- গ | ল্প রোব-e-বর্ণ
- জুলাই ৭, ২০২৪
পদ্মিনী বৃত্তান্ত

অলঙ্করণ: দেব সরকার
হাড়িকন্যা পদ্মিনীকে দেখে রাজা বল্লাল সেনের চিত্ত চঞ্চল হয়। পদ্মিনীর জন্য রাজ্যের খরচখরচান্তর বেড়ে কয়েকগুণ। মহারাজের স্বভাবদোষ নিয়ে দরবারের জ্ঞানীগুণি মানুষজন কৌশলে তাঁর প্রশংসা ও দোষ নিয়ে যথেষ্টই আলোচনা করে।সান্যাল মহাশয় একদিন দরবারে রাজা বল্লালের অগোচরে ভীষণ ভারিক্কী ধরনের কথা বলে বসলেন, আমাদের রাজা বল্লাল গুরুজনের নিকট আদরের ছেলে, যজ্ঞস্থলে পরম ধার্মিক ও দাতা, সভামধ্যে পন্ডিত, যুদ্ধস্থলে মহাবীর, শত্রুদমনে চতুর ও প্রবঞ্চক এবং উপপত্নীর আগারে লম্পট মাতাল। বলে তিনি কয়েকবার সভাসদদের দিকে তাকালেন, কারো কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখে তিনি চুপ করে গেলেন।
সভাপণ্ডিত অনিরুদ্ধ ভট্ট এদিক ওদিক তাকিয়ে একটু কেশে নিলেন, বললেন, আমি আর কী বলি? উনি যে প্রচার করছেন, দানসাগর আর অদ্ভুতসাগর গ্রন্থ দুটি তিনি নিজে রচনা করেছেন। তোমরা তো জানো, এগুলোর জন্য আমাকে কত স্বর্ণমুদ্রা দেওয়ার কথা ছিল। তা-তো পেলামই না, অথচ রাজা বলছেন, এগুলো তাঁর নিজের রচনা। কতটা মিথ্যেকথা বল দেখি?
আর বলো না দাদা। বৃদ্ধ রাজার বীর সন্তান লক্ষণ রাজা হলেই এই রাজ্যের সার্বিক মঙ্গল । সান্যাল কপালে ভাঁজ তুলে চোখ দুটো ছোট ছোট করে তাকিয়ে রইলেন।
বীর লক্ষণ কলিঙ্গ জয় করে হাতির পিঠে সারা রাজপথ ঘুরছিলেন। সাথে পাইক পেয়াদা আর বাদ্যবাদকের আওয়াজ আস্ফালন। চারদিকে পুষ্পবৃষ্টি । মাহুত হাতি থামিয়ে রাখল কিছুক্ষণ। লক্ষণ সেন হাতির আসন থেকে স্বর্ণ সিঁড়িতে বাম পা দিয়ে তারপর ডান পা মাটিতে রাখলেন। চারদিকে খুশির হুল্লোড় । গলা থেকে ফুল পশরার মালা খুলে একজন পাইককে দিয়ে দুহাত উঁচু করে সকলকে কৃতজ্ঞতা জানালেন। বাহু তাঁর যেন দোর্দণ্ড লৌহশলাকা, রাবণহস্তসদৃশ বক্ষ শিলাসংহত। লক্ষ্য তীর নিক্ষেপে জুড়ি নেই তাঁর। কামরূপে বিদ্রোহ দমনে কিংবা কান্যকুব্জ বিজয়ে তিনি সিংহমূর্তি ধারণ করতে পারেন প্রয়োজনে। কিন্তু সুন্দরী পদ্মিনীর বিষয়টি নিয়ে প্রচণ্ড বিব্রত লক্ষণ। জ্ঞান-গরিমা, বংশ মর্যাদা আর কৌলিণ্যের অহঙ্কারে মাটিতে পা পড়ে না যে রাজার, তিনিই কিনা হাড়িকন্যা পদ্মিনীর রূপের ঝলকে কুপোকাত।
