- ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
- সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২৩
চর >।পর্ব ১১।

ধা রা বা হি ক · উ প ন্যা স
•২১•
বিকেলের দিকে পরাণ কি একটা কাজে ডিঙি ভাসিয়েছিল। ডিঙিতে লগি দিয়ে একটা ঠেলা মেরে গভীর জলে ঠেলে দিয়ে গান ধরেছিল –
সর্বনাশা পদ্মা নদী তোর কাছে শুধাই
বল আমারে তোর কি রে আর
কুল কিনারা নাই, কুল কিনারা নাই
ও নদীর কুল কিনারা নাই।।
পাড়ির আশায় তাড়াতাড়ি
সকাল বেলা ধরলাম পাড়ি
আমার দিন যে গেল সন্ধ্যা হলো
তবু না কুল পাই।।
গান গাইতে গাইতে হঠাৎ সে পদ্মার নদীর জলের দিকে তাকাল। তার মনে হল পদ্মার জল কেমন ঘোলা ঘোলা লাগছে। পদ্মার গভীর থেকে বালি আর কাদা মিশ্রিত ঘোলা জল কেমন উথাল পাথাল করছে আর পাক দিচ্ছে। তারমানে পদ্মায় বান ডেকেছে। এবার পদ্মার জল উপরের দিকে উঠতে শুরু করবে। মাঠ ডুবাবে, মাঠের ফসল ডুবাবে, গ্রাম ডুবাবে, গ্রামের বাড়িঘর সব ডুবাবে। সে ডিঙি গ্রামের দিকে ঘোরাল। এখুনি গ্রামে খবর দিতে হবে। কাল সকাল থেকেই কাজে নামতে হবে। গ্রামের সব মানুষ কাজে নামবে। অনেকের বাড়িঘর ঠিক নেই। তারা বাড়িঘর ঠিকঠাক করবে। বাড়ির পৈঠায় মাটি তুলতে হবে। যাদের বাড়ি একটু নিচু, তারা বাড়ির আশেপাশে মাটি তুলবে। বাড়িতে যেন বন্যা না আসে, তারজন্য বাড়ির আশপাশ ঘিরে বাঁধ দিবে তারা। গ্রামে যাতে বন্যার জল না ঢোকে, তারজন্য গ্রামের সকল মানুষকে নিয়ে বাঁধ তৈরি করতে হবে।
সন্ধ্যার আর কিছু বাকী। পরাণ গ্রামে এসে খবর দিল পদ্মায় বন্যা নেমেছে। পদ্মার জল প্রচণ্ড ঘোলা আর প্রবল তার ঘূর্ণি। পরাণের কথা শুনে গ্রামের মানুষ কেউ কেউ পদ্মার দিকে ছুটে গেল। তারাও দেখল পদ্মার জল প্রচণ্ড ঘোলা। প্রবল ঘূর্ণিতে পদ্মার গভীর থেকে ঘোলা জল উপর থেকে নীচে উথাল পাতাল করছে। ধীরে ধীরে গোটা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল, পদ্মায় বন্যা নেমেছে। গ্রামের বড় থেকে ছোট, পুরুষ থেকে মহিলা, সবাই একবার করে পদ্মার পাড়ে গেল আর পদ্মার বন্যা দেখে এল। সবার মুখে এক কথা – পদ্মায় বান এসেছে, পদ্মায় বান এসেছে। বন্যার জল দেখে কেউ বা খুশি, কেউ আনন্দিত, কেউবা আতঙ্কিত। পদ্মায় যখন বন্যা আসে, তখন জানিয়ে আসে, আর জানিয়ে যায়। অবশ্য গত বছর বন্যা এলেও খুব বেশি ক্ষতি হয়নি। বন্যা নিচু নিচু এলাকা দিয়েই বিদেয় হয়েছিল। খুব বেশি বন্যা হয়নি বলে এলাকা ভাসেনি। তবে সব বছর তো সমান যায়না। এ বছর কী সেটাই দেখার।
