- কে | রি | য়া | র-ক্যা | ম্পা | স ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
- সেপ্টেম্বর ৩, ২০২৩
ধারাবাহিক আত্মকথা : আমাদের বিদ্যানিকেতন
ব্রিটিশত্তোর ভারতের আধুনিকয়ানে সোভিয়েত রাশিয়ার অসামান্য অবদানের অন্যতম রূপকার ছিলেন পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু। তাঁর বিশ্বাস ছিল, প্রযুক্তি আর বিজ্ঞান চর্চা কৃষিনির্ভর ভারতকে স্বনির্ভর করে তুলবে, সাম্প্রদায়িকতা আর আধা সামন্তবাদের খপ্পর থেকে বের করে সম্মুখপথে এগিয়ে দেবে

মস্কো সিটি হল
আমিত্বহীনতার বৃত্তান্ত
উজবেকিস্তানের তাসখন্দ থেকে রাশিয়ার মস্কো, টানা একমাস তিনদিন, মধ্য এশিয়া আর ইউরোপ এশিয়ার মহাসন্ধিস্থল সফর করেছেন ভারতের অবহেলিত, উত্তরপূর্বের বৃহত্তম বেসরকারি শিক্ষা নিকেতনের সৃজনশীল প্রাণপুরুষ।১৯৯৫ সালে, সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের প্রথম পর্বে।একাধিক জাতিরাষ্ট্রের আলাদা সত্তার নির্মীয়মাণ মুহূর্তে।
ঐতিহ্যশীল মধ্যএশিয়া আর বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি রুশ ফেডারেশনের মৃত স্বপ্নের সমাধিতে কীভাবে জড়ো, একত্রিত হয়ে উঠবার চেষ্টা করেছে অন্যধরণের আশা আকাঙ্খা এবং নবীন প্রত্যাশা নিয়ে জাগৃতির প্রস্তুতি শুরু করেছে একটি ভূখণ্ড, তা বাইরের চোখ দিয়ে, অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে, কখনো বাঁকা, সন্দেহাচ্ছন্ন নয়নে পর্যবেক্ষণ করেছেন গরিবের প্রশ্নহীন শিক্ষা- হিতৈষী। পাশাপাশি, রুশ ও অন্যান্য জাতিসত্তার সামাজিক টানাপোড়েন, বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর নতুন অভিমুখ, তাঁদের কয়েক হাজার বছরের ইতিহাস, মিশ্রসভ্যতা, বিস্তীর্ণ এলাকায় কমিউনিস্টদের উত্থান আর পতনের গল্পের ভেতরের সত্য গল্প শোনালেন তিনি নিরপেক্ষ ইতিহাস পাঠকের নৈর্ব্যক্তিক ভঙ্গিতে।এখানে তিনি শুধু পর্যটক নন, ইতিহাস-খ্যাত বিদেশি পর্যটকদের মতোই বিশ্লেষণাত্মক আর প্রশ্নমুখর।
সম্পাদক
২২.০৮.২০২৩
• দশম পর্ব •
বিশাল উজবেক বিমান। মস্কোর দিকে উড়ছে। জানলা দিয়ে বাইরে আমার চোখ। চোখে আকাশের রকমফের ছবি, প্রতিছবি—নীল, ধূসর, মেঘলা। কোথাও ভাসমান তরঙ্গ। কোথাও তরঙ্গের ওপর পুঞ্জিভূত, ছড়ানো ছিটানো রাশি রাশি সাদা। মুর্হূমুর্হূ আকাশের রং বদলাচ্ছে, বদলে যাচ্ছে উড়ন্ত মেঘে তৈরি নিসর্গ, কখনো আঁকাবাঁকা নদীর মতো, কোথাও চেহারা তার পাহাড় কিংবা বড়ো বড়ো জলাশয়ের মতো।
