- ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
- অক্টোবর ২৭, ২০২৪
মাটি ব্রতের আখ্যান। শেষ পর্ব
ডাবলো সেকেন্ড অপশনটাই বেশি পারফেক্ট। তবে মার কাছে কীভাবে কথাটা তোলা যায় ! সমস্যা এটাই, অথচ বলতেই হবে, কালকের পর আর থাকা যাবে না...তারপর

তেরো নদীর জলে
রাতটা আজ একটু গড়িয়েই গেছে । গোপাল ঘরে ঢুকেই চিৎকার করলো — মা, খেতে দাও, পেট জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে ।
রমা বলে — হাত পাওখান আগে ধো । বাবায় আর তুই একলগে বইসা পড় ।
— তুমিও বেড়ে নাও, রাত হয়েছে ।
— আগে তগো দিয়া লই, তারপরে খাইতাছি ।
— আমি নিজে তুলে নেবো । বাবাকেও দিতে পারবো । তুমি বসো তো ।
রমার মনে হল ছেলের গালে ঠাস চড় বসায় । বড়ো বড়ো বাতইল্যা ! কাদের সঙ্গে মেলামেশা করে এসব আদব শিখছে কে জানে ! হেসে ফেললো তারপরই রমা । ছেলে সাবালক। তার গালে থাপ্পর মারা যায় ! কী সাংঘাতিক ভাবনা ! যে ছেলে ধমক খেলে হাসে, সে প্রহারে উদ্যত মায়ের হাত দেখে হো হো ফেটে পড়বে, মায়ের ভাষা নকল করে বলবে— বাবা, দ্যাখলা ! মায়ে ওম্মাদ হইছে । তুমি সামলাও ।
বাইরে ঝিঁ ঝিঁ ডাকছিল টানা । ওদের মাঝে মাঝে কী যে হয় ! দুম করে কনসার্ট ধরে বসলো ।
একটু আগেই সাধনের সঙ্গে কথা হচ্ছিল । বিষয়টা গুরুতর । শোরুমের মেয়েটিকে গোপালের পছন্দ হয় কিনা কী করে জানা যায়। সাধনকে গুপ্তচর বানিয়ে ওদের বাড়িঘর, বাবা মা, আত্মীয়স্বজনের খোঁজখবর নিয়েছে । সব মনোমতোই । শুধু গোপালের মতটা জানা চাই । আজ যদি হেমশশী বেঁচে থাকতেন ! রমার মনে অনেকদিন পর হেমশশীর আবির্ভাব হল । এমন হ্যাপার কোনও দরকারই পড়তো না । ঠাকুমার কাছে গোপালের জারিজুরি অচল হয়ে থাকতো । রমা মনে মনে বললো — মা গো, মা হওনের বড়ো জ্বালা ! আগে বুঝি নাই, মা । — জল এলো রমার দুচোখে ।
খাচ্ছিল বাবা ছেলে । থালা থেকে মুখ তুলে গোপাল দেখতে পেয়েছে — কী হয়েছে, মা, কাঁদছো কেন ?
রমা আঁচলে চোখ মোছে — কিছু হয় নাই রে । এমনই চক্ষু জ্বালা করছে ।
— উঁহু । কিছুতো বটেই । কী ?
— কই । তর ঠাকুমার কথা হঠাৎ মনে আইলো । য্যান, দ্যাখলাম তর পাশে মায় বইসা আছে ।
গোপাল বাঁহাত বাড়ায় মাকে ছোঁয় — জল খাও, মা । ঠাকুমা আমাদের সঙ্গে আছেন । সবসময় ।
রমা সামলে নিয়েছে নিজেকে । স্বামী সন্তানকে খেতে দেওয়ার সময় চোখের জল পড়লো ! অশুভ হল না তো ! সে বিব্রত বোধ করে । কেন যে কারণে বিনাকারণে অকারণে এমনটা হয় ! কিছুদিন ধরে প্রায়ই এমন চোখ জলে ভেসে উঠছে । ঢাইন মাছ রান্না করেছিল সে । এখানকার লোকে শিলং মাছ বলে। সাধন খেতে ভালোবাসে । চরগাঙপুরে ছোটোবাজার । অনঙ্গপুর পুরোনো বাজারে ঢাইন আসে কম । তাই যেদিন মেলে সাধন একটু বেশি পরিমানে কেনে । রমী. পরেরদিনের জন্য সাঁতরে জ্বাল দিয়ে রেখে দেয় । মাছ বাসি হলেও নষ্ট হয় না, স্বাদ একই থাকে । দুপুরে দুটুকরো করে খেয়েছে, রাতের জন্য একটুকরো করে বরাদ্দ । রমা দেখতে পেল সাধন নিজের পাত থেকে মাছ গোপালোর পাতে তুলে দিচ্ছে ।
রমা, সাধনও, খাওয়া থামিয়ে ওদিকে চেয়ে থাকে । অচেনা দুটি ছেলে বাইক নিয়ে এসেছে । রমার বুক ধুকধুক করে । মোটরছাইকলের লোকেরা খারাপই হয় । গুন্ডা বদমায়েশ ! সে ভুলে যায় গোপালও একটা সেকেন্ড হ্যান্ড মোটরসাইকেল কিনেছে । রমা শুনতে পেল গোপাল ওদের বলছে — খেতে বসেছি, ভাই । একটু পরেই পৌঁছে যাবো, বলে দেবেন । — ঘরে ঢুকলে রমা শুধোয় — কারা আইছিল ?
