Advertisement
  • ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
  • সেপ্টেম্বর ১০, ২০২৩

চর >।পর্ব ১০।

হাসি নেই শুধু রূপসীর মুখে। মুখ ভার করে বসে আছে ঘরের দাওয়াই। মাছ ধরার উৎসবের এই দিনে প্রায় সব বাড়ি থেকে মাছ ধরতে গেছে, যায়নি শুধু রূপসীর বাড়ির লোক। দুই সপ্তাহের কাছাকাছি হয়ে গেল, বসির বাড়ি আসেনি। সেই যে থানে গিয়েছে, আর তার কোনও খবর নেই। মাঝে মাঝে দু একজনকে দিয়ে খোঁজ খবর নিয়েছে, কিন্তু নিজে আসেনি...তারপর...

সাইদুর রহমান
চর >।পর্ব ১০।

অলঙ্করণ: দেব সরকার

ধা রা বা হি ক · উ প ন্যা স

 

•১৯•

রাত দশটার কাঁটা ছুঁই ছুঁই। বিছানায় শুয়ে গড়াগড়ি করছিল রূপসী। এখন সে রাতে রান্না করেনা। বসির আসেনা বলে দুপুরের খাবার কিছু রেখে দেয়। রাতে সেই খাবার খেয়েই বিছানায় ঘুমিয়ে পড়ে সে। কিন্তু ঘুম আসেনা। কত ধরণের চিন্তা মাথার মধ্যে ভেসে বেড়ায়। বসির ঠিকঠাক আসেনা। তাহলে সে কি ধীরে ধীরে তাকে ভুলে যাবে ! সে কি আর সংসার করবেনা ? মাঝে মাঝে মনে হয় কার জন্য সংসার করবে সে ? নিজের একটাও সন্তান হলনা ! সংসারে বাচ্চা না এলে সংসারতো সংসারই না। সেই সংসার টিকে কী করে ? কিন্তু সংসারে বাচ্চা না আসার জন্য কে দায়ী? নিজের প্রতি পুরো ভরসা আছে তার। বাচ্চা না আসার দায় তার নয়। দায়ী বসির। কিন্তু সে কথা সে বিশ্বাস করেনা। আবার ধরা পড়ে যাবে বলে ডাক্তারের কাছেও যায়না সে। অনেক বুঝিয়ে, অনুনয় করে একদিন গিয়েছিল ডাক্তারের কাছে। কিন্তু ডাক্তারের কথা সে শুনেনি। ডাক্তারের পরামর্শ মতো কোনও পরীক্ষাও সে করেনি। তার সাফ কথা, পুরুষ মানুষের দোষ হয়না। যত দোষ মেয়ে মানুষের। পরিষ্কার করে সে বলেছে, সংসারে বাচ্চা না আসার দায় রূপসীর, তার নয়। এসব কথা মনে আসলেই ঘুম ভেঙে যায় রূপসীর। বিছানায় বসে থাকে। তারপর বিছানা থেকে উঠে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। বাইরে তাকিয়ে থাকে। কিছু দূরে পদ্মা আপন মনে বয়ে চলেছে। সেদিক থেকে মৃদুমন্দ হাওয়া বয়ে আসে। সে হাওয়ায় তার মন উতলা হয়। মনে হয় একটু বাইরে বেরিয়ে পদ্মার পাড়ে বসে আসি। কিন্তু একা সাহস হয়না। দাঁড়িয়ে থেকেই রাত গভীর হয়। পদ্মার পেট থেকে চাঁদ উঠে আসে। ধীরে ধীরে মাঝ আকাশে থিতু হয়। চাঁদের আলোয় ঝলমল করে চারিদিক। রূপসী দাঁড়িয়ে তাকিয়েই থাকে। তাকিয়েই থাকে। তারপর একসময় চাঁদ পশ্চিম আকাশে হেলে পড়ে। আবার বিছানায় উঠে এসে বসে রূপসী। বালিশে মুখ গুঁজে হুহু করে কাঁদতে থাকে। চোখের জলে বালিস ভিজে। মনটা হালকা হয়। তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়ে।

 

আজও বিছানা ছেড়ে উঠব উঠব করছিল রূপসী। এই সময় দরজায় ঠকঠক আওয়াজ শুনতে পেল সে। হঠাৎ করেই গোটা শরীর কাঁটা দিয়ে উঠল রূপসীর। এত রাতে কে এসে দরজার কড়া নাড়ে ! কোনও শব্দ না করে চুপ করে কান পাতল রূপসী। কেউ কোনও সাড়া দিলনা। কিন্তু দরজার কড়া আবার জোরে জোরে বেজে উঠল।

 

এবার রূপসী ভয়ার্ত স্বরে জিজ্ঞাসা করল, “কে?”

