Advertisement
  • ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
  • সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২৩

চর >।পর্ব ১২।

সাইদুর রহমান
চর >।পর্ব ১২।

ধা রা বা হি ক · উ প ন্যা স

 

•২৩•

সে রাতে ঝগড়া করে বসির চলে যাবার পর রপসী ভেবেছিল বসির এবার এসে তাকে তালাক বা ডিভোর্স দিয়ে যাবে। কিন্তু পর পর তিন চারদিন চলে গেল, বসির ঘরে এলনা। কাউকে দিয়ে কোনও খোঁজ খবরও নিলনা। এমিনিতেই এখন বসির খুব কম আসত। কিন্তু এতদিন মাঝে মধ্যে কাউকে না কাউকে দিয়ে খোঁজ খবর নিত। মাঝে মাঝে কিছু টাকা দিয়ে যেত। ইদানিং টাকার চেয়ে বেশি পাঠাত সবজি, ফল, মাংস। তারমধ্যে মুরগীর মাংস বেশি। মাঝে মাঝে খাশির মাংস। এখন নাকি মানত বেশি বেশি করে পড়ছে। মুরগী, খাশি, লাউ, কুমড়ো, পটল – আরও সব নানান জিনিস এখন বেশি বেশি করে মানত আসছে।

 

সফর আলির সাথে শারীরিক সম্পর্ক হবার কয়েকদিন পর এল বন্যা। চারিদিকের মাঠঘাট ডুবিয়ে বন্যা যখন ঘরের দরজায়, সেই সন্ধ্যেবেলায় দুটি ব্যাগে কাপড় চোপড় আর কিছু চাল, ডাল, আলু পটল নিয়ে বসির হাজির হয়েছিল রূপসীর কাছে। রূপসীকে ডেকে বলেছিল, “মনে হচ্ছে বন্যা এবার ভালই ভুগাবেরে রূপসী। জলের গতিক দেখে অন্যরকম লাগছে।”

 

কথাগুলি এমনভাবে বলেছিল বসির যে শুনে মনে হয়েছিল রূপসীর সাথে তার কোনও ঝগড়া হয়নি, কোনও মনোমালিন্য হয়নি। এতদিন সে রপসীর সাথেই ছিল। একইসাথে ঘরসংসার করছিল। এখন বন্যার সময় বন্যার হাত থেকে বাঁচতে কিছু একটা করার জন্য দুজনে যুক্তি করতে বসেছে।

 

বসিরের কথা শুনে রূপসীও আর অন্য কথা তোলেনি। শুধু মুখে বলেছিল, “তাই তো মনে হচ্ছে। ঘরদোর সব ডুবে গেলে কী করা যাবে বুঝে উঠতে পারছিনা। দুজনে না হয় সফর ভাইয়ের ওখানে চলে যাব। সফর ভাইয়ের বাড়িটা বেশ কিছুটা উঁচু। বেশি বন্যা না হলে ডুববেনা।”

 

বসির ব্যাগ দুটো মেঝেতে নামিয়ে রাখতে রাখতে বলেছিল, “সফরের ওখানে যাওয়ার দরকার নাই। আর তোকে ওসব নিয়ে ভাবতে হবে না। দেখ আমি কি করি।”

 

পরের সকালে উঠে দেখেছিল বন্যার জল দুপুরের মধ্যেই বাড়ির ভেতরে ঢুঁকে পড়বে। বসির আর দেরি করেনি। ঘরের ভেতরে পাঁচখানা তক্তা সাজানো ছিল। ইচ্ছে ছিল হাত কিছুটা সরলে মিস্ত্রী ডেকে বড় বড় দুখানা চৌকি বানাবে। কিন্তু এখনও চৌকি বানানো হয়নি। বাঁশ কেটে সেই তক্তাগুলো দিয়ে বসির বাড়ির মাঝখানে মাচা বেঁধেছিল। মাচার উপরে খড় দিয়ে তুলেছিল চালা। পাকা ঘরামির মতোই কাজ করেছিল বসির। তারপর শুরু হয়েছিল বৃষ্টি। নিচে বন্যার জল, আর উপর থেকে বৃষ্টির। এক সপ্তাহের বেশি বসির আর রূপসীর সংসার পেতেছিল সেই তক্তার মাচায়। মাচার একধারে মাটির আখাটা তুলে নিয়েছিল বসির। সেখানেই সকালের দিকে রান্নাবান্না করে নিত দুজনে মিলে।

 

বন্যা এসেছিল গ্রামবাসীদের জীবনে দুঃখের পসরা নিয়ে। কিন্তু, বসির আর রপসীর জীবনে বন্যা এসেছিল দুজনের জীবনের আসন্ন বিচ্ছেদের আগুনকে নিবিয়ে মিলনের সংগীত রচনার জন্য। সারা রাতদিন একই মাচায়, একই বিছানে শুয়ে থাকত দুজনে। দেখে কে বলবে এই কয়েকদিন আগে দুজনের মহাঝামেলা হয়ে গিয়েছিল। রূপসীকে তালাক দিব বলে রাগে গরগর করতে করতে চলে গিয়েছিল বসির! আর রূপসীর প্রতিটি মুহূর্ত কাটছিল নানা চিন্তা আর সংশয়ে। এখন আর সেই চিন্তা নেই, সংশয়ও নেই। বসির রূপসীর গলা জড়িয়ে শুয়ে থাকে আর গল্প করে। ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করে। তার থানের কী করে আরও উন্নতি করা যায়, কী করে আরও বেশি বেশি লোক থানে আসবে – এসব কথা। রূপসীও আর তর্ক করেনা। ঝগড়া করেনা। শুধু চুপ করে বসে থেকে বসিরের কথা শোনে। আর মনে মনে কিছু একটা ভাবে। বসিরকে যেন কিছু একটা সে বলতে চায়। কিন্তু বলতে পারেনা। যেন বলার সময় হয়নি। যেন সে মনে মনে ভাবে আরেকটু সময় যাক। আরও কটা দিন।

