- ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
- অক্টোবর ২২, ২০২৩
চর >।পর্ব ১৬।
গ্রামের মানুষের চোখেমুখে আতঙ্ক ফুটে উঠছে। এরমধ্যেই কেউ কেউ ঘরের ভেতর থেকে আসবাব পত্র বের করে দূরে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে রাখছে। তা দেখে পরাণ বলল, “এসব কর্যা কুনু লাভ হবেনা। রাক্ষুসী যখন খাতে শুরু কর্যাছে...তারপর
অলঙ্করণ: দেব সরকার
ধা রা বা হি ক · উ প ন্যা স
•৩১•
আজ খুব সকাল সকাল উঠে পড়ল সফর আলি। পায়ে চটি গলিয়ে নিয়ে ঘর থেকে বের হল সে। পদ্মা কতদূর এগিয়ে এল ! দেখল গতরাতে যেখানে সে বসে ছিল, সেখানে এখন গভীর জল খেলা করছে। পাশের গ্রাম এখন সম্পূর্ণ পদ্মার পেটে চলে গেছে। গাঁয়ের শেষের দিকে বলে এখনও কয়েকদিন থাকবে তাদের বাড়িটা। এখন গ্রামে বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে বলতে পরাণের, আনসার আলির, আরও দু একজনের বাড়ি আর সফর আলির নিজের বাড়ি। আর বাকী আছে রূপসীদের বাড়িটি। পদ্মার ধারে একেবারে খাড়াভাবে দাঁড়িয়ে আছে স্পর্ধায় মাথা তুলে। কিন্তু সবাই জানে এই স্পর্ধা বেশিক্ষণ থাকবেনা। পদ্মার স্পর্ধার কাছে সবাইকে মাথা নোয়াতে হবে। বাকী সব এখন জলের তলায়।
সফর আলি বাড়ি থেকে বেরিয়ে দেখল আনসার আলি বাড়িঘরের আসবাবপত্র গোরুর গাড়ি বোঝাই করে পেছনের মাঠ দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সামনের রাস্তা দিয়ে এখন আর গাড়ি যাবে না। সামনের রাস্তাটা আর নেই। চলে গেছে পদ্মার পেটে। গাড়ি হাঁকাচ্ছে মহিরুদ্দী। সফর আলিকে দেখে আনসার আলি এগিয়ে এল। তারপর সফর আলির হাত চেপে ধরে কেঁদে ফেলল। তারপর চোখের জল মুছে সফর আলিকে বলল, “চলে যাচ্ছি সফর ভাই। আমার জন্য দুয়া কর।”
সফর আলি আনসার আলির হাতে হাত রেখে বলল, “যেতে তো হবেই আনসার ভাই। আজ না হয় কাল, আমাকেও যেতে হবে। তুমি একদিন আগে যাচ্ছ। আমি একদিন হয়তো পরে যাবো। তুমি তো জায়গা ঠিক করে এসেছ। আমি এখনও ঠিক করিনি কোথায় যাবো!”