 

দরজার ওপার থেকে বসিরের কন্ঠ শোনা গেল, “আমি। দরজা খোল।”

 

বসিরের গলা শুনে আরও ভয় পেল রূপসী। এত রাতে কেন এসেছে সে ? কী উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে? সে কি কিছু করতে এসেছে! রূপসী ঠিক বুঝে উঠতে পারল না।

 

আবার কড়া নড়ে উঠল। এবার রূপসী বিছানা ছেড়ে উঠে গেল দরজা খুলতে।

 

দরজা খুলতেই বসির হনহনিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকে গেল। দরজা লাগিয়ে রূপসী ফিরে এল ঘরে। দেখল বসির বিছানার উপর বসেছে। ঘরে ঢুকতে গিয়েও কী ভেবে সামান্য দাঁড়াল সে। বসিরের দিকে তাকিয়ে দেখল। মুখভর্তি কাঁচাপাকা দাড়ি লম্বা হয়ে বুকের কাছে নেমে এসেছে। মাথার চুলে পাক ধরেছে। কপালের মাঝখানে কালো ঘটা পড়ে গেছে। গায়ে লম্বা জুব্বার মতো পাঞ্জাবী। পরনে নতুন লুঙ্গি। এই সময় ঘরে ঢোকা ঠিক হবে কিনা রূপসী ঠিক বুঝতে পারল না !

 

দরজার কাছে দাঁড়াতেই বসির বিছানা থেকে বলল, “দাঁড়ালে কেন রূপসী! এসো। কাছে এসো !”

 

রূপসী ভেতরে গেল। কিন্তু বসিরের কাছে গেল না। জানালার কাছে গিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “কেন এসেছ?”

 

রূপসীর কথা শুনে বসির চমকে উঠল। ভেবেছিল ঘরে যাওয়া মাত্র রূপসী তাকে খাতির যত্ন শুরু করবে। হাত পা ধুইয়ে দিবে। এই রাতেই কিছু ভালোমন্দ তৈরি করে খাওয়াবে। খুব আদর যত্ন করবে। তারপর একজন স্বামী তার স্ত্রীর কাছ থেকে যা যা পেতে চায়, রূপসী একে একে সব পূরণ করবে। কিন্তু রূপসী এসব তো কিছুই করছেনা। বরং উল্টে প্রশ্ন করছে ‘কেন এসেছ’।

 

প্রথমেই তার মনটা বিষাক্ত হয়ে উঠল। কিন্তু রাগ না দেখিয়ে শান্তভাবে সে বলল, “কেন এসেছি? একথা জিজ্ঞাসা করছো কেন রূপসী? একজন স্বামী তার বউয়ের কাছে আসতে পারে না ?”

 

রূপসী জানালার দিকে মুখ করেই বলল, “আসতে পারে না, সেকথা তো বলিনি। আমি জানতে চাইছি তুমি এত রাতে কেন এসেছ আমার কাছে ?”

 

পুরুষত্বে ঘা খেল বসিরের। সেই সাথে স্বামীত্বেও। সে ভাবতেই পারেনি রূপসী এইভাবে কথা বলতে পারে। তবু সে রাগ দেখাল না। সমস্ত রাগকে দাঁতে চেপে শান্তভাবে বলল, “স্বামী তার স্ত্রীর কাছে এসেছে। তাকে কৈফিয়ৎ দিতে হবে কেন সে এসেছে?”

 

রূপসী জানালার বাইরে তাকিয়েই বলল, “কৈফিয়তের কথা বলছ কেন ? কে তোমার কাছে কৈফিয়ৎ চেয়েছে ? কৈফিয়ৎ চাইলে তো অনেক আগেই কৈফিয়ৎ চাইতে পারতাম। তুমি তো এখন আর আমার কাছে আসনা। তাই জানতে চাইছি কেন এসেছ ?”

