- পা | র্স | পে | ক্টি | ভ রোব-e-বর্ণ
- জুন ১৫, ২০২৫
পথ ভুবনের দিনলিপি। পর্ব ৯

অলঙ্করণ : দেব সরকার
চিলাপাতার বনে
বনজঙ্গলে আমার সহজাত আকর্ষণ৷ কখন যে এ আকর্ষণ আমায় পেয়ে বসেছে টের পাইনি৷ শুধু এটুকু বলতে পারি, বর্ষায় যখন সব জঙ্গল প্রায় বন্ধ থাকে বা ঢুকলেও কোনো পশু দেখা যায় না, তখনো জঙ্গলের চারপাশ দিয়ে টহল মারি৷ আর পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলগুলোর মধ্যে সবথেকে কাছের মনে হয় যে জঙ্গলকে -সেটা হল উত্তরবাংলার চিলাপাতা জঙ্গল৷ এ জঙ্গলের ধার দিয়ে নদী বয়ে গেছে৷ সে নদীতে বিকেলে জল খেতে নামে হাতি আর গণ্ডার৷ তাদের ধোঁয়ারঙের চামড়ায় বিকেল চকচক করে ওঠে৷ জঙ্গলের একাধারে যাতায়াতের পথে রাভা বস্তি৷ রাভারা রাতের বেলা গাছে মাচা বেঁধে শস্য ক্ষেত্র পাহারা দেয়৷ ওদের তৈরি মাচাগুলো অন্যদের শস্য পাহারাঘরের থেকে একটু আলাদা৷ গাছের ডালপালার মধ্যে একটি পূর্ণ ঘরের চেহারা৷ চাঁদের আলোয় প্রতিবার মনে হয়েছে –দিনের মানুষগুলো চাঁদের আলোয় আলাদা সংসার পেতেছে৷ তাদের বউগুলোও বরের সঙ্গে রাতের বেলা মাচায় গিয়ে ওঠে কিনা জানতে আগ্রহ জন্মেছে ৷ যদিও মুখ ফুটে বলতে পারিনি৷
যতবার এই চিলাপাতায় ততবার সে বালকের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে৷ আর প্রতিবারই তার বনপ্রেমী রূপটি আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে৷ প্রথমবার তাকে দেখি মালঙ্গী লজে৷ ঢোকার পথে সে লজের পোষা হাতিকে জল খাওয়াচ্ছিল৷ সুন্দর মুখটুকু দেখে বড়ো আহল্লাদ করে তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম -হ্যাঁ রে হাতি লজের ? কটু গলায় যথেষ্ট পরিমাণ ঝাঁঝিয়ে সে উত্তর করলে – আমার হাতি৷ লজ একটা বাড়ি৷ তার কি প্রাণ আছে যে সে আরেক প্রাণের যত্ন করবে ! এমন পাকা দার্শনিকের উত্তর শিশু কেন ,বুড়োদের গলায়ও কম শুনেছি৷ সেদিন ওখানেই থামলাম৷বুঝলাম, একে প্রশ্ন করতে গেলে নিজেকে আগে প্রশ্ন করার উপযুক্ত করতে হবে৷
খালের মধ্যে একটি জলজ ফুলে পানকৌড়ি এসে বসেছে আর সেই বালক একটা লাল ঘুড়ি নিয়ে তার চোখের সামনে নাচাচ্ছে৷ বললাম, পানকৌড়িকে জ্বালাচ্ছিস কেন ? জবাব এলো সবাই মানুষের সঙ্গে ঘুড়ি ওড়ায়৷ আমি পানকৌড়ির সঙ্গে ওড়াচ্ছি৷ তোমরা জন্তু দেখে আনন্দ কর৷কিন্তু ওরা তোমাদের দেখে আনন্দ পাচ্ছে কিনা ভাব ? ওদের আনন্দ দেবার চেষ্টা কর ?
সেবার শরৎকাল ছিল৷ দুপুরে মালঙ্গী লজের পিছনে গেলাম৷ একটা খাল আছে৷ এপাশ থেকে একটা বাঁশে বাঁধা সেতু খালের ওপারে শেষ হয়েছে৷ আর যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকেই বনের শুরু৷একই জঙ্গল নদীর মতো বয়ে বয়ে কোথায় না কোথায় গেছে৷ খালের ধারে চুপ করে বসে আছি৷ সবুজ দেখতে দেখতে তন্ময় হয়ে আছি৷ হঠাৎ ফিকফিক হাসি৷ দেখলাম খালের মধ্যে একটি জলজ ফুলের ওপর পানকৌড়ি এসে বসেছে আর পাকা বালক একটা লাল ঘুড়ি নিয়ে তার চোখের সামনে নাচাচ্ছে৷ পানকৌড়ির কাছে পৌঁছতে বাঁশের সাঁকোর ওপর থেকে সে যথেষ্ট পরিমাণ সুতো ছাড়ছে৷কিন্তু যে ঘুড়ির আকাশে ঘোরার কথা সে আর কতক্ষণ জলের কাছে উড়তে পারে ! বললাম, পানকৌড়িকে জ্বালাচ্ছিস কেন ? যা নিজের গ্রামে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুড়ি ওড়া৷ উত্তর গুছিয়ে রেখেছিল যেন৷ একইভাবে ঝাঁঝিয়ে বলল, কেন গ্রামে যাব ! বিকেলে টুরিস্ট ঘেঁটে আমার হাতি ফিরবে৷ তাকে চান করাতে হবে৷ এ কী সব বাংলা বলছে! এমনভাবে “টুরিস্ট ঘেঁটে ” বলল যেন টুরিস্ট নয় নর্দমা ঘেঁটে ফিরবে হাতি৷
কথাগুলো তাকে বলেও ফেললাম৷ আরো রাগল৷ এবার টানা গজগজ চলল– সবাই মানুষের সঙ্গে ঘুড়ি ওড়ায়৷ আমি পানকৌড়ির সঙ্গে ওড়াচ্ছি৷ তোমরা জন্তু দেখে আনন্দ কর৷ জন্তুরা পাখিরা তোমাদের দেখে আনন্দ পাচ্ছে কিনা ভাব ? আনন্দ দেবার চেষ্টা কর ?