আনসার আলি বলল, “তুমিও জায়গা ঠিক করে নাও সফর। বলোতো আমি জায়গা ঠিক করতে পারি। তোমাকে জানিয়ে দিব।”
সফর আলি বলল, “না থাক আনসার ভাই। আমি শেষ পর্যন্ত দেখে যাবো। আমিতো তোমার জায়গা চিনি। দরকার হলে আমি তোমার সাথে দেখা করে নিব।”
আনসার আলি এবার সফর আলিকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, “তাহলে এবার চলি ভাই। তোমাকে আমি কোনোদিনও ভুলবোনা।”
সফর আলিও আনসার আলিকে বুকের সাথে জোরে চেপে ধরে বলল, “হ্যাঁ ভাই। এসো। বেঁচে থাকলে আবার দেখা হবে নিশচয়। আর তোমার জন্য দুয়া রইল।”
আনসার আলি আবার চোখের জল মুছে দৌড়তে দৌড়তে গোরুর গাড়ির পেছন ধরল।
আনসার আলি চলে গেলে সফর আলি সামনের দিকে এগিয়ে গেল। আশেপাশে মানুষের চরম ব্যস্ততা। সবাই আপন আপন কাজে ব্যস্ত। কেউ ঘরবাড়ি ভাঙছে। যাদের ঘর নেমে গেছে পদ্মার জলে, তারাও ব্যস্ত। সারারাত ধরে নীল -কালো আকাশের নিচে বসে থেকে এখন আসবাবপত্র বউ ছেলেমেয়ের মাথায় চাপিয়ে রওনা দিয়েছে। কে কোথায় যাবে ঠিক নেই। গ্রামের তো রাস্তা নেই। মাঠের মধ্য দিয়ে সফর আলি হেঁটে যাচ্ছিল। হাঁটতে হাঁটতে কি মনে করে ডান দিকে মোড় নিল সফর আলি। একটুখানি এগিয়েই সামনে রুপসীদের বাড়ি। পদ্মার পাড়ে একা অসহায় দাঁড়িয়ে আছে কারও অপেক্ষায়। সে এলেই পদ্মার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়বে। সফর আলি বাড়িটির পাশে এসে দাঁড়াল। খাঁ খাঁ বাড়ি যেন করুণভাবে তাকিয়ে আছে তার দিকে। বাড়ি বলতে একদিকে মাটির দেয়াল, অন্যদিকে পাটকাটির টাটি। বাড়ির নিচে পদ্মার জল কোলাহল করছে আর হিস হিস করে জিভ কেটে ভেংচি কাটছে। যেন সফর আলিকে বলছে, আর কী দেখতে এসেছিস! আরেকটু সময় দে। এটুকুও দেখতে পাবিনা। সবই তো খেয়ে নিলাম! এখন শুধু তোর বাড়িটি বাকী আছে। খুব শীঘ্রই তোর বাড়ি খেতে আসছি। তুই এখন তোর বাড়ি যা।
সফর আলি আর দাঁড়াল না। একটা নিস্ফল অভিমানে পদ্মার দিকে না তাকিয়ে বাড়ির দিকে মুখ ফেরাল। কয়েক পা এগোতেই দেখল ওদিক থেকে পরাণ হেঁটে আসছে। কাছাকাছি হতেই পরাণ বলল, “তোমার বাড়ি গিয়েছিলাম সফর ভাই। আগামীকাল আমরা চলে যাচ্ছি। আর তো সময় নেই। আজ রাতের মধ্যেই আমার বাড়ি চলে যাবে পদ্মার পেটে।”
“তোমার বাড়ি গেলে আমার বাড়িও যাবে পরাণ। আমার বাড়ি কী আর দূরে আছে!” সফর আলি বলল।
“সে জন্যই তো ঠিক করেছি কাল চলে যাব। আর থেকে কী করব? অনেক কষ্টে ভিটে মাটি তৈরি করেছিলাম। পদ্মা আবার এসে যে নিজের পেটে নিয়ে নিবে কে জানত!” পরাণ বলল।
সফর আলি পরাণের ঘাড়ে হাত দিয়ে কথা বলতে বলতে হাঁটতে থাকল, “সে কি আর আমিও ভেবেছিলাম পরাণ ? ভেবেছিলাম বাপ দাদুর ভিটে মাটি। পদ্মা যতই খেয়ে নিক। এটা তো একসময় বাপ দাদুর ভিটে মাটিই ছিল নাকি! বাপের ভিটের পাশেই তো ঘর তুলেছিলাম। পদ্মা যে আবার খেয়ে নিবে আমি কি জানতাম বল !”
