Advertisement
  • কে | রি | য়া | র-ক্যা | ম্পা | স ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
  • নভেম্বর ৫, ২০২৩

ধারাবাহিক আত্মকথা: আমাদের বিদ্যানিকেতন

জাকির হোছেন্
ধারাবাহিক আত্মকথা: আমাদের বিদ্যানিকেতন

আমিত্বহীনতার বৃত্তান্ত

কেন কীভাবে, অসমের রাজধানী, উত্তরপূর্বের বূহত্তম শহর গুয়াহাটি তাঁর স্থায়ী ঠিকানা হয়ে উঠল, কোন্ লক্ষ্যকে ঘিরে ইতিপূর্বে কখনো সংক্ষেপে, কখনো বিশদভাবে, বিভিন্ন প্রসঙ্গে এসব বলেছেন শিক্ষাদরদী, সমাজসেবী ডঃ জাকির হোসেন ? তাঁর বলা, তাঁর ভাবনা এবং গ্রাহ্য বাস্তবের মধ্যে ফারাক নেই কোথাও, তবু তাঁর ধারণা, কাহিনি যথেষ্ট নয়, একমাত্রিক নয়, এবার তাই একনিষ্ঠ বয়ানে তুলে ধরলেন এনইএফ ( ন্যাশেনাল এডুকেশনাল ফাউন্ডেশন)- এর নির্মাণের চড়াই উতরাই এর কাহিনি। জাকির পেশাদার শিক্ষাসংগঠক, তাঁর পেশাদারিত্বের সঙ্গে ভাবনা, সঙ্ঘবদ্ধ জীবনবোধ এবং সামাজিক দায়িত্ববোধ সংযুক্ত। জন্ম যেহেতু মধ্যআয়ের কৃষক পরিবারে, যেহেতু প্রান্তিক মানুষকে প্রান্তিকতার বাইরে নিয়ে এসে তাঁদের ভেতরে, অলিন্দে, ছড়িয়ে দিতে চান আধুনিক শিক্ষা, যা কেবল পুঁথিগত নয়, চাকরিমুখী নয়, সব অর্থেই জীবনমুখী, জীবনদর্শী সে কারণে, তাঁর নিজের নির্মাণে, প্রত্যাশিত বিদ্যানিকেতনের প্রস্তুতি পর্বে ছায়াপাত করে যেমন আমাদের ঐতিহ্য, তেমনি সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ চক্রাকারে, ইশারায়, সরাসরিও ডাক দেয় নির্মীয়মাণ সমাজকে।

অভূতপূর্ব আশা জাগিয়ে উদ্দীপ্ত করে তোলে তারুণ্যকে। এরকম আমিত্বের উচ্ছেদ আর সৃষ্টির উচ্চারিত বিস্তার সচরাচর দেখা যায় না।

সম্পাদক

৫/১১/২০২৩

 

• পর্ব-১৫ •

জীবন হঠাৎ নাটকীয় মোড় নেয়, দুরকে অদুরে, কঠিন, কঠিনতর, কঠিনতমকে আমরা স্বপ্নের ভেতর দিয়ে, চোখে অদূশ্য গ্লাস লাগিয়ে সবাই নয়, কেউ কেউ দেখতে থাকি, বাস্তবের আবছা ছবি আঁকতে শুরু করি, এরই নাম সম্ভবত মানচিত্রহীন অভিপ্রায়ের সূচনা, যার শুরুতে, মধ্যবর্তী অবস্থানেও লড়াই কেবল লড়াই, লড়তে লড়তে তাই স্বপ্নজারিত সত্যের খোঁজ পেয়ে যাই।অন্যের কথা বলবার সুযোগ নেই, সাহসও নেই, নিজের ন্যারেটিভ কতটা গুছিয়ে বলতে পারবে, অনাড়ষ্ট, সংযত ভঙ্গিতে, এ ব্যাপারে পুরোপুরি সংশয়হীন নই। আমরা যা ভাবি, যার বাস্তবকে নিকটে দাঁড়িয়ে দেখি, স্পর্শ করি, সবসময় তার নিঁখুত চিত্র কি আঁকতে পারি ? না, অনেকক্ষেত্রেই আত্মদর্শনকে ভুলপ্রান্তি, অতিরঞ্জন এসে বিভ্রান্ত, রক্তহীন, কখনো কখনো নিরর্থক করে তেলা ? এ ব্যাপারে আমার বিষয় আশয় নিঃসঙ্কোচ নয়, যে ভাষা, যে যুক্তিময় আবেগের প্রয়োজন, দরকার যে পূর্ব পরিকল্পিত সিদ্ধান্ত, সে সব সাধ্যের বাইরে। সে জন্য কী তথ্যসংগ্রহে, কী ধারাবাহিকতা অক্ষুন্ন রাখতে অন্য একজন সুভানুধ্যায়ীর সাহায্য নিতে হচ্ছে। তার পীড়াপীড়ি আর পরিমিত উৎসাহ দৃশ্যগত আমিকে যাথাসম্ভব আড়ালে রেখে আমার বৃত্তান্ত, আমার হয়ে ওঠার গল্প বলিয়ে নিচ্ছে।সময়ের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।গল্পের নায়ক ব্যক্তি নয় শুধু, অসংখ্য চরিত্র, নগর ও গ্রাম, অসংখ্য প্রয়াত কিংবা জীবিত মুখ এই আত্মকথনের চরিত্র। যেমন কোকরাঝাড়ের ধূসরিত গ্রাম, গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়, কলেজ এবং এঁটো মাটির সড়ক, বিস্তীর্ণ ভূমি, ক্ষমতামত্ত ভাঙন মুখর ব্রহ্মপুত্র, ব্রহ্মপুত্রের শাখা প্রাশাখা, ঠিক তেমনি নিজামের হায়দরাবাদ, ওখানকার বিভিন্ন শিক্ষালয়, অভিভাবক অথবা সহোদর সহপাঠীর মতো  প্রাণিত করছে আমাকে, ঠিক সেরকম আমার জন্মাঞ্চলের ইতিহাস, জঙ্গলাকীর্ণ পারিপাশ্বিকও ঋদ্ধ করেছে।

