- কে | রি | য়া | র-ক্যা | ম্পা | স ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
- নভেম্বর ২৬, ২০২৩
ধারাবাহিক আত্মকথা: আমাদের বিদ্যানিকেতন
আমিত্বহীনতার বৃত্তান্ত
উত্তরপূর্বাঞ্চলের সবচেয়ে বড়ো ব্যাপ্ত আর ফলপ্রসূ শিক্ষা গোষ্ঠী এনইএফ এর স্থপতি জাকির হোসেন বিনম্র ভঙ্গি, গভীর আত্মপ্রত্যয় এবং সংশয়হীন বয়ানে এবার বলতে শুরু করলেন তাঁদের সাত বিদ্যানিকেতন গড়ে তোলার নাতিদীর্ঘ ইতিহাস আর ভবিষ্যতের লক্ষ্য। জাকিরের বিশ্বাস, পূর্বনির্ধারিত ভাগ্য নিয়ে কেউ জন্ম নেয় না । মানুষ, শ্রম আর নিষ্ঠায় এঁকে রাখে ললাট চিত্র, যার অন্য নাম নিয়তি অথবা তকদির ।
সম্পাদক
২৬/১১/২০২৩
• পর্ব-১৬ •
১৯৯৩ সাল পর্যন্ত আমাকে একা কখনো কখনো সমাজদরদীর সঙ্গে নিয়ে ব্যাপক লড়তে হয়েছে, বেসরকারি উদ্যোগে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে । গোড়ার দিককার বূত্তান্ত আগে কিছুটা বলেছি, আবার প্রসঙ্গত বলতে হচ্ছে । দূরশিক্ষা কর্মসূচি দিয়ে আমাদের প্রতিষ্ঠানের আরম্ভ । সঙ্গে হায়দরাবাদের যে অসমিয়া সহপাঠী ছিল, মাঝ পর্বে সে সরে গেল, কারণ ভুল বোঝাবুঝি নয়, কোনো ধরনের পারস্পরিক বিরোধ নয়, তার মনে হল, ভবিষ্যতহীন প্রচেষ্টায় আমরা অবতীর্ণ । কেউ অর্থ জোগাবে না, নিঃসংশয়ে এগিয়ে এসে সহযোগিতা করবে না । আমার বিশ্বাস ছিল, পুরোপুরি আলাদা । আশৈশব যে প্রত্যয় ও পরিবেশে মানুষ হয়েছি, সেখানকার প্রকূতি আমাকে শিক্ষা দিয়েছে, মানুষ একা নয়, তার লড়ািয়ের জেদ, অঙ্গীকার তাকে বাচতে শেখায় । সে জানে, খরস্রোত নদীর এক পাড় ভাঙে, গড়ে তোলে আরেকপার । গ্রামীণ সমাজে প্রকূতির সঙ্গে মানব প্রকূতির নৈকট্য অবিচ্ছেদ্য, প্রতিবছর বন্যায় লোকালয় তছনছ হয়ে যায়, ভাঙনে খসে পড়ে তীরবর্তী অঞ্চল, তবু মানুষ তার জীবন নৌকার হাল ধরে রাখে, এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় বসতি স্থাপন করে জেগে থাকার, বেঁচে থাকবার স্বপ্ন দেখতে দেখতে । তাঁদের যাপনের দিবারাত্রি যেমন স্বপ্নময়, তেমনি দুঃস্বপ্নে রচিত । গ্রামীণ কূষক স্বপ্নের ভেতরে, স্বপ্নের বাইরেও স্বাভাবিক । দুঃস্বপ্ন অতিক্রম করে নির্মাণের চুন, সুরকি, ইট কিংবা লতাপাতার ছাউনি দিয়ে, শৈশব থেকে মূত্যু পর্যন্ত, সাহস আর দুঃসাহসের ইমারত গড়ে তোলে । মূত্যুর পরেও তারা বেঁচে থাকে, তাদের দিনযাপনে, তাদের বিশ্বাসের রসদে তৈরি হয় উত্তরাধিকারা । প্রবল দারিদ্যও হার মানে এসব লড়াকুর সামনে । বংশানুক্রমে আমি কূষিভিত্তিক সমাজের পরম্পরার সন্তান । নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে । আমার ধমনীতে সহিষ্ণু, পরোপকারী পূর্বপুরুষের রক্ত । কখনো ঐতিহ্য চ্যুত হইনি । যতদূর সম্ভব তাদের অর্জিত লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা ও গৌরবকে অক্ষুন্ন রাখার চেষ্টা করি । শিক্ষানিকেতন গনতে গিয়ে হেলে চাষীদের মনোবলের দিকে তাকিয়েছি, খতিয়ে দেখেছি সামাজিক অতীতকে । ওই দূষ্টি, ওই আত্মবীক্ষণ আজও আমার সম্বল ।