পরাণ কিছু না বলে চুপ করে হাঁটতে থাকল। সফর আলি আবার বলতে শুরু করল, “দেখ আমি ইচ্ছে করলে অনেকদিন আগেই ওপারে বা শহরের মধ্যে ভালো কোনও জায়গায় জায়গা নিতে পারতাম। কিন্তু নিই নি। কেন জান ? এখানে বাস করতে করতে এখানকার মানুষগুলোকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। ওদের ছেড়ে আমি কোনোদিনই যেতে চাইনি। আর ছিল বাপ দাদুর ভিটে মাটির প্রতি একটা দায়বদ্ধতা। তাই যখন পদ্মা আবার জমি ফিরিয়ে দিয়েছিল, তখন আমিই প্রথম এখানে ভিটে গেড়েছিলাম। ভালোবাসার জন্যই এখানে ঘর বাঁধা। সেই ভালোবাসার তারকে ছিন্ন করে আবার চলে যেতে হবে।”
পদ্মা তার মুক্ত ডানা মেলে তার বাড়ির দরজার কাছে এসে ডানা ঝাপটাচ্ছে। উথাল পাথাল করছে তার গভীর গহ্বর। ভেতরে ভেতরে তার জিভ লক লক করতে করতে ঢুকিয়ে দিয়ে বাড়ির একেবারে নিচের দিকে। এখন বাড়ির নিচের মাটিকে কুরে কুরে খাচ্ছে। কিছু পরে গোটা বাড়িটাকেই জিভের একটা বাড়ি মেরে হুস করে পেটের ভেতরে চালান করে দিবে
পরাণ হাঁটতে হাঁটতে চুপ করে কথা শুনছিল। সফর একটু থেমে আবার বলতে লাগল, “তবে কি জান? নদীর ধারে বাস করে নদীর উপর অভিমান করতে নাই। এই নদীই আমাদের মারবে। আবার এই নদীই আমাদের বাঁচাবে।”
সফর আলি চুপ করলে পরাণ বলল, “সে সব ঠিক কথা। কিন্তু এখন তুমি কী ভাবছ সফর ভাই? আমাদের চলে যেতে হবে তো?”
সফর আলি কিছু না বলে পরাণের পাশ দিয়ে হাঁটতে থাকল। পরাণ বলল, “এখন বাড়ি গিয়ে আসবাবপত্র সব দূরে মাঠের দিকে নিয়ে গিয়ে রাতটা কাটিয়ে দিব। তারপর সকালে বেরিয়ে পড়ব আমরা। কাল সন্ধ্যেয় হাওড়া থেকে ট্রেন আমাদের।”
সফর আলি বলল, “যাচ্ছ যাও পরাণ ভাই। সময় পেলে এদিকে এসো একবার। আমি হয়তো যাচ্ছিনা।”
“যাচ্ছনা। এখানে কোথায় থাকবে?” পরাণ কিছুটা উদ্বিগ্নের মতো বলল।
সফর আলি বলল, “দেখি। নাহয় এখানেই থেকে যাব!”
পরাণ বলল, “পাগলের মতো কথা বলছ সফর ভাই। এখানে থাকার মতো জায়গা থাকলে তো থাকবে? গ্রাম, মাঠ, ঘাট কিছুই থাকবে না। সবকিছু গিলে খাবে এই পদ্মা।”
সফর আলি আর কিছু বলল না। বাড়ির কাছে চলে এসেছিল। পরাণ হেঁটে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল। বলে গেল, “ভেবে দেখ সফর ভাই। দরকার হলে আজ আমিও তোমাকে সাহায্য করব আসবাব পত্র টানাটানি করতে।”
সফর আলি দাঁড়িয়ে দেখল সকালে যাবার সময় যে জায়গাটিতে ফাটল দেখা গিয়েছিল, এখন সেটা সম্পূর্ণ নদীর গর্ভে চলে গেছে। তার পাশে আরেকটি ফাটল দেখা দিয়েছে। সফর আলি হিসেব করে দেখল, সন্ধ্যা আসতে আসতে পদ্মা বাড়ির দরজায় হানা দিবে! সে পরাণের উদ্দেশ্যে হাঁক দিয়ে বলল, “তোমার কাজ হয়ে গেলে একবার আমার এদিকে এসো পরাণ ভাই। আমারও বাড়িঘর টানাটনি করতে হবে।”