 

কেউ কেউ আজান ফকির, শঙ্করদেব বা লালন ফকিরের মতো সজ্ঞানে উঁচিয়ে ধরেছেন লৌকিক সত্যকে, তাঁদেরই স্ববংশীয়, স্বদেশিদের অসংখ্যজন অজ্ঞাতসারে জীবনযাপনের সত্যকে ছড়িয়ে মহাজনের নৌকোয় পাড়ি দেন । ভিন্নতর  মোহনার উদ্দেশ্যে, সামিল হন শরীরি বা অশরীরি যাত্রায় । স্টেশন, পথ আলাদা হলেও গন্তব্য তাদের চেনা 

 

এখানে আমি কোনো ফ্যাক্টর নই, কিছুই নয়, সবই মহা প্রকূতির শাশ্বত অসীমের, মানুষের আবহমান সাধনার ফসল। নদী যেমন গড়ে এককূল ভাঙে, আরেককুল তার উর্বরতা ছড়িয়ে দেয় দিলখোলা অববাহিকায় আমার অনুভূত, অর্জিত ভাগ্যেও তেমনি যাদু ছোঁওয়া, পরিবেশ আর প্রতিবেশের নসিহত অসামান্য। বংশানুক্রমে তথাকথিত উচ্চ কিংবা মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম হলে, জীবনের স্রোত হয়তোবা অন্যখাতে বইত। চাকরির নিশ্চিত নিরাপত্তার সন্ধানে ছুটতে হত। যাপনের প্রকৃতি আর অস্পষ্ট গন্তব্য যে সৃষ্টিশীল মোহ, মোহ থেকে স্বপ্নের রেখা আর হরফ দেখিয়েছিল, সেটাই ভবিতব্য, বাস্তব হয়ে উঠল। খুঁজলে চাকরি মিলে যেত, মাসিক বেতন নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হত, সেই আপাত নিশ্চিত গার্হস্থ্য বোধকে উদয়ের আগেই খতম করে দিল টিঁকে থাকার সংগ্রাম, উদ্যোগের সন্ধান আর দিবারাত্রির রক্তক্ষরণ। এর নেপথ্যে  নির্দিষ্ট ছক নেই, কৌশল নেই, ভিন্ন কারো পরামর্শ নেই, যা আছে, তার অন্যনাম স্বাভাবিক জলস্রোত, যা জনস্রোতের কোলাহল, আকাঙ্খা থেকে সরাসরি উৎসারিত। একারনেই দাবি করছি, এই আত্মবৃত্তান্তে নির্দিষ্ট কোনো মুখ নেই, নির্বিশেষেই রাশি রাশি বেদনা, রাশি রাশি অভিপ্রায় তার কালহীন, মানচিত্রহীন চরিত্র।তাঁরা কারা, কোন জাতিভূক্ত, কোন অঞ্চলের সদস্য ? সহজভাবে বলতে হয়, বৃহত্তর অসমের বাসিন্দা, গ্রামীন ও শহরে নাগরিক। এসব পরিচিতি ক্ষণস্থায়ী এবং ক্রমাগত পরিবর্তনশীল বলেই দৃঢ়তার সঙ্গে বলা দরকার, মনুষ্যত্বই তাদের ধর্ম, চিরকাল বিশ্ব মানব হয়ে ওঠার সাধনায় তারা ব্যস্ত, নিয়োজিত। কেউ কেউ আজান ফকির, শঙ্করদেব বা লালন ফকিরের মতো সজ্ঞানে উঁচিয়ে ধরেছেন লৌকিক সত্যকে, তাঁদেরই স্ববংশীয়, স্বদেশিদের অসংখ্যজন অজ্ঞাতসারে জীবনযাপনের সত্যকে ছড়িয়ে মহাজনের নৌকোয় পাড়ি দেন। ভিন্নতর  মোহনার উদ্দেশ্যে, সামিল হন শরীরি বা অশরীরি যাত্রায়। স্টেশন, পথ আলাদা হলেও গন্তব্য তাদের চেনা বা অচেনা। এমনই এক ইস্টিশনের, (যা দূশ্যাতীত ও স্পর্শাতীত নয়) দিকে আমরা ছুটছি, যার রূপে, ছন্দস্পন্দে কম বেশি সবাই আলোড়িত। বিস্তিত। সজল অথবা হাসিমুখর।মৃত্যু এখানে তুচ্ছ, তুচ্ছ বূষ্টিমুখরিত ঝঞ্ঝা। জীবন তার কবলে পড়ে যখন থমকে যায়, তখনই তার সর্বশক্তিমান আলোরশ্মি সম্মুখে দাঁড়ায়ে এসে, আকার ইঙ্গিতে প্রত্যক্ষভাবেও নির্দেশ দেয়, উঠে দাঁড়াও, মেরুদণ্ড সোজা করে ছুটতে থাকো, জলযান, স্হলযানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে, দিকহীন প্রত্যয় অচিরে সঙ্গ দেবে তোমাকে, সে সব সংশয়, তীর্যক উপেক্ষা অতিক্রম করে অন্ধকারের ছন্দকে গুঁড়িয়ে পুড়তে পুড়তে ভস্ম হয়েও ফিনিক্স পাখি প্রসব করবে।

