- কে | রি | য়া | র-ক্যা | ম্পা | স ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
- জানুয়ারি ২১, ২০২৪
ধারাবাহিক আত্মকথা: আমাদের বিদ্যানিকেতন
আমিত্বহীনতার বৃত্তান্ত
পূর্বলিখিত ভাগ্য নয়, ঘটনা – শ্রম – নিষ্ঠা – স্বচ্ছতা যে-কোনো ব্যক্তিপ্রতিভা অথবা সংগঠনের সাফল্যের উৎস। এরকম শর্তযাপিত সত্যকে সামনে রেখে, প্রাচ্য-প্রতীচ্যের প্রচলিত, প্রায়োগিক দর্শন ও সমাজত্ত্বের যুক্তি ছড়িয়ে, তাঁদের সংস্থার নির্মাণ আর বিস্তার খতিয়ে দেখলেন ‘এন.ই.এফ’-এর স্থপতি।
সম্পাদক | ২১.১.২০২৪
• পর্ব-২১ •
আমাদের দক্ষতা, আমাদের সাফল্য, আমাদের ধারাবাহিক পরিশ্রম আর নিষ্ঠা নিয়ে আমরা বিনম্র কিন্তু আত্মতুষ্ট নই, আরো অনেক দূর যেতে হবে, পাহাড় ডিঙিয়ে, কাঁটা পেরিয়ে। দরকার অনেককালের হাতের সঙ্ঘবদ্ধ প্রচেষ্টা, সামাজিক সমর্থন আর নবপ্রজন্মের সদর্থক সংযোগ। এ ব্যাপারে নিজেকে কিছুটা ভাগ্যবান মনে হয়। প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন, ব্যক্তিবিশেষের ভাগ্য অন্য কেউ গড়ে দেয় না, তা নিজকেই তৈরি করতে হয়। ভাগ্যের নানারকম ব্যাখ্যা আছে। কারও কারও ধারণা, অদৃশ্য শক্তি জন্মের আগেই মানুষের একদিক ঠিক দেয়। আমি বিষয়টাকে অন্যভাবে দেখি— তদবির ছাড়া একদিকের (ভাগ) নির্মাণ কি সম্ভব? একটি জনপ্রিয় লৌকিক বচন এ ব্যাপারে স্মরণ করা যেতে পারে, কান্দে পুতে দুধ খায়, খিদে পেলে শিশু কাঁদে, তখনই জননী তাকে স্তনের দুগ্ধ দিয়ে তার খিদে নিবারণে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন।
ভারতীয় দর্শনে, খ্রিস্টীয় বিশ্বাসে, ইসলামের ভাগ্য বিশ্লেষণেও নানারকম মতামত ছড়িয়ে রয়েছে। কেউ কেউ অদৃষ্টবাদী। ভাগ্যলেখার (নসিব) অবু কর্মের সংযোগকে আলাদা করা কি সম্ভব আদৌ বাস্তব সম্মত? কর্মবাদে যাদের আস্থা গভীর, যাঁরা বিশ্বাস করেন যে, মানুষ নিজেই তার ভাগ্যের নিযন্তা, তারা উঁচু স্তর থেকে সাধারণ স্তরেও শ্রম তার নিষ্ঠাকে প্রত্যাশা পূরণের সেরা রাস্তা বলে চিহ্নিত করতে অভ্যস্ত। এখানে ব্যক্তির ইচ্ছার জয় সর্বগামী। কবি মহম্মদ ইকবাল ব্যক্তি বিশেষের অভিপ্রায়কে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে বলেছিলেন, খুদি কো কর্ বুলন্দ ইতনা, কে হর তকদির সে পহলে, খোদা বন্দে সে ইয়ে, বাতা তেরি রেজা কেয়া হ্যায়… নিজের আত্মকে ততটাই প্রশস্ত করে যেন ভাগ্য তৈরির করার আগে খোদা যেন ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করতে বাধ্য হন যে, বল্ তোর ইচ্ছে কী?
