- গ | ল্প রোব-e-বর্ণ
- মার্চ ১০, ২০২৪
একটি অরাজনৈতিক ভয়
অলঙ্করণ: দেব সরকার
গদাই নন্দী আন্তরিকতার সঙ্গেই এবারেই প্রথম উদয়কে বাড়ি গিয়ে নিমন্ত্রণ করে এসেছে। বলেছে,’বাড়ির সব্বাইকে নিয়ে অবশ্যই যাবি উদয়দা।’
মানবিক কারণে উদয়কে যেতেই হবে। শাটারে সকাল সন্ধ্যায় আমরা আড্ডা দিই, সেখানে গদাই থেকে উদয় আমাদের সকলের বন্ধু। চোখের সামনে দেখতে দেখতে গদাইর আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে উঠেছে। কলাগাছ যতই ফুলে ফেঁপে উঠুকনা কেন, গোড়ায় জল জমলে উবুত হয়ে পড়ে যাবে। আবার আঙুলটা সে অর্থে ফুলে ফেঁপে ওঠার সময় কয়েকটি আগাছাও জড়িয়ে যায়। গদাই নন্দী যে ধরনের আয় করে, সেটা আগাছা ছাড়া করা কখনো সম্ভব নয়। আগাছা শব্দটা আমি এবং আমরা বকাইদার কাছ থেকে পেয়েছি। শাটারের আড্ডায় অনেক নতুন নতুন শব্দ বেরিয়ে আসে। ভিড়ের মধ্যে নিজেদের একান্ত মতামত বিনিময়ে শব্দগুলো খুব কাজে লাগে। আগাছা ঠিক সেরকমই একটা শব্দ।
কলোনিগড় বাজারে এখন ঘোঁতন দত্তর ফর্মা চলছে। দলের সব পোষ্টারে রতন দত্তর দাঁত ক্যালানো ছবি থাকবেই। সে ছবি দেখে বকাইদার মন্তব্য, আগাছাটা কেমন দাঁত ক্যালাচ্ছে দেখছিস ! সে থেকে আমরা নিজেদের মধ্যে আগাছা শব্দটা ব্যবহার শুরু করি। গদাই নন্দীর ব্যবসার সঙ্গে এইধরনের কয়েকটি আগাছার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ও কথার টেম্পার শুনলে যে কেউ বুঝতে পারবে। উদয়ের ক্ষেত্রেও টেম্পারটা আমরা শুনেছি। নিকট ভবিষ্যতে গদাই নন্দী উবুত হয়ে পড়ে যাবে কি না, নিজেই সেটা ভালো বলতে পারবে। আমি বলতে পারবনা যেহেতু জ্যোতিষচর্চাটা আমার বিষয় নয়। ঘটনার ঘনঘটায় জটিলতাটা শুরু হয়েছে উদয়ের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে। সেখানে আমরা শাটারের বন্ধুরা সবই জড়িয়ে পড়েছি অযাচিত ভাবে।
প্রথমে বলে নেওয়া ভালো আমরা বন্ধুবান্ধবেরা চোখের ওপর দেখেছি অনেক পরিশ্রম করে গদাই আজ এই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। আবার এটাও ঠিক পরিশ্রম তো অনেকেই করে তাই বলে গদাইর মতো এত টাকাপয়সা কজন করতে পারে। এখানেই গদাই বিষয়ক চার আঙুলের কপালটা আলোচনার জায়গা দখল করে ফেলে। সেটাও বাহ্য হয়ে যায় যখন ওকে আমরা ভয় পেতে শুরু করি। গদাই নন্দীর শুরুটা হয়েছিল ফান্ডের ব্যবসা দিয়ে।
টাকাপয়সা অনেকটা চুলকানির মতো। হাবেভাবে কায়দাকানুনে পোশাকে কেনাকাটায় মদের গ্লাসে বহিঃপ্রকাশ হবেই। গদাই নন্দীর বলা-কওয়াতেও সেটা প্রায়শ ঘটে। শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা করলেও প্রকাশ করতে পারেনা কেউ। বন্ধুবান্ধবরা পারতপক্ষে এড়িয়ে চলে। তার অহঙ্কারে ঘন নোংরাজলে মুখ ডোবায়না কেউ, ছিটকে মগজে ঢুকে যাবার ভয়ে। এইরকম পয়সার চাটাম দেখার অভিজ্ঞতা আমার কিংবা আমাদের বন্ধুদের একেবারে কম নয়। এই পাড়াতেই আমরা সুবোধ দাস নিখিল দাসদের কৈশোরে দেখেছি। ওরা মাসে তিনবার করে বাড়িতে বৈষ্ণব সেবা দিয়ে পাড়ার সব খিদেগুলোকে পাতপেড়ে খাওয়াতেন। সেইসময় ধর্ম, মোক্ষ ও পাড়ার মাতব্বর কে হবেন, তারজন্য পোর্ট কমিশানের মোটা স্যালারি সহ ওভারটাইমে অতিরিক্ত আয়করা চাকরিজীবীদের মধ্যে কে কতবড় ভক্ত, কতজনকে নিরামিষ সেবা করাতে পারল সেই প্রতিযোগিতা দুই তিনদিন ধরে লেগে থাকত। এখন সময় পাল্টেছে। তাঁদের নতুন প্রজন্ম এখন বাড়িতে হরিসেবার নামে খোলকরতাল বাজিয়ে কীর্ত্তন দিয়ে তিনচারদিন ধরে খিদেভোজন করায় না। কীর্ত্তনটা পাল্টে হয়েছে কালীপূজা। একদিনেই অনেকরকম শুভানুধ্যায়ীদের বাড়িতে হাজির করানো যায়। চাহিদা মতো মায়ের নামে আমিষ নিরামিষ মদ মাংস সবরকম আপ্যায়নের সুযোগও সেখানে থাকে।