 

বসির মনে মনে ক্ষুব্ধ হলেও রূপসীর কথার মধ্যে কোথাও যেন নরম মনের আভাস পেল। ভাবল রূপসীকে এখন রাগানো যাবে না। নাহলে আজকের রাতটায় মাটি হবে। সে অভিমানের সুরে বলল, “কে বলেছে তোমার কাছে আসি না। এই তো সেদিন এলাম।”

 

রূপসী বলল, “এই তো সেদিন মানে কবে ?”

 

বসির একটু ভেবে বলল, “গত সপ্তাহে।”

 

রূপসী এবার বসিরের দিকে মুখ করে বলল, “গত সপ্তাহে তুমি আসনি। তোমার আসা দু সপ্তাহ হল।”

 

“ওই হল। এক সপ্তাহ এদিক আর ওদিক। আসিতো।” বলে বসির উঠে গিয়ে রূপসীকে জড়িয়ে ধরল।

 

রূপসী বসিরের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বিছানায় গিয়ে চুপ করে বসল। বসিরও গিয়ে বসল বিছানায়। কিন্তু কি বলবে কথা খুঁজে পেলনা। রূপসীর হাতখানা নিজের হাতের উপর তুলে নিল। তারপর বলল, “স্বামীকে স্ত্রী কীভাবে খুশি করে তাতো তুমি জানো রূপসী। এত প্রশ্ন করছ কেন তুমি!”

 

রূপসী চুপ করে অদ্ভুত দৃষ্টিতে একবার তাকালও বসিরের দিকে। সে দৃষ্টিতে আগুন নাকি এক পশলা বৃষ্টির স্নিগ্ধতা, ভালোবাসা নাকি ঘৃনা, অভিমান নাকি রাগ ঝরে পড়ল বসির কিছুই বুঝতে পারলনা। রূপসীর চুপ থাকাকে মৌন সমর্থন ভেবে রপসীর পাশে গিয়ে বসল সে। তারপর রূপসীকে চেপে ধরে তার মুখে একটা চুমো দিল। রূপসী কিছু বলল না। শুধু আগে যেভাবে বসিরের দিকে তাকিয়েছিল, সেভাবে আরেকবার তাকাল। সেদিকে বসিরের দৃষ্টি দেবার সময় নেই। ততক্ষণে তার দুই হাত উঠে গেছে রূপসীর বুকে। কোনও কিছু বোঝার মতো অবস্থা তখন তার আর নেই। তার শরীরে এখন পশুত্বের বল। সমস্ত শক্তি দিয়ে রূপসীকে আজ সে শেষ করে দিতে চায়। কিন্তু রূপসী কোনোভাবে বসিরকে সাহায্য করল না। শুধু শরীরটা বসিরের শরীরে আনমনে ছেড়ে দিল। তার শরীরে কোনও খিদে নেই। কোনও ভালোলাগা নেই। নেই কোনও আদিম রস আস্বাদনের বাসনাও। আর বসির হায়েনার মতো করে রূপসীর শরীর খুবলে খুবলে খেতে লাগল।

 

ধীরে ধীরে হেঁটে গিয়ে পদ্মার জলে পা রাখল রূপসী। এই গরমের সময়েও পদ্মার জল কত শীতল। প্রথমে এক হাঁটু, তারপর এক কোমর, তারপর এক বুক। এবার সামান্য থামল রূপসী। তারমনে হল পদ্মার গভীর থেকে একটা হিস হিস শব্দ উঠে এসে পদ্মার পাড়, গ্রাম, মাঠ পেরিয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। আর সেই শব্দের সাথে কার একটা লিকলিকে জিহবা হিস হিস করতে করতে গ্রামের উপর দিয়ে মাঠের দিকে লম্বা হয়ে চলে যাচ্ছে

 

কিছু পরে ক্লান্ত, অবসন্ন শরীরে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল বসির। রূপসী উঠে পড়ল বসিরের পাশ থেকে। আলুথালু কাপড় খানা শরীরে জড়িয়ে নিয়ে আবার গিয়ে দাঁড়াল জানালার ধারে। বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখল পদ্মার ওপার থেকে কৃষ্ণপক্ষের একফালি চাঁদ তার জানালা দিয়ে ভেতরে প্রবেশের জন্য উঁকি মারছে। কিন্তু লজ্জায় প্রবেশ করতে পারছেনা।

 

