Advertisement
  • ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
  • জানুয়ারি ৭, ২০২৪

মাটি ব্রতের আখ্যান । অষ্টম পর্ব

বইটা বাবার অবকাশ যাপনের খেয়াল ছিল। বিশেষ কাজে লেগেছে তা নয়।তবু হাতের কাছে রাখতেন। কখনো পুস্তকাদেশ মেনে কিছু করেছেন। ফল হয়েছে কিনা তার সঠিক সাক্ষ্য ও সাক্ষী উভয় পাওয়াই মুশকিল...তারপর

সুধীরকুমার শর্মা
মাটি ব্রতের আখ্যান । অষ্টম পর্ব

অলঙ্করণ: দেব সরকার

।। সোরোত কান্ড ।।

 

।। কংসকারা।।

সপ্তাহে একদিন করে ডাক্তার আসেন ক্যাম্পে। সঙ্গে নার্স কমপাউনডারবাবু  ও একজন আর্দালী। তার চিকিৎসার জন্য একখানি ঘর বরাদ্দ।

ভিড় থিকথিক করে সে ঘরের সামনে। পরণের কাপড় নোংরা,শত নাহলেও বহুছিন্নতার চিহ্ন দাগা। কোলে কাছের বাচ্চাগুলোর উদল শরীর, কোনওটা উদোম ন্যাংটো।

হঠাৎ হঠাৎ ঝগড়া লেগে যায় লাইনে। যে গালিগালাজ বিষ্টির মতো ঝরে —তা যে মানুষের জিভ থেকে উগরে এসেছে, সেটা কল্পনায়ও আনতে পারবে না, যারা নিজেদের সভ্য বলে। বিশেষ মেয়েদের মুখ এতটা নিচে নামতে পারে। ‘চাড়াল মাগীর মুখে মুতি’ কী বারো মিনসের ঘরে চুদিয়ে বেড়াস’ বলে যে রমণী,সে একদা শান্ত ব্রাহ্মণঘরণী ছিল।

লাইন পাহারায় থাকে ভলান্টিয়ার বাহিনী, ক্যাম্প থেকে নিয়োগ করা, এলাকারই বাসিন্দা।  ষন্ডা মার্কা চেহারা।মর্দানা জেনানা নির্বিশেষে। এই সুযোগে তারা প্রকাশ্যেই বউ মেয়েদের বুকে হাত দলন করে। দলিতদের অভ্যেসে গালবমিতে ফুঁসে উঠলো। ভলান্টিয়ার ছোকরারা দাঁত বিছিয়ে হাসে। কিচ্ছু করার নেই, পাহারাদারদের অসীম ক্ষমতা।

নার্স দিদিমণি নাকি রুমাল বেঁধে রাখেন, রোগ রুখতে, না লাইনের রোগীদের গন্ধ রুখতে তিনিই জানেন।

ডাক্তারবাবুর মেজাজ চড়া।

কমপাউনডারবাবু ঘরের ভিতরে থাকেন, জানালা দিয়ে কাগজে মোড়া বড়ি ও শিশি ভরা মিকচার দেন, বলেন,
—চারবার খাবে, তিনবার খাবে…এর বেশি একটা শব্দ খরচ করেন না।

—ডাক্তারবাবু —এক উদ্বিগ্ন মা তার অসুস্থ বাচ্চার জন্য,বোধহয়, আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল।

ডাক্তারবাবুর হাত নড়লো— পরের জন।

তখন লাইন সান্ত্রী মা-টিকে টেনে সরিয়ে দিচ্ছে।

চন্দ্রমোহন কেমন পাগল পাগল করছেন। একেবারেই ঘুমান না। উঠে বসে কাঁদতে শুরু করেন। শব্দ  ঢেকে রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করেন বলে কেমন একটা  আওয়াজ হতে থাকে, গোঙানির  মতো টান বেটান

গত হপ্তায় ডাক্তারবাবু আসেননি। আজও… ।

তার জায়গায় নতুন একজন। দেখতে বাচ্চা ছেলের মতো, ডাক্তার মনে হয় না।

আজ প্রচন্ড ভিড়। হেমশশী চন্দ্রমোহনকে নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়েছেন।

—হ্যাঁ, রোগী কে?

—ডাক্তারবাবু, ইনি।

চন্দ্রমোহনকে ডাক্তারের বাঁ পাশে রাখা টুলে বসতে হল।

— বলুন, আপনার কি সমস্যা?

