Advertisement
  • ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
  • নভেম্বর ২৪, ২০২৪

ধারাবাহিক উপন্যাস। পর্ব ৩। নজরবন্দী সময়ের উপকথা

হেদায়েতুল্লাহ
ধারাবাহিক উপন্যাস। পর্ব ৩। নজরবন্দী সময়ের উপকথা


কৃত্রিম নাগরিকতা অথবা দূষিত অতীতমুখিতাকে অতিক্রম করে স্বতন্ত্র মানচিত্র সৃষ্টিতে ব্যস্ত ৭০ ছুঁইছুঁই লেখক। কোনো ‘ইজম’ নেই, চিন্তার স্বাধীনতাই তাঁর দিবারাত্রির অনুশীলন। এই সময়, সমকালীন সঙ্কট এবং চাকরিপ্রার্থী ছেলেমেয়েদের সংশয়, আরোপিত প্রতারণা নিয়ে ডা. হেদায়তুল্লাহ-এর উপন্যাসের তৃতীয় পর্ব

 

সাপের পাঁচ পা

বেলা দশটায় এসআই অফিসে পৌঁছে দেখে,তখনো কেউ আসেনি । তবে একেবারে আসেনি বলাটাও ভুল । একজন দরজা জানালা খুলে ঝাঁটপাট দিচ্ছে । তার কাছে জানতে পারে সাহেব বারোটার আগে আসেন না । তাই সই । অফিসের সামনে রাস্তা । উল্টোদিকে একটা চায়ের দোকান । সেদিকে এগিয়ে যায় । এমন সময় ফোন বেজে ওঠে ।

হ্যালো—কবিরদা—

বলো-।

কোথায় ?

এই তো অফিসে । তুমি কোথায় ?

স্টেশানে নেমেচি ।

বাঁদিকের গেট দিয়ে বেরিয়ে ভ্যানরিক্সা ধরো ।

ঠিক আচে ।

আগের দিন ফোনে কথা হয়েছে তাদের । ডিআইয়ের নির্দেশমতো হাসনাবাদের অফিসে এসেছে । বেলা এগারোটা পর একজন একজন করে আসতে শুরু করেছে । পাক্কা বারোটায় এসআই সাহেব এলেন । তারা কাগজপত্র নিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে খাস কামরায় ঢোকে ।

ভদ্রলোক বেশ বয়স্ক । নস্যির নেশা আছে । ঘন ঘন নস্যি টানতে টানতে কাগজপত্র দেখতে লাগলেন । বেশ কিছুক্ষণ বাদে মাথা তোলেন । সবকিছু লেখা সত্ত্বেও জিজ্ঞেস করেন,তোমাদের বাড়ি ?

আজ্ঞে ! চাঁপাপুকুর ।

মধ্যমপুর ।

ঠিক আছে, তবে একটা কথা।

বলুন,স্যার ! নদীর এপারে কিন্তু হবে না।

ঠিক বুজতে পারচি না । শেফালি বিনীত গলায় বলে।

আমিও ঠিক বুঝতে পারছি না । রহস্যময়ভাবে নস্যির ডিব্বায় হাত দেন এসআই।

তারা অবাক হয়ে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে । তিনি ফোঁত করে রুমালে নাক ঝাড়েন । তারপর স্বগোক্তির মতো বলেন,আমার ছেলের জন্যে কিছু করতে পারলুম না ।

 স্যার ! আমাদের কিচু বলচেন ? শেফালি জিজ্ঞেস করে ।

এবার তিনি তাদের দিকে মুখ বাড়িয়ে দেন । তারপর ফিসফিস করে বলেন, তোমরা এই অফিসে ঢুকলে কী করে ?

স্যার ! পরীক্ষা দিয়ে । কবির শান্ত গলায় বলে ।

তিনি হো হো করে হেসে ওঠেন । সে তো ষাট লাখ দিয়েছে !

কথার মধ্যে বিদ্রুপ, অপমান । কিন্তু তারা প্রতিবাদ করতে পারে না । নিজেদের অনেক ছোট মনে হয় । নিজেদের ওপর তারা নিজেরাই সন্দিহান হয়ে পড়ে ।

যাকগে । তোমরা ঢুকেছো যখন তোমাদের কাজ দিতে হবে । তোমাদের ইছামতীর ওপারে পোস্টিং হবে ।

তারা ঠিক বুঝতে পারে না । তিনি কি রাগ করে তাদের শাস্তি দিতে চাইছেন ?