রাজা পদ্মিনীর জন্য সাম্রাজ্যের সকল মূল্যবান জিনিস ক্রয়ে কার্পন্য করেন না। কাছের লোকেরা অনেকেই রাজাকে ত্যাগ করল। বল্লাল অবশ্য তাতে মোটেও ভাবেন না। শূদ্র হাড়িকন্যাকে পাওয়ার জন্য বল্লালের তখন স্বাভাবিক জ্ঞান-বুদ্ধি বেসামাল লোপ পেয়েছে। সবাই যা আশঙ্কা করেছিল— হলো তাই, সাম্রাজ্যের অর্থনীতিতে পড়ল টান
দরবারের কবিরা এই ঘটনা নিয়ে তুলকালাম সরগরম বাঁধিয়ে ফেলেছে। কিন্তু রাজা তো প্রেমে অন্ধ হয়ে পদ্মিনীর জন্য সাম্রাজ্যের সকল মূল্যবান জিনিস ক্রয়ে কার্পন্য করেন না। মূল্যবান হীরা-জহরত মণি-মাণিক্য সবকিছুই পদ্মিনীকে তাঁর দেওয়া চাই। কাছের লোকেরা অনেকেই রাজাকে ত্যাগ করল। বল্লাল অবশ্য তাতে মোটেও ভাবেন না। বরং যারা তাঁকে ত্যাগ করেছে দেওয়া তাদের প্রতি রুষ্টও নন তিনি। শূদ্র হাড়িকন্যাকে পাওয়ার জন্য বল্লালের তখন স্বাভাবিক জ্ঞান-বুদ্ধি বেসামাল লোপ পেয়েছে। সবাই যা আশঙ্কা করেছিল— হলো তাই, সাম্রাজ্যের অর্থনীতিতে পড়ল টান। কীভাবে এর মোকাবিলা করবেন বল্লাল ? ভাবতে ভাবতে তার একান্ত উপদেষ্টা গোবর্ধনাচার্য্যকে জিজ্ঞেস করলেন, বলতে পারো কী উপায়ে দেশের অর্থের উন্নতি হবে? বছরতো এখনো অনেক বাকি হে। খরচ-খরচান্তরের কী উপায় হবে?
গোবর্ধন হালকা আড়ষ্ট কণ্ঠে বললেন, রাজাধিরাজ সময়ে অসময়ে আপনি তো একজনের কাছেই অর্থ চেয়ে থাকেন তাঁকেই বলে দেখুন। বল্লাল তাকালেন গোবর্ধনের দিকে। গোবর্ধন বললেন, হাঁ জাঁহাপনা আমি বল্লভানন্দের কথাই বলছি। আপনাকে সাহায্য করার মত এই রাজ্যে একজন মাত্র লোকই রয়েছেন, তিনি বল্লভানন্দ।
রাজা বল্লাল সেন মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, বটে। কিন্তু…, কিছু সময় নিয়ে ভাবলেন, এই নন্দ মিচকে শয়তান একটা। তুমি তো জানো, মগধের পাল রাজা আমার শত্রু।সেই পাল রাজার শ্বশুর মশাই বল্লভানন্দ কীরূপে আমাকে সাহায্য করে?
গোবর্ধন চিন্তিত হয়ে মাথা চুলকে বলল, জাঁহাপনা, আমরা একবার তাঁর কাছে চাইতেই পারি। তিনি এই রাজ্যে থেকে না বলার সাহস করতে পারবেন কি ? সে দুঃসাহস তাঁর হবে ?
বল্লাল সেন নিতান্ত নিরুৎসাহিত চোখে গোবর্ধনের দিকে চেয়ে বললেন, সে সাহস বা দুঃসাহস তাঁর হবে না বটে, কিন্তু যদি একবার ‘না’ বলার দুঃসাহস তাঁর হয়েই যায় তবে ভেবে দেখেছো, তা কিরূপে প্রতিকার হবে?