জানালার দিক থেকে মুখ ফেরাল রূপসী। ঘরে টিম টিম করে লণ্ঠনের আলো জ্বলছিল। সেই আলোতে দেখল সর্বাঙ্গ উলঙ্গ একটা মানুষ তার বিছানার উপরে পড়ে আছে। হঠাৎ করেই রূপসীর শরীরটা ঘিন ঘিন করে উঠল। যে মানুষটা তাকে ভালোবাসেনা, যে মানুষটা তাকে কেবল একটা নারী বলেই মনে করে, যে মানুষটা মিথ্যে হলেও তার পুরুষত্বের কাছে নিজেকে বড় বলে মনে করে, যে মানুষটা শুধু শরীরের লোভে আজ এই রাতে ভালোবাসার ভান করতে এসেছে – সেই মানুষটাকে কেন সে দেহ দিয়েছে। বসিরকে তার একটা কামাতুর পুরুষ ছাড়া আর কিছু মনে হল না।

 

রূপসী জিজ্ঞাসা করল, “তোমার কাজ তো হয়ে গেছে। তুমি এখন কী করবে?”

 

বসির শুয়ে থেকেই বলল, “মানে? আমার কাজ মানে?”

 

রূপসী বলল, “তুমি তো শরীরের লোভে এসেছিলে। শরীর তুমি পেয়ে গেছ। এবার কী করবে তুমি?”

 

বসির এবার উঠে বসল। বলল, “শরীরের লোভ মানে? তুমি আমার স্ত্রী। তোমাকে যখন খুশি, যেভাবে খুশি ভোগ করতে পারি। এটা আমার অধিকার। সেখানে লোভের কথা আসছে কেন?”

 

রূপসী বলল, “তুমি শুধু স্বামীত্বের অধিকার ফলাতে এসেছ এত রাতে। আর স্ত্রীর প্রতি দায়িত্ব থাকেনা বুঝি। স্ত্রীরও তো কিছু অধিকার থাকে।”

 

উঠে বসে কোনোরকমে লুঙ্গিখানা পরে নিয়ে বসির বলল, “কে বলেছে স্ত্রীর প্রতি দায়িত্ব আমি পালন করিনা ? আমি প্রতি সপ্তাহে তোমার খোঁজ নিই। তোমার যা যা দরকার আমি কারও না হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিই। এরপরও বলবে আমি দায়িত্ব পালন করিনা ?”

 

“না। তুমি দায়িত্ব পালন কর না। যেটুকু কর সেটা আমার শরীরের জন্য, সংসারের জন্য নয়।” রপসী এবার জোরের সাথে বলল কথাটি।

 

বসিরও এবার গলা চড়িয়ে বলল, “সংসারের দায়িত্ব বলতে তুমি কী বুঝাতে চাইছ সে কি আমি বুঝতে পারছিনা ? কিন্তু তার জন্য তো আমি দায়ী নই। আমার কোনও হাত নেই। তোমার পেটে যদি বাচ্চা না আসে আমি কী করতে পারি ?”

 

রপসী বসিরের কাছ থেকে একথা শুনে শুনে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। এসব নিয়ে আর কথা বলতে তার ভালো লাগেনা। শুধু রাগে আর ক্ষোভে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “তোমার কাছ থেকে একথা শুনতে আমার আর ইচ্ছে করেনা। তোমার পুরুষত্বের এতই যখন জোর, তাহলে ডাক্তারি পরীক্ষা করাতে এত ভয় পাও কেন? ক্ষমতা থাকে তো একবার চলো ডাক্তারের কাছে।”

 

“এ জগতে ডাক্তারই সব নয়। ডাক্তার যা বলবে আর সেটাই ঠিক হবে কে বলেছে তোমাকে? শোন। আমাদের থানে যে কানা ফকির আছে, ওর কাছে এসো একদিন। ও গাছ দিবে। খেয়ে দেখ তো !” বসির বলল।

 

“আমি কোনও গাছ খাব না। আমার কোনও দোষ নাই। গাছ খেতে হলে তুমি খাও।” রূপসী জোরের সাথে কথাটি বলল।

 

বসির এবার রাগ দেখিয়ে বলল, “আমার মুখের উপরে কথা বলছ। দিন দিন তুমি বেখাল্লা মাগীর মতো হয়ে যাচ্ছ রূপসী। তোমাকে জব্দ করতে হবে।”

