Advertisement
  • গ | ল্প রোব-e-বর্ণ
  • জুন ৩০, ২০২৪

মাটি বলে

ময়ূরী মিত্র
মাটি বলে

 
এ•ক

 
মাটির ঘরের কালো কাঠের জানলাটা দিয়ে সুকুবুদ্দিনের গোয়ালঘরের দিকে তাকাল ভুলু ৷
 
ফাতিমাকাকী চারটি ধুপকাঠি জ্বালিয়ে গরুকে আরতি করছে৷ ধূপকাঠির একটু সস্তা-উগ্র গন্ধ বেরিয়ে ভুলুর নাক সুরভিত করছে৷ গন্ধটা ভুলুর ভালো লাগে — কাকীকে রাতের ঘুমে জড়িয়ে ধরে এ গন্ধ আরো নিতে ইচ্ছে করে৷ সুকুকাকুর নাকডাকার জ্বালায় কাকীমার কাছে শোওয়ার উপায় আছে ভুলুর ! তাছাড়া ভুলু ঠিক করে ফেলেছে – প্রকৃতিবিজ্ঞানী হবে৷ ফলে রাতে বাড়ি-উঠোন-পুকুর ঘুরে ঘুরে আকাশ, জল, গাছ, পাখি দেখে বেড়ায়৷ ফতেকাকী বলেছে — জগতে প্রাণহীন বলে কিছু হয় না৷ আকাশ-জল-বাতাসেরও প্রাণ আছে — আলাদা আলাদা বাঁচার ধরণ আছে৷কাকীর হুকুম — বইপড়া ছাড়াও ভুলুকে দিনের বিভিন্ন সময় এগুলো দেখতে হবে৷ কখনো আকাশ কীভাবে ডাকে — কখনো বাতাস ওড়ার সময় কতখানি দোলা দেয় পাতায় ! ফতেকাকী পাগল — ফতেকাকীর ভুলুও পাগল৷ দুটো গাছ, পশুর সঙ্গে গপ্প মেরে কাটায়৷
 
আরতি সেরে গরুর পায়ে উপুড় হয়ে এবার প্রণাম করবে ফাতিমা৷ তাঁর পুরো রুটিন ভুলুর জানা৷ সবথেকে ভালোবাসারজনের সব কিছু যেমন উল্টোপিঠের মানুষটির জানা হয়ে যায় ঠিক তেমনি করেই ভুলু জেনেছে পাশের বাড়ির গোয়ালিনীকে৷ প্রথম যেদিন ভুলু গরুর সামনে ধূপকাঠি ঘোরাতে দেখেছিল, এই জানলাটা দিয়েই চেঁচিয়ে বলেছিল —
 
কাকীমা মশা তাড়াচ্ছ এত ঝক্কি করে ! দু চারটে পাঠকাঠি পোড়াও না ! হুঁ হুঁ বাবা ! বাছারা সব পালাবে৷ আমার মা বলত৷ আরে আমার বাবা তো এমনি করেই মশা ওড়ায় আকাশে৷ সে দুপুরে ফাতিমা একবাটি ঘন ক্ষীর ভুলুর সামনে ধরে ফাতিমা বলেছিল — — ভুলু রে গরু শ্রেষ্ঠ জীব ৷
 

গরু শ্রেষ্ঠ জীব কেন ? হাতী কেন নয় কাকীমা ? থোড়ের খোলার মতো সাদা দাঁত ! ওই দাঁতের তৈরি একটা সিঁদুরকৌটো থেকে সিঁদুর পরত মা ! কী মিষ্টি লাগত মাকে ! আর তুমি বলছ গরু সবার থেকে ভালো ! সবসময় মাথায় খালি প্রশ্ন ঢুকিয়ে দাও কাকীমা৷ উত্তর খুঁজতে খুঁজতে অন্যান্য সাবজেক্টে একভাবে ফেল করে যাচ্ছি আমি, বলে ভুলু