তিনি একটা জ্যাবদা খাতা খুলে পাতা ওল্টাতে থাকেন । তারপর মুচকি হেসে বলেন, এইতো পেয়েছি । তোমাদের কিন্তু একই স্কুলে হবে না ।

ভয়ে সিঁটিয়ে থাকা শেফালি জিজ্ঞেস করে,কেন,স্যার ?

এবারে স্বাভাবিক গলায় বলেন, কোথাও দুটো পদ খালি নেই ।

চাকরিতে জয়েন করেও মনে কোন স্বস্তি নেই । অথচ সদাশয় হেড়মাস্টার পেয়েছে । পথের সাথী হিসেবে মন্দ নয় শেফালি । যদিও এক স্কুলে হয়নি তবু অধিকাংশ পথ একসঙ্গে যেতে হয় ।

সেদিন সন্ধ্যেবেলা নাস্তাপানি দিতে দিতে মা বলে, খোকা একটা কথা বলব ?

বলো ।

তোকে কেন মন মরা দেকাচ্চে ?

কে বলল ? নিজেকে লুকোনোর চেষ্টা করে কবির ।

মায়ের মন । আমি ঠিক টের পাই ।

সে কোন জবাব দেয় না । চায়ে চুমুক দিয়ে সাঁজের আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে । মানুষের জীবন বড়ো অদ্ভুত । একটা কিছু পেলে আরেকটা হারাতে হয় । ডালিয়া কি তার কাছ থেকে ক্রমশঃ সরে যাচ্ছে ? যাঃ ! এসব কী ভাবছে । একসময় মায়ের কথায় চটকা ভাঙে ।

আচ্চা ! ক’দিন সেই মেয়েটাকে দেকচি নে ?

কোন মেয়েটা ?

দখিনপাড়ার তাকে ।

চমকে ওঠে সে । মাকে যতখানি হালকাভাবে নেয়,সে তো না নয় । কবির ধরা পড়ে যায় । লজ্জায় কোন কথা বলে না। মা আবার বলে,তোরা তো দুজনে একসাথে লেখাপড়া করতিস । সে কি চাকরি পেয়েছে ?

মা তার মোক্ষম জায়গায় আঘাত করেছে । সে আমতা আমতা করে  বলে,কী জানি । বোধহয় পাবে ।

তুই ঠিক জানিস নে ? গভীরভাবে তার ছেলের দিকে তাকায় । বয়েস কম হয়নি । পাশ দিয়ে সে সংসারে ঢুকেনি । তবে অভিজ্ঞতায় কম যায় না । মায়ের সন্দেহ প্রকাশে থতমত খায় । কবির এবার সত্যি কথা অকপটে স্বীকার করে । টগর বেগম যেন আপশোস করে । কার জন্যে ঠিক বুঝতে পারে না কবির ।

ষাট লাখ জনের দাপদাপি তার মাথার ভেতর চলতে থাকে। সবার বাঁচার অধিকার আছে। নিজেকে এখন আর সৌভাগাবান মনে হয়না। সে কি সঠিক হতে চায় ? কয়েক হাজার  নয়। সে লক্ষ কোটির ভেতরে থাকতে চায়

রাতেরবেলা ঘুম আসে না । সব যেন তালগোল পাকিয়ে যায় । এ জগত যেন সে জগত নয় । সহজ সরল ছেলে সে । দুনিয়ার সমস্ত ঘোরপ্যাঁচের বাইরে দাঁড়িয়ে জীবনকে ভেবেছে । আলোকে আলো আঁধারকে কালো বলে জেনেছে । পূর্ণিমা ম্যাডামের কথা ভেসে ওঠে। ধোঁয়াশা ? কীসের ধোঁয়াশা ? কোথায় ধোঁয়াশা ? কবির তো এখন পদে পদে উপলব্ধি করতে পারছে । সত্যি মিথ্যে গণ্ডি ভেঙে গেছে । মানুষ সত্যিটাকে মিথ্যে ভেবে আর মিথ্যে সত্যি ভেবে অদ্ভুত এক কুয়াশা জাল তৈরি করেছে নিজের চারপাশে । তার চাকরিটাকে কেউ বিশ্বাস করতে চাইছে না । হঠাৎ তার ভাবনার স্রোত অন্যদিকে বইতে থাকে । চাকরির মোহে সে খেয়াল করেনি । আজকে মনে হচ্ছে, ষাট লক্ষ ছেলেমেয়ের মধ্যে মাত্র কয়েক হাজার চাকরি পাবে । বাকিরা কী করবে ? তাদের জীবন চলবে কী করে ? চাকরি কি সব ? সে তো পরীক্ষাটাই দিতে চায়নি । তাহলে এই চাকরির মানসিক দাবিদার সে হতে পারে ? মাথা তার গরম হয়ে উঠছে । কলতলায় গিয়ে ভালো করে মাথায় স্রোত ঢালে ।