 

“আমাকে জব্দ করতে হবে না। তোমার সাথে আমি থাকতে চাই না। তুমি আমাকে আলাদা থাকার ব্যবস্থা করে দাও।” রূপসী কোনও কিছু না ভেবেই কথাগুলি বলল।

 

বসির রেগে বলল, “ভেবে দেখেছিস কি বলছিস ? একবার তালাক দিলে তোর কী অবস্থা হবে তুই জানিস ? এখানে তোর থাকা হবেনা। আর পুরুষগুলা তোকে লুট্যাপুট্যা খাবে।”

 

“আমার কথা আমাকেই ভাবতে দাও। আমাকে তালাকই দাও। যেদিকে দুটো চোখ যাবে চলে যাব। তাতেই আমার শান্তি হবে। আমি এই নরকে আর থাকতে চাই না।” রূপসী খুব জোরের সাথে কথাগুলি বলল।

 

“তোর এত দেমাক হল কী করে রে ? ওই শালা সফরার লাগ্যা। শালা সফরা তোকে সাহস দিচ্ছে। পরের কথায় নাচিস না। পরে কষ্ট পাবি। আর আমি শালা সফরাকে এবার দেখ্যা লিচ্ছি।” বলে বসির গেঞ্জীর উপর জুব্বা পাঞ্জাবীটা পরে বেরিয়ে গেল।

 

যাবার সময় পাঞ্জাবীর পকেট থেকে একটা বই বের করে রূপসীর দিকে তাকিয়ে বিছানায় ছুঁড়ে দিয়ে বলল, “এই বইটা পড়বি। তাহলে বুঝতে পারবি স্বামীকে কীভাবে সেবা করতে হয়। মনে রাখিস স্বামীর পায়ের তলে স্ত্রীর বেহেস্ত।”

 

রূপসী বইটির মলাটের দিকে তাকিয়ে তার মনে পড়ে গেল এই বইটি তার এক দূর সম্পর্কের দিদির ঘরে দেখেছিল। পুরো বইটার মধ্যে স্বামীদের কীভাবে সেবা করতে হবে, আর স্বামী কীভাবে তার স্ত্রীকে ভোগ করবে তার বিবরণ আছে।

 

রূপসী তাড়াতাড়ি বইটি হাতে নিয়ে বসিরের গায়ে ছুঁড়ে মারল। বলল, “এই বই পড়ার কোনও দরকার নাই। নিয়ে যাও তুমি এই বই। আর কাওকে দাওগে তোমার এই বই।”

 

বসির রাগে কাঁপতে কাঁপতে এসে রূপসীর গালে জোরে একটা চড় মারল। তারপর বলল, “খানকি মাগী। তোর এতবড় ক্ষমতা বই পাক মারিস ! কালকেই তোকে তালাক দিবরি মাগী !” বইটি হাতে কুড়িয়ে নিয়ে খুব জোরে হেঁটে বেরিয়ে গেল সে।

 

রূপসী গালে হাত দিয়ে চোখের জল ফেলতে ফেলতে জানালার ধারে গিয়ে বাইরের দিকে তাকাল। দেখল পূবের একফালি চাঁদ এখন আকাশের অনেক উপরে উঠে এসেছে। ঝিলমিল ঝিলমিল নদীর জলে পড়ছে তার আলো। সেখান থেকে আলো ছিটকে এসে পড়ছে আশেপাশের পাড়, ফসল, গাছপালা, বাড়িঘরের উপর। চোখের জল মুছে রূপসী একমনে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকল। তার মনে হল নদী তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। নদীর জলে ঝাঁপিয়ে পড়তে ইচ্ছে হল তার। একমাত্র পদ্মায় পারে তার জীবনের সব দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা, আশা, আকাঙ্ক্ষা আর ব্যর্থতা থেকে মুক্তি দিতে।

বাইরে বেরিয়ে এল রূপসী। দরজা খোলা রেখেই একমনে হেঁটে গেল পদ্মার পাড়ে। নদীর জল শান্তভাবে বয়ে চলেছে। চারিদিকে নিঝুম নিঃশব্দ। পূব দিক থেকে মৃদুমন্দ বাতাস নদীর জলের উপর দিয়ে পাখা মেলে উড়ে এসে গায়ে লাগছে রূপসীর। সেই বাতাসে তার চুলগুলি এলোমেলো উড়তে থাকল। রূপসীর মনে হল পদ্মার বুকে নিজেকে সঁপে দিতে এটাই তার উপযুক্ত সময়। এই সময়েই পদ্মা তাকে মুক্তি দিতে পারে।