মহাকাশের নিজস্ব রং কী ? কালো ? নীল ? গেরুরা ? তার রংবাজির চেহারা কী ? যতদূর জানি, আকাশের নিজের কোনো রং নেই। ঊর্দ্ধে, আরো ঊর্দ্ধে, সীমান্তহীন অন্ধকার শুধু। সূর্যের আলোকিত প্রচ্ছদের ছায়ায় সে রূপ বদলায়। মূলত সে অখণ্ড। অবিভাজ্য। মানুষ তার সীমাবদ্ধ ধান-ধারণা দিয়ে তাকে ভাগ করে নেয়। এই ভাগাভাগি স্থির থাকে না, রাষ্ট্রের মানচিত্র বদলের মতো তার মালিকানার সত্ত্ব আরোপিত পরিবর্তনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। ব্রিটিশ আমলে ভারতীয় আকাশের যে-চেহারা ছিল, তা আজ-অতীত। এখন তিন দেশে বিভক্ত। সোভিয়েত রাশিয়ার অখণ্ড আকাশও বিলুপ্ত।
অবিভক্ত সোভিয়েতের আকাশসীমার মালিক ছিল ১৫ রিপাবলিক। সে আকাশ পূর্ব ইউরোপ, বলেটিক আর মধ্য এশিয়া মধ্যে ভাগ হয়ে গেছে। একই ভূপ্রকৃতির ওপর ঝুলন্ত মহাকাশকে আলাদা করে নিয়েছে স্বাধীন আর স্বনিয়ন্ত্রিত দেশগুলি।
আওতাধীন রাষ্ট্র বদলালেও প্রকৃতির গন্তব্য, তার নীলাখেলা কি আদৌ বদল মানে ? মানুষের নিয়ম কানুনকে অতিক্রম করে সে বিরাজ করে নিজের অবিচ্ছিন্ন রাজত্বে। সোভিয়েত রাশিয়ার ভাঙনের পরেও তার আকাশ অখন্ডের স্বাভাবিক ধর্ম হারায়নি। আকাশ আকাশেই আছে।
তথাকথিত বিভাজিত আকাশপথে বিমান উড়ছে। নীচে ভাসছে পাহাড়, জলা, নির্জলা ভূখণ্ড। কোথাও জঙ্গল, মরুভূমি আর মানুষের বসতি। দিব্যি আকাশকে, ওপর থেকে নীচের লৌকিক ভুবনকে দেখছি, উপভোগ করছি অজেয় প্রকৃতির বাহাদুরি। দেখতে দেখত পৌনে চারঘন্টায় ৩৩৮৮ কিলোমিটার পেরিয়ে এলাম। ক্লান্তিহীন যাত্রা। বহুদেশীয় যাত্রীতে ঠাসা বিমানের একটি আসনও ফাঁকা নেই। সুকন্ঠী বিমান ঘোষিকা মোলায়েম উজবেক ও ইংরেজিতে জানিয়ে দিলেন, ফ্লাইট ল্যান্ড করবে, কিছুক্ষণের মধ্যে অমুক বিমান বন্দরে। খবর দিলেন বাইরের আবহাওয়ার। সবই নিয়মমাফিক। বাইরে বিশৃঙ্খলা নেই, অহেতুক তাড়াহুড়ো নেই, আগের দুর্ভেদ্য কানুন যেন অক্ষত। অব্যাহত বন্দরকর্মীদের গাম্ভীর্য।
ঝকঝকে পরিবেশ। অত্যাধুনিকের স্পর্শে আমি উজ্জীবিত। পুলকিত বোধ করছি, এলেম নতুন দেশে। যে-দেশকে ইতিহাসে, বইপত্রে আশৈশব দেখে এসেছি, আমি আজ হাজির তার হৃদবলয়ে। নবীণ বিস্ময় ছুঁয়ে আছে আমাকে। নিঃশব্দে মস্কোবাসীদের শারীরিক ভাষা পড়ছি। অতীতের রহস্যময়তা উধাও। হঠাৎ অবরুদ্ধ বাড়ির দরজা-জানলা খুলে দিলে যা হয়, এখানকার অবস্থাও তাই। সবদিকে মুক্ত হাওয়ার আলিঙ্গন।বিশাল দেশের প্রসস্ততম বিমান বন্দর। কর্মীদের চোখে মুখে উষ্ণ অভ্যর্থনার ইশারা। প্রায় সবাই ইউরোপীয় ঘরানায় অভ্যস্ত। প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর।