রাত আটটার দিকে গ্রামের কিছু মানুষ এক জায়গায় জড়ো হল। গ্রামের কিছু কিছু জায়গায় মাটি তুলে বাঁধ দিতে হবে। নাহলে খুব তাড়াতাড়ি জল ঢুকে পড়বে গ্রামের ভিতর। কথা হল আগামীকাল সকাল থেকেই প্রত্যেক বাড়ি থেকে একজন পুরুষ মানুষ পাঠাতে হবে মাটি তোলার জন্য। যাঁদের বাড়িতে পুরুষ মানুষ নেই। তাদের বাড়ি থেকে না গেলেও চলবে।
কথামতো সকালবেলায় সবাই দলে দলে মাটি তুলতে লাগল। গ্রামের যে সমস্ত রাস্তা ভেঙ্গে গিয়েছিল, যে সমস্ত জায়গা দিয়ে বন্যার জল ঢূকে যাবার সম্ভাবনা ছিল, সেই সব জায়গায় মাটি তুলে উঁচু করল। তারপরে প্রত্যকে বাড়ির লোক নিজেদের বাড়ির আশপাশগুলো উঁচু করতে লাগল, যাতে বন্যার জল বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়তে না পারে। পরের দিন গ্রামের মানুষ গ্রামের একটি উঁচু মতো জায়গায় আরও বেশি মাটি তুলে উঁচু করতে থাকল। যদি বন্যা বেশি হয়, যদি বন্যা এসে গ্রামের বাড়িঘর সব ডুবিয়ে দেয়, তবে গোরু ছাগল নিয়ে সেই উঁচু জায়গায় আশ্রয় নেওয়া যাবে। তাই সবাই মিলে মাটি তুলে জায়গাটি উঁচু করতে থাকল।
এদিকে নদীতে বন্যার জল হুহু করে বেড়ে চলল। বন্যার ঘোলা কাদা জল পাক খেয়ে খেয়ে এসে পড়ল নালা, খড়ির মুখে। আরেকটু বাড়লেই ঢুকতে শুরু করবে নালার ভেতরে। তারপর খাল, বিল ভরিয়ে ধীরে ধীরে বন্যা মাঠ ঘাট ডুবিয়ে ঢুকে পড়বে গ্রামে। যাদের নৌকা ছিল তারা নৌকা তালি দিয়ে আলকাতরা মাখিয়ে রোদে শুকাতে দিল। বন্যার জল বাড়লেই নৌকা নামাতে হবে।
এবং বন্যার জল দ্রুত বাড়তে লাগল। খড়ির মুখ উঁচিয়ে, নালা বেয়ে খাল বিল ডুবিয়ে বন্যার জল ঢুকল মাঠে। মাঠের ধান, পাট ডুবতে থাকল বন্যার জলে। হেঁসো, কাস্তে নিয়ে চাষীরাও নেমে পড়ল জলে। এই অসময়ে গ্রামে শ্রমিকের দরকার ছিল বেশি। এই দূর চরের দূর গ্রামে বাইরে থেকে শ্রমিক আসেনা। বরং গ্রামের ছেলেরাই বাইরে, বিদেশে কাজ করতে চলে যায়। মুম্বাই, চেন্নাই, কেরালা, গুজরাতে এইসব গ্রামের প্রচুর ছেলে কাজ করতে যায়। তারা ছ’মাস। এক বছর পরে গ্রামে ফিরে, তারপর গ্রামে কয়েদিন থেকে আবার চলে যায় বাইরে, বিদেশে। বিদেশে গিয়ে তারা রাজমিস্ত্রীর কাজ করে। পকেটে কাঁচা পয়সা ঢোঁকে। দুহাত ভরে তারা খরচ করে। অনেক করে তারা বাড়িতেও টাকা