গোবর্ধন চুপ করে রইলেন।
রাজা বল্লাল অনেকটা অনিচ্ছায় গলা চড়িয়ে বললেন, দূত প্রস্তুত কর। ধনকুবের বল্লভানন্দ শেঠের কাছে গিয়ে বলো, সেন রাজা বল্লালের প্রয়োজন দেড় কোটি স্বর্ণমুদ্রা। প্রস্তুত হও।
দূত হিসেবে দূর্গাচরণ ও আরো ত্রিশ জন অমাত্য দৈনিক হাতি ও ঘোড়া প্রস্তুত করে বল্লভানন্দ শেঠের বাড়ি পৌঁছে রাজা বল্লালের চাহিদার কথা তুলে ধরলেন।
বাড়ির বাইরে পায়চারি করছিলেন বল্লভানন্দ। জামাতা পাল মগধাধিপতির বিজয়গর্বে গর্বিত হয়ে একধরনের প্রশান্তির হাসি বিরাজ করছিল তাঁর চোখেমুখে। মেয়ের পত্র পেয়েছেন। বলেছে, কিছুদিন সমস্যার মধ্যে থেকে মাত্র স্বস্তি ফিরেছে রাজ্যে। পাল রাজাদের একসময়ে যে প্রবল প্রতাপ ছিল তা যে বিলীন হতে চলেছে, তার মধ্যে এই সুখবরে পিতা বল্লভানন্দের প্রাণেমনে বেশ ফুরফুরে বাতাস বইছে। বাড়ির ত্রিসীমানায় রাজার সৈনাদলের আগমনে সে আনন্দের আলোয় কিছুটা আঁধারের ছায়া পড়ল যেন।
দুর্গাচরণ কোমরে বাঁধা কোষবন্ধ খাপ থেকে বল্লাল সেনের পত্র তুলে দিলেন বল্লভানন্দের হাতে। নন্দ পত্রটি খুলে পাঠ করলেন। দূর্গাচরণ ও কয়েকজনকে ইশারায় ডেকে নিলেন কিছুটা দূরে গুবাক বাতায়নের ছায়ায়।
জামাতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে বল্লাল সেনকে কয়েকবার নিষেধ করেছিলেন নন্দ। তার পরামর্শ কখনোই গা করেননি সেন রাজা। এতে ভীষণ ক্ষুব্ধ ছিলেন নন্দ। আজ আবার সাম্রাজ্যের এই অর্থনৈতিক দুর্দিনে তাঁর কাছেই সাহায্যের ঝুলি নিয়ে এসেছে বল্লাল সেন।
বুঝেছো দুর্গাচরণ? তোমার রাজার যে দৈন্য তাতো আর প্রকৃতই দৈন্যদশা না। এ হচ্ছে গিয়ে বল্লালী দারিদ্র্য। কোন হাড়িকন্যা শূদ্র পদ্মিনীর পায়ে অঝোর ধারায় খরচ করে এক রাজা । এ কি রাজার কর্ম? তাছাড়া রাজা ক্রমাগত যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত থেকে অর্থক্ষয় করছেন। এ হেন যুদ্ধ-বিগ্রহে সাহায্য করা আমি অন্যায় মনে করি। প্রজার হিত করা রাজাদের করা কর্তব্য। তবে যদি তিনি বঙ্গের কিছুটা ভূমি আবদ্ধ রেখে ঋণ গ্রহণ করতে চান, তবে আমি দিতে পারি। তুমি আমার এ প্রস্তাব তোমার রাজাকে গিয়ে বলবে। তিনি যদি মত সেন তবেই আমি তাঁর প্রার্থীত স্বর্ণমুদ্রা প্রদান করব।
দুর্গাচরণ তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে ক্ষীপ্রগতিতে হাতি আর যে যার ঘোড়ায় চড়ে বসলেন। সেন রাজার দরবারে পৌঁছে বল্লাল সেন বললেন, কী বার্তা দূর্গাচরণ? মন্দ নয়তো?
দূর্গাচরণ অন্ধকার মুখে ধনকুবের বল্লভানন্দের বলা সকল কথা সেন রাজার নিকট ব্যক্ত করল।
রাজা অস্বস্তিসহকারে শুনলেন। ঝড় আসার পূর্বে যেমনটি থাকে আকাশের অবস্থা ঠিক তেমনটি শান্ত দেখাচ্ছিল বল্লালকে। বল্লভানন্দের স্পর্ধিত উক্তিতে রাজা বল্লাল হঠাৎ ক্রোধে জ্বলে উঠলেন। বললেন, আমি আগেই এমনটি ধারণা করেছিলাম। গোবর্ধনের পরামর্শে আমি তবুও পাঠালাম। সে যাই হোক রাজার মর্যাদাকে তো ছোট করা যাবে না। এখন আমাদের ভাবতে হবে- কী উপায়ে এর প্রতিশোধ নেওয়া হবে?