গদাই নন্দী চার দাদার ছায়ায় কলোনীগড় বাজারে প্রথমে শুরু করেছিল ছোট ছোট পানবিড়ি সিগারেটের কাউন্টারে সাপ্লাইয়ের কাজ। পরিচিতি পেতেই ফুটে বসা ছোট ব্যবসায়ীদের থেকে প্রতিদিন সেভিংস নিয়ে ফান্ডের ব্যবসা শুরু করল। অল্প সুদে বছরে সেইসব ক্ষুদে ব্যবসায়ীদের লোন দিত। অল্প কিছুদিনের পর থেকেই পুরনো ফান্ডের ব্যবসাটাই সুদের ব্যবসায় দাঁড়িয়ে গেল
গদাই নন্দী প্রথম প্রথম এইরকম একটা সুযোগ খুঁজছিল বাড়িতে ঘটা করে কিছু একটা করে এলাকার লোকদের ব্যবসায়ীদের বন্ধুবান্ধবদের খাওয়াবে। এইভাবে পরিচিতদের খাওয়াবার একটা পার্মানেন্ট ইস্যু খুঁজছিল। তাতে খরচটা ভাগেভাগে না হয়ে একবারে হয়ে যাবে। যেটার মধ্যে একটা প্রচার থাকবে। বছর পনেরো আগেই সুযোগটা ঠিক বের করে ফেলেছিল গদাই নন্দী। ঘোঁতন দত্তর বাড়ির বাৎসরিক কালীপূজায় লোকজনের সমাগম দেখে।
শাটারের আড্ডায় ঢুকেই বলেছিল, ‘আগামী মঙ্গলবার বাড়িতে কালীপূজা সন্ধ্যায় চলে যাবি সবাই। আরও বলেছিল, বন্ধুদের জন্য হুইস্কি থাকবে !’ সত্যিকথা এটাই ওইসময়ে এইরকম ফ্রিতে হুইস্কি খাওয়ার নিমন্ত্রণ কখোনই পাওয়া যেত না। প্রায়দিনই চাঁদা তুলে খেতে হত…! সেটাও বেশীরভাগ দিন বাংলামদে গিয়েই পৌঁছাতো। আগামী মঙ্গলবার সরাসরি হুইস্কি খাবার… শাটারে আমাদের সেকি আনন্দ হয়েছিল সেদিন। আড্ডায় সবচাইতে কমকথা বলত পীযূষ। নিমন্ত্রণ পেয়ে গলাটাকে ঝেরে বলল, ‘হঠাৎ তোদের বাড়িতে কালীপূজা! কী ব্যাপার?’ —গদাই এই সুযোগটার জন্যই মনেমনে অপেক্ষা করছিল। পীযূষের প্রশ্ন যতই মৃদু হোক গদাইর উত্তরটা ধেয়ে এসেছিল তীব্র অনুভূতিতে, —’ মা কবে মানত করেছিল, মেজদার অসুখের সময়। ভুলেই গ্যাছিল। গত রবিবার রাতে মেজদার হঠাৎ শরীর খারাপ হওয়ায় মা মেজবৌদিকে বলল, দীলুর নামে মানত করছিলাম মায়েরে পাঁঠা দিমু। অ বৌমা আমি তো ভুইল্যাই গ্যাছি !’
মায়ের মানত দিয়েই কালীপূজাটা বাড়িতে প্রথম শুরু করেছিল গদাই নন্দী। প্রথমবার শাটারে বসেই কাকে কিভাবে সেবা দেওয়া হবে সেই নকশাও তৈরি হয়েছিল। তিনপেটি বাংলামদ , গোটা পনেরো হুইস্কির পাঁইট, বলীর জন্য একটা পনেরো ষোলো কেজির জ্যান্তপাঁঠার লিস্ট হয়েছিল। পুজোর পরের দিন পাঁঠার হিসেব বাদে কোনও হিসাব মেলেনি। আরও আনতে হয়েছিল। মায়ের মূর্তির ধারেকাছে না থেকেও খুব আনন্দ করেছিলাম প্রথমবারের পূজাতে মাল খেয়ে। নেমতন্ন পেয়ে তখনকার বামবোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান আনন্দ বোসও এসেছিল গদাই নন্দীর বাড়ি। পাশের বাড়িতে আলাদা ঘরে বসিয়ে এমন সেবা করিয়েছিল গদাই, কথার ফোয়ারা ছুটিয়ে রাত বারোটা পর্যন্ত গদাইর আনন্দ কাকু বাড়ি ফেরার কথা ভুলেই গিয়েছিল। একরকম জোর করেই রিক্সা ডেকে তুলে দিয়েছিলাম আমরা বন্ধুবান্ধবরা। মায়ের পূজা শুরু করলে তিনবার করতেই হবে। সেভাবেই তিন বছর আমরা বছরের ওই দিনটার জন্য আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতাম শুধুমাত্র ফ্রিতে মদ খাবার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে। নভেম্বর মাস আসার আগেই গদাইকে মনে করাতে থাকতাম মায়ের পূজা উপলক্ষে মদ খাবার আগ্রহে।
চতুর্থ বছরে এসে গদাই নন্দীর নিমন্ত্রণের স্টাইলটা পাল্টে গেল। মায়ের মানতের পূজা পরিবর্তীত হয়ে গেল ভিন্ন ভাষায়। নিমন্ত্রণে বলা শুরু করলো, ‘বাড়ির বাৎসরিক পূজা, ওই দিন সবাই চলে যাবি ! এবারে আরো লোক বাড়বে।’ — দেখতে দেখতে কয়েক বছরের মধ্যেই গদাইর পাকাবাড়ি উঠেছে মায়ের কৃপায়। পরিচিতি অনেক অনেক বেড়েছে। ব্যবসার পরিধিও বেড়েছে। গত কয়েকবছর থেকে কলোনীগড়ের হাতকাটা পল্টু,নাককাটা গনা,চোখকটা ফিঙ্গে খুনে ডাকাত হল্লাবাজ কটাই, সাট্টার প্যাড লেখা ঘুন্না, জুয়ার বোর্ড চালানো ছুঁচো কার্ত্তিক, ব্ল্যাকে মদবেচা নিগ্রো , রাউডি বোমফুচু-দের ভীষণ রকমের খাতিরদারি, অন্যদিকে কলোনীগড়ের ডান-বাম-গেরুয়া-দাদাদের দামি মদ খাওয়াবার আপ্যায়নে আমরা শাটারের বন্ধুরা বসার জায়গা পর্যন্ত পেতাম না। অনেকক্ষণ দাঁড়াবার পর আমাদের ছয়সাতজনকে একটা পাঁইট হাতে ধরিয়ে গদাই বলত, ‘ কোথাও বসে খেতে থাক, লাগলে আরও দেওয়া যাবে।’ —তারপর আর খুঁজে পাওয়া যেতনা গদাইকে। আমরা খুঁজে পেলেও, এইমাত্র সব বোতল শেষ হয়ে গেছে, শুনে শুনে আমরা শাটারের বন্ধুরা বেশ কয়েকবছর নিমন্ত্রণ পেলেও গদাই নন্দীর কালীপূজাতে যাইনা। আসলে যাওয়ার ইচ্ছাটাই নষ্ট হয়ে গেছে আমাদের। উদয় বেচারার ফাটা বাঁশে অণ্ডকোষ আটকে যাওয়ার মতো অবস্থা হওয়াতে বাধ্য হয়ে ঝাপাতে হল। দেখলাম এ গদাই অন্য গদাই সেই গদাই আর নেই।
তার আগে উদয় সম্বন্ধে ছোট্ট করে কয়েকটি কথা বলা খুবই প্রয়োজন। পঞ্চায়েত অফিসের ডি-গ্রুপ কর্মী উদয়। পৈতৃক একটা আধকাচা বাড়িতে মা বাবা বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকে। অনেক চেষ্টা চরিত্তির করে ব্যাঙ্ক থেকে হাউজলোনটা স্যাংশান করিয়েছে। চাকরি করে বলে সরকারের দেওয়া আবাসনের সুযোগ উদয় পায়নি। ফলে হাউজলোন ছাড়া উপায় ছিলনা। প্রথম কিস্তির টাকা ব্যাঙ্কে ঢোকার খবরে উদয় শাটারের আড্ডায় এসে আমাদের একপ্রস্ত চা আর সিগারেট খাইয়েছে। গদাই নন্দীও তার ভাগ পেয়েছে। উদয় বাড়ির ভিত দু’একদিনের মধ্যেই শুরু করবে। আনন্দ এবং ব্যস্ততার মধ্যেই উদয় এখন। আমরা সবাই মিলে একদিন মাল খাওয়াতে হবে বলে দাবি করে রেখেছি। উদয় কথা দিয়েছে ছাদ ঢালাইর দিন সেটা খাওয়াবে। গদাই নন্দী এবারে প্রথম উদয়ের বাড়ি গিয়ে সপরিবার নিমন্ত্রণ করে এসেছে। কথাটা জানতে পেরে আমরা প্রত্যেকে প্রত্যেকের মুখের দিকে শুধু তাকিয়েছিলাম। আমরা যথারীতি শাটারের বন্ধুবান্ধবরা প্রতিবারের মতই গদাই নন্দীর বাড়িতে কালীপূজায় যাইনি। উদয়টাও না গেলেই পারত। উদয়ের বউ ছেলেমেয়ে যায়নি। বাড়ি এসে বলে গেছে ভেবে একা একাই গদাই নন্দীর বাড়িতে গেল। গিয়েই উদয় আষ্টেপৃষ্ঠে এমনভাবে জড়িয়ে পড়ল যে আমরাও জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হলাম। এসব সত্বেও গদাইদের পরিবারের উত্তোরণের লড়াইটা একেবারে ফেলে দেবার মতো নয়। আমরা সেটাও জানি।
গদাইর বাবা সুবলকৃষ্ণ নন্দী। সুবলকাকার মুখেই আমরা শুনেছি পাকিস্তান আমলে নোয়াখালীর পানবরজে পুরো পরিবার নিয়ে মজুরের কাজ করতেন তিনি। একাত্তরের যুদ্ধের সময়ে প্রাণের ভয়ে তেনারা স্বামীস্ত্রী, ছয় ছেলে, তিন মেয়ে সহ পুরো এগারো জনের পরিবার নিয়ে এই ছোট্ট কলোনীগড় শহরটায় পালিয়ে চলে এসেছিল। সূত্র সুবলকৃষ্ণের দাদা রাধাবল্লভ নন্দী। তিনি দেশভাগের পরপরই এই কলোনীগড় শহরে চলে এসে যে সুতোর সেতুর অস্তিত্ব রেখেছিল, সেই নড়বড়ে সেতুটাকে ধরেই শ্রীচরনেষু দাদার সংসারে পুরো ফুটবলের টিম নিয়ে হাজির হয়েছিল সুবলকৃষ্ণ নন্দী একাত্তর সালে। গদাই ছিল পাঁচনম্বর ছেলে। গদাইর পরের জন রতন।
পরিশ্রমী এবং রোজগারমুখীন মানুষ ছিলেন সুবলকৃষ্ণ নন্দী। এই দেশে এসে ছেলেমেয়েদের স্কুলে না পাঠিয়ে রোজগারের ধান্ধা ধরিয়ে দিয়েছিল। যেটুকু টাকাপয়সা সঙ্গে এনেছিল দাদার সংসারে থেকেই নিজের জানা পানের ব্যবসা শুরু করেছিলেন। বড় চারছেলেকে দশগোজ করে পান নতুন কেনা ঝুড়িতে সাজিয়ে আশেপাশের তিন চার কিলোমিটার দূরের সপ্তাহের হাটে হাটে পাঠিয়ে দিতেন। নিজেও স্থানীয় বাজারে একটা জায়গা দেখে পান চুন সুপারি জর্দা নিয়ে ব্যবসায় বসে পড়লেন। এখন গদাইর উপরের চার দাদা কলোনীগড় বাজারে আলাদা আলাদা পান সুপারি জর্দার হোলসেল ব্যবসায়ী। স্থানীয় বাজারে সুবলকৃষ্ণের দখলকরা জায়গায় ছোটছেলে রতনের এখন পার্মানেন্ট দোকান। দাদারা আর ভাই রতন মিলে সিজিনে কয়েক কুইন্টাল সুপারি কিনে মজুত করে অফ সিজিনে চড়াদামে বিক্রি করে সব