পাঠায়। সেই টাকায় বাড়িতে বাবা মায়েরা একটু সুখের মুখ দেখতে পায়। হাট করে খোলা দরজা না থাকা বাড়িতে দরজা আসে। চালের ছাউনি উড়ে যাওয়া বাড়িতে ছাউনি পড়ে। অনেকের বাড়িতে নতুন টিউবয়েল বসে। তখন জল খাবার জন্য কলসী কাঁখে মেয়েদের আর নদীর দিকে ছুটতে হয়না। এই মুহূর্তে গ্রামের বাইরে প্রায় এক থেকে দেড়শো যুবক শ্রমিক কাজ করতে বাইরে আছে। এরা ঘরে ফিরবে ঈদের আগে। তারপর কিছুদিন থেকে এদিক ওদিক ছুটে বেড়িয়ে আবার চলে যাবে বিদেশে কাজ করতে।
তাই গ্রামে শ্রমিকের অভাব। এবার তো জমির ফসল নিড়ানি দেওয়ারও শ্রমিক পাওয়া যায়নি। যার বাড়িতে দুটো যুবক ছেলে আছে, তার একজন চলে গেছে বাইরে। কারও কারও বা দুজনেই চলে গেছে বাইরে কাজ করতে। তাই আনসার আলি, গোলাম মিঞা নিজেরায় নিজের পাট কাটতে বেরিয়ে পড়েছে। লাল্টুর নিজের খুব কম পরিমাণ জমি। সে নিজের জমিতে যেমন খাটে, তেমনি পরের জমিতেও কাজ করে। সে নিজের পাট কেটে নেবার পর একবার গোলাম মিঞার, একবার আনসার আলির কাজ করছে। একটা ছোট্ট মতো নৌকা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে আনসার আলি। নৌকাকে ঠেলে ঠেলে জমির কাছে নিয়ে যায়। তারপর জলের ভেতরে হেঁসো চালিয়ে, কখনও কখনও টেনে টেনে পাট তুলে পরে পাটের গোড়ালি কেটে নিয়ে আঁটি বেঁধে নেয়। দুপুর পর্যন্ত মাঠে কাজ করে আনসার। তারপর পাটের আঁটিগুলো নৌকায় সাজিয়ে লগি ঠেলতে ঠেলতে বাড়ির দিকে রওনা দেয় আনসার আলি। বাড়ি গিয়ে নৌকা থেকে পাট নামিয়ে ছাগলকে পাতা খেতে দেয়। গোলামের নিজের কোনও নৌকা নেই। তাই সে নিজে নিজেই হেঁটে মাঠে যায়। দুপুর পর্যন্ত পাট কেটে পাটের আঁটিগুলোকে জাগের মতো করে সাজিয়ে ভালো করে বেঁধে টানতে থাকে গোলাম। এভাবে টানতে টানতে একসময় বাড়ির কাছে পৌঁছে যায় সে। কোনোদিন বা আনসার বলে, “আজ ক আঁটি পাট কাটবি গোলাম?”
গোলাম পাট কাটতে কাটতে বলে, “আজ বেশি কাটবনা আনসার ভাই। আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে হবে।”
তখন আনসার বলে, “ঠিক আছে। আজ আমিও বেশি কাটবনা। তোর পাটগুলো আমার নৌকায় চাপিয়ে দিস। একসাথে চলে যাব আমরা।”
তখন গোলাম তার পাটের আঁটিগুলি আনসার আলির নৌকায় চাপিয়ে দেয়। আনসার আলি লগি ঠেলতে ঠেলতে নৌকা নিয়ে চলে আসে গ্রামে। আনসারের বাড়ি থেকে মাথায় বোঝা করে গোলাম তার পাটের আঁটি বাড়ি নিয়ে যায়। শুধু আনসার বা গোলাম মিঞা নয়, গ্রামের সমস্ত চাষী বন্যার জলে নেমে ফসল কাটতে থাকে। কারও জমিতে এক হাঁটু জল তো কারও জমিতে বুক পর্যন্ত। কারও কারও জমি এখনও ডাঙ্গা আছে। তারাও তাড়াতাড়ি করছে ফসল কেটে নেবার জন্য।