 
সেবছর ভুলু প্রকৃতিপাঠে প্রথম হয়েছিল৷ তখন থেকে ঝড় বা রোদ – আকাশে যে কোনো কিছু হলেই একটা ভুরু সংশয়ে কুঁচকে রাখে ভুলু৷ স্বাভাবিক বিষয়ে গাদা প্রশ্ন রেখে গ্রামের লোককে ভুলু বুঝিয়ে দিচ্ছিল— সে বিজ্ঞানী হতে চায়৷ ফলে ফাতিমাকে গরু নিয়ে প্রশ্নে জেরবার করার হক ভুলুর ছিল — অন্তত ভুলু তা মনে করত৷
 
এক চুমুতে অনেকটা ক্ষীর টেনে ভুলু বলেছিল — কেন ? গরু শ্রেষ্ঠ জীব কেন ? হাতী কেন নয় কাকীমা ? থোড়ের খোলার মতো সাদা দাঁত ! ওই দাঁতের তৈরি একটা সিঁদুরকৌটো থেকে সিঁদুর পরত মা ! কী মিষ্টি লাগত মাকে ! আর তুমি বলছ গরু সবার থেকে ভালো ! সবসময় মাথায় খালি প্রশ্ন ঢুকিয়ে দাও কাকীমা৷ উত্তর খুঁজতে খুঁজতে অন্যান্য সাবজেক্টে একভাবে ফেল করে যাচ্ছি আমি ! তোমার মোটে আমার দিকে নজর নেই !
 
কোন কথা থেকে যে কোথায় চলে যায় ভুলু৷ কথার নদী বইয়ে বিজ্ঞান খোঁজে ! ভুলুর কথা বাড়তে দিলে খুব মুশকিল ফাতিমার৷ ছেলেটা যেদিন প্রশ্ন শুরু করে — সুকুবুদ্দিনকে শুধু ভাত ডালটুকু রেঁধে দিতে পারে ফাতিমা৷ পেটুক সুকু ফতেমা ভুলু —দুটোকেই টেনে গালাগাল দেয়৷ ভুলু প্রশ্ন শুরু করতে ঝটপট উত্তর দিয়েছিল ফাতিমা—
 
— গরু বাচ্চাদের খাবার জোগাড় দেয় রে ভুলু ৷ পৃথিবী জুড়ে বাচ্চাগুলো দুধের বোতলে চো চো টান মারে৷ তাই গরু সবের বড়ো৷
 
প্রশ্ন থামানো ভুলুর ধাত নয় —
 
—  অর্ধেক দুধ তো বাছুরকে খাইয়ে দাও তুমি !
 
পৃথিবীর কাছে পৌঁছোয় তোমার দুধ ? যত্ত গুল তোমার আমাকে – তাই না ?
 
ফাতিমা হেসেছিল —  যে সবার খাবার দেয় -তার বাচ্চা সবার আগে পেট পুরে খাবে !
 
—  এমনটাই হওয়া উচিত বলছ ?
 
—  উচিত আর অনুচিত বোকারা ভাবে ! তুই একটা বিজ্ঞানী লোক ভুলু ! তুই বরং চলে ফিরে দ্যাখ -এমন হয় কিনা !
 
ভুলু হাসে৷ কাকীমা তো জানে না — কবে থেকেই ভুলু সব লক্ষ্য করতে শুরু করেছে ! এই যে কাকীমার বেশিরভাগ গরু যে আজকাল দুধ দিচ্ছে না— এটা ভুলু দেখেনি ! দু চারটে এত বুড়ো হয়ে গেছে যে ঘাস ছিঁড়ে খেতেও পারে না ৷ শুধু পা দিয়ে মাঠ দাবিয়ে ফসল নষ্ট করে আর তারপর কাকীমার গোয়ালে ফ্যান্টাস্টিক জলখাবার খায়৷
 
