Advertisement
  • কে | রি | য়া | র-ক্যা | ম্পা | স ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
  • সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২৩

ধারাবাহিক আত্মকথা : আমাদের বিদ্যানিকেতন

জাকির হোছেন্
ধারাবাহিক আত্মকথা : আমাদের বিদ্যানিকেতন

মস্কো মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়

আমিত্বহীনতার বৃত্তান্ত

 
স্বপ্ন আর নির্মাণের গল্প বলতে বলতে সামাজিক দায় আর দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দিলেন এন.ই.এফের রুপকার। সমাজ, দারিদ্র, সমাজের বঞ্চনা আর দুর্বিসহ যাপন কথা হয়ে উঠছে তাঁর কাহিনীর অসংখ্য চরিত্র। সজল বয়ানে, সহজিয়া ভাষায় শোনালেন তার যাদুবৃত্তান্তের লক্ষ্য আর অভিমুখ। আমিত্ব আর আত্মতাকে আড়াল করে, এরকম অশ্রুসিক্ত, সুদূঢ় উচ্চারণ সচরাচরে দেখা যায় না। স্বতন্ত্র তাঁর ভাষা, পুরোপুরি ন্যায়নিষ্ঠ, পর্যবেক্ষণের গাম্ভীর্য।
 

সম্পাদক
১৭.০৯.২০২৩

 

• পর্ব ১২ •

অচোনা মস্কোকে, খুব বেশি জানার সুযোগ হয়নি। বড়ো শহর। প্রশস্ত। আকারে ইউরোপের বহু দেশের সমান ! ঘন বসতি নেই। বাড়ির এক মুখো চেহারা আর নেই। সব বদলে যাচ্ছে। চওড়া। মসৃণ রাস্তা। যাতায়াতের ব্যাপক সুবিধা। আমার মতো আজনবি একা ঘুরতে পারে। অসুবিধা রুশ ভাষা জানি না। পড়তেও পারি না। রাস্তাঘাটে আসি বাড়ির নাম ফলক সবই আমার কাছে হিরুর মতো লাগল। যাব আসামের যে ছেলেটির গেস্ট হয়ে হস্টেলে থাকে, আমাকে নিয়ে ঘুরবে, তার সমস্ত কোথায়? ক্লাসরুম, ল্যাবে তার দিন কাটে, রাতেও সে ব্যস্ত। আমাকে একা শহরের নানা প্রান্তে, কখনো শহর থেকে দূরে ঘুরে বেড়াতে হল। মস্কোর মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, কখনো সরকার নিমন্ত্রিত বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে।
 
আগে বেছে বেছে ছাত্রদের ভর্তির সুযোগ দেওয়া হত, মূলত কমিউনিস্ট পন্থী, কমিউনিস্ট দেশগুলোর পড়ুয়াদের। ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকার ছাত্রদের সংখ্যা ছিল হাতে গোণা। সোভিযেত ইউনিয়ন তাদের সন্দেহের নজরে দেখা হত। এখন খুলে গেছে বাঁধন, যে কেউ, যে কোন দেশের ছাত্র শিক্ষকরা মস্কোয় পড়াশুনো আর প্রশিক্ষণের সুযোগ পান, নিঃখরচায় নয়, নিজের খরচে। তাদের জন্য সব দুয়ার উন্মুক্ত। জানলা দিয়ে মুক্ত হাওয়া ঢুকছে। এ হাওয়ার দেশ কোথায়? পশ্চিম, পূর্ব, দূর প্রাচ্য, আফ্রিকা – যে কোনো মুলুক হতে পারে।
 
দরজা জানলা যখন বদ্ধ থাকে, আটক-হাওয়ার একধবনের গন্ধে থাকে। সে গন্ধ দূরিভূত। বদলে দেশ-বিদেশের সুগন্ধ, সুশিক্ষা, বহুবিদ্যা অবাধে ঢুকছে। রাশিয়া আজ একধরনের জাতি রাষ্ট্র, রুশরা ছাড়াও অন্যভাষারাও আছেন। তবে রুশদের প্রাধান্য, প্রভাবও বেশি। যেমন রাজনীতিতে, তেমনি প্রশাসনের নানা স্তরে, ব্যবসা বাণিজ্যেও। শিক্ষাকেন্দ্রে বিদেশি শিক্ষকদের উপস্থিতি নগণ্য।
 
ঘুরতে ঘুরতে একদিন আর্ন্তজাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি হাজির। তৃতীয়, অনুন্নত বিশ্বের যে-কোনো শহরের মতো তার আয়তন। ভেতরে বড়ো বড়ো রাস্তা। খোলা মাঠে ঘাসের গালিচা। প্রাঙ্গন থেকে প্রাঙ্গনে পাহারারত বড়ো বড়ো বৃক্ষ। নানা দেশের ফুলে ভরা বাগিচা, কোথাও যান্ত্রিকতার বাড়াবাড়ি নেই। নিয়মমাফিক গাছ, ঘাস, মাঠ – সবই।
 