এদিকে বন্যার জল প্রতিদিন একটু একটু করে বাড়তে থাকল। যতদিন যায়, জল বাড়তেই থাকে। জল নাকি উঁচু থেকে নিচের দিকে যায়। বন্যার জল পুরো উল্টো। সে নিচু থেকে উপরের দিকে উঠে। মাঠ ঘাট ভর্তি করে দিয়ে বন্যার জল ধাওয়া করল গ্রামের দিকে। গ্রাম যাতে জল না ঢুকে তারজন্য গ্রামের মানুষেরা যে বাঁধ দিয়েছিল। বাঁধের গা বেয়ে বন্যার জল উপরের দিকে উঠতে থাকল। দিনে রাতে গ্রামের মানুষ বাঁধের উপর দিয়ে হাটাহাটি করে বাঁধ পাহারা দিতে থাকল। কিন্তু পদ্মার দিক থেকে জলের তোড় অনবরত গ্রামের দিকে ছুটে আসতেই থাকল। ফলে বাঁধের উপর চাপ পড়তে থাকল তীব্র। একদিন রাতে জলের চাপে বাঁধ গেল ভেঙে। হুহু করে বন্যার জল ঢুকে পড়ল গ্রামের ভিতর। গ্রামের যে সমস্ত বাড়ি নিচু দিকে ছিল, সেগুলো বন্যার জল ঢুকে গেল তাড়াতাড়ি। তারা তাদের ধান, চাল, গোরু, ছাগল নিয়ে আশ্রয় নিল গ্রামের উঁচু জায়গায়। কিন্তু বন্যার তোড় কিছুতেই কমল না। বন্যার জল বেড়েই চলল। ফলে একের পর এক বাড়িঘর সব ডুবতে থাকল বন্যার জলে। শেষে কোন বাড়িটা উঁচু আর কোন বাড়িটা নীচু থাকলনা। ধীরে ধীরে সব বাড়িঘর বন্যার জলের তলায় ডুবতে থাকল। নশিপুর ঘাট থেকে রাজসাহীর পাড় পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে শুধু জল আর জল। যেন এক বিশাল সমুদ্র। এই সমুদ্রের মাঝে বাড়িঘর দূর থেকে এক একটা ছোট্ট ছোট্ট পাখীর বাসার মতো মনে হতে লাগল। মানুষ চেপে বসল বাড়ি ঘরের চালের উপর। এক বাড়ি থেকে আর এক বাড়ি যাওয়ার কোনও কাঁচা রাস্তা জেগে নেই। এক বাড়ি থেকে আর এক বাড়ি যেতে হলে নৌকায় চেপে যেতে হবে। গ্রামের প্রত্যেক বাড়ি এক কোমর বা এক বুক জলের নিচে চলে গেছে। গ্রামের যে অংশে মাটি উঁচু করে রাখা ছিল সেখানেও জল পৌঁছে গেছে। এখন আর সামান্য জল বাড়লে সেটাও জলের তলায় চলে যাবে। কিন্তু সেখানে তো আর বেশি লোক ধরবেনা। বন্যা শুরুর দিকে যারা উঁচু জায়গায় চলে গিয়েছিল, তারাই মোটামুটি দখল করে আছে জায়গাটি। ফলে অন্যান্যদের সেখানে আর জায়গা হচ্ছেনা। বসির আলি কিছু লোকজন নিয়ে মাটি তুলে থান উঁচু করেছিল। কিন্তু নদীর ধারে হওয়ায় মাটি