ভোরবেলা ঘুম ভেঙে যায় । মোবাইল বারবার বেজে উঠছে । কবির একটু টানটান হয় । এ আবার কী শোনাবে ? তন্দ্রাচ্ছন্নভাব কাটিয়ে সে সবুজ বোতাম টেপে—হ্যালো—

হ্যালো—তুই জয়েন করেচিস ? ক্রুদ্ধ গলা মনিরের ।

হ্যাঁ ! নীচু গলায় বলে সে ।

অন্যকোন খবর রাকিস ?

কী খবর ? যেন অপরাধীর গলা ।

সত্যিই কোন খবর পাসনি ? তাহলি শ্যামলের বাড়ি চিনিস তো ?

কেন ? কী হয়েচে ?

অত কথা এখন ব্যাখা করা যাবে না । ফোন কেটে দেয় মনির ।

সে কিছু বুঝতে পারেনা । এই তো কদিন আগে তাকে বাপমা তুলে অকারণে বিশ্রি গালাগাল করল । তাদের বাড়ি যেতে হবে ?

এসআই অফিস থেকে বেরিয়ে ইছামতী নদী পেরোয় । ট্রেকারে যেতে হবে। এসআই সনাতনবাবু হয়তো কৃপা করেছেন । ট্রেকারে পঁচিশ মিনিটের মাথায় বরুনহাটি । সেখানে শেফালির স্কুল । আরো বিশমিনিট পর দুলদুলি । সেখানে কবিরের । দুজন দুজনের স্কুলে গেছে । বরুনহাটি স্কুলের হেড় মিসট্রেস পলি মণ্ডল বললেন,আপনারা দুজনেই কি এখানে জয়েন করবেন ?

আমি একা ?

তারদিকে আগাপাশতলা তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ও !

এখানে আরো ভ্যাকান্সি আচে ? কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করে কবির ।

চারিদিকে তাকিয়ে দেখুন ।

প্রায় পাঁচ ছশো ছেলেমেয়ে খাওয়ার জন্যে লাইন দিয়ে বসে আছে ।

দেকচেন তো ! আমি একা কত সামলাব ?

আপনি একা ? শেফালি জিজ্ঞেস করে ।

আরেকজন আচে । তবে সে নামকা ওয়াস্তে । কোন নেতার আত্মীয় । মাসে একদিন এসে সই করে আর মাইনে তুলে নিয়ে যায় ।

বাঃ ! বেশ তো ! আপনি কিচু বলেন না ?

ভদ্রমহিলা কবিরের দিকে ম্লান মুখে তাকান । এসআইকে বলেছিলুম । তিনি বললেন,কার ধড়ে কত মাথা । আপনি যদি বাঁচতে চান তো এখানে এসে এসব কথা বলবেন না ।

কবিরের মনে ভেসে ওঠে,সনাতনবাবুর মুখ । বিষণ্ণ হয়ে পড়ে । একটা ধোপদুরস্ত মানুষকে কত মিথ্যাচার করতে হয় । দূর থেকে এসব বড়ো চোখে পড়ে না ।

দুলদুলিতে গিয়ে এক প্রস্থ নাটক হল । স্কুলের গেট দিয় ঢুকে দেখে মারকাটারি অবস্থা । যেন খাবারের জন্যে যুদ্ধ চলছে । শয়ে শয়ে ছেলেমেয়ে থালা হাতে মারমুখি হয়ে আছে । তারা ভেতর দিয়ে এগিয়ে যায় । স্কুলের বারান্দায় একজন বয়স্ক ভদ্রলোক সাদা টুপি পরে একমনে কাগজপত্রে হিসেব করছেন । তারা যে পাশে অপেক্ষা করে আছে তাঁর খেয়াল নেই । কিছুক্ষণ বাদে মুখ ঘুরিয়ে চমকে উঠলেন,আপনারা ?

আমরা-।

হ্যাঁ ! আপনারা কি আমার ঘণ্টা বাজাতে এলেন ?