এরকম ক্যাম্পাস দেখে চোখ আমার ছানাবড়া। ভেতরে যাকিয়ে উঠল স্বপ্ন। স্বপ্নের নিঃশব্দ তরঙ্গ দেখে আমি অভিভূত, মোহাচ্ছন্ন – বিশ্ববিদ্যালয়, কিংবা বিদ্যা নিকেতন এভাবেই গড়তে হবে। বেসরকারি উদ্যোগে, অসমের মতো চড়া উৎরাই, সুযোগহীন কাজে অত্যাধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণ কিংবা অন্যধরনের শিক্ষা চত্বর গড়ে তোলা দুঃসাধ্য অভাব অর্থের। অভাব এক লপ্তি জমির। সরকারি সহযোগিতাও দূরঅস্ত। কিন্তু স্বপ্ন লালন করতে বাধা কোথায় ? স্বপ্নে আমরা পাহাড় ডিঙিয়ে থাকি, ডানাহীন আমার উড়ানও আকাশকুসুম কল্পনাকে ছুঁতে থাকল। স্বপ্ন দেখতে দেখতেই মানুষ নির্মাণ করে। নব নব আবিষ্কারে যোগ দেয়, পাড়ি দিতে চায় সূর্যে, সশরীরে চাঁদের সঙ্গে দেখা করে নির্বিঘ্নে স্বগ্রহে, স্বগ্রহে ফিরে আসে, আমার বিশ্বাস জীবনের আরেক নাম স্বপ্ন, স্বপ্নের রীতিগতি ভিন্ন, বাস্তব আর অবাস্তবকে ছুঁয়ে থাকা, নাটকীয় উত্থানের দিকে এগিয়ে যায়, কখনো সে আচমকা গন্তব্যে পৌঁছে যায়, পৌছানোর আগে পরে নিজেই ভাবতে পারে না। বা ভাবলেই অবাক হয়, যা হবার নয়, যা ছিল কল্পনার একটু রেখা চিহ্ন, সে টাই পরাবাস্তবকে স্পর্শ করে মহামান্য গ্রহণযোগ্য বাস্তব হয়ে উঠল। জন্ম মৃত্যুর  মাঝখানে বারবার আপাত অদৃশ্য যৌগিকের সঙ্গে দেখা হয় আমাদের। আমরা যাকে অলৌকিক অ্যাখ্যা দিয়ে বিস্ময় আর বিশ্বাসকে চওড়া করি, প্রকৃত অর্থে সেটা যৌকিকেরই অংশ। দিন, সপ্তাহ, মাস, বছরের পর বছর জুড়ে যা আমরা ভাবি, যে অধরাকে স্পর্শ করতে চাই, আমাদের ভেতরেই বসবাস। পাকা ফল যেমন মাধ্যাকর্ষণের জোরে নীচে পড়ে যায়, আমাদের লালিত স্বপ্নের সুন্দর, স্বপ্নের সহোদর আর সহযোগী যথাসময়ে দৃষ্টির সামনে, পেছনে, দূরে অদূরে ছিটকে পড়ে। আমরা তাকে বহুভাবে দেখি, বহুভাবে ব্যাখ্যা করি, নাটকীয় মনোহরকে নিয়ে মেতে উঠি, তারই পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ নির্দেশে কর্মসূচি সাজিয়ে তুলি, কর্মের বিন্যাস সাজাতে সাজাতে গেয়ে উঠি, স্বপ্ন আমার সফল আজ।
 