ভাইরা। গদাই নন্দী চার দাদার ছায়ায় কলোনীগড় বাজারে প্রথমে শুরু করেছিল ছোট ছোট পানবিড়ি সিগারেটের কাউন্টারে সাপ্লাইয়ের কাজ। পরিচিতি পেতেই ফুটে বসা ছোট ব্যবসায়ীদের থেকে প্রতিদিন সেভিংস নিয়ে ফান্ডের ব্যবসা শুরু করল। অল্প সুদে বছরে সেইসব ক্ষুদে ব্যবসায়ীদের লোন দিত। ক্রমে ফান্ডের পরিধি বাড়াতে বাড়াতে গ্রামের চাষি, ছোট ব্যবসায়ীদের ফান্ডের সদস্য করে চড়া সুদে লোন দেওয়া শুরু করল। অল্প কিছুদিনের পর থেকেই পুরনো ফান্ডের ব্যবসাটাই সুদের ব্যবসায় দাঁড়িয়ে গেল। মুখোশ হিসাবে রয়ে গেল ফান্ড। মুখ হল সুদের ব্যবসা। গদাই নন্দীর কাছে বাজারে বাড়িতে শুধু লোন নেওয়া লোকদের যাতায়াত বাড়তে লাগল। তারজন্য প্রতিদিন ওর ক্যাশটাকা চাই। ফান্ডের সংগ্রহ বাদেও বাড়তি সুবিধা খোঁজা লোকদের টাকাও ওর সুদের ব্যবসায় গোপনে খাটতে থাকল। বাজারে সত্যি মিথ্যা অনেক খবর রটল। আমাদের চোখের ওপর গদাই নন্দী মাত্র কয়েক বছরে কয়েকটি ফাঁকা প্লট কিনে ফেলে রাখলো। ক্রমাগত চকমক করা গদাই নন্দীর থেকে আমরা অনেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে বাধ্য হলাম। দেখা সাক্ষাতে মৃদুকথা শাটারের আড্ডায় কালেভদ্রে একসঙ্গে হলে চটুল রসিকতার বাইরের আমাদের সবার সঙ্গেই গদাই নন্দীর আন্তরিকতা একেবারেই শূণ্য হয়ে গেল। উদয়ের কেসটাতে এসেই আবার পচা কাদায় আমরা ফেঁসে গেলাম। সেখানে পুরনো কথা কিছু এসেই যায়। সেটাই হল।
গদাই যেভাবে সুদের ব্যবসাটা পুরো বাজারটা জুড়ে করে সেটা ইচ্ছে করলেই যে কেউ করতে পারবেনা। গদাই সেটা পারে। আমরা প্রথম প্রথম আড্ডার সময় গদাইকে গদাইলস্করি চাল বলে টিপ্পনি কাটতাম। ও যে সেটা আদতে একদমই নয় বরং উল্টোটাই সেটাই প্রতিষ্ঠিত করেছে। গদাই নিজেকে প্রমাণ করেছে খুবই ক্ষীপ্র এবং বুদ্ধিমান হিসেবে। আমার ধারণা সেটা ম্যাচিওর মাথায় পুরো পরিবারটি মাইগ্রেটেড হওয়ার জন্য। একটা সতেজ কিশোরের মাথা নিয়েই এই দেশে এসে যে কোনও ঊপায়ে বেঁচে থাকার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পুরো পরিবার সমেত। সমাজের আস্তাকুঁড় গুলোকে সামনাসামনি দেখার এবং মেলামেশা করার সুযোগ হয়েছিল। বেশীরভাগ আঞ্চলিক রাজনীতিজীবীদের উত্তরণ ওই আস্তাকুঁড় ধরেই। গদাই নন্দীর কাচা টাকার ব্যবসায় প্রতিদিন ফান্ড সংগ্রহ করতে হয় সদস্য ব্যবসায়ীদের থেকে। সেই টাকাটাই লোনে ছেড়ে দিতে হয় নাহলে ফান্ডের ব্যবসা চলবে না। কিছু রগচটা পোলাপানকে পুষতে হয় তাদের নিত্য নতুন আবদার মেটাতে হয়। সেই ফাঁক দিয়েই বকাইদার ভাষায় গদাই নন্দীর ব্যবসায়ে কয়েকটি আগাছাও জড়িয়ে আছে। আগাছাকে অস্বীকার করে সুদের ব্যবসা চালানো একেবারেই অসম্ভব। উদয়ের অণ্ডকোষ আটকানো ঘটনাটা ঘটানোর মূল কারিগর এমনি একজন আগাছা। আগাছা সংস্কৃতি প্রথমে হালকা করে অঙ্কুর মেলে। খেয়ালে না রাখলে পুরো জমিটায় আগাছা শিকড় ঢুকিয়ে একেবারে গভীরে চলে যায়। গদাই নন্দীর ব্যবসার জমির অনেকটা ঘোঁতন দত্তের মতো আগাছার দখলে চলে গেছে। যার জলজ্যান্ত শিকার উদয়। বলা যায় সফট টার্গেট।
উদয় যথারীতি পূজার দিন সন্ধ্যার একটু পরেই গদাইর বাড়িতে পৌঁছে গেছিল। উদ্দেশ্য দেখা দিয়েই চলে আসবে। পৌঁছাতেই গদাই উদয়কে ডেকে বসার ঘরে বসিয়ে হালকা দুটো পেগ ধরিয়ে দিয়েছিল। উদয় খাবে কি খাবেনা ভাবতে ভাবতে দু পেগ শেষ করে তৃতীয় পেগের জন্য গ্লাসটা বাড়িয়ে দিল। নিমন্ত্রিতরা এক এক করে তখন ঢুকছে। সময়ের অনেক আগেই ঘোঁতন দত্ত একজনের মোটরসাইকেলের পেছনে বসে চলে এসেছে। এসে সোজা বসার ঘরে। ঘোঁতন দত্ত মোটরসাইকেলে আসা ছেলেটিকে দেখিয়ে গদাইকে বলল, ‘ওকে লোনটা এক্ষুনি দিতে হবে গদাই। খুব বিপদে পড়েছে ছেলেটা। আমি গ্যারান্টার থাকবো !’