হায়দরাবাদ মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সহপাঠী গুয়াহাটির পরিবেশে বড়ো হয়েছে । বিশাল বিত্তবান পরিবারের সন্তান, এরকম নয় । মধ্য আয়ের পরিসর ছিল তার চারপাশে । ফাঁপা নাগরিক কৌশল ও আত্মস্বার্থ ভালো বুঝতে । যৌথ লড়াই, যৌথ ত্যাগের যে হিম্মতের দরকার, তা ছিল না বলেই সে মিলিত প্রচেষ্টায় নির্মিত প্রকল্প ছেড়ে কেটে পড়ল । তার আচরণে হতাশ হইনি । একক চেষ্টার পরিধিকে বাড়িয়ে তুললাম । ব্যক্তিগত আয়ের পথ সীমাবদ্ধ । দেশ বিদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কনসালটেন্সি করি ।
কখনো বেহিসেবি ছিলাম না, সঞ্চয় করতে সবসময় ভালোবাসি । সঞ্চয়ের অর্থেই আমার কাজাকিস্তান ও রাশিয়া সফর । ১৯৯৫ সালে । ওই সফর আমাকে আরো আত্মপ্রত্যয়ী করে তোলে । দুই দেশের একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখে মনে হল, উত্তর পূর্বের অসমে বহুমুখী বেসরকারি শিক্ষা নিকেতন গড়ে তেলা সম্ভব । ফিরে এসে অনেকের সঙ্গে কথা বললাম, বিশেষ সাড়া পাইনি । সিদ্ধান্ত নিলাম, একক উদ্যোগে শুরু করে দিলে বহু হাত এসে জড়ো হবে ।
১৯৯৭ সালে এনইএফ জুনিয়র কলেজ স্থাপিত হল । গুয়াহাটিতে তখনো বেসরকারি মহাবিদ্যালয়ের উপস্থিতি প্রায় নেই । অনেকেই চেষ্টা করেছিলেন, যাঁদের পরিকাঠামো রয়েছে, রয়েছে ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল, লালফিতের বন্ধন খুলতে তাঁদের প্রয়াস কেন জানি সাফল্য দেখতে পায়নি । কেন ? রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুকুল নয় বলে ? কারণ খতিয়ে দেখার আমার তখন অবকাশ কোথায় ? নিজের যুক্তি, বিবেক আর বাস্তব বোধের ওপর দাঁড়িয়ে ভাড়া বাড়িতে এনইএফ পঠন পাঠন প্রক্রিয়া শুরু হল । ছাত্র শিক্ষকের সংখ্যা সীমিত । এনইএফ পঠন পাঠন প্রক্রিয়া শুরু হল । ছাত্র শিক্ষকের সংখ্যা সীমিত ।
বিভিন্ন সূত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন অর্জনের চেষ্টা করলাম । গুয়াহাটি ইউনিভার্সিটি সরাসরি বিমুখ করল । অন্যান্য রাজ্যে উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বললাম, সংশয়ে প্রায় সবাই পিছিয়ে গেল ।
অবাক হবার মতো ঘটনা । ১৯৯৭ সালে, আমার প্ৰথম সন্তান, আমার ছেলের জন্ম । তার জ্ন্মদিনেই ভেসে এল অন্য এক সুসংবাদ, হিমাচল প্রদেশ বিশ্ববিদ্যালয় এনইএইএফকে ডিসটেন্স এডুকেশন কোর্স খোলার অনুমতি দিয়েছে ।
শিল্প বিপ্লবের আগে, অন্ধ বিশ্বাসের বাইরে বের হতে পারেনি পশ্চিমের বিয়োগান্তিক কিংবা সানন্দ চেতনা । শেক্সপিয়ার ছিন্ন করে দিলেন অতীতের এবং তাঁর সমসাময়িক ভাবনা চিন্তাকে । নাটকে, কবিতায় সরাসরি ঘোষণা করলেন, মানুষ তাঁর ভাগ্য নিয়ন্তা
প্রকৃতি আর প্রচেষ্টার এ এক চমৎকার ফসল । মানব প্রকূতিকে ছুঁয়ে জগতে প্রবেশ করল আমার ছেলে । আর তার বাবার পরিশ্রম ও সংকল্প স্পর্শ করল দীর্ঘায়ত প্রচেষ্টা । এই সাফল্যের নাম কী ? ঘটনা আর আত্মবিশ্বাসের ব্যাপ্তি না নিছক ভাগ্যযোগ ?