দুপুর গড়িয়ে বিকেল। বিকেল গড়িয়ে গড়িয়ে সন্ধ্যে। সফর আলি পরাণ আর একজনকে ডেকে নিয়ে বাড়িঘর থেকে সব আসবাব পত্র দূরে মাঠের একধারে রেখে এসেছিল। সন্ধ্যের দিকে সফর আলি পদ্মার পাড়ে এসে দাঁড়াল। দেখল পদ্মা তার মুক্ত ডানা মেলে তার বাড়ির দরজার কাছে এসে ডানা ঝাপটাচ্ছে। উথাল পাথাল করছে তার গভীর গহ্বর। ভেতরে ভেতরে তার জিভ লক লক করতে করতে ঢুকিয়ে দিয়ে বাড়ির একেবারে নিচের দিকে। এখন বাড়ির নিচের মাটিকে কুরে কুরে খাচ্ছে। কিছু পরে গোটা বাড়িটাকেই জিভের একটা বাড়ি মেরে হুস করে পেটের ভেতরে চালান করে দিবে।
তখনও সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসেনি। দিগন্ত থেকে আঁধারেরা সবে পাখা মেলে বেরিয়ে আসছে। একটু পরে ঢেকে ফেলবে গোটা জগৎটাকে। সফর আলি দেখল পদ্মার পাড় এখানে খাড়াভাবে নিচের দিকে নেমে গেছে। সফর আলি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে সেই খাড়া ঢালের দিকে। নিচে পদ্মার জল ফোঁস ফোঁস করছে। সফর আলির মনে হল সে একবার নিচের দিকে নেমে যাবে। পদ্মাকে ছুঁয়ে বলে আসবে, “পদ্মা তোর এত রূপ আছে। জানতাম না !”
সফর আলি শক্ত পাড় খুঁজে সেখান দিয়ে নিচে নামার চেষ্টা করল। এই সময় দূর থেকে চেঁচিয়ে উঠল পরাণ, “সফর ভাই! কী করছ তুমি! এখুনি পাড় ধ্বসে পড়বে। তুমি আর উঠতে পারবেনা।” বলতে বলতে পরাণ দৌড়তে দৌড়তে ছুটে এল। সফর আলির কানে পরাণের কথা গেলনা। সে পাড়ের নিচের দিকে দু ধাপ নেমে পড়ল। আর তখনই ছুটে এসে হাত বাড়িয়ে সফরের ডান হাত জোরে চেপে ধরল পরাণ। কিন্তু পরাণের পায়ের চাপে পাড়ের আলগা মাটি ফস করে সরে গেল। তাতে পরাণ আর সফর আলি একসাথে গড়িয়ে পড়ল একেবারে পাড়ের নিচে। নিচ থেকে পরাণ দেখল তারা যেন একটা বিশাল উঁচু পাহাড়ের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। সামনে অভেদ্য পাহাড়ের ঢাল নিচের দিকে নেমে এসেছে। এই ঢাল বেয়ে কোনোভাবেই উপরে ওঠা যাবেনা।
সফর আলি পদ্মার জল স্পর্শ করতে যাবে, এই সময় পরাণ আবার সফর আলির হাত ধরে জোরে টান মারল। সেই টানে সফর আলি ছিটকে এসে পড়ল পাড়ের ঢালের উপর। পরাণ একটা জোর ধমক দিয়ে বলল, “কী পাগলামি করছ সফর ভাই? এখন আমাদের উপরে উঠতে হবে।”
সফর আলি পরাণকে কিছু বলল না। চুপ করে সফরের হাত ধরে পাড়ের মাটি বেয়ে উপরে উঠে এল।
•৩২•
সকাল হয়ে এসেছে। সূর্য তখনও উঠেনি। পরাণ এসে ডাক দিল, “সফর ভাই। উঠবেনা তুমি?”