—টাকার অঙ্কটা ঘোঁতন দত্ত বললেও উদয় সেটা খেয়াল করেনি। গদাইর উত্তরটা শুধু শুনতে পেল, ‘ এইমুহূর্তে আমার হাতে ক্যাশটাকা নেই ঘোঁতন দা। কাল দুপুরে কালেকশানের পরে ছাড়া হবেনা।’—বলতেই ঘোঁতন দত্ত ধমকে উঠল, ‘কাল দুপুরের পর টাকা ওর কোনো কাজে লাগবে না। যা করার তোকে এক্ষুনি করতে হবে। তোকে তো গত সপ্তাহে বলে রেখেছিলাম!’— ঘোঁতন দত্তের ধমক খেয়ে গদাই নন্দী আমতা আমতা করতে শুরু করলো, ‘এখন কার কাছে এতটাকা আমি পাব !’ —বলতে বলতে উদয়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, তোমার কাছে তো লোনের প্রথম কিস্তির টাকাটা আছে?” উদয় যথারীতি বলে দিল , ‘হ্যাঁ, আজকেই ব্যাঙ্ক থেকে তুলেছি, কাল থেকে মালের দাম পেমেন্ট করব !’
— সকালে না করে সন্ধ্যাবলা পেমেন্ট করো। আমি তোমাকে দুপুরে কালেকশন করে বিকেলে টাকাটা দিয়ে দেব। এখন কত টাকা ক্যাশ আছে তোমার কাছে? গদাই বলেছিল।
— আমি মাত্র পঞ্চাশহাজার টাকা তুলেছি ব্যাঙ্ক থেকে। উদয় বলতে বাধ্য হয়েছিল।
— ওই টাকাটাই আমাকে দাও!
— না না ওই টাকা আমি দিতে পারবনা।
— ‘তুমি টাকাটা দাও , কথা দিলাম কাল সন্ধ্যাবেলা তোমাকে পঞ্চাশের সঙ্গে আরও তিন হাজার টাকা এক্সট্রা দেব।’ গদাই হাবেভাবে একটা চাপ দিল।
উদয় মোটামুটি চারবার গ্লাস খালি করে ফেলেছে কথা বলতে বলতে। ওদের দুজনের কথার মাঝখানে তৃতীয় জন ঢুকে গেল। অনুরোধ করলো ঘোঁতন দত্ত, ‘ কাল সন্ধ্যাবেলা গদাই টাকা না দিলে আমাকে বলবেন আমি আদায় করে দেব। ছেলেটির টাকা খুব দরকার জাস্ট উপকার করবেন।’ এলাকার নামী একজন আগাছা ঘোঁতন দত্ত। উদয়ের সাধ্য হয়নি ওদের দুজনের চাপাচাপি থেকে নিজেকে উদ্ধার করতে। উদয় বাধ্য হয়েছিল সেই ছেলেটির মোটরসাইকেলে বসে বাড়ি থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়ে গিয়ে গদাই নন্দীর হাতে দিতে। তারপর আবার মদ খেয়েছে উদয়। ভোরের দিকে নেশা নাবতেই হেঁটে বাড়ি ফিরেছে।
এর পরের ঘটনা যথারীতি দ্বিতীয় দিন থেকে গদাইর মোবাইলের সুইচ অফ। রাতে বাড়ি গিয়ে দেখা করে টাকা চাইতেই উল্টে দাবড়ি দিয়েছে গদাই। বলেছে, তিন হাজার টাকা কি ফাউ আসে না কি! তুমি টাকা খাটিয়েছ। টাকা খাটুক তারপর পাবে।
— তুইতো আমার কাছে একরাতের কথা বলে টাকা নিলি। আমাকে এক্সট্রা তিনহাজার দিতে হবেনা, ওটা আমি চাই না। ধারের টাকাটাই দে।
— দেব তো ! তোমার তো বাড়ির কাজের টাকা। কাজ শুরু কর লাগলে আরও দেব।
— তুই আমার টাকা ফেরৎ দে।
গদাই পাঁচহাজার টাকা হাতে দিয়ে বলল, ” এটা আপাতত রাখ। দেখছি।”
— না আমি ছিঁড়ে ছিঁড়ে টাকা নেব না। বলে গদাইর বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিল উদয়।
অগত্যা উদয় পরের পরের দিন ঘোঁতন দত্তের বাড়িতে যায়। দেখা করে টাকা আদায়ের কথা বলতেই ঘোঁতন দত্ত বলল, ” তোমাদের নিজেদের লেনদেনের মধ্যে আমি মাথা গলাব না ভাই। নিজেরা মিটিয়ে নাও।” পুরো পাল্টি খেয়ে গেল আগাছা ঘোঁতন দত্ত। তারপর যথারীতি উদয়ের অফিস কামাই। রাগে দুঃখে টাকার শোকে কলোনীগড় বাজারে উদয় বনাম গদাইর কথা কাটাকাটিতে লোক জমে যায়। গদাই এই সুযোগটাই খুঁজছিল। উদয় সেই ট্র্যাপেই পা দিয়ে ফেলেছে। গদাইর নিজস্ব ব্যবসায়ীরা উদয়কে উপযাচক হয়ে সিদ্ধান্ত দিল, ‘ টাকা আপনি গদাইকে সুদে খাটাতে দিয়েছেন তারজন্য অপেক্ষা করতে হবে। টাকা দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে টাকা তুলে নেবেন বললে হবে? টাকাটাতো বাজারে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে !’ উদয় বাধ্য হয় বলতে, — আমি টাকাটাতো বাজারে খাটাতে গদাইকে দিই নি ! বিশেষ অসুবিধায় এক রাতের জন্য আমার থেকে টাকাটা ধার নিয়েছে গদাই। সেই টাকা ফেরত দিতে বলছি। জবাব পেল, একরাতের জন্য পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে তিনহাজার টাকা সুদ চাইছেন কেন !