— ওই দ্যাখো, কী করতাছো ?
— আমি দুইফরে দুডে খাইছি । এবিলা আর খাবোনে না ।
রমা অবাক, ছেলেটা হাসতে হাসতে সেই টুকরোটা তক্ষুনি ভেঙে মুখে পুরে দিল । রমা কী করে এবার ! নিজের ভাগেরটা থেকে ভেঙে সাধনের থালায় দেয় — আধাখান খাও । কইলাম । গোয়াইড়া কইরা সমুস্ত কাম গুলাইয়া দাও । বুড়া হইয়া গেলা । ওইভ্যাস যায় না !
গোপাল হেসেই চলেছে — তোমারটাও আমাকে দিতে পারতে, মা । তাহলে আর মাছ ভাগাভাগি করতে হতো না ।
— চাপুড় দিমু কিন্তু । শয়তানি হইতাছে ।
— হাসিঠাট্টাই চলছিল, হঠাৎ বাইরে থেকে আওয়াজ এলো — গোপালবাবু, বাড়ি আছেন ? গোপালবাবু !
এঁটো হাতেই গোপাল বাইরে যায় । রমা, সাধনও, খাওয়া থামিয়ে ওদিকে চেয়ে থাকে । অচেনা দুটি ছেলে বাইক নিয়ে এসেছে । রমার বুক ধুকধুক করে । মোটরছাইকলের লোকেরা খারাপই হয় । গুন্ডা বদমায়েশ ! সে ভুলে যায় গোপালও একটা সেকেন্ড হ্যান্ড মোটরসাইকেল কিনেছে । রমা শুনতে পেল গোপাল ওদের বলছে — খেতে বসেছি, ভাই । একটু পরেই পৌঁছে যাবো, বলে দেবেন । — ঘরে ঢুকলে রমা শুধোয় — কারা আইছিল ?
— আচার্য জেঠিমা ডেকে পাঠিয়েছেন, মা । কী জরুরি দরকার ।
— ও — রমা মন্তব্য করে — ওবাড়ি থিকা অতিথ অইভ্যাগত সোকোলে বুঝি বিদায় নিছে । দিদি, মনে লয়, ঘরে একা । ডর পাইতাছে বুঝি । শুনছি ইমারত দালানবাড়ি । লাগনেরই কথা । তুই যা, বাবা । রাইতে ফিরা আওনের দরকার নাই ।
মুনলজ প্রাসাদের সদর দরজা হাট খোলা । ড্রয়িং রুমে স্নেহলতা সোফায় বসেছিল । বাইরের সমস্তটাই দেখতে পাচ্ছে সে । গেটে জোরালো হেডলাইটের আলো পড়তেই বুঝতে পেরেছে । উঠলো না । গোপালের ছায়া আবছা পড়তেই ডাকলো — আয়, বাবা ।
সুসভ্য লন পেরিয়ে গোপাল ঘরের দরজায় যায় । তার ছায়াটা আবছা তেরচা হয়ে স্নেহলতার গায়ের উপরে পড়ে ।
— আয়, আমার কাছি আসি বস, দেখি ।
গোপাল বসে স্নেহলতার দিকে চেয়ে থাকে । পরখ করে যেন । স্নেহলতাকে ম্লান মনে হয় গোপালের ।
— জেঠিমা, তোমার শরীরটা কি খারাপ লাগছে ?