 

রূপসী ভেবেছিল বসিরকে ভালোবাসার পরশে বেঁধে নিয়ে একদিন সুযোগ মতো তার গলা ধরে বলবে কথাটা। তাই প্রথম দিকে চুপ করে থেকে বসিরের সব কথা সে শুনতে থাকল। সব আবদার সে পূরণ করতে থাকল। তারপর বন্যা নেমে গেলে মানুষের জীবনে আবার ছন্দ এল। এল আবার কাজের গতি। যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল মানুষ। মাঠের জল নেমে গেছে। পুরো মাঠটাই এবার ডুবে গেছিল জলে। তাই পুরো মাঠ জুড়ে অনেক উঁচু হয়ে পলি পড়েছে। গোটা মাঠে এবার ভালো ফসল হবে। এখন কলাই বোনার সময়। চাষীরা গামছা মাথায় দিয়ে কলাইয়ের বীজ হাড়ি বা গামলাতে নিয়ে সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত খেয়ে না খেয়ে মাঠে পড়ে আছে। জমির কোন অংশটুকু কখন ডাঙ্গা হয়, কখন কোন ডাঙ্গা শুকিয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি বীজ ফেলতে হবে। চাষীদের মাঝে ব্যস্ততার শেষ নেই।

 

বসিরও মাচা ভেঙে আবার নতুন করে ঘর সাজাল। বন্যার জলে বাড়ির পূব দিকের দেয়াল ভেঙ্গে গিয়েছিল। বসির পাটকাটি সংগ্রহ করে টাটি বেঁধে দিল। তারপর থানের দিকে গিয়ে দেখল সেখানেও জল সব নেমে গেছে। কিছু লেবার লাগিয়ে বসির দুদিনে থানকে আবার আগের মতো অবস্থায় নিয়ে চলে এল। বসিরের মনটাও ফুর ফুর করতে শুরু করল। যেন জীবনে তার আর কোনও গোল নেই। জীবন এখন তীব্র গতিতে চলমান। বসির এখন সপ্তাহে দুদিন তিন দিন ঘরে যায়। রূপসীর খোঁজ খবর নেই। রূপসীও বসিরকে বুকে চেপে থাকে।

 

সেদিনও রাত ন’টা সাড়ে ন’টা হবে। বসির ঘরের দরজায় হাজির হয়ে ডাক দিল, “রূপসী দরজা খোল।”

 

রূপসী দরজা খুলে দিল। বসিরের ব্যাগে কে জি খানেকে মুরগীর মাংস, একটা পাকা পেঁপে, একটা কচি লাউ আর একটা ছোট্ট ফুলকপি। চাষিদের প্রথম ফসল। থানে দিয়ে গেছে তারা। রূপসী ব্যাগ হাতে নিয়ে রান্না ঘরের মেঝেতে রেখে এসে একটা মগে করে বসিরকে জল দিল। বসির হাত পা ধুয়ে বসলে রূপসী খেতে দিল বসিরকে। বসির খেয়ে পকেটে রাখা পান চিবোতে চিবোতে বিছানায় গিয়ে বসল। মাস ছয়েক থেকে বসির পান খাওয়া ধরেছে। রূপসী অবশ্য নিষেধ করেছে বার বার। বলেছে, “তুমি পান খাওয়া ছাড়। পান খাওয়া না ছাড়লে আমার মুখে মুখ রাখতে দিবনা।”

 

বসিরও কথা দেয়, “এটাই শেষ পান খাওয়ারে রূপসী। আর কোনোদিন খাবোনা।”

 

কিন্তু তার পরেও সে পান খায়। পান খাওয়াটা তার নেশাতে চলে গেছে। রূপসীও আর বিশেষ কিছু একটা বলেনা। ভাবে পুরুষ মানুষের একটা কিছু নেশাতো থাকেই। আর যাইহোক, বিড়িটিড়িতো খায়না।

 

বসির বিছানায় গিয়ে বসলে রূপসীও আসতে আসতে বিছানায় গিয়ে বসল। বসির আজ রূপসীর মধ্যে প্রথম থেকেই একটা আলাদা অদ্ভুত কিছু আচরণ লক্ষ্য করছিল। সে আজ কথা কম বলছে, হাঁটছে আসতে আসতে। সবসময় যেন একটা সাবধানতা অবলম্বন করছে সে। রূপসী বিছানায় গিয়ে বসলে বসির তাকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে বলল, “কী ব্যাপাররে রূপসী! আজ তোকে যেন অন্যরকম মনে হচ্ছে। কিছু হয়েছে নাকি তোর!”