রাজার আদেশমত সকল আয়োজন সম্পন্ন হলো কিন্তু ভেতরে ঘটে গেল অন্যকিছু ঘটনা। সহসা কিছু সুবর্ণবণিকদের মাঝে অসন্তুষ্টি দেখা দিল। ফিসফিসানি থেকে চরম গণ্ডগোলে গড়াল বিষয়টি
পুত্র লক্ষণ সেনকে বললেন, তুমি বিক্রমপুর নিয়ে তোমার পিতৃব্য সুখ সেন এবং কুমার ধ্রুবকে ডাকার ব্যবস্থা করো। আর ভীম সেন, তুমি এ রাজ্যের সমস্ত লোক সকলকে সমাগমের ব্যবস্থা করো। আমাদের এই দরবারে হবে পিতৃপিণ্ডযজ্ঞের অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানে সব প্রদেশের রাজা, জমিদার, বণিক সম্প্রদায় মান্ডলিক, মহা মান্ডলিকের উপস্থিতি থাকতে হবে।
রাজার আদেশমত সকল আয়োজন সম্পন্ন হলো কিন্তু ভেতরে ঘটে গেল অন্যকিছু ঘটনা। সহসা কিছু সুবর্ণবণিকদের মাঝে অসন্তুষ্টি দেখা দিল। ফিসফিসানি থেকে চরম গণ্ডগোলে গড়াল বিষয়টি। ভীম সেন অপ্রস্তুত হয়ে সুবর্ণবণিকদের উদ্দেশ্যে হাত জোড় করে বলল, বাবুগণ, আয়োজনের যে কোনো ত্রুটি আমরা মাথা পেতে অপরাধ স্বীকার করি। আপনাদের এ গগুগোলের হেতু কি জানতে পারি?
আমরা অপমানিত হয়েছি। একজন সুবর্ণবণিক বেশ উচ্চকণ্ঠে হাত নেড়ে পেছন ঘুরে দাঁড়াল। ভীম সেন দু হাত একত্রিত করে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে হাঁটু গেড়ে বসলো, দয়া করে ক্ষমা করবেন। আমাকে বলুন, আমরা আপনাদের অপমানিত করেছি কীভাবে?
একজন ব্যবসায়ী উঠে থমকে দাঁড়িয়ে বলল, কীভাবে ? আমাদের এখানে ডেকে এনে অপমানিত করা হয়েছে। শূদ্রদের সঙ্গে খাবার খেতে দেয়া হয়েছে। আমরা তাদের সঙ্গে খেতে পারি না। এ আমাদের জন্য অসম্মান। এ তোমাদের সম্মান নমুনা?
ভীম সেন আবারো দু হাত জোড় করে বলল, অপরাধ মার্জনা করবেন। আপনাদের আসন অন্যস্থানে ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। আপনারা চলে যাবেন না। দয়া করে আপনারা চলে যাবেন না।
ব্যবসায়ীরা কেউ কেউ দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে পড়ছিল। এ অবস্থায় তাদের মধ্য থেকে কয়েকজন বণিক চিৎকার করে বললেন, উঠো, চলো। আমরা অভুক্ত হয়েই চলে যাব। আসতাম না। এতো বড়ো অপমাণ আমাদের সঙ্গে করা হয়েছে। আগে জানলে আমরা কখনো আসতাম না।