জীবনের ধারণক্ষমতা অনিঃশেষ। তার আরম্ভ আছে, শেষ নেই। এই যে আমি যে সব কর্ম করছি, তার শুরু একটি বিন্দুতে। এক বিশেষ  সময়ে। কিন্তু কর্মফলের বিরতি কোথায়? আমার পরেও, এই প্রজন্ম, এরকম প্রজন্মের পর প্রজন্মরা ইহজাগতিকতার, লাল আর সবুজের, বর্ণময় বৈচিত্র্যের নির্মাণের কোরাস গাইবে।

ব্যক্তির মৃত্যু হয়, প্রতিষ্ঠান মৃত্যুহীন। সে কালজয়ী, ভূগোলজয়ী। অধরা, অগোছালো অবস্থান নিয়ে জন্ম নেয়, শৈশব ও যৌবন পেরিয়ে অস্তাচলের মুহূর্তে শিখিয়ে যায় সংরাগের মন্ত্র। শুরুতে ক্ষীণ হলেও কালের পরিধি পরিমিত ও স্থায়িত্বকে গেঁথে রাখে অমিত্রাক্ষর অথবা অন্তরাময় সঙ্গীতে।

বিশ্বাস করতে, বলতে, ভাবতে ভালো লাগে, কালহীন আমাদের প্রতিটি কলস। ব্রিজের নীচের শূণ্যতার অবসান দাবি করে মানুষের নির্মাণ; তার ইচ্ছার শক্তি নিয়ন্ত্রণের বাইরে, সে যখন দীর্ঘতম গম্বুজে কারুকার্য স্থাপন করে শূণ্যের ওপর দাঁড়িয়ে। সে তখন ফরহাদ, শিরিনকেও মনে পড়ে না, রাজার প্রতি বিদ্রোহ আর প্রতিস্পর্ধা তার বার বার মনে পড়ে যায়। আমরা যখন ন্যাশেনাল এডুকেশনাল ফাউন্ডেশনের ইমারত গড়তে ব্যস্ত, তখন আমাদের শিরিন কোথায়? সামনে, পেছনে একটাই নিঃশর্ত উচ্চারণ, আনা-অল-হক, আমিই সত্য, আমি মনসুর, আমিই আল্ হাল্লজ।ভেতরে রচিত পংক্তি জপতে জপতে হায়দরাবাদ থেকে গৃহমুখী, অসমগামী ট্রেনে চাপলাম, স্বাভাবিক নিয়মে বাড়ি ফেরার কথা, ফেরা হল না, যাত্রা শেষ করে গুয়াহাটির পানবাজার স্টেশনে এসে থমকে দাঁড়াল ট্রেন, আমিও নেমে পড়লাম, ট্রেনের কিন্তু বিরতি আছে, আমার নিশ্চিত-অনিশ্চিত যাত্রার শেষ নেই এখনো। উজান বাইছি, দাঁড় টানছি, আশা করি লোকান্তরের পরেও আমার স্মৃতির ডালপালায় পাজরেও ক্ষণে ক্ষণে বেজে উঠবে দাঁড়ের সমবেত শব্দ।

♦—♦♦—♦♦—♦♦—♦

লেখক: উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রথম বেসরকারি কলেজ গোষ্ঠী এন.ই.এফ-এর চেয়ারম্যান। গুয়াহাটির বাসিন্দা

আগের পর্ব পড়ুন: পর্ব ১৪

 

 

 


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!