— না রে, বাবা । শরিল ঠিক রইছে ।
— না, ঠিক করে বলো । ডাক্তার ডাকি । তোমাদের এপাড়াতেই তো দু তিনজনের নেমপ্লেট দেখতে পাই । কল করলে ওঁরা রাতে আসেন তো আবার !
— না রে । সিসব কিছু না ।
— ও । তাহলে কি তোমার ভয় লাগছে ? ভয় পেও না জেঠিমা । আমি আছি । সারারাত থাকবো । বলো যদি, পরপর কয়েকদিন থাকবো ।
— ইটাও না রে, বাবা । ভয় কী ? ঘরে গুষ্টির ঝি চাকর । ফটকে দরোয়ান ।
— তবে ? — গোপাল এবার থতোমতো খায় ।
— তোর কাছি আমার কয়েকখান কথা জেনার দরকার । তাই-ই ডাকিছি । সারাদিনমান বেয়াপার নেয়ি ডুবি থাকিস । ডাকবো কখন, ক ?
— আমার কাছে জানতে চাও ! কী ?
— হ্যাঁ । সত্যিই কবি তো ?
গোপাল মাথা নাড়ে ।
— মিথ্যি কবি না তো ?
গোপাল আবার মাথা নাড়়লো ।
— আমায় ছুঁয়ি থাক ।
স্নেহলতার হাত ধরে গোপাল । মায়ের হাতের মতোই, তবে নরমভাবটা বেশি মায়ের তুলনায় ।
— আমার মাথার দিব্যি কর ।
গোপাল আর অপেক্ষা করতে পারে না, — ও, জেঠিমা, বলো তো এবার ।
তবুও স্নেহলতা অনেকক্ষন চুপ করে বসে থাকে । যেন সে চোখ বুঁজে দিকদিগন্ত দেখতে পাচ্ছে । কাঁচামাটির রাস্তা । অনেকটা দূরে খুলনা গার্লস ইস্কুলটা দেখা যায় । খুলনা টাউন তখন ঘিঞ্জি নয় । চুলে দোলনদোলা কলাবিনুনির জোর । আগায় সাদাফিতের ফুল ফোটানো । সেই পথে সখীদের সাথে ভীরু পায়ে চলা এক কিশোরীকে দেখতে পাচ্ছে স্নেহলতা । রাস্তার পাশে অগোছালো বৃক্ষবীথি । কত পাখির গান । সখীদের দেখে দূরে সংকোচডোবা যুবকের দল চেয়ে থাকতো । তাদের অভাষিত আবেগের কথাগুলো যেন সেই পাখিগুলো ডেকে ডেকে বলতো । সব দেখতে পাচ্ছে স্নেহলতা এখন, সব শুনতে পাচ্ছিল । বাবাকে দেখলো । মাকেও । তারপর হঠাৎ সে দেখে ওখানে সে নেই । যশোর । মুক্তোকান্দির ঘর । রাজরানী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে স্নেহলতা । চন্দ্রমোহনকে বড়ো ভয় লাগতো, অথচ মানুষটাকে কখনও রাগতে দেখেনি । হঠাৎ স্নেহলতা শ্বশুরকে দেখতে পেল সামনে । ঋজু সেই মানুষটা তার মাথায় হাত রাখলেন, ‘ তুমার কোনো পাপ নাই, মা । এ বিশ্বে কারোর পাপ নাই । পাপ সময়ের । তুমি তো বাইবেল পড়ো নাই বউমা । ভগবানপুত্র যীশু কয়েছেন, তোমরা আমার নিকটে আইস । আমি তোমাদিগকে প্রেম দিব ।’ – মা, প্রেমই একমাত্র পূণ্য, একমাত্র ঈশ্বর । — চলে গেলেন চন্দ্রমোহন । স্নেহলতা দেখেন হেমশশী এসেছেন — ও মা, খায়ি নেও । সন্তান খিদি পেটি রলি মায়ের বুক যে শুকোয়ে যায় । — কাঁদবে না স্নেহলতা, কাঁদবে না আজ, কিছুতেই…।
— কী হল জেঠিমা !
— শোন, আমি মরি গেলি কাউরি খবর দিবি না । কাউয়িরি না । তুই আমায় শমশানে নেয়ি যাবি । চেতায় তোলবি । মুখে আগোন ছুঁয়াবি । মাটির ভান্ডে আমার না পুড়া অস্থিখান নদীর জলে ভাসায়ে দিবি । ধড়াচুড়ে পড়বি । ছেরাদ্দ শান্তি করবি । এগুলান করবি ? বল, করবি ?