ভীম সেন অনুরোধে না পেরে শেষপর্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে বলল, আসলে তোমাদের মনে তো এই রকমই ছিল। তোমদের তো শূদ্রদের সঙ্গে বসানোই সমীচীন। যাও যাও। তোমরা চলে যাও। তোমাদের আমন্ত্রণ জানানোই ঠিক হয়নি। সকলের এমন রাজদরবারে বসবার এবং খাদ্য গ্রহণ করবার যোগ্যতা হয় না।
বণিকরা সারিবদ্ধভাবে গালি দিতে দিতে বেরিয়ে গেলে তীম সেন রাজা বল্লাল সেনের কাছে গিয়ে সব ঘটনা খুলে বলল। রাজা হওয়ার পর এমন অভিজ্ঞতা হয়নি তার। তবু কিছুদিন থেকে তার কেমন যেন অপমানকর পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে। সব শুনে শান্ত, স্থির ও দৃঢ় থাকার চেষ্টা করলেন। বললেন, দূরাশয় বল্লভানন্দের প্ররোচনায় এই বণিকদের স্পর্ধা এতটা বেড়ে গেছে। উচ্চকণ্ঠে বলতে বলতে বল্লালের সর্বশরীরে ক্রোধে কম্পিত হয়ে উঠল, দাঁত কিড়মিড় হতে লাগল। মাথা ঘুরতে লাগল। একসময় হঠাৎ তাঁর মস্তক থেকে পড়ে গেলো হীরক মুকুট।
ভীম সেন চিৎকার করে উঠল, ‘পপাত মস্তকাত তস্য কিরিটং হীরোকোজ্জলম।’
বল্লাল সেন স্থির হওয়ার চেষ্টা করলেন। মাথায় শীতল জলের পরশ বোলানো হল। শত সেবিকার স্পর্শে সেন রাজার মুখে হাসি ফিরল। গোবর্ধন রাজার কানে কানে কী যেন বললেন। বল্লাল সেন চিৎকার করে উঠলেন আবার। কোথায় মনিদত্ত? কোন মনিদত্ত?
গোবর্ধন কিছুটা অপ্রস্তুত, কিছুটা আড়ষ্ট হয়ে বলল, আজ্ঞে মহাশয়, মনিদত্ত বল্লভানন্দের ভাগ্নে।
ভাগ্নে? বল্লভানন্দের ? ডাকো বল্লভানন্দকে।
ভীম যেন তাকিয়ে রইলো গোবর্ধনের দিকে।
অনুচ্চকণ্ঠে বলল, গোবর্ধন, এক ব্রাহ্মণের একশত আটি ভরি স্বর্ণের মধ্যে খাদ নিয়ে ঠকাচ্ছিল মনিদত্ত। ব্রাহ্মণ অভিযোগ করেছে।
মুচকি হেসে চুপ রইল ভীম সেন।
রাজা গুম্ভীর কন্ঠে বললেন, আমি সুবর্ণবণিকদের দিয়ে এই স্বর্ণ পরীক্ষা করাব। যদি খাদ থাকে, তবে মনিদত্ত, তার ধনকুবের মামা বল্লভানন্দ আর তার সাঙ্গপাঙ্গদের আস্ত রাখব না আমি। সবাইকে নির্বাসিত করে ছাড়ব।
ডাকা হল বল্লভানন্দকে। স্বয়ং রাজা বল্লাল জিজেস করলেন, এই স্বর্ণের মধ্যে কি কোনো খাদ আছে? পরীক্ষা করে তারপর জানান।
ভাগ্নেকে বাঁচানোর জন্য আর কোনো উপায়ন্তর না দেখে ধনকুবের বল্লভানন্দ বলে ফেললেন, না রাজা মহাশয়, এই স্বর্ণে কোনো খাঁদ নেই। একদম খাঁটি সোনা।
যদি স্বর্ণে খাদ থাকে প্রমাণ হয়? তাহলে আপনার কী পরিণতি হবে ভেবে দেখেছেন?