 

ধীরে ধীরে হেঁটে গিয়ে পদ্মার জলে পা রাখল রূপসী। এই গরমের সময়েও পদ্মার জল কত শীতল। প্রথমে এক হাঁটু, তারপর এক কোমর, তারপর এক বুক। এবার সামান্য থামল রূপসী। তারমনে হল পদ্মার গভীর থেকে একটা হিস হিস শব্দ উঠে এসে পদ্মার পাড়, গ্রাম, মাঠ পেরিয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। আর সেই শব্দের সাথে কার একটা লিকলিকে জিহবা হিস হিস করতে করতে গ্রামের উপর দিয়ে মাঠের দিকে লম্বা হয়ে চলে যাচ্ছে। এই শব্দ আগেও সে শুনেছে। রাত হলেই পদ্মার পাড়ে কে যেন কাঁদে। ক্রমে সেই কান্না পদ্মার পাড় বেয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তারপর চারিদিক থেকেই চাপা কান্না ভেসে আসে। মনে হয় কে যেন তার যন্ত্রণা আর হাহাকারকে জোর করে চেপে রেখে নদীর পাড় থেকে উঠে এসে গোটা মাঠ জুড়ে কিছু একটা খুঁজে চলেছে।

 

এই সময় রূপসীর সফর আলির কথা মনে এল। সে মরে যাবে। কিন্তু সফরের সাথে তার আর দেখা হবে না। সফর আলিকে অনেক কিছু বলার ছিল। সেই না বলা কথাগুলো চিরদিনের জন্য না বলায় থেকে যাবে। অথচ কথাগুলো বলা দরকার। হঠাৎ সফর আলির জন্য তার মনটা আকুলি বিকুলি করতে লাগল। কোনোকিছু হলেই সে সফর আলির কাছে গিয়েছে। তার কাছে গিয়ে কত নালিশ জানিয়েছে। পাশে এসেও দাঁড়িয়েছে সে। তবে আজ কী সে পাশে দাঁড়াবেনা। মানুষের মৃত্যু কি এতই সহজ! জীবন তো আমি একবারই পেয়েছি। শুধু ওই একটা লোকের জন্য সেই জীবনকে এত তাড়াতাড়ি বিসর্জন দিব!

 

একবুক জলে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ভাবল রূপসী ! তারপর পেছনের দিকে পা বাড়াল সে।

 

•২০•

আজ সারাদিন সফরের বেশ খাটুনি গেছে। গ্রামে কী এক ধরনের জ্বর এসেছে। সঙ্গে মাথা ব্যথা। সকাল থেকে রোগীদের ভিড় ছিল বেশি। কেউ দু দিন থেকে, কেউ বা তিন-চার দিন থেকে জ্বরে ভুগছে। প্রত্যেকের রক্ত পরীক্ষা করা দরকার। কিন্তু এখানে রক্ত পরীক্ষার কোনও ব্যবস্থা নেই। সফর আলিরও অসুবিধা হচ্ছে রোগীদের চিকিৎসা করা। জ্বরটা কী থেকে হচ্ছে, কেন হচ্ছে, কী জ্বর হয়েছে, এসব ঠিক বুঝে উঠতে পারছেনা সে। সকাল থেকে তিনজন কে শহরে পাঠিয়েছে। তাদের অবস্থা আয়ত্বের মধ্যে ছিলনা। সফর আলি মনে মনে ভেবেছে এবার শহরে গেলে প্রাথমিক রক্ত পরীক্ষার কয়েকটি কিটস কিনে আনবে। অন্তত সিরিয়াস রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসাটুকু তো করা যাবে !