না পেরে বললাম –তুই কি ঘুড়ি দেখিয়ে পানকৌড়িকে আনন্দ দিচ্ছিস৷
–দিচ্ছিই তো৷ পানকৌড়ির রঙ কালো৷ লাল ঘুড়ি দেখলে সে আনন্দ পাবে তাই৷
হাসি চেপে বসে রইলাম৷ রাগত নয়ন মেলে পাজির পাঝাড়াটা চলে গেল৷তার হাতি টুরিস্ট ঘেঁটে ফিরেছে৷ সন্ধেতে দেখলাম সে হাতি চান করাচ্ছে৷ পারে নাকি ! অতটুকু ছেলে সে৷ সে কেবলই হাতির গায়ে জল ছেটাচ্ছে আর নিজে ভিজছে৷ বলাবাহুল্য আমাকে দেখে তার জল ছেটানোর কায়দা বেড়ে গিয়েছিল৷ কলকাতায় যখন ফিরছি মনে হয়েছিল, সে থেকে গেছে আমার সঙ্গে৷
দ্বিতীয়বার গেলাম ভরা বর্ষায়, ওই মালঙ্গী লজেই৷ সে বালক মাথায় বেড়েছে এবং আগেরবারের চেয়ে পরিষ্কার জামা প্যান্ট পরেছে৷ শুনলাম, সে স্কুলে যাচ্ছে৷ পরীক্ষায় ভালো ভালো ফল করছে৷ স্কুল তাকে স্কুল ড্রেস, বইপত্তর এসব দিচ্ছে৷ বালক আমায় চিনতে পারল কিনা বুঝতে পারলাম না৷ আর আমার তাকে আলাদা করে চেনবার দরকারই হল না৷ সে তো আমার চেনা হয়েই ছিল৷ শুধু বুঝতে পারলাম না কী করে সে পরীক্ষায় ভালো ফল করছে ! তখনো তার ” হাতিচান ” কিংবা “হাতির পা চান ” অব্যাহত ৷ হাতির পা ধরেই পরীক্ষা উতরোচ্ছে ছেলেটা ! মা সরস্বতী বাহন পরিবর্তন করেছেন হয়ত !
সকালে পৌঁছে সেই একবারই দেখেছিলাম সেদিন৷ তবে ঘরে বসে আন্দাজ করেছিলাম সে ওই লজেই আছে এবং হাতি নিয়েই কাটাবে সারাদিন৷ রবিবার ছিল সেদিন৷ হাতি এখন তার ছুটির দিনের বন্ধু৷ পরেরদিন বিকেলের ট্রিপে জঙ্গল যাব বলে জিপে বসে আছি৷ লাফ মেরে উঠল ড্রাইভারের পাশে৷ জঙ্গলে গিয়ে শুনলাম, জঙ্গল বন্ধ৷ এদিক ওদিক ঘোরাঘুরিতে সময় গেল৷ বালক একদম চুপ৷ সুবোধ বালক৷ সন্ধেতে মেঘ সরে চাঁদ উঠেছে৷ দেখলাম, রাভা বস্তির ক্ষেতের ওপরের মাচার ঘরে চাঁদ ঝলকাচ্ছে৷ প্রত্যেক ঘরকে এক টুকরো চাঁদ লাগছে৷এতক্ষণে ড্রাইভারের পাশ থেকে কথা এল—
এক লাখ চাঁদ উঠেছে৷
– তোকে এসব কে বলেছে ? খালি পাকা কথাবার্তা ! দেখা আমায় এক লাখ চাঁদ৷
– তুমি পাবে না৷ আমি দেখতে পাব৷
– কেন তোর চোখ আমার চেয়ে বড় ? শয়তান ছেলে কোথাকার !
– উঁহু৷ তোমরা টুরিস্ট৷ পশু দেখে আনন্দ পাও৷ আমি ওদের আনন্দ দেবার চেষ্টা করি৷ তাই চাঁদ আমার কাছে অনেক হয়ে আসে৷ এবার থেকে জঙ্গলের পশুর ভালো ভাববে ম্যাম৷
ম্যাম ডাক সে স্কুল থেকে রপ্ত করেছে হয়ত৷
কান মুলব ভেবেও হাত নামিয়ে নিলাম৷
পৃথিবীর প্রথম মস্তিস্কবিজ্ঞানী ভগবান বুদ্ধ মানুষকে মানুষের ভালো ভাবতে বলেছিলেন তাঁর অষ্টাঙ্গিক মার্গে৷
পাকা বালকের মার্গ বুদ্ধের থেকে আরো দূর …
♦·♦–♦·♦♦·♦–♦·♦
ক্রমশ..
আগের পর্ব পড়ুন: পথ ভুবনের দিনলিপি । পর্ব ৮
❤ Support Us