ঠিক বুঝলুম না । কবির বলে ।

এই শেষ বয়েসে এসে ফ্যাসাদে পড়ে যাব ?

কেন বলুন তো ?

আজকাল শহরের দিকে কোন খবর নেই । তারা গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে । এই করে তো আবাদখালির সেকেন্ডমাস্টার ফেঁসে গেল ।

আমরা কোন সাংবাদিক নই ।

তবে-?

আমরা দেখতে এসেচি ।

কী দেখতে এসেচেন ? তখনো সন্দেহের নজরে হেডমাস্টার সোমনাথ মণ্ডল তাদের দিকে তাকিয়ে বলেন ।

আমি এখানে জয়েন করব । অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেয়েচি ।

আপনি ! আগে বলবেন তো । তিনি উঠে এসে কবিরকে বুকে জড়িয়ে ধরেন ।

উষ্ণ অভ্যর্থনায় বিব্রত হয় সে । কিন্তু সোমনাথবাবুকে মন্দ লাগে না । দু’চারদিন যেতে বুঝেছে সে, এরকম কলিগ পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার ।

তাঁকেই সে ফোন করে । চাকরি পেলেও সে গ্রুপের মধ্যে আছে । মনিরের কথা খেলাপ করে কি করে ? এ ক’দিনে সোমনাথবাবু শুধু তার কলিগ না গার্জেনও বটে । তিনি বলেন,খুব জরুরি ?

কবির আমতা আমতা করে ।

ওবেলা আসতে পারবে না ?

ঠিক বলতি পারচি নে ।

তিনি গম্ভীরস্বরে বলেন, সবে একমাস হয়েচে।এখন কামাই করা ঠিক না।কে কোথায় খোঁচা দিয়ে দেবে।

আমি চেষ্টা করব, স্যার।

শ্যামলের বাড়ি যায় নি কখনো। রাস্তাঘাট অপরিচিত নয়। কার্তিকপুর পালপাড়ায় বাড়ি। তাদের পাড়ার কাছে এসে দেখে হাজার হাজার লোক। সে অবাক হয়ে যায়।পরিচিত কাউকে দেখতে পায় না। ভেতরে ঢোকার চেষ্টা না করে একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ বাদে পরিচিত একজনকে দেখতে পায়।পূজার দাদা।সে গম্ভীর মুখে ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে। কবির ছুটে গিয়ে বলে,শোভনদা ! কী হয়েচে ?

তুই কিছু শুনিসনি ?

মাথা ঝাঁকায় সে।

এদিক আয়। ভিড় থেকে টেনে একপাশে নিয়ে যায়। তার কথা শুনে মাথা ঘুরে যায়। পাশে গাছের একটা কাটা গুঁড়ি ছিল। তার ওপর বসে পড়ে। কতক্ষণ এভাবে বসেছিল তা কে জানে। হঠাৎ মনির এসে ডাকে, এভাবে বসে আচিস কেন ? অনেক কাজ আচে।

কবির ধরা গলায় বলে, এর জন্যে কি আমি দায়ি !

সেসব অনেক গল্প। চল ভেতরে।

শ্যামলের বাবা হরিচরণ পাল সরকারি অফিসে কেরানির কাজ করতেন। রিটায়ারের পর যে টাকা পেয়েছেন তা সবটা ব্যাংকে ফিক্সড করে সংসার চালাতে থাকেন। পেনশানও ছিল। শ্যামলের মাথা ভালো, অঙ্কে বিএসসি পাশ করেছে।পরীক্ষা সে ভালো দিয়েছে টেটের ভাইভাতে ডাক পেয়েছে। কিন্তু জনশ্রুতিতে মাথা রেখে সে বুঝেছে, যাই কর ! আপনি আপ চাকরি এখন হবে না। আরো কিছু রহস্য দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। দুই মাথা হরতন দে আর রুইতন পালের সঙ্গে কথা বলে। সুলুক জানার চেষ্টা করে। হরিবাবু অনেকবার বারণ করেছেন। কিন্তু শ্যামল তর্ক করেছে, তুমি আমার ভালো চাও না ?

কী যে বলিস ?

তুমি চাকরি করেচ। আমাকে করতে দিতে চাও না ?