মাঠের মধ্যে তিরপলের কুঁড়ে করেছিল সফর আলি। কুঁড়েটি পরাণই করে দিয়েছিল। আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বাড়িঘরের আসবাব পত্র, আর ওষুধের বাক্স প্যাটরা। মাটির মেঝেতে পাশাপাশি মা আর ছেলে। মা বলেছে, “এবার সময় হয়েছে সফর। আর পাগলামি করিস না! এবার ওপারে চল। কোথাও একটা মাথা গোঁজার ব্যবস্থা কর।”
সফর আলি বলেছিল, “ঠিক আছে মা। তুমি আর চিন্তা করনা। সকাল হলে আমি সব ব্যবস্থা করব।”
দুই মা ছেলেতে গল্প করতে করতে মা কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল। সফর আর ডাকেনি। কিন্তু সফর আলির ঘুম আসছিল না। এর মধ্যেই চারিদিক থেকে ভেসে আসতে শুরু করেছে সেই ‘হিস হিস। হিস হিস’ শব্দ। সফর আলি ভালো করে লক্ষ্য করে দেখল, শব্দের মধ্যে একটা পরিবর্তন এসেছে। আগে শুধুই ‘হিস হিস। হিস হিস’ শব্দ হত। এখন ‘হিস হিস। হিস হিস’ শব্দের সাথে যুক্ত হয়েছে ‘খিল খিল। খিল খিল’ শব্দ। কে যেন সারা মাঠ জুড়ে খিল খিল করে হেঁসে বেড়াচ্ছে আর গোটা মাঠ জুড়ে তার লেজের ছড়ি ঘোরাচ্ছে। গভীর রাতের দিকে সফর আলি স্পষ্ট শুনতে পেল সেই গভীর কান্না। মনে হল বহুদূর থেকে সেই কান্নার সুর ভেসে আসছে। সেই কান্না কখনও স্পষ্ট হয়ে কানে বাজছে, আবার কখনও বাতাসের তেজে হারিয়ে যাচ্ছে। শব্দ আবার আসে, আবার যায়। সফর আলির আর ঘুম আসেনা। সে ইচ্ছে করে সেই কান্নার সুর যেখান থেকে ভেসে আসছে, সেখানে সে যাবে। বিছানা ছেড়ে উঠে বসে সে। তারপর অদ্ভুত ভাবে লক্ষ্য করে কান্নার সুর আর এক জায়গায় থেমে নেই। পদ্মার দিকে থেকে, মাঠের চারিদিক থেকে, মনে হল আশেপাশে ফেলে রাখা আসবাব পত্রের ভেতর থেকেও সেই সুর ভেসে আসছে।
আবার বিছানায় শুয়ে পড়েছিল সফর আলি। ঘুম এসেছিল সকালের দিকে। গভীর ঘুম। তার কিছু পরেই পরাণের ডাক এসে ঘুম ভাঙিয়ে দিল তার। পরাণের ডাকে ধসমস করে উঠে বসল সফর আলি। চোখ মুছে তাকাল। পরাণ বলল, “সকাল বেলায় ঘুমটা ভাঙিয়ে দিলাম সফর ভাই। কিন্তুক ঘুম ভাঙাতেই হত। আমরা চলে যাচ্ছি।”
সফর আলি উঠে দাঁড়াল। পরাণের সাথে সাথে হেঁটে গল পরাণের বাসাক্র দিকে। সফর আলি গিয়ে দেখল মালতী, সমীর ঘাড়ে, হাতে ব্যাগ নিয়ে প্রস্তুত হয়ে তাদের অপেক্ষা করছে। সফর আলি কাছে যেতেই মালতী হুহু করে কেঁদে উঠল।
সফর আলি বলল, “কেঁদোনা ভাবি! চলে যাবার সময় কাঁদতে নেই !”
