিকা, সাধনকে টানতে টানতে জোনাকির অরণ্যে ছুট লাগালো।
♦—♦♦—♦♦—♦♦—♦
ক্রমশ…
আগের পর্ব পড়ুন: পর্ব ২৩
❤ Support Us