বল্লভানন্দ নিজেও ভাগ্নে সম্পর্কে জানেন। ব্যবসায়ী হিসেবে তাকে কখনো বিশ্বাস করতে পারেননি তিনি। তাই বলে বল্লাল সেনের হাতে এইভাবে চরম বিপদে ভাগ্নেকে তিনি ফেলতে পারেন না। আর একবার যখন বলেই ফেলেছেন, তখন তাঁকে খাঁটি সোনা প্রমাণ করতেই হবে। কখনো স্বীকার করা যাবে না যে, এতে কোনো ধরনের খাদ আছে। উনি বললেন, রাজা মহাশয়। আমি খাঁটি সোনা চিনি। আমি বলছি— এই স্বর্ণে কোনো খাদ নেই।
এরপর নিজের বাড়িতে ফিরে বল্লভানন্দ স্থানীয় ব্যবসায়ী, স্বর্ণবোদ্ধা, সুবর্ণবণিক, গন্ধবণিক সকলকেই রাতারাতি হাত করে ফেললেন । কাউকে বিরাট অংকের মুদ্রা দিয়ে কাউকে ভবিষ্যতের সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার প্রলোভনে।
অন্যদিকে রাজা বল্লাল সেন স্থানীয় ব্যবসায়ী, স্বর্ণবোদ্ধা, সুবর্ণবণিক, গন্ধবণিকদের ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা তো বিষয়টি শুনেছি। স্বর্ণের মধ্যে খাদ থাকলে কি তোমরা বুঝতে পারি? তারা একবাক্যে বলল, আজ্ঞে পারি মহাশয়।
রাজা একজন পাইককে স্বর্ণের ঢেঁপুটি আনতে বললেন।
এই ঢেঁপুতে কোনো খাদ আছে কিনা তোমরা দেখে বলো।
তারা দেখেই একই কথা বলল। না মহাশয় এটিতে কোনো খাদ নেই।
রাজা বল্লাল এই উত্তরে সন্তুষ্ট হতে পারছেন না। তিনি বুঝতে পারছিলেন তারা কিছু একটা গোপন করতে চেষ্টা করছে।তিনি প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা তোমরা কিরূপে বুঝছ যে, এতে কোনো খাদ নেই?
তাদের কেউ কেউ বল্লভানন্দের চোখের দিকে চেয়ে তাৎক্ষণিক বলল, আমরা দেখামাত্র ভেজাল চিনতে পারি। বল্লভানন্দের ঠোঁটে হাসির রেখা।
রাজা বল্লাল সেন সবই বুঝছিলেন কিন্তু কী উপায়ে তাদের অপরাধ সনাক্ত করা যায়, তা বুঝে উঠতে পারছিলেন না।এবার তিনি পুত্র লক্ষণ সেনকে ডাকলেন, বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করলেন। বললেন, পুত্র তুমি প্রজ্ঞাবান ও যথেষ্ট পরিণত। অর্ধশতক বর্ষ তোমার অভিজ্ঞতা ও শরীরকে করেছে পোক্ত। রাজ্যের বেশ কিছু বিষয় নিয়ে আমি বিব্রত হচ্ছি, তুমিও জানো।
পিতা কী উদ্দেশ্যে আমাকে আপনি স্মরণ করেছেন।
সে সথাই বলতে চাই তোমাকে।
তুমিও জেনেছ ইতোমধ্যে, বল্লতানন্দ ও তার ভাগ্নের বিষয়টি। আমি চাই তাদের অপরাধটি প্রমাণ করতে ও শাস্তি দিতে।
পিতা, দুটি সুযোগ রয়েছে আপনার হাতে।
বল্লালের চোখে কৌতূহলি। বলো হে পুত্র। এ আমার মর্যাদার প্রশ্ন। আমি কীভাবে বল্লভানন্দকে শাস্তি দিতে পারি?
আসলে পিতা এ ধরনের সমস্যাগুলোর সমাধান করতে হলে তাদের পথই অনুসরণ করতে হবে আমাদের।
কী রকম? একরাশ প্রশ্ন নিয়ে তাকালেন রাজ্য বল্লাল সেন।
এ সব ব্যবসায়ী, সুবর্ণবণিক, গন্ধবণিককে তারা উৎকোচ দিয়ে হাত করে ফেলেছে। সুতরাং অন্য অঞ্চল থেকে আমরা সুবর্ণ বণিক নিয়ে আসব। আমরা কাশী থেকে আনতে পারি। শুধু তাই না…
তাহলে?