 

বিকেলের দিকে রোগীর সংখ্যা কমতে শুরু করেছিল। সন্ধ্যার পর আর কোনও রোগী আসেনি। রাতের দিকে চেম্বার বন্ধ করে রাতের খাবার খেয়ে টেবিলে এসে বসল সফর আলি। জমে থাকা ক’টি হিসেব সম্পূর্ণ করল সে। আর কী কী ওষুধ আনাতে হবে তার একটা লিষ্ট বানাল। ওপার থেকে একটি ছেলে আসে ওষুধ দিতে। সপ্তাহে দুদিন। কী কী ওষুধ দরকার, তার একটা লিষ্ট বানিয়ে তাকে দিতে হয়। তখন সে লিষ্ট অনুযায়ী পরের দিন ওষুধ দিয়ে যায়। মোটামুটি সব কোম্পানির ওষুধ পাওয়া যায় ওর কাছে। যে গুলো পাওয়া যায়না, সেগুলো এদিক ওদিক ম্যনেজ করে নিয়ে আসে সে। আগামীকাল সে আসবে।

 

সব কাজ শেষ করে বিছানায় যেতে রাত সাড়ে এগারোটা বেজে গেল সফর আলির। সারাদিনের ক্লান্তি ছিল। বিছানায় বালিশে মাথা দিতেই চোখে ঘুম চলে এল। অন্যদিনের তুলনায় গরমটা বেশিই ছিল। পদ্মার দিক থেকে হালকা শীতল হাওয়া মাঝে মাঝে দমকা মেরে উড়ে এসে জানালা দরজার ফাঁক দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ছিল সফর আলির। তাই জানালা দরজা খোলায় রেখেছিল সে।

 

মধ্যরাত। নরম হাতের হালকা স্পর্শে ঘুম ভেঙে গেল সফর আলির। চোখ খুলে দেখল বিছানার একপাশে চুপ করে বসে আছে এক নারী মূর্তি। ঘরে আলো জ্বালানো ছিলনা। দরজা বন্ধ। জানালার ফাঁক দিয়ে দুপুর রাতের চাঁদের আলো ঘরে প্রবেশ করছে। সেই আলোতে সফর আলি দেখতে পেল বিছানায় বসে আছে রূপসী।

 

চমকে বিছানায় উঠে বসল সে। ভাবল রূপসীর জ্বর টর হল নাকি! তাছাড়া এতরাতে সে কেন আসবে এখানে! জিজ্ঞাসা করল, “কী হয়েছে রূপসী! এতরাতে এখানে!”

 

রূপসী বলল, “কেন গো ? সবসময় কিছু হতেই হবে নাকি ? কিছু নাহলে এখানে আসা যাবে না ?”

 

“নানা তা নয়। আসলে চারিদিকে খুব জ্বর হচ্ছে তো। তাই ভাবলাম তোর আবার কিছু হল নাকি ? কিছু না হলে তো এতরাতে কেউ ডাক্তারের বাড়ি আসেনা?” সফর আলি বলল।

 

“তা যদি হয়, তাহলে বলব আমিও এমনি এমনি আসিনি। আমারও একটা কিছু হয়েছে। তাই এতরাতে তোমার কাছে চুপি চুপি এসেছি।”

 

 “বল। কী হয়েছে তোর?”

 

রপসী কোনও উত্তর করল না। চুপ করে বসে থাকল।

 

সফর আলি আবার বলল, “রূপসী। তোর কী হয়েছে বল!”

 

রূপসী এবার চুপ না থেকে সোজাসুজি বলল, “তুমি আমাকে একটা বাচ্চা দিতে পারবে সফর ভাই!”

 

রূপসীর কথা শুনে চুপ করে গেল সফর আলি। কোনও উত্তর তার মাথায় এলনা। জানালার বাইরে তখন চাঁদের শেষ আলো শেষবারের মতো সফর আলির ঘরে ঢুঁকে এদিক ওদিক উঁকি মারছে।

 

সেদিকে তাকিয়ে থেকে সফর আলি বলল, “তোর কথা আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না রূপসী ! আমি কীভাবে তোকে বাচ্চা দেব ?”

 

রূপসীর মধ্যে কোনও ভয় বা আড়ষ্টতা নেই। সে আরও স্পষ্ট করে বলল, “না বুঝার মতো কোনও কথা তো বলিনি। আমি সমস্তরকম ভাবে প্রস্তুত হয়ে এসেছি। আমাকে একটা বাচ্চা একমাত্র তুমিই দিতে পার সফর ভাই ! আজ তুমি না করোনা !”

 

সফর আলি ভেতরে ভেতরে কেমন যেন দুর্বল হয়ে পড়ল। কিন্তু মুখে বলল, “তা কী করে হইরে রূপসী! এটা আমার পক্ষে সম্ভব নয়!”