আগাছা আর পরগাছা জড়িয়ে গদাই নন্দী এখন আমাদের অজান্তেই অনেকের সমীহ আদায় করে নিয়েছে। সুদ নিলেও কিছু সুবিধা ও বিপন্ন মানুষকে দেয়। ওর থেকে যেকোনো সময় টাকাপয়সা ধারে পাওয়া যায়। ফলে বিপক্ষে কথা বলে নিজের আখেরটা নষ্ট করতে কেউ চাইছে না
— আমি সুদ নিতে ওকে টাকা দিইনি। গদাই মিথ্যে কথা প্রচার করছে। — উদয় ব্যবসায়ীদের আসল সত্যটা বিশ্বাস করাতে চেষ্টা করে। পাশ থেকে আর একজন গদাই ভক্তের টিপ্পনি ভেসে আসে, ‘ এই গদাই অন্য জায়গায় বেশী সুদে টাকা লাগাবার পার্টি পেয়েছে, তাই তোর থেকে টাকা তুলে নিতে চাইছে। সেয়ানা মাল।’ — ঝগড়ার রেশটা কান ঘুরে ঘুরে উদয়ের বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। উদয়ের বাবা মা বউ যেটা শুনেছে সেটা আরও মর্মান্তিক। শুনেছে উদয় লোনের টাকাটা চড়া সুদে বাজারে খাটাতে গিয়ে পুরো টাকাটাই চোট খেয়েছে। উদয় কাউকেই সত্যি কথাটা বোঝাতে পারছে না। গদাই নন্দী এতসব কান্ড ঘটানোর পরও আলাদা ডেকে সেই পাঁচহাজার টাকাই দিতে চেয়েছিল। উদ্দেশ্য একটাই পঞ্চাশহাজার টাকাটা অনেকগুলো ভাগে ভাগে খেয়ালখুশিমতো শোধ করবে। গদাই কখনো ফান্ড ভাঙলেও একবারে সব টাকাটা পার্টিকে দেয়না। ভেঙে ভেঙে দেয়। উদয়ের ক্ষেত্রেও সেটাই উদ্দেশ্য। গদাই নন্দীর এই স্বভাবটা উদয় নিজেও জানে। উদয় সেটা মানবে কেন? গদাইর দেওয়া পাঁচহাজার টাকা ও নেয়নি। একলটে পুরো টাকা নেবার দাবি থেকে একটুও নড়ল না।
এই নিয়ে কয়েকদিন ধরে নিজের ভেতরে টাকা চোট খাওয়ার অশান্তি,পরিবারে ভুল বোঝাবুঝির অশান্তি সব মিলিয়ে উদয় খুবই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে। বউ পরে সবটা বুঝতে পেরে উদয়কে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে। অবশেষে উদয়ের সত্যিকথাটা ওর বউ বিশ্বাস করেছে। আমাদের কয়েকজনকে ডেকে উদয়ের বউ ঘটনাটা বলেছে। তার আগে শাটারের আড্ডায় খবরটা কলোনীগড় বাজারের ক্যাচাল ঘুরে এসেছিল গদাই মারফত। আসল সত্যিটা কী জানিনা বলেই আমরা বন্ধুরা মাথা গলাইনি। এদিকে উদয়ের নতুন বাড়ির কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। পুরনো কাচাঘরটা ভেঙে পুরো পরিবারটা উঠোন জুড়ে অস্থায়ী শিবির বানিয়ে আপাতত আছে। বড়ো ঝড়বৃষ্টি আসলে সমূহ বিপদ। উদয় টাকার শোকে ক্ষিপ্ত। বন্ধুদের দেখলে অহেতুক রেগে যাচ্ছে।
দু ♦ ই
আমরা বন্ধুরা বুঝতে পারছি উদয়কে নিরীহ এবং ভালো মানুষ পেয়েই গদাই নন্দী খেলাটা খেলেছে। টাকাটা দেবেনা বলছে না ভাবে বোঝাচ্ছে ওর মর্জিমতো টাকাটা দেবে। সেই টাকাটা উদয়ের বাড়ি তৈরির কাজে লাগুক বা না লাগুক সেটা গদাই নন্দীর কিছু যায় আসেনা। এটাও ঠিক লেনদেনের সময় যে কথাবার্তা হয়েছিল আমাদের সামনে হয়নি। আমরা বন্ধুরা সরাসরি গদাইকে চেপে ধরতেও পারছিনা। আগাছা আর পরগাছা জড়িয়ে গদাই নন্দী এখন আমাদের অজান্তেই অনেকের সমীহ আদায় করে নিয়েছে। সুদ নিলেও কিছু সুবিধা ও বিপন্ন মানুষকে দেয়। ওর থেকে যেকোনো সময় টাকাপয়সা ধারে পাওয়া যায়। ফলে বিপক্ষে কথা বলে নিজের আখেরটা নষ্ট করতে কেউ চাইছে না। অথচ উদয় আমাদের বন্ধুদের মুখের দিকে তাকিয়ে বসে আছে টাকাটা আদায় করে দেবার জন্য।
ভালো হোক খারাপ হোক উদয়ের কেসটার মিশ্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে বাজারে। অনেকেই আড়ালে অন্যায় বললেও উদয়ের হয়ে কেউ ওকালতি করার জন্য সরাসরি গদাই নন্দীকে কিছু বলছে না। একটা অংশ ঘটনাটা সহ্য করতেও পারছেনা। চাইছে গদাইকে ডেকে জিজ্ঞাসা করতে। তাদের সংখ্যাটা খুবই কম। এসবের মধ্যেই একটা মৃদু প্রতিবাদ অতর্কিতে হয়ে গেল শাটারে। সেটা অনেকটাই মানসিক। গদাই নন্দী বুঝতে পারলেও আমাদের কাছে ধরা দিলনা। এহেন বলিষ্ঠ প্রতিবাদটা সংগঠিত হয়ে গেল নিজে নিজেই।