গোপালের কথা সরে না । শুধু সে স্নেহলতার মুখে চেয়ে রইলো । এতদিন বাবা মায়ের কথায়, জেঠিমা কথিত এই মহিলার মিষ্টি বাচনে, আচরণে সম্মান দিয়েছে গোপাল । কিন্তু এখন এই রাত্রির মরা প্রহরে এই প্রাসাদের অধীশ্বরীর জন্য দোলা দিয়ে উঠলো গোপালের বুক, মায়ের জন্য যেমন হয়, ভিতরটা শিরশির করে, চিনচিন করে, অবিকল সেইরকম, বললো — জেঠিমা, তুমি…।
— উঁহু । বল, যা কলাম, করবি ?
গোপাল অসহায় বোধ করে । বিমূঢ় । বিভ্রান্ত । যেন অচেতনে চেয়ে চেয়ে দেখছে এতদিনের উচ্চাসীনা স্নেহলতাকে । তারপর কে যেন তার সম্পূর্ণ অর্ধচেতনায় মাথাটিকে সম্মতিতে নামিয়ে দেয় । সত্যিই সে পারবে কি পারবে না, যে জানে না, তবু বলে বসলো — করবো ।
— ইবার যা, গোপাল । দিদি চেন্তা করতিছে । আজ রাত্তির থেকি, যে কয়দিন বাঁচি থাকি, শান্তিতি ঘোমাতি পারবো ।
।। ফক্কাকান্ড ।।
ঈশ্বরপুত্রদিগের দেশের দস্তাবেজ
একটি জাতি অনুসন্ধান প্রকল্প: খ্রিস্টীয় ০০০৫ সহস্রাব্দ ।
প্রতিবেদনএ ক্ষণে পৃথিবী নামক গ্রহে সর্বত্তম দেশটি আমাদেরই দেশ । সর্বত্র এ দেশ স্টেটস নামে উল্লিখিত হয়ে থাকে । ধনের প্রাচুর্যে, আকর খনিজের পরিপুষ্টতায়, জ্ঞানের বৈভবে, শক্তির মদমত্ততায় তার জুড়ি নেই । এই দেশের মধ্যে অবস্থিত নিও হারভারড বিশ্ববিদ্যালয় এ গ্রহের তাবৎ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে সর্ববিষয়ে কুলশ্রেষ্ঠ । বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনায় সাম্প্রত বিশ্বের কয়েকটি জাতি সম্বন্ধে যথাযথ ও বিজ্ঞানসম্মত অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রকল্পের সূচনা করা হয়েছিল । প্রায় দশ বৎসরকাল বিস্তৃত এই বিরাট ও ব্যয়বহুল প্রকল্পে বা কর্মযজ্ঞে গবেষকগণ চমকপ্রদ তথ্যাদি আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছেন । বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা পড়া তাঁদের সন্দেশ এ সময়ে পেনসিলভানিয়া থেকে প্রকাশিত দুনিয়ার শ্রেষ্ঠতম রিসার্চ জারনাল বলে সম্মানিত ‘দ্য ভেইলড মিরর’ পত্রিকায় দীর্ঘদিন ধরে মুদ্রিত ও প্রচারিত হয়েছে । সাড়াজাগানো এই গবেষণাপত্রটি আন্তর্দেশীয় চিন্তাচর্চার ক্ষেত্রে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দলিল বলেই প্রাজ্ঞ বিজ্ঞ পন্ডিতগণ গণ্য করেন । প্রকাশিত সেই রিপোর্টেরই একটি অংশের সারাৎসার টোকিওর ‘আশিয়ান ওল্ডেরা’ পত্রিকায় পুনর্মুদ্রণের জন্য পাঠানো হল ।
আফ্রিকা মহাদেশের সিয়েরা লিওন নেশান-রাষ্ট্রে গবেষণার উদ্দেশ্যে একটি পাইলট প্রজেক্ট দল পাঠানো হয়েছিল পাঁচবছর আগে । অনুসন্ধানে জানা যায় একদা সেই দেশের ( সিয়েরা লিওন) দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা, অর্থাৎ সে দেশের শাসনতন্ত্র স্বীকৃত সরকারি যোগাযোগের ভাষার নাম ছিল বাংলাভাষা । বাংলা বাঙালি জাতির ভাষা ছিল । কীভাবে ওই ভাষা এবং ওই জাতি আফ্রিকা মহাদেশে পৌঁছেছিল তা বিষ্ময়ের দাবি করে ।