কেটে কেটে থানও জলের তলায় চলে গেছে। ফলে থান থেকে সবাই চলে গেছে আপন আপন বাড়ি। বসিরও রাতে চলে এসেছে রূপসীর কাছে। সে বাঁশ কেটে বাড়ির মাঝখানে চৌকিটাকে উঁচু করে বেঁধে নিয়েছে সে। সেখানেই তারা রাত কাটায়। দিনের বেলায় থানের আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়। কাঠ, খড় যাতে ভেসে না চলে যায় তা দেখাশোনা করে। বাঁশের খুঁটি ভেঙে চালা বসে গেছে। বসির চালার উপরে একটা বাঁশে থানের চাঁদ তারা পতাকা বেঁধে খাড়া করে দিয়েছে। যাতে সবাই জানতে পারে এখানে থান আছে। গ্রামের অন্যান্য বাড়ির লোকও বাঁশ দিয়ে চৌকিকে মাচার মতো করে উঁচু করে বেঁধে নিয়েছে। মাচা থেকে ছিপ ফেলে জলে। বন্যার জল। নানারকমের মাছ ঘুরে বেড়ায়। ছিপ ফেলে তারা দু একটি মাছ পায়। বেশির ভাগ ট্যাংরা আর পুঁটি মাছ। দু একটি ছোট রুইও ছিপ খায়। কিন্তু তাদের ধরা যায়না। তবে দু একটা যে একেবারে উঠে না, তা নয়। যাদের বাঁশ বা চৌকি নেই তারা আশ্রয় নিয়েছে বাড়ির চালের উপর। কেউ বা নৌকার উপরেই ঘর বেঁধেছে। একটা ফাঁকা জাগায় নৌকাকে লগি দিয়ে বেঁধে রেখে নৌকার উপর ছোট করে চাল তুলে নিয়েছে। দূর থেকে দেখে মনে হয় একটা চালের বাড়ি নদীর জলের উপর ভেসে আছে। শুধু সফর আলি আর মহীরুদ্দীর বাড়ির ভিটে অনেকটা উঁচু। সেখানেও কেউ কেউ উঠে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। সেখানে এখনও জল উঠেনি। তবে যেভাবে জল বাড়ছে, তাতে মনে হয় আর কয়েকদিনের মধ্যে সেখানেও জল উঠে পড়বে। আগাম সতর্কবার্তা হিসেবে সফর আলি বাড়ির চারিধারে উঁচু করে মাটি তুলিয়ে নিয়েছে। যারা এসে আশ্রয় নিয়েছিল, তারাই মোটামুটি উদ্যোগ নিয়ে মাটি তুলে দিয়েছে। জল যখন জোর কদমে বাড়ছিল, তখনই রূপসী বসিরকে বলেছিল সফরের ওখানে উঠে যেতে। বসির রাজি হয়নি। বলেছিল, “আমার নিজের ভিটেতে পড়ে থেকে ডুবে যেতে রাজি আছি। কিন্তু সফর আলির ওখানে যাবনা।” বসিরের কথা শুনে রূপসী আর যাবার জন্য জোর করেনি।
বন্যার সাথে আর এক বিপদ এসে ভিড়েছে বৃষ্টি। পর পর পাঁচদিন একনাগাড়ে বন্যা বাড়ার পর সে কিছুটা স্থির হল। কিন্তু আকাশ ভেঙে নামল বৃষ্টি। শ্রাবণের বৃষ্টি। এ বৃষ্টি ছাড়ার নাম নেই। গ্রামের বয়স্ক মানুষেরা বলাবলি করল সাত দিনের আগে এ বৃষ্টি ছাড়বে বলে মনে হচ্ছেনা।