অগত্যা অবুঝ ছেলেকে বোঝানোর জন্যে ফিক্সড ডিপোজিট ভাঙতে হয়।

শোকের আবহাওয়া ক্রমশ পাল্টাতে থাকে। পোস্টমর্টেমের পর দেহ আসতেই মুহুর্মুহু শ্লোগান উঠতে থাকে। শেষে তার দেহ নিয়ে স্বতঃফুর্তভাবে টাকিরোড অবরোধ হয়। অনেকে ছোটে রুইতন আর হরতনের বাড়ির দিকে।

স্কুলে আর যেতে পারেনি। নিমতলা শ্মশানঘাট থেকে ফিরতে রাত হয়ে গেছে।

উত্তেজনায় রাতে ঘুম আসে না। সেদিন খুব গালাগালি দিয়েছিল তাকে। সে বিষণ্ণ আর অবাক হয়েছে। আজ  নিজেকে অপরাধী মনে হয়। যখন বেগতিক অবস্থা বুঝে শ্যামল টাকা ফেরত চায়, তখন রইতন আর হরতন টালবাহানা শুরু করে। শেষে এক গোপন জায়গায় নিয়ে গিয়ে তারা পিস্তল বের করে। তবে কবিরের মনে হচ্ছে, সেজন্য নয়। শ্যামল হয়তো ভেবেছে তার যোগ্যতা কী এমন কম যে চাকরি আর সে পাবে না ! ষাট লাখ জনের দাপদাপি তার মাথার ভেতর চলতে থাকে। সবার বাঁচার অধিকার আছে। নিজেকে এখন আর সৌভাগাবান মনে হয়না। সে কি সঠিক হতে চায় ? কয়েক হাজার  নয়। সে লক্ষ কোটির ভেতরে থাকতে চায়। হঠাৎ একটা অবসন্নতা তাকে গ্রাস করে। সে কি আত্মহত্যা করবে ? কে যেন তার ভেতরে জবাব দেয়,জীবন পদ্মপাতার জল না।

সকালে শেফালি ফোন করে, তোমার শরীর খারাপ নাকি ?

 কে বলেচে ? একটু রুঢ় কণ্ঠে বলে সে।

কালকে আসোনি তাই।

আরো অনেক কারণ থাকে।ফোন কেটে দেয় সে।

চাঁপাপুকুর স্টেশান থেকে পৌনে নটার ডাউন ট্রেন ধরে।মধ্যমপুর থেকে ওঠে শেফালি।তারা দুজনে সাত নম্বর বগিতে যাতায়াত করে।তাতে সুবিধে হয়।গেট থেকে বেরিয়ে ভ্যানরিক্সা স্ট্যান্ড। আজকে অন্য ব্যাপার ঘটে।কবির জানালা দিয়ে গলা বাড়িয়ে দেখে সে লেডিস কামরায় উঠছে। দেরি হয়ে গেছে বোধহয়। হাসনাবাদ স্টেশানে নেমে পেছন থেকে ডাকে, সাড়া মেলে না। এবার যেন টনক নড়ে তার।মনোক্ষুণ্ণ হয় সে। নিজের ওপর রাগ ধরে। আপনার মানসিক বিপন্নতার দায়ের জন্যে সে অপরের সঙ্গে অযাচিত ব্যবহার করতে পারে না। লজ্জায় অধোবদন হয়ে চলতে থাকে। মুখ তুলে তাকাতে পারে না।

আজ মঙ্গলবার রথযাত্রার ছুটি। হড়োয়া কিছু দরকারি জিনিসপত্র কিনতে গেছে। বাড়িতে মিস্ত্রি লাগিয়েছে। পুরোনো ঘরবাড়ি মেরামত করবে। একতলা বাড়ি।টিনের ছাউনি। বহুদিন বাড়ির কাজে হাত পড়েনি। বাজারে বল্টুর সঙ্গে দেখা। সে বলে,কতদিন ধরে তোমাকে খুঁজচি।

নতুন ঘর পেলি নাকি ?

সে আর হয়েচে।

কেন ?

মেয়েটার মাথা ভুত চেপেচে।

কী বলচিস ! চমকে ওঠে সে। আবার কোন অঘটন ঘটবে নাকি ? সে চুপ করে আছে দেখে বল্টু বলে, তোমাকে আসল কথা বলা হয়নি। সফুরাবেটি তোমার সঙ্গে দেকা করতি চেয়েচে।

ঠিক আচে। ওবেলা যাবার চেষ্টা করব।

চেষ্টা নয়। আসতি হবে অবশ্যই।নইলে বুজব—

কী বুজবি ?