 

রূপসী একটুও সময় না নিয়ে হাসিমুখে বলল, “হ্যাঁ গো! তোমার জন্য সুখবর আছে। মনে হচ্ছে আমি তোমার ছেলের মা হতে চলেছি!”

 

রপসীর কথা বসির পরিষ্কারভাবে শুনতে পেল। তবু তার মনে হল যেন সে কিছু ভুল শুনেছে। নিজের কানকে সে বিশ্বাস করতে পারলনা। তাই আবার সে জিজ্ঞাসা করল, “কী বললি রূপসী? আমি তোর কথা বুঝতে পারলুনা।”

 

এবার রূপসী আসতে আসতে বলল, “গত মাসেও পিরিয়ড হয়নি! এমাসেও হয়নি! মনে হচ্ছে আমি মা হতে চলেছি।”

 

চমকে উঠল বসির। কে যেন তাকে হঠাৎ কয়েক হাজার ভোল্টেজ কারেন্টের শক দিয়েছে। দুহাতে বল ছুঁড়ে ফেলার মতো করে বিছানার একধারে রূপসীকে ছুঁড়ে ফেলে লাফিয়ে উঠে বসল সে। সামান্য চাপা গলায় গলার ভয়েসটা মোটা করে জিজ্ঞাসা করল, “তুই মা হতে চলেছিস? কার সন্তানের মা?”

 

“কার মানে? তোমার সন্তানের মা!” রূপসী চাপা গলায় বলল।

 

কঠিনভাবে অস্বীকার করল বসির। বলল, “না। হতে পারেনা। আমি তোর সন্তানের বাবা হতে পারিনা। তোর পেটের সন্তান আমার হতে পারেনা!”

 

“কেন? কেন হতে পারেনা?” খুব চাপা গলায় বলল রূপসী।

 

বসিরের কন্ঠ আর চাপা নেই। সে জোরে জোরে বলল, “ভালোভাবে আমি জানি, কোনোদিনও আমি সন্তানের বাবা হতে পারবনা। তুই নিজেও সেটা জানিস!”

 

রূপসী এবার সামান্য গলা তুলে বলল, “তাহলে এতোদিন তুমি মিথ্যা বলতে সেটা তুমি স্বীকার করছো!”

 

বসির জোরে জোরে বলতে শুরু করল, “কি সত্য বলেছি আর কি মিথ্যে বলেছি সে সব কথা আমি জানিনা। জানতেও চাইনা। আমি শুধু জানতে চাই তোর পেটের সন্তানের বাবা কে?”

 

রপসী ধীরে ধীরে বলল, “তুমি! তুমিই আমার সন্তানের বাবা! তুমি ছাড়া আর কে হতে যাবে?”

 

আবারও বসির জোরে জোরে অস্বীকার করল, “না। আমি তোর সন্তানের বাবা নই। তুই সত্য করে বল তোর সন্তানের বাবা কে? কার সাথে তুই প্যাট বাধিয়েছিস?”

 

রূপসী আবারও জোর দিয়ে বলল, “বললাম তো তুমিই আমার সন্তানের বাবা।”

 

এবার হঠাৎ করেই বসির রূপসীর গলা চেপে ধরে বলল, “আমি মাঝে একদিন শহরে গিয়ে সব পরীক্ষা করে এসেছি। ডাক্তারে বলেছে আমি কোনোদিনই বাবা হতে পারব না। আর তুই আমাকে ফাঁকি দিচ্ছিস হারামজাদী! তোকে আজ আমি খুন করেই ফেলব।”

 

রূপসী প্রতিরোধ না করে বলতে শুরু করল, “দে। আমাকে শেষ করে দে। রোজ রোজ আগুনে না পুড়ে তোর হাতে আমার মরণই ভালো।”

 

এবার বসির এক হাত দিয়ে রূপসীর চুলের মুঠি জোরে জোরে টেনে ধরল, “হ্যাঁ রি খানকী মাগি! তোকে আমি মেরেই ফেলব। তার আগে তুই বল তোর পেটের বাচ্চা কার?”

 

বসিরের চিৎকার চেঁচামেচিতে গ্রামের আশপাশ থেকে একটা একটা করে লোকজন আসতে শুরু করেছিল। তাদের মধ্যে আনসারও ছিল। আনসার দেখল বসির তার এক হাত দিয়ে রূপসীর গলা আর এক হাত দিয়ে তার চুলের ঝুটি টেনে আছে। যন্ত্রণা পাচ্ছে রূপসী। ছটফট করতে করতে সেও বাঁচার জন্য তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলছে। কিন্তু পারছেনা। দ্রুত ছুটে গেল আনসার। একটান দিয়ে বসিরের হাত ছুটিয়ে দিয়ে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিয়ে বলল, “ছি বসির! মেয়ে মানুষের উপর এভাবে হাত তুলতে হয়!”