শ্রাবণের বৃষ্টি। অঝোর ধারায় বৃষ্টি। এ শুধু বৃষ্টি নয়, একেবারে বন্যার জলের উপর থেকে আকাশ পর্যন্ত অনন্ত ধারায় বৃষ্টির জলের ধারা নদীর ধারার মতোই বহমান। তার সাথে শুরু হয়েছে বাতাস। বৃষ্টি যত বাড়ছে, তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বাতাস, দমকা বাতাস। বৃষ্টি আর বাতাসের মধ্যে যেন প্রতিযোগিতা চলছে। তাদের প্রতিযোগিতার আন্দোলনে কাঁপছে আশেপাশের অর্ধেক জলে ডুবে থাকা গাছপালা। কাঁপছে আশেপাশের বাড়িঘর। আর বাতাসের বেগের তালে তাল রেখে বন্যার জলে উঠছে সমুদ্রের ঢেউ। অগাধ সমুদ্রের অসীম ঢেউ আশেপাশের ডুবে থাকা বাড়িঘরকে ভেঙে তছনছ করে দিতে চায়। একটার পর একটা ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে ডুবে থাকা বাড়িঘর, গাছপালা, আর জেগে থাকা ডাঙামাটির উপর। তাতে ডাঙ্গামাটি একটু একটু করে কেটে যায়, ভেঙে যায়। তারপর কাটতে কাটতে, ভাঙতে ভাঙতে একসময় জলের নিচে চলে যায়। তখন ডাঙ্গা আর ডাঙ্গা থাকেনা।
•২২•
চারদিন ধরে একনাগাড়ে টানা দূর্যোগে কাঁপছে গোটা চরাচর। আনসার আলি বগলে নৌকার হাল চেপে ধরে লগিতে ঠেলা দিল। গোলাম মিঞার ছেলেটা কাল থেকে অসুস্থ। বমি আর পাতলা পায়খানা। আনাসার আলির দুটো বাড়ির পরেই গোলাম মিঞার বাড়ি। সাতসকালে উঠে মাথল মাথায় দিয়ে গোলাম আনসার আলির কাছে গিয়ে বলল, “নৌকা লিয়্যা আজ সাহায্য করতে হবে আনসার ভাই।”
“ক্যানরে গোলাম। কার কী হল?” মুড়ি খেতে খেতে বলেছিল আনসার।
“কাল থাক্যা ছেলেটার খুব বমি আর পায়খানা। একটু বসির ডাক্তারের কাছে যাতে হবে। জল আর বৃষ্টির যা অবস্থা ছেলে কোলে কর্যা যাওয়া যাবে না। ওকে যদি একটু ডেকে আনা যায়।” আকুতির মতো করে বলেছিল গোলাম মিঞা।
“বাতাসের যা তেজ, নৌকা ঠেলে যেতে পারবরে গোলাম? আর গেলেও কি বসির আসবে?” মুড়ি খেতে খেতে বলেছিল আনসার।
“সে জন্যেই তো তোমার কাছে আসা আনসার ভাই। তুমি বললে নিশ্চয় বসির না করবেনা।” গোলামের কথায় আবার সেই আকুতির স্বর।
“তুই কী করে বুঝলিরে গোলাম? আমি বললেই সফর আসবে কী করে বুঝলি?” আনসার আলি বলেছিল।
“তোমার সাথে সফরের সম্পর্ক খুব ভাল। আমি জানি। তুমি বললে না করবে না।” বলেছিল গোলাম মিঞা।
“এটা তোর ভুল ধারণা গোলাম। সফরকে ডাকলে ও এমনিই চলে আসবে। ও এমনই ছেলে। তবে এই দুর্যোগের সময় আসবে কিনা বলা যাচ্ছেনা।”
তারপর এক গ্লাস জল খেয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, “চল। দেখি। কী হয়!”