নাহ ! কাকীমার মন বোঝা ভার ! এই যে এতক্ষণ ধরে দুধের সর চাইছে ভুলুর জিভ — তা কি বুঝতে পারছে কাকীমা ! ছেলের কষ্ট না বুঝে শুধু গরু-গোবর— এইসব করে বেড়াবে৷ আসুক সুকুকাকা৷ দাঁত কিড়মিড় করল ভুলু৷ আজ যদি বাবা খোল বাজিয়ে মুড়কি নিয়ে ফেরে তো একদানাও দেবে না কাকীমাকে৷ বাবা বললেও না৷ মুঠোয় লুকিয়ে কাকুর মুখে ঢুকিয়ে দেবে ভুলু৷

 

 
দু•ই

 
— ভুলু ! ভুলুরে !
 
— কে ডাকছে ? সরস্বতী না ?
 
ঘর ছেড়ে দাওয়ায় এল ভুলু ৷ ভুরু আবার কুঁচকে যাচ্ছে !
 
— আবার ! আবার ঘ্যানঘ্যান করছিস সরস্বতী ? বাচ্চাদের মতো একই জিনিস নিয়ে বায়না করিস কেন রে ?
 
— ও ভুলু আমি তো বাচ্চাই রে ৷ দেখছিস না পাতাগুলো কত ছোট আমার ৷ প্লিজ আমায় টব থেকে নামিয়ে দাওয়ায় পুঁতে দে ৷ এখানে রোদ পাই না — একটু ছড়াতে পারি না ৷ — আমায়ও তো সবার মতো বড়ো হতে হবে রে ভুলু ৷ অন্তত তোর মতো বড়ো হব না ? নাহলে তো তোকে ছুঁতে পারব না৷ মানুষের ছোঁয়ার মতো বড়ো হতে দে ভুলু ৷ — টব থেকে সরস্বতী কাঁদছিল ৷
 

ভুলু সম্প্রতি সে জেনেছে গাছের প্রাণ আছে — আর সে মানুষের মতোই বাড়ে৷ সেই ইস্তক সরস্বতীকে জঙ্গল থেকে কুড়িয়ে বারান্দার টবে পুঁতেছে সে — সারও দিচ্ছে৷ সুকুকাকা কত্তরকম সার যে বানায়। এত খাবার খেয়েও সরস্বতী উঠোন খোঁজে !

 
—  ছোটো ছোটোর মতো থাকবি৷ কোথায় তোকে পুঁতব – আমি বুঝব৷ দুবেলা দু হাঁড়ি চায়ের পাতা গিলিস৷ তাও এখনো বড়ো হলি না — লজ্জা করে না গলা বের করতে ! — ভুলু খুব রেগে যাচ্ছিল সরস্বতীর ওপর৷
 
সম্প্রতি সে জেনেছে গাছের প্রাণ আছে — আর সে মানুষের মতোই বাড়ে৷ সেই ইস্তক সরস্বতীকে জঙ্গল থেকে কুড়িয়ে বারান্দার টবে পুঁতেছে সে — সারও দিচ্ছে৷ সুকুকাকা কত্তরকম সার যে বানায়। এত খাবার খেয়েও সরস্বতী উঠোন খোঁজে !
 
— কেন রে ? ভুলুর ওপর কি তোর এতটুকু বিশ্বাস নেই রে সরস্বতী ? আমি একটা বিজ্ঞানী মানুষ — বা ধর বিজ্ঞানী হব৷ এখানে বসে আমি বিজ্ঞান বই পড়ি৷ তুই চোখের সামনে থাকলে তোর বাড় বুঝব! ক্ষয় বুঝব -তবে তো তোকে মেরামতি করে বড়ো করব৷
 
বিড়বিড় করতে করতে সরস্বতীর নেতানো দুটো পাতায় দুটো টোকা মারল ভুলু৷ পাতাদুটো একটু ওপরমুখো হয়ে নেতিয়ে গেল ফের৷ দেখে ভুলু বলে — বেশ হয়েছে৷ তোর জন্যই আমার বিদ্যে বাড়ছে বটে – তা বলে একটুও শাসন করব না – ভাবিস না৷

 