ইসলাম, অন্যান্য ধর্মেও অদৃষ্টবাদকে প্রশ্নহীন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। বলা হয়েছে, অভিপ্রায় আর কর্মই ভাগ্যের নিয়ন্ত্রক। মহম্মদ ইকবাল তকদিব-এর নির্মাণের ধারণায় পূর্বলেখনকে আমল দেননি, দিয়েছে ব্যক্তির অভিপ্রায় আর কর্মকে। আমি সামান্য মানুষ, আমার বিশ্বাস, – অভিপ্রায়, পরিকল্পনা আর নিরন্তর চেষ্টা ও পরিশ্রমের সাহায্যে কর্মের বুনিয়াদ তৈরি হয়, গড়ে ওঠে আত্মবিশ্বাসের শক্তি। রবীন্দ্রনাথ খুদে প্রজাপতিকেও ক্ষুদ্র ভাবেননি, বলেছিলেন আপন বলে সে বলীয়ান, ডানা মেলে সে উড়ে বেড়ায় আপনার জোরে। বিশাল ব্রহ্মাণ্ডে আমিও এক প্রজাপতি। স্বপ্ন দেখেছি। ঘটনাক্রম, সমাজের ইচ্ছা আর শুভানুধ্যায়ীদের পরামর্শ আমার লক্ষ্য আর কর্মকে সবসময় সমর্থন করেছে। সময় আর বন্ধুদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। [দূর শিক্ষা কর্মসূচি দিয়ে কোনো বৃহৎ শিক্ষানিকনের যাত্রা শুরু হয়েছিল, এরকম দৃষ্টান্ত সম্ভবত বিরল।] কী করব, কেন করব, ভবিষ্যতের পরিকল্পনা কী, অভিমুখ কোনদিকে, এসব নিয়ে কোথাও, কখনো সংশয় তৈরি হয়নি। গত শতকের, ৯০-এর দশকের শেষ পর্বে ওই যে আমাদের আরম্ভ, ওই যে খসড়া তৈরি হয়েছিল, আজ তা বিবর্তিত হতে হতে নির্দিষ্ট চেহারা ধারণা করেছে। এখানে আমার ভূমিকার পাশাপাশি সমাজের দাবি ও প্রত্যাশা বিলকুল নগণ্য নয়। সমাজ চাইছিল, তার আকাঙ্খা পূর্ণ হোক। গড়ে উঠুক বহুমাত্রিক এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যেখানে আমাদের ছেলেমেয়েরা বহুবর্ণে রঞ্জিত হয়ে উঠবে, নিজেদের ভবিষ্যত খুঁজে পাবে। আমি তাদের আকাঙ্খা আর আত্মনির্মাণের প্রস্তুতির অন্যরকম রূপকার হতে পেরে প্রগাঢ় আনন্দ অনুভব করছি। আমাদের আরব্ধ কর্মসূচি সমাপ্ত হয়নি, তার অপরিহার্য প্রস্তুতি অব্য়াহত। শেষ কোথায় কে জানে। বিধাতা আমাকে শক্তি যুগিয়েছেন, আমি স্বনির্ভির হলেও নির্বিশেষের ইচ্ছা আর অনিচ্ছাকে গুরুত্ব দিয়ে হাঁটছি।
পথ আমার স্বনির্বাচিত, পথের বিস্তার স্বরচিত, এখানে পূর্বলিখনের নির্দেশ নেই, চিহ্ন নেই, পথ পথকে তৈরি করছে, এগিয়েও নিয়ে যাচ্ছে, চিন্তা, ভাবনা আর কর্মের সংযোগ এক্ষেত্রে অবিচ্ছিন্ন, অবিচ্ছেদ্য। সমাজ বিজ্ঞান আর প্রায়োগিক দর্শনের একটি সুস্পষ্ট প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে বলেই সম্ভবত, বহুমুখী বিদ্যাচর্চার ৮টি ক্যাম্পাস গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে। ব্রহ্মপুত্রের উত্তরতীরে প্রকৃতি আর আধুনিক নগরায়নের সমন্বয়ে, সংস্পর্শে আয়ুর্বেদিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের নির্মাণ শুরু হয়েছে। কঠিন কাজ। সরকার ও সমাজ আমাদের সবধরনের সহায়তা করছে। প্রাচীন-ভারত, সেকালের গ্রিস আর মধ্যযুগীয় আরবদের চিকিৎসা বিদ্যা এবং স্বাস্থ্য পরিষেবা সময়-উপযোগী প্রতিষ্ঠান আমরা গড়ে তুলতে চাইছি। আশা করি, যে রকম ভাবছি, পরিকল্পিত প্রত্যাশাও সিদ্ধান্ত সেভাবেই পূর্ণ, পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে। এরকম স্বপ্ন আর সমাজের অভিপ্রায়কে সঙ্গে নিয়ে, দু দশকের মধ্যে আমরাই আমাদের প্রতিদ্বন্ধী হয়ে ওঠার শক্তি অর্জন করেছি। কালোক্রমে সরাসরি একই প্রতিষ্ঠানের ছত্রতলে গড়ে উঠেছে আটটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। পঠন-পাঠনে আমাদের গুণগত অবস্থান এবং সর্বভারতীয় স্তরে আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি, তা শিক্ষামহলে