মালতী চুপ করলে পরাণ সফর আলির হাত ধরে হু হু করে কেঁদে উঠল। সফর আলি পরাণকে বুকে টেনে নিয়ে কানে কানে বলল, “পরাণ ভাই। তোমার চোখে জল শোভা পাইনা। এখানে তুমিই ছিলে আমার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বন্ধু। আজ তুমি যখন চলে যাচ্ছ, আমারও কি বুক ফাটছেনা ! কিন্তু কী করব ! তোমাকে যে যেতেই হবে পরাণ ! যাও। মালতীর হাত ধরে বেরিয়ে পড়। এখান থেকে মুম্বাই অনেক দূর! যাও! বেরিয়ে পড়।”
এখন যেখানে পদ্মা তার লেজ আছড়াচ্ছে, সেখানে গ্রাম ছিল, রাস্তা ছিল, জনপদ ছিল। এখন কেউ নেই, কিছু নেই। কে কোথায় চলে গেছে কেউ জানেনা। গ্রাম নেই, গোটা মাঠও এখন জনশূণ্য। আর মাঠ অপেক্ষা করে প্রহর গুনছে কখন তারা পদ্মার পেটে যাবে
পরাণ চোখ মুছে বলল, “আমি চলে যাচ্ছি। জামাইয়ের ফোন নং দিয়ে যাচ্ছি। তুমি ফোন করে খবর নিও। আর কোথায় থাকছ সেই ঠিকানাটা দিও। বেঁচে থাকলে অবশ্যই একবার আসব।”
পরাণেরা বেরিয়ে গেলে সফর আলি পদ্মার দিকে তাকাল। এখান থেকে পদ্মাকে বিশাল চওড়া মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে একটা বিশাল সমুদ্র হঠাৎ করে সকালবেলায় চোখের সামনে জেগে উঠেছে। সফর আলি ধীরে ধীরে পদ্মার পাড়ে গিয়ে দাঁড়াল। রাতের মধ্যে বাড়িটাও চলে গেছে পদ্মার পেটে। গ্রামের আর একটাও বাড়ি দাঁড়িয়ে নেই ! সব চলে গেছে পদ্মার উদরে। পদ্মার পেট যে এত বড়ো কে জানত ! তার পেটের শুরু নেই, শেষও নেই। গোটা গ্রাম, গোটা মাঠ, খেয়েও তার খিদে মিটছেনা। কে বলবে এখন যেখানে পদ্মা তার লেজ আছড়াচ্ছে, সেখানে গ্রাম ছিল, রাস্তা ছিল, জনপদ ছিল। এখন কেউ নেই, কিছু নেই। কে কোথায় চলে গেছে কেউ জানেনা। গ্রাম নেই, গোটা মাঠও এখন জনশূণ্য। আর মাঠ অপেক্ষা করে প্রহর গুনছে কখন তারা পদ্মার পেটে যাবে।
সফর আলি মনে মনে হিসেব করে দেখল কোথায় তাদের বাড়িটা ছিল। সেই সামনে গিয়ে দাঁড়াল সফর আলি। বাড়ি যেখানে ছিল, পদ্মা খিল খিল করে সেখানে ঘুরপাক খাচ্ছে। সফর আলির মনে হল সেখানে যেন বিরাট এক কালোমূর্তি কালোমেয়ে জলকেলি করছে। মাথায় তার ভয়ংকর লম্বা কালো চুলের ঝুটি। কালো মুখের ঝিকঝিকে সাদা দু পাটি দাঁতে কী যে সে চিবিয়ে চলেছে অনবরত। আর খিল খিল করে হেঁসে উঠছে।
সফর আলি একদৃষ্টিতে সেই দৃশ্য দেখতে থাকল। এমন সময় তার কানে ভেসে এল মা ডাকছে। সফর আলি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখল হাত বাড়িয়ে করুণ সুরে ডেকে চলেছে মা, “ফিরে আয় সফর! ফিরে আয়!”
মায়ের ডাকে চেতনা ফিরল সফর আলির। সে পদ্মার দিকে আবার ঘাড় ফেরাল। দেখল কে যেন তাকে হাত নাড়িয়ে বিদায় জানাচ্ছে। হাত তার কালো। কালো হাতে রংবেরঙের চুড়ি। অবিন্যস্ত কালো ঝুটি থেকে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে অগনিত জলের ফোয়ারা।
কখন অজান্তেই সফর আলি জোরে চিৎকার ডেকে উঠল, “ডাইনি! রাক্ষুসী পদ্মা।”
পেছন ফিরল সফর আলি। দেখল তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে পরাণ।
—স•মা•প্ত—
পূর্ববর্তী পর্ব পড়ুন : চর >।পর্ব ১৫।
❤ Support Us