 

“কেন? কেন সম্ভব নয় সফর ভাই?” রূপসীর কথায় কঠিন জিজ্ঞাসা।

 

“কেন বলতে পারব না। শুধু বলব আমার মন সায় দিচ্ছেনা।”

 

“কেন সায় দিচ্ছে না সফর ভাই। আমি কী ভালো নই। দেখতে সুন্দর নই। আমাকে দেখে তোমার ইচ্ছে জাগে না ?” জিজ্ঞাসা করল রূপসী।

 

“না তা নয় রূপসী। তুই যথেষ্ট সুন্দরী। তোকে দেখে মনের মধ্যে ইচ্ছে জাগবে না এরকম পুরুষ নাই জগতে ! তবু…” কথা শেষ করল না সফর আলি। চুপ করে থাকল।

 

“তবু কী সফর ভাই ! তুমি নিজেকে আলাদা বলতে চাইছ ! না তুমি আলাদা নও। কোনও পুরুষই আলাদা নয়। নারীর বেলায় সব পুরুষ সমান। তুমি যেটা করছ সেটা মিথ্যে করছ। নিজেকে মিথ্যার আড়াল দিয়ে লুকিয়ে রাখছ। চুপিয়ে রাখছ। তাই যদি হয়…” রূপসী চুপ করে সফর আলির পাশে সরে গিয়ে সফর আলির পুরুষাঙ্গের উপর হাত রাখল। দেখল সেটি শক্ত হয়ে আছে। সেটিকে দেখিয়ে রূপসী বলল, “তুমি যদি ঠিক হও, তোমার কথায় যদি সত্য হয়, তাহলে এটা কী সফর ভাই ? তুমি মিথ্যে বলতে পার। কিন্তু এটা তো মিথ্যা বলতে পারেনা। আর এই মিথ্যা আড়ালের দরকারটাই বা কী ?”

 

“আমিও তো পুরুষ মানুষ। আমারও তো ইচ্ছে আছে, কামনা বাসনা আছে। সেটাকে অস্বীকার করি কী করে রূপসী ! তাই তোকে পাশে পেয়ে আমার শরীরের আদিম কামনা জেগে উঠেছে। কিন্তু আমি তোকে এমনভাবে ভাবিনি রূপসী ! এটাই আমি তোকে বোঝাতে চাইছি।”

 

“আমি এত তত্ত্ব কথার মাঝে যেতে চাইনা সফর ভাই। আমি শুধু একটা বাচ্চা নিতে চাই। আর তুমিই পার আমাকে একটা বাচ্চা দিতে। একমাত্র তুমিই পার আমাকে পাপ থেকে উদ্ধার করতে।”

 

রূপসী তার শরীর থেকে একে একে কাপড়গুলো খুলে ফেলে সফর আলির সামনে দাঁড়াল।  বলল, “তুমি আমাকে স্পর্শ কর সফর ভাই। তুমি আমাকে পবিত্র কর।”

 

সফর আলি দেখল এই গহীন কালো রাত্রির সমস্ত অন্ধকার দূরে সরে গিয়ে একটা উজ্জ্বল আলোর সাদা পবিত্র নারীদেহ সমস্ত সীমানার বাঁধন ছিঁড়ে তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে। সে দেহকে যেমনভাবে স্পর্শ করা যায়, আলিঙ্গন করা যায়। তার ভেতরে জেগে উঠল এক অকৃত্রিম আদিমতা। রূপসীর দিকে তাকাল সে। দেখল রূপসীর চোখ চিকচিক করছে। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না সফর। রূপসীকে টেনে নিয়ে বুকে চেপে ধরল সে। হাত দিয়ে চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে রূপসীর ঠোঁটে একটা লম্বা করে চুমু দিল। দেখল রূপসীর শরীর কেমন কেঁপে কেঁপে উঠছে। রূপসীকে আরও বুকের ভেতর টেনে নিল সফর আলি। তার দুই হাতে এখন দুই তাল কাদা। সেই কাদা দিয়ে সফর আলি ইচ্ছে মতো খেলতে পারে।

 
ক্রমশ…

♦—♦♦—♦♦—♦♦—♦

 
পূর্ববর্তী পর্ব পড়ুন : চর (নবম পর্ব)

চর >।পর্ব ৯।


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!