জানা যায় খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় সহস্রাব্দের শেষার্ধে সিয়েরা লিওনের অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক প্রমাদ দেখা দিয়েছিল । রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছিল। সেকালে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠান ( ইউ এন ও নামে পরিচিত) ওই দেশে একটি আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা সেনাবাহিনী পাঠান । ওই সেনাবাহিনীর অংশ হিসাবে বাংলাদেশ নামে একটি নেশান-রাষ্ট্র থেকে বাঙালি জাতির একটি বিরাট অংশ এসেছিলেন । দীর্ঘদিন তাদের থাকতে হয়েছিল প্রবাসে । স্বদেশভূমি থেকে তাদের কেউ কেউ স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের নিয়ে আসে । আবার অনেকে সিয়েরা লিওনের দেশীয় নারীদের বিবাহ করেন । বেশকিছু মানুষের ব্যাক্তিনাম পরিক্ষণ নিরীক্ষণ করে আমাদের মনে হয়েছে এরা সেই বাংলাদেশী মানুষেদের বংশধারা । নমুনা হিসাবে কয়েকটি নাম উল্লিখিত হল — ভিমলে ক্যালুকডে, নাসিডা, মামুডে, রাইনা, হৌক চাউড্রা ইত্যাদি । এখন তারা সিয়েরা লিওনি আফ্রিকান জাতির অংশ হয়ে গেছে । তাদের ভাষাও আর বাংলা নয় । সিয়েরা লিওনি আফ্রিকান ভাষার সাথে মিশ্রিত হয়ে হারিয়ে গেছে । আজ থেকে পাঁচশো বছর আগে সিয়েরা লিওন সংবিধান সংশোধন করে দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত ধারাটি বাতিল করে দেয়।
এই সূত্র থেকে আমরা বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশের অস্তিত্ব নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করি । অনুসন্ধান থেকে জানতে পারি যে আশিয়া মহাদেশের দক্ষিণ পূর্ব প্রান্তে অতি প্রাচীনকালে ভারতবর্ষ নামে এক আইডিয়ালিষ্টিক দেশ ছিল ওই অঞ্চলের প্রাচীন মহাকাব্য পুরান ইত্যাদিতে ভারতবর্ষ নামের উল্লেখ পাওয়া যায় । বাস্তবে ওই নামে কোনও নেশান-রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ছিল না । প্রাচীনকালের গ্রন্থেই ভারতবর্ষের অন্তর্গত বিভিন্ন রাষ্ট্রের নাম পাওয়া গেছে । তার মধ্যে একটি বঙ্গদেশ । যদিও আমাদের গবেষকবৃন্দ পুরাগ্রন্থকথিত বঙ্গদেশ ও পরবর্তীকালের অস্তিত্বসূচক বঙ্গদেশ এক কিনা তা নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেননি ।
অস্তিত্বের বঙ্গদেশের তথ্য আমরা সংগ্রহ করতে পেরেছি । খ্রিস্টীয় প্রথম সহস্রাব্দের সাতশো থেকে আটশো খ্রিস্টাব্দের মধ্যে আর্য জাতি, দ্রাবিড় জাতি, অস্ট্রিক জাতি ও ভোটচিনীয় জাতি পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহ মিশ্রণ বিমিশ্রণের পর্বে বাঙালি জাতীর সূচনা হয়েছিল । খ্রিস্টীয় বারোশো অব্দে তুর্কোজাতিরা বাংলার শাষককে পরাজিত করেন । তারপর দুশোবছর এক অন্ধকারের মধ্যে বাঙালি মহাজাতিতে পরিনত হয় । তারপর ভারতে ব্রিটিশশাসন অবসানের জন্য যে আন্দোলন গড়ে ওঠে ধর্মীয় পাগলামিতে তা দ্বিধাবিভক্ত হয়। ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হয়, পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয় ও বঙ্গদেশ ভাগ হয় । বাঙালিজাতি বিভক্ত হয়ে পড়ে । তখন থেকেই বাঙালিজাতির পতনের সূচনা ।