 
তি•ন

 
মাঝরাতে সুকুবুদ্দিন বুকের মধ্যে প্রাণীর নড়াচড়া টের পেল । ধড়ফড় করে উঠে বসল সুকু ৷ — ঠিক ধরেছে ! ভুলু ৷ নিশ্চয় বাবা আজ রাতেও ফেরেনি৷
 
পাশে শোয়াতে গিয়ে সুকুবুদ্দিন দেখল — ভুলু কাঁদছে৷ দ্রুত ফাতিমাকে ডেকে তুলল সুকু৷ কারণ ভুলু ফাতিমা — দুটোর কারোরই কাণ্ড বুঝে উঠতে পারে না সুকুবুদ্দিন৷ তাই একজন কারোর সমস্যা যখন মেটাতে পারে না — দুটোকে মিলিয়ে, কেটে পরে সুকুবুদ্দিন৷
 
আজ কিন্তু ফতেমাকে এড়াতে চাইছিল ভুলু৷ কাঁদতে কাঁদতে বলল — না কাকু ৷ তুমিই চলো কাকু ৷
 

ভুলু কাকিমার পেটে মুখ রেখে বলতে চাইছিল — টবেও তো মাটি ছিল কাকীমা৷ তবে কি যার প্রাণ আছে সে তার পছন্দের মাটিতে বড়ো হতে চায় ? নাকি বড়ো হতে গেলে সবার সমানভাবে গোটা ধরিত্রীই লাগে ?

 
লুঙ্গি সামলাতে সামলাতে ভুলুর উঠোনে এসে সুকুবুদ্দিন দেখল — দাওয়ার ওপর সরস্বতী মরে পড়ে আছে৷ দীর্ঘদিনের চাষি, বুঝল — দু একটি পাতা থাকলেও গাছটার জান চলে গেছে৷ জোছনায় খয়েরি হয়ে যাওয়া পাতা হলুদ দেখাচ্ছে৷ আর তাতেই ভুলু ভাবছে — সরস্বতী বেঁচে আছে ৷ রোদ না খাওয়া গাছটাকে চাঁদের আলো দিয়ে বাঁচাবার চেষ্টা করতে লাগল ভুলু৷ কতবার যে কাণ্ডটাকে চাঁদের দিকে টেনে তুলতে লাগল !
 
— ডালটা তুলে জঙ্গলে ফেলে আয়৷ বাড়িতে মরা সরস্বতী রাখতে নেই৷ তোর বিদ্যের কমতি পড়বে ! — পিছন থেকে কঠিন কন্ঠে ফাতিমা বলল৷
 
আর ঠিক সেই মুহূর্তে ভুলু কাকিমার পেটে মুখ রেখে বলতে চাইছিল — টবেও তো মাটি ছিল কাকীমা৷ তবে কি যার প্রাণ আছে সে তার পছন্দের মাটিতে বড়ো হতে চায় ? নাকি বড়ো হতে গেলে সবার সমানভাবে গোটা ধরিত্রীই লাগে ?
 
প্রশ্নগুলো কিছুতেই করা আর হল না ভুলুর ৷ ফতেমার পেটই খুঁজে পাচ্ছে না সে ! যতবার পেটে মুখ চুবোতে চায় — ততবার দেখে — পোয়াতি জোছনায় ফতেকাকীর পেটের জায়গায় জমাট আঁধারের গোল টুকরো ৷ গোয়ালের শেষ জাগ্রত প্রাণীটি এখন ঘুমিয়ে — শুধু বিজ্ঞানী হতে চাওয়া বালক মায়ের গর্ভ খোঁজে৷ চারপাশের বিশাল গাছগুলো নীরব অপেক্ষায় থাকল৷ তারা খুব উদাসীন নয়৷
 

♦•⋅—♦•⋅♦•⋅—♦•⋅♦•⋅—♦

 

লেখক পরিচিতি:

পেশায় শিক্ষক, নাট্যকর্মী। কলকাতার বাসিন্দা


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!