 

বসির নিজেকে সরিয়ে নিতে নিতে বলল, “ছেড়ে দাও আনসার ভাই। আমাকে ছেড়ে দাও। শালীকে আজ খুন করে ছাড়ব। শালী আমার সাথে চালাকী করছে।”

 

আনসার বসিরকে আরও দূরে ঠেলে ফেলতে ফেলতে বলল, “আবার মুখ খারাপ করছিস! তোর কিছু বলার থাকলে গাঁয়ে মানুষ আছে। তাদের ডেকে বল তোর কী সমস্যা। তাবলে তুই এভাবে একটি মেয়েকে মারতে পারিস না।”

 

“তুমি চুপ কর আনসার ভাই। শালীকে আজ আমি খুন করবই।” বসির আবার চেঁচিয়ে উঠে লাফিয়ে আসার চেষ্টা করে।

 

আনসার ওকে ধরে আবার দূরে সরিয়ে দিয়ে বলল, “তুই এখন থানে যা বসির। সেখানে বসে মাথা ঠাণ্ডা কর। এখন তুই রেগে আছিস। কী বলতে কী বলছিস বুঝতে পারছিস না।”

 

এবার বসির একলাফে ঘরে ঢুকল। একটা ব্যাগ হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসল। তারপর চিৎকার করে জোরে জোরে হাঁটতে হাঁটতে বলতে থাকল, “শালীকে এবার এসে তালাক দিব। শালীকে নিয়ে আর আমার ঘর সংসার করা হবেনা।”

 

উপস্থিত সকলের মাঝে একটা চাপা গুঞ্জন শোনা গেল। সবার মুখে একটা ভেসে আসল রূপসী পোয়াতি। কিন্তু কার ছেলের মা বসির জানেনা। কেউ কেউ আবার একটু বাড়িয়ে বলতে শুরু করল, রূপসী ধরা পড়েছে। কার সাথে হাতে নাতে ধরে ফেলেছে বসির। তাই বসির তাকে তালাক দিয়েছে। আনসার অনেকের কথার বিরোধীতা করার চেষ্টা করল। কিন্তু কে শোনে কার কথা। দূর্যোগের রাতের ঝড়ের মতোই কথাটা ছড়িয়ে পড়ল রূপসীর পেটে অবৈধ সন্তান। বসির রূপসীকে তালাক দিয়েছে।

 

•২৪•

রাত দশটার কাছাকাছি। বিছানায় উঠে বসল সফর আলি। মাস খানেক থেকে টানা খাটুনি চলছে। শরীর ক্লান্ত হয়ে উঠেছিল সফর আলির। তার ইচ্ছে করছিল কয়েকদিন টানা বিশ্রাম নেওয়ার। কিন্তু সুযোগ হচ্ছিল না। বন্যা নেমে যাওয়ার পর চারিদিকে নানা ধরনের অসুখ বেড়েই যাচ্ছিল। কার পেটে ব্যথা তো কার জ্বর, কার বমি-পায়খানা তো কার সর্দি -কাশি। কাজের ব্যস্ততায় বেশ কিছুদিন রূপসীর খবর নেওয়া হয়নি। রূপসীও এদিকে আসেনি। বন্যার সময় একবার দেখা হয়েছিল। সফর আলি নিজেই নৌকা চেপে প্রত্যেক বাড়ি বাড়ি খবর নিতে বেরিয়েছিল মানুষের। কারও বাড়িতে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে কিনা। কেউ না খেয়ে পড়ে আছে কিনা। এই সময় সফর আলিকে সঙ্গ দিয়েছিল পরাণ। পরাণই নৌকা চালিয়ে চালিয়ে এবাড়ি ওবাড়ি নিয়ে গিয়েছিল সফর আলিকে। সেই সময়েই রূপসীর সাথে তার দেখা হয়েছিল। রূপসীর সাথে বেশি কথা হয়নি। শুধু দূর থেকে সফর আলি জানতে পেরেছিল ভালো আছে ওরা। কারও কোনও সমস্যা নেই। আর দেখে এসেছিল একই তক্তার মাচার উপর বসির আর রূপসীর সুখের সংসার। খুব ভালো লাগলেও বুকের ভেতরটা কেমন ধড়াস করে উঠেছিল সফর আলির।

 

কিন্তু আজ সকাল থেকেই একটা কথা বার বার কানে এসেছে সফর আলির। রূপসী গর্ভবতী। কিন্তু তার গর্ভের সন্তানের বাবা কে তা  বসির নিজেই জানেনা। কারও কোনও কথার উত্তর দেয়নি সফর আলি। আসলে কী উত্তর হতে পারে জানা ছিলনা সফর আলির। সে কি সেদিনের সামান্য ভুলের ফসল! যদি তাই হয়, তাহলে সে কী করবে! সে কি অস্বীকার করবে! তারপক্ষে কি অস্বীকার করা সম্ভব হবে! যদি তা সম্ভব না হয়! তারচেয়ে বড় কথা রূপসী কী ভাবছে? সে কী করে মুখ দেখাবে এই সমাজে? তাছাড়া এ তো আর বড় কোনও শহর নয় যে কেউ কারও কোনও খবর রাখবেনা! এখানে প্রত্যেকে প্রত্যেকের খবর রাখে। একদিন না একদিন আসল ঘটনা বের হবেই। আজ দুপুরের দিকে রূপসীর সাথে দেখা করার জন্য ওর বাড়ির দিকে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল সফর আলি। যেতে যেতেও যেতে পারেনি। কিছুদূর গিয়েও ফিরে এসেছিল। আসলে কীভাবে রূপসীর সামনে দাঁড়াবে বুঝতে পারছিল না সে।