চন্দ্রমোহন বড়ো করে হাসলেন— আমার কোনও সামিস্যে যে নাই। আমি যে বসি বসি খাচ্ছি ! যা পাথর দেন,তাই খাই। যা মোন্ড দেন,তাই গিলি। সমিস্যি যাগেরে,তাগেরে আমি আপনি চক্ষুতে দেখতে পাতিছি না।  পাওয়া যাবেনে না। অশরীরী প্রেতযোনি অদৃশ্য ভবানি ভব…

—থামুন, থামুন ! —ডাক্তার মৃদু ধমকান। — পাগলামি করছেন কেন?

—হেমশশীকে উদ্দেশ্য করেন তিনি,- মা, আপনি বলুন,ওনার কী হয়েছে।

হেমশশীকেই বলতে হবে। সংক্ষেপ করার জন্য চিকিৎসকের তুজুকও সঙ্গে থাকে।

মোদ্দা কথা, চন্দ্রমোহন কেমন পাগল পাগল করছেন। একেবারেই ঘুমান না। উঠে বসে কাঁদতে শুরু করেন। শব্দ  ঢেকে রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করেন বলে কেমন একটা  আওয়াজ হতে থাকে, গোঙানির  মতো টান বেটান। হেমশশীর নিদ্রা ছুটে যায়, বালিশের তলা থেকে দেশলাইয়ের বাকসোটা নিয়ে  মশারির বাইরে বেরিয়ে আসেন। ক্যাম্প থেকে মশারি দিয়েছে প্রত্যেক ঘরে। উটকো  গন্ধ সেটার কাপড়ে, সোডা গরম জলে ধুয়েও হেমশশী সে গন্ধ দূর করতে পারেননি। নিরাপদ  কোণে এসে হ্যারিকেনটা জ্বালালেন তিনি। কালি পড়েছে চিমনিতে,আলো বিলোচ্ছে কম। বেশিক্ষণ আলোটা রাখা যাবে না, তেল ফুরিয়ে যাবে। মাপা তেল। এক হ্যারিকেন বাটি কেরোসিন ভরে দিয়ে ক্যাম্পবাবুরা হেঁকে দেন— এক হপ্তা চালাবে। এবার আবার বরাদ্দ কেরোসিন নাকি আসেনি। সত্যিই  হয়তো। কে জানে!

বিছানায় ফিরে এসে স্বামীর পিঠ ডলতে থাকেন হেমশশী— বেথা কমিছে নীল দাঁড়ায় ?

উত্তর না জুগিয়ে চন্দ্রমোহন উদাস চেয়ে থাকেন স্ত্রীর মুখে। কী কারনে হঠাৎ কী মনে হল,হাত  দিয়ে স্ত্রীর গাল সাপটে দিলেন, কিছুর স্পর্শ না পেয়ে যেন অবাকই— তুমি কানতিছিলে না?  আবাজ শোনাতে পালাম।

হেমশশীকে এবার ডুকরে উঠতেই হয়।

—তানি কে কানতিছিল?

চন্দ্রমোহনকে শুইয়ে দিলেন হেমশশী। কোণে গিয়ে লন্ঠন নিবিয়ে মশারীতে ঢুকে গেলেন। সময়ের ফাঁকটুকতেই মশার ঝাঁক ঢুকে পড়েছি, শুরু  করে দিয়েছে মাইফেল। আঁচল দিয়ে ঝাঁট মেরে কীট সরাতে এই  অন্ধকারেও কী দক্ষ  হয়ে গেছেন তিনি ! বললেন— আপনের কি শরিল খারাপ  লাগতেছে?

চন্দ্রমোহন বলেছেন— হেম, আমার কিছু হয় নাই। স্বপন টপন দেখিছিলাম বুঝি। তুমি ঘুমায়ে পড়ো।

হেমশশী তাঁর মাথায় ধীরে ধীরে আঙুলে বিলি কাটেন। অত বড়ো মাথাটায় কয়েক গাছি শীর্ণ চুল,তারই  ছোঁয়ায় আঙুলে সুড়সুড়ি লাগছে। একটু হাসিও পেলো। চন্দ্রমোহন যেন তার অবুঝ খোকা নীলু। নানা ছলে এখন ঘুম পাড়াতে হবে। হতে হবে নিদজমানি মাসিপিসি। এও কামনার অন্যরূপ! হেমশশী জানেন না।টস করে চোখ ভাঙা নুনকণা পড়লো চন্দ্রমোহনের গালে,কী কপালে।

চন্দ্রমোহন টের পেলেন। এখন একটা হাত স্ত্রীর মণিবন্ধে আঁকড়ে ধরেছে—হেম, এট্টা গান শোনাবা?