সাপের পাঁচ পা গজিয়েচে।

খোঁচা হজম করে সে অন্য চিন্তায় মগ্ন হয়। সফুরা বেগম ডালিয়ার মা। বিশেষ কোন দরকারে ডেকেচে ? বল্টু বলল কেন ডালিয়ার মাথায় ভুত চেপেছে ? কই তার তো তেমন মনে হচ্ছে না। এখন দেখাসাক্ষাত কমে গেলেও নিয়মিত কথা হয়। এইতো দশদিন আগে এসএসসির রেজাল্ট বেরিয়েছে। সে ওপরের দিকে আছে।

বিকেলে মিস্ত্রির কাজ শেষ হলে সে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।তাদের যেমন উত্তরে মুফতিপাড়া, এদের তেমন দখিনে মিরপাড়া। তিন নম্বর রেলগেট পেরিয়ে যেতে হয়।তারা মামার বাড়িতে থাকে। তবে পাশাপাশি ভিটে।

সফুরাবেগম তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে ঠিক মায়ের মতো বলে,তুমি আর এদিকে আস না কেন ? কী হয়েছে ?

মুচকি হাসে কবির। তাতে যেন জবাব পেয়ে যায় সফুরা। বুজেচি। সময় পাও না। সে তো স্বাভাবিক। বাজে কথায় সময় নষ্ট করতি চাইনে। ডালিয়াকে নিয়ে বড়ো চিন্তায় পড়েচি। বয়েস তো বাড়চে। পাড়ার কথা কী আর বলব ?

সে তো এসএস সিতে ভালো রেজাল্ট করেচে।

জীবনে পরীক্ষা কি সব ?

আপনি কী বলতে চাইচেন ?

তুমি বুজতি পারলে না ?

ইতিমধ্যে বল্টুর বোন দোয়েল চা বিস্কুট নিয়ে হাজির। চায়ে চুমুক দিতে দিতে ভাবতে থাকে সে।ইঙ্গিত যে ধরতে পারচে না তা নয়। ডালিয়া বাড়ি নেই। তার আড়ালে কী এসব কথা মন খুলে বলছে তার মা ? ধন্দে পড়ে যায়। সে বলে,আপনার কথা আমার মাথায় থাকবে তবে তার মত কী ? সেইতো হয়েচে ভীষণ জ্বালা। বাপ মরা মেয়ে বড়ো জেদি আর একগুঁয়ে। এমন মেয়েকে নিয়ে কোন মা শান্তিতে থাকতে পারে ?

অন্যমনস্কভাবে সাইকেল চালাতে চালাতে সে অনেক কথা ভাবে। সফুরাবেটি হয়তো তার দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু ডালিয়াকে কি চেনে না ?

বাড়ি ফিরলে মকবুলমিয়া বলে,খোকা ! সিরাজ সাহেবেরলোক এসে তোর খোঁজ করছে ?

কেন ? খানিক বিরক্ত হয়ে বলে।

কী জানি ! তোকে দেকা করতি বলেচে।

আমি যাব না। তাৎক্ষণিক উত্তেজনায় সে বলে।

তা কী হয়, খোকা ! এরা ভালো না করতি পারুক মন্দ করতি এদের যেন আটকায় না।

কোন জবাব দেয় না সে। বাপ যে ঠিক বলেছে এতে কোন সন্দেহ নেই। দুনিয়া চিনতে হয়তো বাকি আছে। তবু সে আগের মতো নেই। জগত সংসারের আলো আঁধারি তার কাছে আপনা থেকে ধরা দিচ্ছে। তবে আজকে সে ক্লান্ত।আরো অনেক ভাবনা চিন্তা আছে। ডালিয়ার সঙ্গে একান্তে কথা বলতে হবে। মনে মনে রঙিন একটা স্বপ্ন পাখা মেলছে। ঘুম নয় সে হয়তো এক গভীর স্বপ্নে ডুব দিতে চায়। এখানে কোন কর্কশ বাস্তবতাকে আমল সে হিসেবের মধ্যে গণ্য করে না। ভেতরের উঠোনে লেবুগাছে বোধহয় ফুল ধরেছে। একটা মিষ্টি গন্ধে চরাচর ভেসে যাচ্ছে। সে জেগে আছে। স্বপ্ন তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে।ঘুম ঘুম চোখে একটা পাখির ডাক শুনতে পায় ।

 

♦·♦–♦·♦♦·♦–♦·♦

ক্রমশ..

আগের পর্ব পড়ুন: পর্ব ২

ধারাবাহিক উপন্যাস। পর্ব ২। নজরবন্দী সময়ের উপকথা


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!