 

বহুদূর দিগন্তের ওপার থেকে একটা চাপা আর্তনাদ ভেসে আসছে। সেই আর্তনাদ ধীরে ধীরে আশেপাশের খাল, বিল, নদী, নালা, ঘর, বাড়ি সব ভাসিয়ে আছড়ে পড়ছে। আচমকা তার গা ছম ছম করে উঠল। লক্ষ্য করল তার শরীরের প্রতিটি লোম খাড়া হয়ে গেছে

 

বিছানা থেকে নেমে এল সফর আলি। মনের ভেতরে ঝড় চলছে। তারমনে হল রূপসীর কাছ থেকে একবার ঘুরে এলে হয়। কী জানি সে করছে! লজ্জা রক্ষা করতে অন্যকিছু করে ফেলছে নাতো! কথাটা ভাবতেই তার গা শিউরে উঠল। দ্রুত ঘরে থেকে বেরিয়ে এল। চটিটা পায়ে গলিয়ে নিয়ে আনমনে রূপসীর ঘরের দিকে হেঁটে গেল সে। কিছুদূর গিয়ে রূপসীর বাড়ির কাছাকাছি গিয়ে দূর থেকে তাকিয়ে থাকল সফর আলি। দেখল চারিদিকের গাঢ অন্ধকারের মাঝে নিশ্চুপে দাঁড়িয়ে আছে রূপসীর এক চিলতে ঘর। আর এগোলনা সফর আলি। তার ভয় হল। তার মনে হল শান্ত স্থির এই ধরণির বুকে নিঃশব্দে, নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রূপসীর ঘর। থাকনা। কী দরকার এই শান্ত স্থির এই সময়ে কাউকে অস্থির করে তোলার। সে আবার ঘরের দিকে ফিরে এল। তার ইচ্ছে হল একবার পদ্মার পাড়ে বসতে। কিন্তু সেদিকে সে পা বাড়াল না। ফিরে এসে ঘরে বিছানার উপর উঠে বসল সফর আলি। চেষ্টা করল ঘুমানোর। কিন্তু ঘুম এলোনা চোখে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে সফর আলি এপাশ ওপাশ করতে থাকল। ঠিক এই সময় ঘরে প্রবেশ করল বাইরের একটি আবছা মানবী ছায়া। সফর আলি বিছানার উপর উঠে বসে তাকিয়ে দেখল রূপসী। বিধ্বংসী চেহারা। সারাদিনের অভুক্তি সারা শরীরে স্পষ্ট। চোখে মুখে একরাশ হতাশা। ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আলতোভাবে তাকালো সফর আলির দিকে। সফর আলি জিজ্ঞাসা করল, “রূপসী! এতরাতে!”

 

‘ভয় পাচ্ছ!” সফর আলির দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট বলল রূপসী।

 

সফর আলি সামান্য থেমে বলল, “ভয়! কিসের ভয় পাব রপসী! আমি কোনোকিছুকে ভয় পাইনা।”

 

“তুমি গত রাতের কথা শোননি!” সফর আলির দিকে তাকিয়ে আবার বলল রূপসী।

 

সামান্য থেমে সফর আলি বলল, “শুনিনি বললে ভুল হবে। শুনেছি। তবে সব শুনিনি!”

 

এবারও রূপসী আগের মতোই সফর আলির দিকে তাকিয়ে বলল, “কী শুনেছ সফর ভাই!”

 

সফর আলি বেশি ভূমিকা না করে বলল, “তুই যে অন্তসত্বা কী করে শিওর হলি? তুই কি কিছু টেস্ট করেছিস?”

 

“আমার কিছু টেস্ট করার দরকার নাই। আমি জানি। আমার শরীর বলছে আমি মা হতে চলেছি।” নির্ভাবনায় প্রায় জোর দিয়ে বলল রূপসী।

 

“যদি তাই হয়। তবে এখন কী করবি? শুনেছি বসির তো অস্বীকার করেছে।” রপসীর দিকে তাকিয়ে বলল সফর আলি।

 

“সেজন্যই তোমার কাছে এসেছি আমি। তার আগে বল তুমি আমার বাড়ির দিকে যেতে যেতে আবার ফিরে এলে কেন? খুব ভয় পেয়ে গেছ?” রূপসী বলল।

 

“না। ভয় ঠিক না। তোর ঘরে যেতে যেতে ফিরে এলাম। আসলে এতরাতে তোকে বিরক্ত করতে চাইনি। এমনিতেই তুই খুব চাপে আছিস!” সফর আলি বলল।

 

“তোমার মনে হয় আমার কী করা উচিত? তুমি তো জেনে গেছ বসির মেনে নেয়নি।” বলল রূপসী।

 

“বসির যে স্বীকার করবেনা আমি জানতুম।” সফর আলি বলল।

 

“তুমি কী করে জানতে?” রপসী বলল।

 

“বসির ভালো করে জানে সে বাবা হতে পারবেনা। তোকে না জানিয়েও সে নিজে চুপি চুপি শহরে গিয়ে অনেক কিছু টেস্ট করে এসেছে। ডাক্তার ওকে স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে সে বাবা হতে পারবেনা কোনোদিনই।” সফর আলি চুপি চুপি আসতে আসতে বলল কথাগুলি।