এ কী আবদার করছেন চন্দ্রমোহন !  গান ছিল ঢাকায় বিয়ের আগে। রীতিমতো ওস্তাদ রেখে গানের তালিম দিয়েছিলেন বাবা। তাঁর সাধ ছিল মেয়ে রেডিও স্টেশনে গাইবে। ইচ্ছেটা পূরণ হতে পারেনি। মাঝপথে চন্দ্রমোহনের কত্তামা মেয়েকে দখল করে নিয়ে গেলেন আদরের পৌত্রটির জন্য। যশোরে, মুক্তোকান্দিতে ভদ্রাসনে আর সে চর্চা ফেরেনি। সেই কবেকার ফেলে আসা দিনের গান কি আজ গাওয়া যায়? না গাহিতে আছে? ধাস ঘরে এক একদিন হেমশশীকে চেপে ধরে বায়না করতেন চন্দ্রমোহন, নীলু ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগের কথা। চাপাস্বরে শোনাতে হতো। শ্বশুর  শাশুড়ির কানে যেন না যায়। ছি:! লজ্জার একশেষ! কানাকানি হবে—আচাজ্জি বাড়ির বউ রাতের বেলা রাতির বেলায় গান ধরিছে। কায়েগের বাড়ির মেয়ি আনিছে বেরাজ পন্ডিতের মা! রামো:। রামো:। চন্দ্রমোহনের গলায় সর ছিল না, সেটা ছিল কানে। শুনতে চাইতেন দ্বিজুবাবুর গান, বিশেষ করে একটি। হেমশশীর চোখ বুঁজে যেত ভাবের ভারে। চৌকির পাশে দাঁড়িয়ে, সেই ছোট্ট কামরায়, গেয়ে উঠতেন হেমশশী—আমরা এমনি এসে ভেসে যাই।

চন্দ্রমোহন আবার বিনতি করেন, হেম, একখান গাও, আমার ঘোম আসতেছে না।

হেমশশী নাক টানলেন, আমার এক পিসি  ঠাকুর মা কেত্তন গাইতেন।তারই এট্টুখান। যেটুকু মনি পড়ে। —স্বর নিচুগ্রামে রাখলেন প্রথমে, যেন অজস্র নুড়ি স্তুপ হয়ে আছে অজল স্রোতোপথে, সুদূরাগত বিস্মৃত বাতাসের লীলায় নুড়িগুলো পরস্পর ঘা খেয়ে খেয়ে ভেঙে ভেঙে গেল,সরে গেল এদিক ওদিক, তারপর হড়পা বান ডাকলো দু কুল ভাসিয়ে। গাইছেন হেমশশী, কিশোরী হেমশশী, মথুরা নগরে প্রাণের প্রভুরে কোথা  খুঁজি শ্যাম আমারে বলো।          — রিফুজি ক্যাম্পের টিনের ছাউনি,টিনের দেয়াল ফুঁড়ে গানের ঘুড়ি লাট খেতে লাগলো এই নদীয়ায়,মধ্যরাতের কালো আকাশ জুড়ে।

ডাক্তারের গলা খাঁকারিতে হেমশশীর সম্বিত ফিরে আসে, বললেন করজোড়ে— ডাক্তারবাবু, আপনে আমার ছেলির মতোন, –কান্না আটকে দিতে চাইছে স্বরতন্ত্রী,–ওনারে ভালো করি দেন। ভগবান আপনেরে সব দেবে।

ডাক্তারের মায়া জাগলো,মনে হয়, শুধালেন,–উনি অদ্ভূত রকমের কোনও আচার ব্যবহার করছেন, এমন চোখে পড়েছে?

—হ্যাঁ, বাবা, সুময় অসুময় নাই, ঘর থে ছুট্টে  বেরায়ে যান,ধরি আনতি লাগে। কন তো, এই বিদেশ বেভোয়ে কুথাও ওনার চিনা নাই। হারায়ে যাবেন না। আমি যে বুড়ি হলেম, ওনারে চোখি চোখি  রাখবার পারি!ছোটতে  পারি ওনার সাথি?