আগেই মস্কোর সঙ্গে খানিকটা যোগাযোগ ছিল আমার। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কনসালটেন্সির দায়িত্ব পালন করেছি, এখনও করতে হয়, স্থানীয় অনেকের কণ্ঠস্বর আর ভাবভঙ্গি তাই অজানা নয়। কোথাও থাকব, কী করে পৌছব, আসার আগেই জেনে এসেছি। অদেখা হলেও মস্কোর হাবভাব আমার খনিকটা চেনা। একসময়, বিশেষ করে মেডিকেল আর ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ভারতীয় ছাত্ররা দলে দলে রাশিয়ায় পড়তে আসত। সোভিয়েত সরকার তাদের বৃত্তি দিয়ে পড়াত। থাকার ব্যবস্থাও করে দিত, মস্কোতে প্যাট্রিক লুমুবা পিপলস ফ্রেন্টশিপ ইউনিভারসিটির ছাত্রবাসে। মস্কোর বাইরে, বিভিন্ন রিপাবলিকের যারা পড়তে যেত, তাদের খাতিরদারিতেও রাষ্ট্রের কার্পন্য ছিল না। এলাহি উদারতা আর উষ্ণ আলিঙ্গনে জড়িয়ে রাখত ভারতীয় ছাত্র-গবেষকদের।

পিপলস ফ্রেন্টশিপ ইউনিভারসিটি
ব্রিটিশত্তোর ভারতের আধুনিকয়ানে সোভিয়েত রাশিয়ার অসামান্য অবদানের অন্যতম রূপকার ছিলেন পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু। তাঁর বিশ্বাস ছিল, প্রযুক্তি আর বিজ্ঞান চর্চা কৃষিনির্ভর ভারতকে স্বনির্ভর করে তুলবে, সাম্প্রদায়িকতা আর আধা সামন্তবাদের খপ্পর থেকে বের করে সম্মুখপথে এগিয়ে দেবে। এখানে আমেরিকা-ব্রিটিশ বন্ধুত্বের চেয়ে সোভিয়েতের মিত্রতার আত্মিক ও অর্থনৈতিক ওজন অনেক বেশি, যা বিদেশনীতিকে দিশা দেখাবে। সোভিয়েত ইউনিয়ন নেহেরুর উষ্ণতাকে গুরুত্ব দিয়েছিল। আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র থেকে প্রযুক্তি সরবরাহে সবক্ষেত্রে ভারতের পাশে ছিল মস্কো। ভারত-পাক যুদ্ধ, চিন-ভারতের সঙ্ঘাত – এরকম সব সঙ্কটে মস্কোর সহযোগিতা ইতিহাস হয়ে আছে। নেহরু থেকে ইন্দিরা-রাজীব জমানা—এবং আজও এ গভীর সম্পর্কে কেউ ফাটল ধরাতে পারেনি। শুধু বৈষয়িক কারণে নয়, চিন্তার বিস্তারেও সোভিয়েত আর ভাঙ্গনত্তোর রাশিয়া ভারতের স্বাভাবিক বন্ধু। বন্ধুত্বের বহু পর্ব, বহু ধাপ। বহু স্থপতি। বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের রাজনৈতিক অবস্থান যাই হোক না কেন, ভারত-সোভিয়েতের হৃদ্যতা বাড়িয়ে তোলার প্রশ্নে সবাই অভিন্ন। বিভক্ত রাশিয়াও তাদের ভাগ হতে দেয়নি।
আজ ভাঙনোত্তর যে রাশিয়া আর তার রাজধানী মস্কোতে আমি সফরত (১৯৯৭), সে রাশিয়া কিংবা তার সব কর্মকান্ডের প্রাণকেন্দ্র আমার চেনা, কিছুটা অচেনা। তাকে চিনি ইতিহাস-পাঠের সূত্রে। আর, সে অচেনা নব জামানার পরিবর্তনের-ইঙ্গিতে।
ভাঙনের পরেও মস্কোর আয়তন বাড়ছে। বিদেশিদের আসা- যাওয়ার গতিও অবাধ। জনসংখ্যা বাড়ছে । বড়ো বড়ো বহুতল বাড়ির স্থাপত্যে—নির্মাণের যুগ-বদলের চিহ্ন। জীবন-যাত্রাও নানা খাতে বইছে। বাণিজ্য, লেখাপড়া আর একমুখী নয়। বৈচিত্র্য আসছে। যান্ত্রিকতা যা তার অগ্রগতিকে থমকে দিয়েছিল, নতুন বিন্যাসে সে জাগ্রত। তার চিত্তে, তার বৃত্তে প্রসারিত মুক্ত পরিসর। মুক্ত ভাবনা। মুক্ততার রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিভঙ্গি। আকারে, বিশাল হলেও, ঘন বসতির অসুখ স্পর্শ করেনি নগরায়নের উত্তরণকে। মস্কো আয়তনে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ মহানগর।