বাতাসের তেজ বাড়ছে, কমছে। তার সাথে বৃষ্টির ধারাও বাড়ছে কমছে। মাঝে মাঝে আকাশের এ প্রান্ত ঠেকে ও প্রান্ত আঁকাবাঁকা পথ চিরে আকাশ কখনও দ্বিখণ্ডিত, কখনও ত্রিখণ্ডিত, কখনও বা শতখণ্ডিত হচ্ছে। আনসার আলিও দু পা এগোয় তো এক পা পিছোয় করে বাতাসের বিরুদ্ধে নৌকা ঠেলে চলেছে। বাতাসের বিরুদ্ধে যেন সে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। সে যুদ্ধে তাকে জিততে হবেই। নৌকায় বসে আছে গোলাম। তার মাথায় মাথল। বাতাসে জলের ঝাপটায় সে ভিজে জুবুথুবু হয়ে গেছে। আনসার আলির মাথায়ও মাথল। একটা দড়ি দিয়ে মাথা ও গলার নিচের সাথে বাঁধা আছে যাতে বাতাসে উড়ে চলে না যায়।
তারা বসির আলির বাড়ি পৌঁছল বেলা দশটার দিকে। মাত্র দশ বারো মিনিটের রাস্তা পৌছতে তাদের সময় লেগে গেল প্রায় কুড়ি বাইশ মিনিট। এমনই জল আর বাতাসের ঝাপ্টার তেজ।
বসিরের চেম্বারে পৌঁছে আনসার আলি শুনল বসির বাড়িতে নেই। রোগী দেখতে বেরিয়ে গেছে। আর তার জন্য চেম্বারে অপেক্ষা করছে আরও কয়েকজন রোগী। তারমধ্যে একজনের মাথা দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। মাথাটা একটা কাপড় দিয়ে বাঁধা আছে। বাতাসের তোড়ে ঘরের চালা উড়ে যাওয়ায় একটা বাঁশ প্রচণ্ড জোরে উড়ে এসে পড়েছিল তার মাথায়। তাতেই তার মাথা ফেটে গেছে। তাকে নিয়ে এসেছে দুজন। আরেকজনের পেটে যন্ত্রণা আর বমি। আনসার আলি ও গোলাম মিঞা ঘরের এক কোণে গিয়ে দাঁড়াল। বসার উপায় নেই। গোটা শরীরের সামান্য অংশও শুকনো নেই। সব ভিজে গেছে। পরণের লুঙ্গি দিয়ে চুঁইয়ে পড়ছে বৃষ্টির জল। গোলামেরও একই অবস্থা। সেও জুবুথুবু অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকল। একে ওকে জিজ্ঞাসা করল কখন আসতে পারে ডাক্তার। কেউ সেভাবে কিছু বলতে পারলনা।
সফর আলি এল ঘন্টা খনেক বাদে। একটি নৌকা করে কারা যেন বসিরকে রেখে গেল। নৌকার উপর টোপর তোলা ছিল। তাই বসির ভিজে নি। বসির নৌকা থেকে নেমে প্রথমেই ঢুকল চেম্বারে। আনসার আলিকে দেখে বলল, “কী ব্যাপার আনসার ভাই? কী হল তোমার? এই বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে এসেছ।”
আনসার আলি বলল, “আমার কিছু হয়নি সফর ভাই। গোলামের ছেলেটা খুব অসুস্থ। তোমাকে যেতে হবে একটিবার।”
“সে না হয় যাওয়া যাবে। তোমারা যেভাবে ভিজে জুবুথুবু হয়ে আছ, তোমাদের ঠাণ্ডা লেগে যাবে যে।” বলে সফর ঘরের ভেতর গিয়ে একটা গামছা এনে দিল। বলল, “মাথা মুছে বসো আনসার ভাই। এদের দেখে আমি যাচ্ছি।” এই বলে সফর আলি যে লোকটির বমি আর পেটে যন্ত্রণা হচ্ছিল, তাকে দেখে ওষুধ দিল। তারপর যে লোকটির মাথা ফেটে গিয়েছিল, তার মাথায় ব্যান্ডেজ করে দিয়ে ওষুধ দিয়ে আনসার আলিকে বলল, “বল গোলাম। তোমার ছেলের কী হয়েছে?”