—আর কিছু?

—কী সব বলি চোখি দেখতে পান।

—দেখেন !

—আইগ্যে, ডাক্তারবাবা। নানা কথা, মানে নাই সেগুলার। এমন আশচয্যি কথা  শোনেনও নাকি।

ডাক্তার চন্দ্রমোহনকে জিগ্যেস করলেন,-  কী দেখেন বাবা, আপনি?

—দেখি ! চন্দ্রমোহনের চোখ চকচক করে উঠলো —দেখি লাল আসমান, টকটকা লাল,কালো সূর্য জ্বলতেছে,কালো শিষের আগুন, ধাক করে দেচ্ছে,স-অ-ব,দেখো রোস্থরখান নাই। রাত্তির নামলি, কালো চাঁদ, অমাবস্যেও নাই।

যুবক চিকিৎসকটি মাথা ঝাঁকান,নার্সকে বললেন আস্তে— সাসপেক্ট করছি গ্রোথ অব ইনস্যানিটি, বাট ইয়েট পার্শিয়াল, প্রিলিমিনারি স্টেজ। এটাই ভরসা। নার্স জবাব দেয় না,দিতে নেই, সে জানে। ডাক্তার আবার শুনতে চান, —আর কী কী শুনতে পান, আপনি?

—মেয়া মানুষ কানতেছে। ছেলামানুষ কানতেছে। কচ্ছে—বুড়োরে গোলি করি, মারিছে। মরশুম হয়ি গিছি কায়েদি।

—হুঁ!  আচ্ছা,মা, বলতে পারেন, আপনাদের দেশে, যখন রায়ট হয়েছিল,তখন উনি কোনও খুন টুন হতে দেখেছিলেন?

—মা, বাবা, আমাগের গিরামে রাইওট লাগে নাই।

—ও-কে ! মরহুম নামের, সম্ভবত মুসলমান, কাউকে চেনেন আপনারা?

—না।

—ঠিক আছে। শুনুন, আমি কয়েকটা ট্যাবলেট দিলাম।ওনার ঘুম দরকার। আরেকটা কথা, ওনাকে নিয়ে আমাদের বড়ো হাসপাতালে আসবেন। এই শহরেই। মাসের প্রথম ও তৃতীয় সোমবারে কলকাতা থেকে ওনার রোগের স্পেশালিষ্ট  ডাক্তারবাবু আসেন।ওনাকে দেখাবেন। সব এই প্রেসক্রিপশনে লিখে দিয়েছি, এটা নিয়ে যাবেন। ওই ডাক্তারবাবুকে দেখাবেন।বেলা দশটার মধ্যে গিয়ে আউটডোর টিকিট করে নেবেন। ভয় নেই, মা।উনি সেরে যাবেন। কেমন?… হ্যাঁ, পরে কে?

হেমশশী সায় নেড়ে বেরিয়ে এলেন সে ঘর থেকে।

ভিড় সামান্য দূর বৃত্ত রচনা করে। রোগটা ছোঁয়াচে,ভয়  লাগছে তাদের। স্বজনের স্বজনহারা হওয়ার রক্তঝরানি রেশ কি তারা পাচ্ছে নিজের নিজের বুকের বাক্সে?  তারা নিজেরাও কি জানে সে কথা?  অসাড়বোধের পঙ্গুত্ব যেন তাদেরকেও ধীরে অতি ধীরে জীয়ন্ত লাশ করে তুলছে, কেবল বেলচাডগায় কিংবা দড়ি আংটায় ছুড়ে ফেলা হচ্ছে না

সেই দিনই।

রাত্তির নিজেই ঘুমিয়ে এলা। রোল উঠলো দূরে ক্যাম্পের একধারে। অনেকগুলি মানুষের আকাশছেঁড়া হাহাকার ঘন শীত চাদরে সজোরে আঘাত করছে।

ঘুম ভেঙ্গে যায় হেমশশীর। উঠে বাইরে এলেন। আঁচ করতে চেষ্টা করলেন এই আর্ত বিস্ফোরণের হলকাটা কোনদিক থেকে আসছে। ক্রমশই কান্নার উদগার বারছিল। দেখতে পেলেন— কয়েকজন, নানা বয়সের পুরুষ, প্রায় দৌড়ে পূব সীমানার দিকে ছুটছে।—ওগো, কী হয়িছে গো? —হেমশশী  বড়ো ব্যাগ্র।