টোকিও, লন্ডন, সিঙ্গাপুর, বেঙ্গালুরু, সাংহাই, জাকার্তা আর দিল্লির পরেই তার অবস্থান। সে তুলনার জনবসতি অনেক কম, ঘনত্বহীন। শ্রমিক কর্মীরা বিশ্বের দেশটির নানা প্রান্তে ছড়িয়ে আছেন। পরিযায়ীদের সংখ্যা যৎসামান্য। বিভিন্ন অঞ্চলে শহর, উপশহর গড়ে উঠেছে। এসব শহরের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করেছে রেল, বিমান, মেট্রো রেল, সড়ক পরিবহণ। মস্কোকে মেট্রোরেলের শহর বলা যেতে পারে। রেল ব্যবস্থার উন্নয়ন আর রদবদল বিস্ময়কর।

মস্কোর মেট্রো রেল স্টেশন
বিভিন্ন রিপাবলিক আর পাশ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলি সমতা আর সাম্যবাদী স্বার্থে একদা সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে মসৃণ ও বৃহত্তর যোগাযোগ কাঠামো গড়ে তোলে। রাষ্ট্র বিভাজনের পরেও সে ব্যবস্থা অনেকটাই অব্যাহত। বরং কোথাও কোথাও উন্নতি হয়েছে, বর্হিবাণিজ্যকতা ও সমগোত্রীয় কূটনৈতিক সম্পর্ক বাড়িয়ে তুলতে।
মস্কোর প্রধান কথ্যভাষা রাশিয়ান, পাশাপাশি ইংরেজিও সচল। মাতৃভাষায় অবাধে কথা বলতে পারেন যে কোনো দেশের নাগরিকরা। আমিও ইংরেজিতে কাজ সেরে নিচ্ছি। তাসখন্দের মতো একদম বিচ্ছিন্ন বোধ করছি না।
আগে থেকেই খাওয়া থাকার ব্যবস্থা করে রেখেছি। বিমান বন্দর থেকে আমাকে একটি হস্টেলে নিয়ে যাবে অসমের কয়েকজন ছাত্র। তাদের গেস্ট হয়ে থাকব। খাওয়া-দাওয়াও হোস্টেলে করতে হবে। অতএব আনুষঙ্গিক ব্যয় হাতের নাগালে।
বিমান বন্দরে যথাসময়ে হাজির আসামের ছাত্ররা। তাদের কেউ পূর্ব পরিচিত, কেউ কেউ সদ্য চেনা। এয়ারপোর্টের বাইরে আসতেই এগিয়ে এলেন তাঁরা। আমি তাঁদের ফলো করছি। সামনেই গাড়ি। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের নিয়ে হন হন করে বেরিয়ে গেল যাত্রীযান। ফাঁকা রাস্তা। কোথাও সড়কজট নেই। প্রশস্ত পরিসর। সুশৃঙ্খল সেনার মতো গাছ-গাছালি। পল্লবিত ছায়ার ভেতর দিয়ে আকাশ উঁকি দিচ্ছে। সর্বত্র সবুজের ছাউনি। চারদিকে যথার্থ পরিচর্যা। আবর্জনা জমে থাকার উপায় নেই। মুহূর্তে সরিয়ে দিচ্ছেন পুরকর্মীরা।
রাস্তা থেকে দূরে, অদূরে এক ধাঁচের বাড়িঘর বদলে যাচ্ছে, বৈচিত্র্য এখন মস্কোর শান্তিপূর্ণ বসবাসের অন্যতম গন্তব্য। শৈশবে, নিয়মের কড়াকড়ি নিয়ে শুনেছি যা, তার সবই মিথ্যা মনে হচ্ছে। আধুনিক রাশিয়া হয়ে উঠছে অযান্ত্রিক। অকৃত্রিম। বিস্তার ঘটছে তার এককতা কেন্দ্রিক ক্ষমতার।
♦—♦♦—♦♦—♦♦—♦
লেখক: উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রথম বেসরকারি কলেজ গোষ্ঠী এন.ই.এফ-এর চেয়ারম্যান। গুয়াহাটির বাসিন্দা
আগের পর্ব পড়ুন: নবম পর্ব
❤ Support Us