তারপর তাদের আমরাও উৎকোচ দেব। তাদের সঙ্গে যেন কোনো প্রকারে বল্লভানন্দের লোক দেখা করতে না পারে, সে ব্যবস্থা করব। আর আমরা কী ধরনের উত্তর চাই সেটিও তাদেরকে বলে দেব। আমরা যা চাই সেই উত্তর যদি তারা না দেয় তাহলে তাদের শাস্তি হবে গুরুতর— এই কথাটি যদি তারা জানে তবে সবাই আমাদের পছন্দমত কথাই বলবে।
বল্লাল সেন আনন্দে লাফিয়ে উঠলেন। সাব্বাশ পুত্র। তুমিই অভিজ্ঞ কূটনীতিক, ভবিষ্যতের রাজা।
বিকেলে সূর্যের ফিকে আলোয় বসল স্বর্ণ পরীক্ষার আয়োজন। কাশী থেকে আগত সুবর্ণবণিকদের বিশেষ ব্যবস্থায় রাখা হয়েছে। কোনোরকম যোগাযোগ যেন কেউ না করতে পারে সে ব্যবস্থা পাকা । সুবর্ণবণিকরা স্বর্ণ পরীক্ষা করে শেষপর্যন্ত ফলাফল বলেছে, সোনার মধ্যে খাদ রয়েছে।
সুতরাং যা হবার তাই হল। বল্লাল সেন বল্লভানন্দের ষোলো কোটি স্বর্ণমুদ্রা, তার ভাগ্নে ও সমস্ত আত্মীয়-স্বজনের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে রাজার তহবিল হিসেবে ঘোষণা করে দেওয়া হল। নির্বাসনে পাঠানো হলো বল্লভানন্দ আর তার ভাগ্নেকে।
বল্লাল সেন দরবারে আবার মনোযোগী হয়েছেন। দরবারি কবিদের নিয়ে খোসগল্পে মাতোয়ারা প্রতিদিন। কেউ তাঁর বিরুদ্ধে আর কথা বলার সাহস পায় না। কোন প্রকারে কী উপায়ে কে যে কখন শায়েস্তা হয়ে যায়, সবাই ভীষণ তটস্থ।সভা কবিরাও প্রশংসার বাণীতে বল্লালের প্রাণ-মনকে সরস-দরদি করে ফেলেছে। পদ্মিনীর আগমনও বেড়েছে এ তল্লাটে। এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি এবং সর্বসমক্ষে। মাস তিনেক পর এমনই এক সন্ধ্যায় লক্ষণ সেন বাবার সামনে এলেন। বললেন পিতা, আমি শুনেছি, আপনি রাজ্যের মুদ্রা দিয়ে হাড়ির কন্যা পদ্মিনীর জন্য স্বর্ণপিঁড়ি বানিয়েছেন, নির্দেশ দিয়েছেন সোনার পানভোজন পাত্র বানানোর। আবার আপনার দরবারি কর্মকর্তা, মান্ডলিক ও মহামান্ডলিকদের ভোজন করারও নির্দেশ দিয়েছেন? আর যারা পদ্মিনীর রান্না করা খাবার খাবে, তাদের সকলকে একই ধরনের স্বর্ণপিড়ি উপহার দেবেন— এ কথা কি ঠিক? লক্ষণ সেনর কণ্ঠে অসহিষ্ণু উচ্চতা।
রাজা বল্লাল পুত্রের দিকে নিশ্চুপ তাকিয়ে রইলেন। কথাগুলোর কোনোটিই মিথ্যে নয়। কিন্তু সন্তানের কাছে তো এতটা ছোট হওয়া সাজে না। ভাবলেন, অযথা রেগে চিৎকার দিয়ে উঠবেন, বরাবর যা করে থাকেন তিনি।কিন্তু এত সভাসদদের মাঝে তিনিও অপ্রস্তুত, মনে মনে ভাবলেন লক্ষণ সেনকে, কোনো ক্রমে প্রলোভন দেখিয়ে সভা থেকে বিদায় করবেন।
খুব শান্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কে বলেছে এইসব?
আমি কি মিথ্যে শুনেছি, এবার লক্ষণ আরো তেজোদীপ্ত, আরো প্রখর।
বল্লাল বীরশান্ত কণ্ঠে বললেন, পুত্র ! তুমি শান্ত হও। রাজ্যের প্রয়োজনে তুমি যে উপকার করেছো, আমি কৃতজ্ঞ।এই সাম্রাজ্যের ভবিয্যতের দায় ভার তোমার হাতেই আমি তুলে দিতে চাই ।
সভাসদরাও সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো রাজা বল্লালের এ একদম উচিত সিদ্ধান্ত । নিজের চালেই এবার পরাস্ত হলেন রাজা বল্লাল
লক্ষণ সেন স্মিত হাসি ছড়িয়ে, এবার দরবার ত্যাগ করলেন।
♦–♦♦–♦♦–♦♦–♦
❤ Support Us