 

রূপসী বলল, “দেখ সফর ভাই। ও যেভাবে কথা বলেছে তাতে তোমাকে ও সন্দেহ করছে। আর একদিন না একদিন আসল ঘটনা সব জেনে যাবে। সেদিন কী হবে? সেদিন তোমার অবস্থা নিয়েই আমি বেশি চিন্তিত।” রপসী চিন্তা করতে করতে বলল কথাগুলি।

 

সফর আলি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর বলল, “আমার তো মনে হচ্ছে তোর অ্যাবর্সন করে নেওয়া ঠিক হবে। এছাড়া তোর অন্য কোনও উপায় আছে বলে তো আমার মনে হচ্ছেনা।”

 

রূপসী সময় না নিয়েই বলল, “না। এটা হয়না। অ্যাবার্সন করার ইচ্ছে থাকলে তো আমি নিজে থেকেই সেকথা বলতাম। কিন্তু আমি তো অ্যাবার্সন করাব না।”

 

সফর আলি বলল, “তাহলে কী করবি?”

 

রূপসী আবার বলল, “দেখ সফর ভাই। আর কেউ না জানুক, তুমি তো জান আমার ছেলে নেওয়ার কত বড় ইচ্ছে। জীবনে যাই ঘটুক না, পেটের সন্তান আমি নষ্ট করব না।”

 

“তুই কী বলতে চাইছিস রূপসী? তুই কি আমার কাছে কিছু পেতে চাইছিস?” সফর আলি বলল।

 

“কিছু পেতে চাইছি মানে? কী পেতে চাইছি আমি?” রূপসী হতবাকের মতো প্রশ্ন করল।

 

“না। মানে এইধর টাকাপয়সা। বা আশ্রয়।” সফর হালকাভাবে বলল।

 

হঠাৎ করেই রূপসীর কেমন পরিবর্তন হয়ে গেল। সফর আলির কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর খুব আসতে করে বলল, “তুমি আমাকে এত ছোট ভাব সফর ভাই। তুমি কী করে ভাবলে আমি তোমার কাছে টাকাপয়সা দাবী করব? আমাকে তুমি এতই নীচ ভাব! না! তোমার কাছে আমি আর কোনোদিন আসব না।” মৃদু অভিমানের মতো করে মুখ করে রূপসী ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়াল।

 

এতক্ষণ সফর আলি চুপ করে বিছানার উপর বসে বসে কথা বলছিল। রূপসী ঘুরে দাঁড়ালে এক লাফে বিছানার নিচে নেমে এল সে। তারপর তাড়াতাড়ি রপসীর হাত ধরে টেনে নিয়ে এসে বিছানায় বসাল। বলল, “আমি জানি তুই কতবড় সমস্যার মধ্যে আছিস। আমি শুধু তোকে পরীক্ষা করার জন্য কথাটি বলেছি রূপসী। আমি তোকে ভালোভাবে জানি। চিনি। আমার চেয়ে তোকে আর কে বেশি চেনে বল!”

 

রূপসী কিছু না বলে চুপ করে থাকল। তার চুপ করে থাকা দেখে সফর আলি আবার বলল, “বসির কোনোমতেই এ ছেলে মেনে নিবে না। তুই যদি এই ছেলের বাবা কে না বলিস, ও তোকে তালাক দিবে। আবার বললেও তোকে তালাক দিবে। তোর সমস্যা আমি বুঝতে পারছি।”

 

রূপসী আবার চুপ করে থাকল। সফর আলি রপসীর হাত চেপে ধরে ছিল। হাত চেপে ধরেই সে বলল, “তুই যদি অভয় দিস তো বলি। আমার মা ইদানিং আমার বিয়ের জন্য বায়না ধরেছে। তুই যদি রাজি থাকিস তোকে আমি বিয়ে করে নিব। তুই আমার কাছে থাকবি। তোকে আমি সমস্ত লজ্জার হাত থেকে বাঁচাব রূপসী। তোর পেটের ছেলে আমার। ও আমার পরিচিতি নিয়েই পৃথিবীর মাটি দেখবে। তুই চিন্তা করিস না।”

 

এবার রূপসী সফর আলির হাত থেকে নিজের হাত হালকা করে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, “না। এটা হতে পারেনা। আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারবনা সফর ভাই। তোমার একটা আলাদা সামাজিক মূল্য আছে। তাকে আমার জন্য কখনই ছোট হতে দিবনা। তবে তুমি ভেবনা। আমার সব দিক ভাবা আছে। আমি একদিন ঠিক রাস্তা বের করে নিব।”

 

সফর আলি বলল, “সে কী রাস্তা রূপসী!”