গোলাম তার ছেলের কী হয়েছে সব বলল। সব শুনে সফর আলি বলল, “চল। তোমার ছেলেকে দেখে আসি।” বলে সফর আলি ঘরের ভেতরে গেল। একটি রেনকোট পরে বেরিয়ে এসে বলল, “চল।”
এই সময় বাতাসের ঝাপটা সামান্য কমেছে। আনসার আলি সফর আলিকে নিয়ে নৌকার হাল আবার চেপে ধরল। বাতাসের ঝাপটা কিছুটা কমলেও বৃষ্টির ঝাপটা কিন্তু কমেনি। চারিধারে কালো অন্ধকার করে মুষলধারে বৃষ্টি আকাশ থেকে নেমে আসছে। চারিদিকে শুধুই শোঁ শোঁ শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছেনা। তারমধ্য দিয়েই আনসার আলি শক্ত করে নৌকার হাল ধরে এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে।
গোলামের বাড়ি যখন পৌঁছল সফর আলি, বেলা দুপুর গড়িয়ে গেছে। সফর আলি দেখল বাচ্চার অবস্থা খুব খারাপ। একেবারে নেতিয়ে পড়েছে। ডিহাইড্রেশন হয়ে শরীরে একফোঁটাও জল নেই। সবার আগে ওর শরীরে ওয়ারেশ দরকার। তাড়াতাড়ি একটি ওয়ারেশের প্যাকেট কেটে দিয়ে সফর আলি বলল, “গোলাম। ছেলেকে নিয়ে আমার ওখানে যেতে হবে। স্যালাইন লাগিয়ে চব্বিশ ঘন্টা ওকে ওয়াচে রাখতে হবে। ছেলের অবস্থা খুব ভালো না।”
সফর আলির কথা শুনে গোলাম ছেলেকে একটি পলিথিনে জড়িয়ে নিয়ে বুকে চেপে ধরে আবার রওনা দিল সফর আলির চেম্বারের উদ্দেশ্যে। আনসার আলি আবার শক্ত করে চেপে ধরল নৌকার হাল। বাতাসের ঝাপটা একইরকম। বৃষ্টির তেজও কমেনি। চারিদিকে সমুদ্রের জল। সেই অগাধ আর অসীম সমুদ্রের মাঝে একটা ছোট্ট তরী জলের ঢেউয়ের মাথায় উঠে আবার নিমেষে নেমে যায় নিচের দিকে। এই করে করে একসময় নৌকা এসে ভিড়ল সফর আলির চেম্বারের দোরগোড়ায়।
ছয় দিনের দিন সকালের দিকে জলে দম ধরল। দুপুরের দিক থেকে জল ভাটার টানের মতো নিচের দিকে নামতে শুরু করল। সন্ধ্যার দিকে গ্রামের অধিকাংশ বাড়ি জেগে উঠল। বন্যার জল যেভাবে বাড়তে বাড়তে গোটা গ্রাম, মাঠঘাট ডুবিয়ে দিয়েছিল, তারচেয়ে বেশি গতিতে সবকে জাগিয়ে দিয়ে জল নেমে গেল।
এটাই নিয়ম। পদ্মার বন্যার এটাই নিয়ম। যখন সে আসে, চারিদিক ডোবাতে ডোবাতে আসে। দেখতে দেখতে চারিদক বন্যার জলে ডুবিয়ে দেয়। তখন তার কোনও মায়াদয়া বোঝা যায়না। দেখাও যায়না। আবার যখন সে নামতে শুরু করে, মুহুর্তের মধ্যে নেমে যায়। শুধু চারিদিকে রেখে যায় তার ধ্বংসের নানা স্তূপ। এবারেও জল নেমে যাওয়ার পর একে একে ধ্বংস স্তূপেরা তাদের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এল। কারও বাড়ির দেয়াল ধসে পড়েছে। কারও বাড়ির দেয়াল ধসে মাটির সাথে বিলীন হয়ে গেছে। ঘরের চালাও গেছে ভেসে।
পরের সকালে গ্রামের মানুষ উঠে দেখল বন্যা সমস্ত গ্রাম, বাড়িঘর, মাঠঘাট ছেড়ে পদ্মায় এসে মিলিত হয়েছে। সমস্ত মাঠ জুড়ে থিক থিকে কাদা। আর ডোবা মতো জায়গায় জায়গায় জল জমে আছে। নালা গুলোতেও জমে আছে বন্যার জল। এখন মাছের মরসুম। নালাগুলোতে রুই, কাতলা, গড়াই, চ্যাং, পুঁটি, মাগুর, ট্যাংরা মাছে ভর্তি হয়ে আছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই গ্রমের চাষীরা জাল নিয়ে নামবে নালার জলে।
ক্রমশ…
♦—♦♦—♦♦—♦♦—♦
পূর্ববর্তী পর্ব পড়ুন : চর >।পর্ব ১০।
❤ Support Us