প্রায় কয়েক বছরই আমরা শাটারের বন্ধুরা গদাইর বাড়ির কালীপূজায় যাইনা। এতবছর আমাদের না যাওয়া নিয়ে কোনও তাপউত্তাপ গদাইর মধ্যে ছিলনা। এত স্থানীয় প্রভাবশালীরা নিমন্ত্রণে যায় যে আমাদের না যাওয়াটা এতবছর প্রাসঙ্গিকতাই পায়নি। এবারে উদয়ের সঙ্গে চিটিংবাজীটা করার পর মনে মনে বুঝতে পারল আমরা ওর কাজটা মন থেকে মেনে নিইনি। তাছাড়া কলোনীগড় বাজার থেকে শাটারের আড্ডার জায়গাটার দূরত্ব প্রায় এক কিলোমিটার। কলোনীগড় বাজারে উদয়কে যেভাবে সাজানো লোক দিয়ে বেয়াকুপ বানানো হয়েছে সেটাও খুব অন্যায় হয়েছে। টাকাটা নিজের ইচ্ছেমত শোধ করার পাকাপোক্ত সিলমোহর লাগিয়ে নিয়েছে। এসব গুলোকে ধামাচাপা দিতেই দুটো হুইস্কির বোতল আর কিছু খাবারের চাট নিয়ে সন্ধ্যার একটু পরেই শাটারে এসেছিল গদাই নন্দী। পূজার প্রায় দিন পনের বাদে। বোতল দুটো একটু আড়াল করে রেখে বলল,
‘ পূজায় তোরা যাসনি বলে মেজদা তোদের জন্য পাঠিয়ে দিল। মেজদা কিনে এনে আমাকে বললো এগুলো শাটারে দিয়ে আসবি !’ বলেই আপাত কঠিন মেজদার কোমল মনের পরিচয় দিতে বলে উঠল, ‘ পূজার পাওনাগন্ডা নিয়ে মেজদার ঘরেই আমাদের পারিবারিক আড্ডা চলছিল। বাবা মা বড়বৌদি, মেজবৌদির সামনে মেজদা সরাসরি আমাকে চার্জ, তোর শাটারের একটা বন্ধুও আসেনি তুই ওদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করিসনা বলে।’ — বলেই সরাসরি হুকুম করল, ‘প্রায় পনের থেকে কুড়িজন ওখানে তোরা আড্ডা মারিস। আমি কাউন্টার থেকে আনিয়ে রাখব তুই আমার হয়ে দিয়ে আসবি !’ বলেই এবার নিজের কথা বলল, ‘ তোমাদের মাল তোমাদের হাতে পৌঁছে দিলাম, আমাকে যদি দু’পেগ ভালোবেসে দাও খেতে পারি ! লাগলে পরেরটা আমি দেব ‘ — বলেই হাসি হাসি মুখ করে সবার মুখের দিকে তাকাল। এটা ঠিকই সন্ধ্যার পরপর এই সময়টা শাটারে কোনো কোনো দিন পঁচিশজনও হয়ে যায়। কাজকর্ম সেরে এক এক করে আড্ডায় জমতে থাকে। সেদিন প্রায় পনের জনের মতো আমরা হাজির হয়েছি। গদাইর কথা শেষ হলেও আমরা কেউ কোন আবেগ বা উচ্ছ্বাস দেখাতে পারলাম না। দেখালামও না। ক্ষণিকের জন্য আমাদের সবার চুপ করে থাকাটা একটা প্রশ্নচিহ্ন তৈরি করে দিল। নীরবতাটা ভাঙলো পীযুষই। বলল, ‘ বড়দা বাড়িতে এখন। আমার বিছানায় শোবে। আমাকে বাবার সঙ্গে রাতে ঘুমাতে হবে। আজ খেতে পারব না। তোরা খা ! ‘— পীযূষের কথা শেষ হতেই এক এক করে প্রায় সবাই আজ না খাওয়ার যুক্তি সাজিয়ে বলে গেল। বাকি রইলো আমি আর গদাই বাদে দুজন। আমিও সুযোগ পেয়ে বললাম, চারজনের পক্ষে দুটো সাড়ে সাতশো অনেক বেশী। আজ বাদ দে গদাই অন্যদিন খাব।’ আমার কথা শেষ হতেই সুজিত বললো, ‘গদাই বোতল দুটো তোর কাছেই রাখ। শাটারে রাখা ঠিক হবেনা। সাটারের তালা যে আটকায় না অনেকেই জানে। রাতের বেলা ঝেরে দেবে।’ — গদাইকে বিকল্প কোনো কথা বলার সুযোগ দেওয়াই হোলনা। ফোকটে মাল পেয়েও মাল না খাওয়ার সিদ্ধান্ত কস্মিন কালেও শাটারে হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। কখনো কখনো জায়গা এবং সময় পাল্টেছে পরিস্থিতি অনুসারে।
ভয় আমাদের সবসময় জড়িয়ে থাকে। আমরা নিপাট আত্মকেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত মাত্র। মুখে মুখে বিপ্লবী। নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে বিপ্লবের গল্প শুনতে ভালোবাসি। রাষ্ট্রের সমালোচনা করি।