মানুষের ধর্মবোধে, পুরাণকথায় ভাগ্যলিখনকে প্রশ্নহীন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি । কর্মের সঙ্গে, শ্রমের সঙ্গে, ত্যাগের সঙ্গে ভাগ্যের যোগ বিয়োগের সম্পর্ক নিরবিচ্ছিন্ন । প্রচীনকালে, গ্রিকরা বিশ্বাস করতেন, অদূশ্য কোনো এক শক্তি নিয়ন্ত্রণ করে অপরিহার্য নিয়তিকে । হোমারের ইলিয়াড বা গ্রিক নাটক এরকম বিশ্বাসকে ঘিরে মর্মান্তিকতা চিত্রিত হতে দেখি আমরা । শিল্প বিপ্লবের আগে, অন্ধ বিশ্বাসের বাইরে বের হতে পারেনি পশ্চিমের বিয়োগান্তিক কিংবা সানন্দ চেতনা । শেক্সপিয়ার ছিন্ন করে দিলেন অতীতের এবং তাঁর সমসাময়িক ভাবনা চিন্তাকে । নাটকে, কবিতায় সরাসরি ঘোষণা করলেন, মানুষ তাঁর ভাগ্য নিয়ন্তা । তার কর্ম, তার সাধনা নির্মান করে দেয় ভাগ্যের গতিপথ । শেক্সপিরিয়ান ট্যাজেডি কর্মদোষের পরিণামে । গড়ে তোলে তার অনিবার্য শেষ দূশ্য । এই বিশ্বাস কোন্ সূত্রে লালিত হয়েছিল শেক্সপিয়ার মানসে ? প্রাচ্যের ধারণা কি প্রাণিত করেছিল স্রষ্টার মতো স্রষ্টাকে । ইসলাম ও ভারতীয় চিন্তায় কতটা প্রভাবিত তাঁর কালোত্তীর্ণ সূষ্টি ? এ বিষয়ে আমার লেখাপড়া সীমিত ।
কেবল এইটুকু বলতে পারি, রামায়ন ও মহাভারতের মতো মহাকাব্য মানুষের প্রচেষ্টা আর অনুশীলনকে অশেষ মূল্য দিয়েছি । সততা ও চেষ্টার জোরে রামচন্দ্র রাবণকে বধ করে উদ্বার করেছিলেন সীতাকে । রামায়ণের ফসল পূর্ব নির্ধারিত নয় । মহাভারতও মানবিক যুক্তি ও কর্মকে একত্রিত করে ধনধান্যে, পুষ্পে ঋদ্ধ করেছে আমাদের । ইসলাম একইভাবে মানুষকেই তার ভাগ্য রচয়িতার আসনে বসিয়ে রেখেছে । তকদির যুক্তিময়তা আসলে বসিয়ে রেখেছে । তকদির যুক্তিময়তা আর পরিশ্রমের ফসল ।
ব্যক্তিগতভাবে আমি ঘটনাচক্রে বিশ্বাসী । পরিশ্রম, ত্যাগ আর হিস্যব কষে সম্মুখে পা ফেলি ।
বিনয়ের সঙ্গে বলছি, সহজে হার মানি না, পালিয়ে যেতে শিখিনি । ব্যক্তি কিংবা সমষ্টিকে কথা দিলে, তা যথাসম্ভব পালন করার চেষ্টা করি । এটাই আমার ভাগ্যলেখা । যে সহজপথে আসে না, আসে স্বনির্মিত পথে, সুনির্দিষ্ট গন্তব্যের অভিমুখে এগোতে থাকে । দূরশিক্ষা কর্মসূচি, এনইএফ জুনিয়র কলেজ এনইএফ ল কলেজ যে সাত শিক্ষাঙ্গন আমরা তৈরি করেছি, তাদের ক্যাম্পাসে আবেগ, যুক্তি এবং কর্মযোগকে হেয় করা অসমম্ভব ।
নব্বই এর দশকের গোড়ার দিকে গুয়াহাটিতে জুনিয়র কলেজের নির্মান ও পরিচালনা ছিল পর্বতারোহনের মতো কষ্টসাধ্য ঝুঁকি । তখনকার অসম সরকারের মনোভাব অনড় । সেকেলে । সরকারি আমলারা আমাদের আর্জিকে উড়িয়ে দিলেন না । কলেজের পরিকাঠামো দুর্বল । যোগ্য শিক্ষকের অভাব । সবদিক থেকে হাওয়া প্রতিকূল । এরকম আবহে আমার একান্ত সঙ্গী আমার জেদ আর সংশয়হীন সঙ্কল্প । একবছরের মধ্যে সুফলা হয়ে ওঠে তরুণ গাছগাছালি । মধ্যপ্রদেশের ঘাসিদাস বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের নিষ্ঠা ও যোগ্যতা যাচাই করে তাদের স্টাডি সেন্টার খোলার সম্মতি জোগাল । আমরা পুলকিত । উদ্বুদ্ধ । বিবিএ আর বিসিএ কোর্স চালু করলাম । সমাজ আর স্থানীয় শিক্ষা প্রশাসনের দূষ্টির ভাঁজ হঠাৎ উধাও । বহু হাত আমাদের প্রচেষ্টাকে স্পর্শ করল । ওই স্পর্শানুভূতি শিহরিত, উৎসাহিত করে এখনো ।
♦—♦♦—♦♦—♦♦—♦
লেখক: উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রথম বেসরকারি কলেজ গোষ্ঠী এন.ই.এফ-এর চেয়ারম্যান। গুয়াহাটির বাসিন্দা
আগের পর্ব পড়ুন: পর্ব ১৫
❤ Support Us