কেজিবির সদর দফতর

এই যে আমার তাসখন্দ সফর, মস্কো সফর একদিন আমার ভেতরে ঘুরঘুর করছিল। অর্থের ব্যবস্থা আর সুযোগ হাতের নাগালে যেই এল, নাটকীয় কৌশলে, সফর সূচি তৈরি করে তাসখন্দ আর মস্কোতে পৌঁছে গেল। আগেই বলেছি, রাশিয়ার কয়েকটি সংগানে কনসালটেন্সির কাজ করতাম। ভালো আয় হত। সে আয়ে নিজের খরচ চলত, আয়ের টাকা ব্যাঙ্কেও জমা পড়ত। এও আমার স্বপ্ন চর্যার অংশ। যে চর্চা আর চর্যা আমাকে লাগাতার সমৃদ্ধ করেছে, বহুমুখী সুন্দরকে উপহার দিয়েছে। অতএব বলতে বিলকুল বাধা নেই, স্বপ্ন নিয়ে রাশিয়া ঘুরতে গেছি। স্বপ্নের চোখে রুশ জনগণকে তাদের কাজকর্ম, তাদের শৃঙ্খলা, তাদের আতিথ্য অনুভব করেছি। শহরের বাইরেও ঘুরেছি। দেখেছি কমিউনিস্ট জামানার বড়ো বড়ো ইমারত। প্রতিষ্ঠান, প্রতিষ্ঠানগুলির অঙ্কও বহির্মুখ। মস্কো স্টেট ইউনিভারসিটি থেকে কেজেবি-র হেড কোয়াটারের বাইরে, পুলিসের প্রশাসনিক ভবন চত্বর কোথাও যাতায়াতে বিধি নিষেধ নেই। কে জি বি দফতর যেন কোনো ছোট দেশের সেক্রেটারিট। ভেতরে প্রবেশ নিষিদ্ধ। বহুতল বাড়ি। এক গেট থেকে আরেক গেটে বন্দুক হাতে পুলিস ও আধা সেনা। সেনাবাহিনী সেখানে নাক গলায় না। সোভিয়েত আমলে বিদেশি এজেন্টরা ঢুকতে পারত কিনা, জানা নেই। কড়া পাহারায় আজও সে আবৃত। একা যাইনি, নিয়ে গিয়েছিল আমার অসমবাসী বন্ধু যে- মেডিকেলে পড়ত। সে বলল, উপরে কে জে বি-র অফিস, মাটির তলায় সারিবদ্ধ গোয়েন্দা দফতর। একসময়, সারা বিশ্বে তারা চক্কর কাটত। সোভিয়েতের কমিউনিস্ট এজেন্টদের নির্বাচন করত। এজেন্টরা সরকারি টাকায় সোভিয়েত সফর করত। ছদ্মবেশী গোয়েন্দারা বিদেশের সংস্কৃতি কেন্দ্র, শিক্ষালয়ে ছড়ি ঘোরাত। বিনিময়ে মোটা টাকা, খ্যাতি, পুরস্কার। লেখক, কবি, চিত্রকর, গায়ক, শিক্ষাবিদরাই কে জে বি-র এজেন্টের কাজ করতেন। আমাদের অসমের খ্যাতিমান কে জে বি এজেন্টের তালিকাভুক্ত ছিলেন। সবাই সুপরিচিত, স্বনামধন্য মুখ। ওদের বিরুদ্ধে আঙুল তুলবে, এরকম সাহস ছিল না কারো, মনে মনে সম্ভবত অনেকেই ভাবতেন, কে জি বি-র এজেন্ট হওয়ার সুযোগ পেলে মন্দ হত না। রথ দেখবেন, কলা বেঁচবেন, অন্যদেরও সোভিযয়েত পন্থী মনোনীত করে সামাজিক সম্মান, পুরষ্কার, হয়তো বা টাকাকড়ির মুখ দেখবেন। [সোভিয়েত আমলে আমি ওই দেশে যাইনি। গেলে রটনার শিকার বনতে হত। ভাগ্য ভালো, স্পর্শ করার সুযোগ পায়নি। ছাত্র জামানায় কমিউনিস্টেরও দ্বারস্থ হইনি। মুক্ত মানুষ। সব সময় মুক্ত চিন্তার অনুজ। পরিস্থিতির চাপে, আজার আজন্ম ভাই হলেও হোথায় হোথায় সে আমার সঙ্গে পায়নি। নিজের মতো বড়ো হয়েছি, কী পড়ব, কোথায় পড়ব নিজেই ঠিক করছি। লেখাপড়া শেষ হলে, কী করব, সে ভাবনায় আমার নিজস্ব। ওই একই স্বনিবার্চিত নিয়ম মেনে রাশিয়ায় ভ্রমণ করি, ভারতের নানা প্রান্তে ঘুরে বেড়াই, উত্তর থেকে দক্ষিণে, গো বলয়ের প্রাণকেন্দ্রে। স্বাধীন চিন্তা, স্বাধীন কর্ম, মর্মে মর্মে স্বাধীনতার অনুভব আমাকে যা দিয়েছে, তা অলৌকিক নয়, লৌকিক এবং অতি অবশ্যই স্বপ্নজাত। সংক্ষেপে বলতেই পারি, স্বপ্ন আমার অনুজ, অগ্রজ স্বপ্নই সহগামী।

 

♦—♦♦—♦♦—♦♦—♦

 
লেখক: উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রথম বেসরকারি কলেজ গোষ্ঠী এন.ই.এফ-এর চেয়ারম্যান। গুয়াহাটির বাসিন্দা
 
আগের পর্ব পড়ুন: পর্ব ১১

ধারাবাহিক আত্মকথা : আমাদের বিদ্যানিকেতন


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!