 

“সেটা তোমার জানার দরকার নাই সফর ভাই। সেটা সম্পূর্ণ আমার।” রূপসী বলল।

 

“সেটা কী এমন হতে পারে রূপসী যে আমি জানতে পারিনা?” সফর আলি কিছুটা দাবীর মতো করে বলল কথাটি।

 

“তুমি জানবে। তবে কিছু করতে পারবেনা। আর হ্যাঁ, তোমার কথা কেউ কোনোদিন জানতে পারবেনা। শুধু আমিই জানতে পারব আমার ছেলের বাবা কে? এ আমার কতবড় পাওনা তুমি বুঝতে পারবেনা। একমাত্র আমি ছাড়া। আমার মাতৃহৃদয় ছাড়া!” রপসী বিছানা থেকে নেমে এল।

 

“রূপসী!” চমকে ওঠার মতো করে বলল সফর আলি।

 

“আমি অনেক দূরে চলে যাব সফর ভাই। অনেক দূর চলে যাব। সেখানে আমাকে কেউ চিনবেনা। কাউকে আমিও চিনতে পারবনা। সেখানে নতুন করে জীবন শুরু করা যাবে। আমি সেখানেই চলে যাব।” রপসী বাইরের দিকে পা বাড়াল।

 

সফর আলি চাপা গলায় বলল, “তুই কি কোনোদিন আমাকে ভালবেসেছিলি রূপসী?”

 

“কেন? একথা জানতে চাইছ কেন সফর ভাই?” রুপসী যেতে যেতে দাঁড়িয়ে পড়ল।

 

“এই এমনি জানতে চাইলাম রপসী! আমার জানার খুব দরকার!” সফর আলি আবার চাপা গলায় বলল।

 

রপসী সামান্য দাঁড়িয়ে বলল, “একথার উত্তর দিতে আমি পারব না সফর ভাই। তুমিই নিজে একদিন এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজ। উত্তর পেয়ে যাবে। আমি আজ চলে গেলাম। হয় তো এটাই শেষ দেখা।”

 

নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল রূপসী।

 

রূপসী বেরিয়ে যাবার পর সফর আলি কিছুক্ষণ চুপ করে বিছানায় বসে থাকল। রূপসী বলে গেল হয়তো এটাই শেষ দেখা। তারমানে কী বলতে চাইল রূপসী! সে কি কোথায় চলে যেতে চায়? গেলে সে কোথায় যেতে পারে? নিজের বলতে রূপসীর এখন কেউ নেই। শুনেছে রূপসীর এক দূর সম্পর্কের দাদা আছে। কিন্তু সেওতো কোনোদিন খোঁজ খবর রাখেনা রূপসীর। যদি সম্পর্ক থাকত, যদি রূপসীর কোথাও যাওয়ার থাকত, তাহলে মাঝে মাঝে সে যেভাবে জ্বালা যন্ত্রণা সহ্য করে – কোনোদিন না কোনোদিন সে তো তার সেই আত্মীয়ের বাড়ি কিছুদিনের জন্য ঘুরতে যেত। কিন্তু সে তো যায়নি।  তাহলে রূপসী কোথায় যেতে পারে। ভাবতে ভাবতে সফর আলির হঠাৎ মনে হল – রূপসী আত্মহত্যা করবে না তো! ভাবতেই তার সারা শরীর শিউরে কাঁটা দিয়ে উঠল। রূপসী কি সেরকম কিছু ইঙ্গিত দিয়ে গেল। হয়তো হতে পারে। সফর আলি ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি। এক লাফে সফর আলি ঘর ছেড়ে দরজার বাইরে বেরিয়ে এল। কিন্তু রূপসীর দেখা সে পেলনা। তার অনেক আগেই রূপসী চলে গেছে। সফর আলি ভাবল রূপসীর বাড়ি থেকে একবার ঘুরে এলে হয়। কিন্তু সে সাহস তার হলনা। দরজার বাইরে বেরিয়ে এসে সে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল আর এদিক তাকিয়ে থাকল।

 

বাইরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সফর আলি সামনের রাস্তায় নেমে গেল। রাস্তার ওপারে কয়েক পা হেঁটে গেলেই পদ্মা। পদ্মা নদী। আপন খেয়ালে বয়ে চলেছে সে। এখান থেকেই তার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ শোনা যাচ্ছে। সফর আলি পদ্মার দিকে হেঁটে গেল। কিন্তু সেখানে বেশিক্ষণ থাকলনা। শুধু এদিক ওদিকে তাকিয়ে থাকল সফর আলি। নদীর ছলাৎ ছলাৎ শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা যাচ্ছেনা। কোনোদিকে কোনও লোকও দেখা যাচ্ছে না। কোনও মানুষের কোনও সাড়াশব্দ নেই।

 

নদীর পাড় বেয়ে সফর আলি কিছুটা এগিয়ে সামান্য বাঁক নিয়ে মাঠের দিকের রাস্তায় নেমে পড়ল সফর আলি। এই রাস্তাটা সামনের দিকে সোজাসুজি এগিয়ে গিয়ে আবার নদীর সাথে মিলিত হবে। সেখান থেকে দু চার পা এগোলেই বসির আলির থান। দূর থেকে থানের আলো দেখা যাচ্ছে। লন্ঠনের আলো। টিম টিম করে জ্বলছে।

 