—কলেরায় লাগছে, মাসিমা। আপনি য্যান নাইরেন না।

যে বা যারা ওই কথাগুলো উগরে চলে গেল, তাকে, বা তাদের আর দেখতে পেলেন না হেমশশী। তবে আরো কয়েকজনকে দেখা গেল, ওই ঠিকানার দিকেই যাচ্ছে যেন। ওরা কথা বলছিল পরস্পরে, হেমশশীর কানে আসে।

—এইভাবে আমাগো মারতে চায় এই দ্যাশের গরমেইন।

—হালায় মসুলমানের হাত হইতে পলাইয়া আইলাম। বাচুম কইরা।

এ হালা হিন্দুর দ্যাশে। হেই হারামজাদাগুলানও আমাগো বাচাইল না !

—হ:। কীয়ের হিন্দু ! কীয়ের মুসলমান ! সবঅই এউবকা।

খেয়াল করেননি হেমশশী, কখন যে চন্দ্রমোহন তাকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে ওইদিকে ছুট লাগিয়েছিলেন। যখন নজরে পড়লো, তখন তিনি বেশ দূরে। হেমশশীর অপেক্ষা করলে চলে না, এদিকে শরীর ভেঙে আসতে চাইছে, হঠাৎ দেখেন সাধন তার মুখে জড়িয়ে ধরলেন তাকে, —বাবা রে, তোর খুড়ে ওইপানে রয়েনা করলেন রে, দেখ ধরি আনতি পারিস কিনা।

লাশগুলোকে  তুলে তুলে ফেলা হচ্ছে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বেঁটে লরিতে। সকালবেলায় ও গাড়িটা শহরবাসীর ফেলে দেওয়া ময়লা রাস্তা গলি ডাস্টবিন থেকে নিয়ে যায়। এখনও সে যানের পাটাতনে জঞ্জালের অবশেষ আছে, ওঁচা গন্ধ বলক দিয়ে  উঠছে ক্ষণে ক্ষণে হালকা হাওয়ায়। যেমন বেলচা দিয়ে ময়লা সময় দেখা যায়, ঠিক তেমনি, প্রায় নারকেলের তা বেঁধে দেহাতি কয়েকটা লোক, সারাশরীর মদাক্ত, আস্তো একটি দেহ ছুঁড়ে দিল উপরে।

চারদিকে ভিড়, একটু বাড়ছে, সামান্য দূর বৃত্ত রচনা করে। রোগটা ছোঁয়াচে,ভয়  লাগছে তাদের। স্বজনের স্বজনহারা হওয়ার রক্তঝরানি রেশ কি তারা পাচ্ছে নিজের নিজের বুকের বাক্সে?  তারা নিজেরাও কি জানে সে কথা?  অসাড়বোধের পঙ্গুত্ব যেন তাদেরকেও ধীরে অতি ধীরে জীয়ন্ত লাশ করে তুলছে, কেবল বেলচাডগায় কিংবা দড়ি আংটায় ছুড়ে ফেলা হচ্ছে না।

সাধন খুঁজে পেল চন্দ্রমোহনকে। তিনি ভিড়ে মিশে নয়, দাঁড়িয়ে মৃত্যুপর্বতের শোভা দেখছিলেন, চোখ  যাকে বলে উদ্ভাসিত তরল। সাধন তাঁর বাহুমূলে নাড়া দেয় —খুড়েমশাই, চলেন ইবারে। খুড়িমা বড়ো চেন্তা করতিছে।

—কেডা? ও তুই ! ক, দেখি পারিস নাকি!নরক  কয় প্রকারের?

সাধন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো। খুড়িমা তাহলে ঠিকই ভয় পাচ্ছেন।

—জানিস নে, তো?  শাস্তরে সাত রকমের। কিন্তু নামের ফের। সবই এক।

ওই দেখ, তাকায়ে দেখ নরক।পুঁজ, চাপ পুঁজ থকথক  করতিছে।

সাধন তার হাত ধরে টেনে আনে, কান্না আসতে চাইছে, —চলেন খুড়েমশাই,আর না।

ক্রমশ…

 

আগের পর্ব পড়ুন: পর্ব ৭


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!