সুবিদিত, বিশেষভাবে চর্চিত। সব ছাত্রকে জায়গা দিতে পারি না। মেধার ভিত্তিতে তাদের বেছে নেওয়া হয়, প্রতিটি শিক্ষাঞ্চলেই একই ব্যবস্থা, নিয়মের তারতম্য হয় না। দ্বিতীয়ত, পঠন-প্রক্রিয়া ছাড়াও চারিত্রিক গঠন ও নিয়মানুবর্তিতাকে আমরা বিশেষ গুরুত্ব দিই। গড়তে চাই ছাত্রছাত্রীর সৃজনশীল, অর্থপূর্ণ ভবিষ্যৎ। তৃতীয়ত, আমাদের বিদ্যাদাতাদের নিষ্ঠা আর যোগ্যতা প্রশ্নাতীত। ছাত্র-শিক্ষকের দৈনন্দিন মতবিনিময়ের পরিধি বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে আলাদা। বহুমতের সহযোগী আমিও, এক্ষেত্রে পৃষ্ঠপোষক নই, প্রশাসক নই, ছাত্রছাত্রীদের মতোই একজন শিক্ষানবিশ।
এন. ই. এফ- গ্রুপের সরাশরি আওতায় গুয়াহাটি নিম্ন ও মধ্য অসমে যে-সব বিদ্যায়ন পরিচালিত হয়, সেগুলি যে ছাত্র কতটা ব্যতিক্রম, তা নিজে বলব না, বলবে ভবিষ্যৎ এবং সমাজের সচেতন অংশ। আমি কেবল দু’দশকে নির্মিত প্রতিষ্ঠানের তালিকা পেশ করে এই ২১ পর্ব শেষ করব। পাঠকের সুবিধার্থে আমাদের ট্রাস্টের নেতৃত্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলির নাম আর পঠন-পাঠনের বৈচিত্র উল্লেখ করছি।
- ১। এন. ই. এফ ল’ কলেজ, গুয়াহাটি। গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয় ও বার কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া অনুমোদিত।
- ২। এন. ই. এফ কলেজ অফ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড টেকনোলজি, গুয়াহাটি, ডিব্রুগড় বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদিত।
- ৩। এন. ই. এফ কলেজ (পিজি), গুয়াহাটি। গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং অসম সরকার অনুমোদিত আর স্বীকৃত।
- ৪। এন. ই. এফ কলেজ অফ ফারমাসি। গুয়াহাটি এস এস ইউ এইচ এস এবং ফারমাসি কাউন্সিল – অনুমোদিত।
- ৫। এন. ই. এফ কলেজ অফ ফারমাসিকেল ইডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ, নঁওগা। ফারমাসি কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া অনুমোদিত।
- ৬। এন. ই. এফ কলেজ অফ হেলথ সায়েন্স, গুয়াহাটি। অসম সরকার অনুমোদিত।
- ৭। এন. ই. এফ ইন্সটিটিউট অফ নার্সিং, গুয়াহাটি। রাজ্য নার্সিং কাউন্সিল এবং অসম সরকারের অনুমোদিত। স্বীকৃত।
- ৮। ইকরা একাডেমি অফ নার্সিং, নঁওগা। অসম সরকার অনুমোদিত।
আমি বিশ্বাস করি, সত্যের প্রাথমিক শর্ত সার্বিক স্বচ্ছতা। যে কোনো প্রতিষ্ঠান নির্মাণের আগে আমরা সামাজিক সথ্য আর সরকারি নিয়মকানুনকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিই, প্রতিটি ধাপে তা প্রয়োগ করি। আমাদের এমন কোনো প্রতিষ্ঠান নেই, যা সরকার ও সংলিস্ট সংস্থার স্বীকৃতি আর অনুমোদন ছাড়া ছাড়া তৈরি হয়েছে। আমার ধারণা, বেসরকারি প্রতিটি সংস্থা, প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে সামাজিক সমর্থন ও অনুমোদন নিতে হবে। তা হলে কাজ আর অনুশাসনের মধ্যে সহজবোধ্য সমন্বয় তৈরি হয়, গড়ে ওঠে সদর্থক ব্যবস্থা তার ব্যবস্থাপনা নির্মেদ গতি। এ ব্যাপারে আমাদের ফেকাল্টি মেম্বার্স, পরিচালনা সমিতি এবং অন্যান্য কর্মীদের দায় আৎ মনের সায় একে – অন্যের পরিপূরক। টিমওর্য়াক বলতে যা বোঝায়, সেখানে সবাই ঐক্যবদ্ধ। সঙ্ঘধর্মের সংকল্পে আত্মনিবেদিত।
ক্রমশ…
♦—♦♦—♦♦—♦♦—♦
লেখক: উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রথম বেসরকারি কলেজ গোষ্ঠী এন.ই.এফ-এর চেয়ারম্যান। গুয়াহাটির বাসিন্দা
আগের পর্ব পড়ুন: পর্ব-২০
❤ Support Us