বাঙালিজাতির অবস্থান, তাদের ভাষার বৈশিষ্ট্য পুনরাবিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় । গবেষকদলগুলিতে ছিলেন নৃতত্ত্ব, শারীরতত্ত্ব, ধর্মতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব ও ইতিহাসবিভাগের কৃতবিদ্য অধ্যাপক ও সমীক্ষক অধ্যাপকেরা । তাঁরা যে মূল্যবান তথ্যসমূহ পেয়েছেন, সেগুলি হল :
এক. উল্লিখিত বাংলাদেশ এবং /অথবা ভারতের ওয়েস্ট বেঙ্গল ও অন্যান্য প্রদেশগুলিতে কোথাও বাঙালিজাতির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।
দুই. ওদের বাক্যবিনিময়ের ভাষা বাংলা নয় ট্যাঁশ ইংরাজি এবং / অথবা ট্যাঁশ হিন্দি। যদিও ওই দেশের মানুষেরা ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে ক্রিসমাস কিংবা নিউ ইয়ার্স ইভ পার্টির মতো জমজমাট সেলিব্রেশন করে ইন্টারন্যাশনাল মাদার টাং ডে পালন করে থাকে।
তিন. প্রশ্ন করে জানা গেছে, ওরা গিউরোডেভ ট্যাগোর, এবং কাৎসি ন্যাসরুল ইসলাম নামদুটি শুনেছেন। ওঁদের রচনা কেউ কেউ ইংরেজি বা হিন্দি ভাষায় পড়েছেন।
চার. ওরা আর্কাইভ থেকে সাটিয়াজিট রে- এর দ্য ওয়ার্ল্ড, চ্যারুলেট, এবং রিটভিক গাটাকের স্টার আন্ডার দ্য ক্লাউড এবং টাইটাস-দ্য রিভার সিনেমা দেখেছেন। মূল্যহীন ছবি বলে তারা মন্তব্য করেন।
পাঁচ. ভারতের ওয়েস্ট বেঙ্গল প্রভিন্সে নিউ সিটি নামে একটি জনপদে আমরা যাই। ওখানে প্রাকৃতিক গ্যাসের একটি বড়ো প্ল্যান্ট আছে। জানতে পারি পূর্বে ওই জায়গাটির নাম ছিল চরগাঙপুর। ওখানে বাঙালিজাতির একটি প্রজাতির উপনিবেশ ছিল। এরা কাঠবাঙাল অথবা রিফুজিবাঙাল নামে পরিচিত ছিলেন। এলাকায় সমীক্ষা করতে গিয়ে দেখি প্ল্যান্ট বসানোর সময় ওখানকার মানুষেরা সকলে ভূমিচ্যুত হয়। এখন ওখানে যারা আছে তারা সকলে ভারতের অন্য প্রদেশবাসী অথবা অভারতীয় অধিবাসী। ওই কাঠবাঙালেরা রাতারাতি কোথায় হারিয়ে গেছেন সূত্র পাওয়া যায়নি।
ছয়. ওই অঞ্চলে একটি পুরাতত্ত্ব সংরক্ষিত স্থান আছে। ভিতরে একটি ছোট্ট পুকুর। পাশে একটি হোর্ডিং, তাতে লেখা আনঙ্গিনী নদী। ওই পুরাতত্ত্ব সংরক্ষিত এলাকায় একটি পোড়ো মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। আমাদের সমীক্ষকদের মতে মন্দিরটি গড শিবার ছিল।
সাত. ওই সিঁড়িতে একটি লোককে বসে থাকতে দেখি। সম্ভবত ভিক্ষুক গোছের । বিড়বিড় করে কীসব বকছিল। পাগল বলেই মনে হয়েছে আমাদের। তবু আমাদের এক গবেষক কৌতুহলে ওর কথাগুলি রেকর্ড করে নিয়ে এসেছেন।
আট. ওই গবেষকের ধারণা হয় যে প্রলাপবচনটি হয়তো বাংলাভাষা।
নয়. রেকর্ডটি বিশ্ববিদ্যালয়ের লিঙ্গুয়িস্টিক অ্যানালাইসিস ও রিসার্চ উইংয়ের ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয়েছে। এখনও রিপোর্ট আসেনি।
পরিশেষে আমরা ওল্ড টেস্টামেন্টের সন্ত জেরমাইয়ার বানীটি স্মরণ করতে পারি—
তুমি আমার অস্ত্রসমূহ;
তুমি আমার যুদ্ধকুঠার;
এই অস্ত্রগুলি ধারণ করেই
আমি জাতি বিনাশ করি ।
স• মা • প্ত
♦—♦♦—♦♦—♦♦—♦
আগের পর্ব পড়ুন: পর্ব ৪৬
❤ Support Us