সফর আলি হাঁটতে হাঁটতে থানের কাছে চলে এল। তাকিয়ে দেখল থানের পাশেই একটি ঘর তোলা হয়েছে। সেই ঘরে একটি চৌকি আছে। ঘরের দরজা এখনও করা হয়নি। ঘরের ভেতরেও টিম টিম করে একটি ছোট্ট বাতি জ্বলছে। তাতে ভেতরের অনেকটাই দেখা যাচ্ছে। সফর আলি দেখল, বিছনায় শুয়ে আছে বসির। তার পায়ের নিচের দিকে একটা মাটির চাতাল উঁচু করে তোলা। সেখানেও শুয়ে আছে একজন। কিন্তু কে সেটা বুঝতে পারলনা সফর আলি। নদীর দিক থেকে হালকা ঠান্ডা হাওয়া আসছিল। থানের পাশ বেয়ে সফর আলি সামনের দিকে আরও একটু এগিয়ে গেল। এখান থেকে একটি রাস্তা নদীর পাড় বেয়ে সোজা টিকলিচরের দিকে চলে গেছে। আরেকটি মাঠের দিকে। সফর আলি মাঠের দিকের রাস্তায় নামল। রাস্তাটা সামনের দিকে কিছুটা গিয়ে একটি নালার কাছে শেষ হয়েছে। নালা পার হবার পর একটি বাঁশের ব্রিজ। ব্রিজ পার হলে সোজা রাস্তা একেবারে আখরিগঞ্জের ঘাটের দিকে চলে গেছে।

 

রাস্তা বেয়ে সফর আলি কিছুটা এগোলেই তার কানে ভেসে এল সেই পরিচিত শব্দ, হিস হিস। হিস হিস।

 

এখন গভীর রাত। রাত হলেই শব্দটা বাড়ে।  হিস হিস হিস হিস। এই শব্দের কুল নেই, কিনারাও নেই। কোথায় তার উৎপত্তি, আর কোথায় তার শেষ – কেউ জানেনা।  শব্দটা শুধু ভেসে ভেসে আসে।

 

সফর আলির মনে হল বহুদূর দিগন্তের ওপার থেকে একটা চাপা আর্তনাদ ভেসে আসছে। সেই আর্তনাদ ধীরে ধীরে আশেপাশের খাল, বিল, নদী, নালা, ঘর, বাড়ি সব ভাসিয়ে আছড়ে পড়ছে। আচমকা তার গা ছম ছম করে উঠল। লক্ষ্য করল তার শরীরের প্রতিটি লোম খাড়া হয়ে গেছে। হাঁটতে হাঁটতে থমকে দাঁড়াল সফর আলি। এভাবে তার গা তো কোনোদিন ছম ছম করে উঠেনি। কথাটা ভাবতেই তার মাথার চুল খাড়া হয়ে উঠল। আশেপাশে তাকাল সফর আলি। কোনোদিকেই কিছু সে দেখতে পেলনা। আকাশের দিকে তাকাল সে। দেখল তারারা যেন ক্লান্ত চোখে তার দিকে চেয়ে আছে। শুধু পেছন দিকে তাকিয়ে দেখল দুটো শেয়াল আনমনে তার পেছন পেছন হেঁটে এসে পাশ বেয়ে অন্যদিকে চলে গেল। সফর আলি হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল রাত বারোটা বেজে চল্লিশ মিনিট। আর দাঁড়ালনা সফর আলি। পেছন ঘুরে জোরে জোরে বাড়ির দিকে রওনা দিল। যত সে হাঁটার গতি বাড়াল, তত চারিদিক থেকে ভেসে আসতে শুরু করল হিস হিস শব্দ। সফর আলির মনে হল প্রতিদিনের হিস হিস শব্দের সাথে আজকের শব্দ যে কিছুটা আলাদা। মনে হচ্ছে কারও কোনও গোপন জিহবা গোপনে গোপনে কিছু একটা চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে আর সেইসাথে নিষ্ঠুর হাসি হাসছে। যেন সফর আলিকে সে উপহাস করছে।

 

দেরি না করে জোরে জোরে সোজা হেঁটে গেল সফর আলি। আর তার সাথে সেই হিস হিস শব্দ।

 

হিস হিস! হিস হিস!

 
ক্রমশ…

♦—♦♦—♦♦—♦♦—♦

 
পূর্ববর্তী পর্ব পড়ুন : চর ।পর্ব ১১।

চর >।পর্ব ১১।


  • Tags:

Read by:

❤ Support Us
Advertisement
homepage block Mainul Hassan and Laxman Seth
Advertisement
homepage block Mainul Hassan and Laxman Seth
Advertisement
শিবভোলার দেশ শিবখোলা স | ফ | র | না | মা

শিবভোলার দেশ শিবখোলা

শিবখোলা পৌঁছলে শিলিগুড়ির অত কাছের কোন জায়গা বলে মনে হয় না।যেন অন্তবিহীন দূরত্ব পেরিয়ে একান্ত রেহাই পাবার পরিসর মিলে গেছে।

সৌরেনি আর তার সৌন্দর্যের সই টিংলিং চূড়া স | ফ | র | না | মা

সৌরেনি আর তার সৌন্দর্যের সই টিংলিং চূড়া

সৌরেনির উঁচু শিখর থেকে এক দিকে কার্শিয়াং আর উত্তরবঙ্গের সমতল দেখা যায়। অন্য প্রান্তে মাথা তুলে থাকে নেপালের শৈলমালা, বিশেষ করে অন্তুদারার পরিচিত চূড়া দেখা যায়।

মিরিক,পাইনের লিরিকাল সুমেন্দু সফরনামা
error: Content is protected !!