গদাই নন্দীর তৃতীয় বোধে ব্যাপারটা ধরা পড়তেই আমাকে সহ দুজনকে বাড়িতে নিয়ে যাবার জন্য পীড়াপীড়ি শুরু করে দিল। বলল, ‘ রাতে তোমাদের বাড়িতে পৌঁছে দেবার দায়িত্ব আমার চলো ! ফ্রিজে খাসীর মাংস আছে বউকে কষিয়ে দিতে বলব !’ — বললাম, ‘ তাড়াহুড়ো করার কিছু নেই দুইতিনজন মিলে না খেয়ে সবাই মিলে খাব। তোর ফ্রীজে বোতল দুটো আপাতত রেখে দে। কয়েকদিনের মধ্যেই আর একটা তারিখ করব।’ — গদাই নন্দীর রাগ হলেও আমাদের কাছে ধরা দিলনা। তখনই ওর একটা একটা ফোন আসল। কথা বলতে বলতে বলল, ‘তুই ওখানেই দাঁড়া, আমি গাড়ি নিয়ে যাচ্ছি।’ — বলে স্কুটারের ভেতরে বোতল দুটো ভরে বেরিয়ে গেল। গদাই নন্দী বেরিয়ে যেতেই আমরা যুদ্ধজয়ের আনন্দে আচমকা চিৎকার করে উঠলাম। ঘটনা ঘটার পূর্ব মুহূর্তেও আমরা জানতাম না এমনটা ঘটবে। সমস্ত ধন্যবাদের প্রাপ্য অবশ্যই পীযূষ। মোক্ষম যুক্তিটা খাড়া করতেই অন্যরা সুযোগ তৈরি করে নিলাম। বোতল দুটো ফেরত পাঠিয়ে দেবার কৃতিত্বও একেবারে কম নয়। সেই কৃতিত্ব অবশ্যই সুজিতের। শাটারের তালা ভাঙার কথাটা বলে যুক্তিটাকে পোক্ত করেছে। বোতল দুটো নিয়ে যেতে বাধ্য করেছে।
পরে ভেবে দেখলাম সেটাও ছিল আমাদের সংঘর্ষের মুখোমুখি না দাঁড়িয়ে এড়িয়ে যাবার সপক্ষে যুক্তি সাজানো। আচ্ছা, আমরা এটাও তো করতে পারতাম, সেই রাতে সবাই মিলে বোতল দুটো খেয়ে নিয়ে গদাই নন্দীকে বাধ্য করতাম কাল সকালের মধ্যে উদয়ের পঞ্চাশ হাজার টাকাটা ফেরত দিতে। সেটাতো একেবারে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হোত। গদাই নন্দী আমাদের সমবেত চাপের কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হোত হয়তো। আর কিছু না হোক ও যে অপরাধী সেটা আমাদের সকলের সামনে চিহ্নিত হোত। হাতে সুযোগ আসলেও আমরা কায়দা দেখিয়ে সুযোগটাকে কাজে লাগালাম না। কেননা আমরা ব্যক্তিগতভাবে কেউই গদাই নন্দীর শত্রু হতে চাইনা। পাগলেও বোঝে উদয়ের পক্ষে জোর সওয়াল করার অর্থ গদাইর শত্রু হওয়া। প্রতিবাদ করছি ভেবেই আমরা গদাইর অফার করা মদটা খাইনি। মদটা সেবন করার পর আমাদের ইমান যদি জেগে উঠত। তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়তাম। তাহলে গদাই নন্দীর সঙ্গে পাকাপাকি একটা শত্রুতা তৈরি হয়ে যেত। সুতরাং আপাতত মদের আসরটা ভেস্তে দাও। পরে ভাবা যাবে। গদাইর হাতে কাচা পয়সা আছে, মাস্তান আছে, কয়েকটা আগাছা আছে, সুদের আয়ে ওদের খোরপোষ চালাতে হয়। গদাই নন্দীকে চাপ দিলে পাল্টা চাপ দিতে ওদের ছেড়ে দেবে। সেটাই ছিল আসলে আমাদের ভীতি। সম্মান হারাবার ভীতি, মার খাওয়ার ভীতি, বিপদে ফেলে দিতে পারে, এইরকম অনেক ভীতি আমাদের সবসময় জড়িয়ে থাকে। আমরা নিপাট আত্মকেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত মাত্র। আমরা মুখে মুখে বিপ্লবী। নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে বিপ্লবের গল্প শুনতে ভালোবাসি। রাষ্ট্রের সমালোচনা করি।
রাতে একটা অহংকার নিয়েই শাটারের আড্ডা সেরে বাড়ি ফিরতে ফিরতে ঠিক করলাম, সবাই মিলে জোর করে গদাইকে আলোচনায় ডাকবো। ওকে চাপ দিয়ে বলব, তোমার কাছে পঞ্চাশহাজার টাকা কোনও ব্যাপার নয়। উদয়ের ব্যাঙ্ক লোনের টাকাটা ফেরত দাও! এটাই সবাই মিলে চেপে ধরে বলা হবে। উদয়কেও সেটা জানিয়ে দিয়ে বলেছি তুইও থাকবি আলোচনায়।
নির্দিষ্ট দিনে আমি একটু আগেই শাটার খুলে ভেতরে বসলাম। সবাইকে সময় দেওয়া আছে। সবাই এলেই গদাইকে ডেকে আনা হবে । হিসেবমতো আজকে তিরিশ জনের মতো থাকার কথা। সেই আশায় বসে আছি। কিছুক্ষণ পর থেকে কুড়ি থেকে বাইশজন ফোন করে জানালো বিশেষ কাজে ফেঁসে গেছে আসতে পারবে না। বাকি কয়েকজনকে ফোন করতেই দেখলাম, ” সুইচ অফ! কী করব বা এই মুহূর্তে কী করা উচিত মাথায় কিছু ঢুকলনা। এমনি পরিস্থিতিতে দূরে দেখতে পেলাম উদয় হাঁটতে হাঁটতে শাটারের দিকেই আসছে। আমি ভয় পেয়ে গেলাম সত্যি সত্যি। আগুপিছু না ভেবে উদয়ের চোখের আড়াল হতে দ্রুতপায়ে শাটার থেকে বেরিয়ে বাজারের ভেতরে লুকোতে লাগলাম।
♦—♦♦—♦♦—♦♦—♦
❤ Support Us