- কে | রি | য়া | র-ক্যা | ম্পা | স ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
- মার্চ ১০, ২০২৪
ধারাবাহিক আত্মকথা: আমাদের বিদ্যানিকেতন

চিত্রকর্ম: জ্যাকব লরেন্স
আমিত্বহীনতার বৃত্তান্ত
সাবালর্টান হিস্ট্রি আর সিমাজিক নৃতত্ত্বের নানা রকম সিঁড়ি, উপসিঁড়ি দেখতে, দেখতে নিজের পূর্বপুরুষের পরিব্রজনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস শোনালেন ডঃ জাকির হোসেইন। কম্বোডিয়া থেকে লাসা এবং দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বহু জমি, বহু জনপদকে স্পর্শ করে মহা-ভারতের চূড়ান্ত উত্তর-পূর্বে, আজকের অসম-সীমান্তে এসে তাঁর পূর্বজরা এখানকার মানুষ, মাটি,নদী আর লোক সংস্কৃতির অবিভাজ্য শরিক হয়ে উঠলেন, সে আশ্চর্য কাহিনী বললেন এনইএফ- এর স্তিতধী শিক্ষাবিদ। কী এই মনোহর, সুবিস্তৃত গল্পও।
সম্পাদক। ১০.০২.২০২৪
• পর্ব-২৫ •
গুয়াহাটিতে আমার ছেলের বউভাতে, কিংবা পুত্রবধূর পিত্রালয় হবরগাঁওয়ের প্রান্তিক গ্রাম যে জনসমাবেশ দেখার সুযোগ হয়েছে, তা থেকে অনুমান করতে পারছি, মিশ্র ভাষা, মিশ্র সংস্কৃতি, মিশ্র ইতিহাসের নির্মাণ মানুষের স্বাভাবিক লক্ষণ। অশেষ চেষ্টা করেও কোনো জাতি, কোনো সম্প্রদায়, ক্ষুদ্র অথবা বৃহৎ জনগোষ্ঠী তার আদি, তার অকৃত্তিম অভ্যাস টিঁকিয়ে রাখতে পারে না। গ্রহন আর বর্জনের পথ তাকে বেছে নিতে হয়। হবরগাঁও এ পূর্ববঙ্গ থেকে যে জনপদ তাঁদের ভাষা, লোকজ সংস্কৃতি আর ধর্মজাত সিমিত অনুভূতি নিয়ে, দেশভাগের অনেক অনেককাল আগে থেকে, মধ্য অসমে এসে বসতিস্হাপন করেছিলেন, তাঁদের মৌখিক জবানে, আবেগে, কৃষিনির্ভর দিনযাপনে নিকটবর্তী পূর্বপুরুষের স্মৃতি কি টিঁকে নেই আর? অবশ্যই আছে। বাড়িতে, স্বপ্নে, স্বজনের সঙ্গে নিত্যদিনের যোগাযোগের সংলাপ তাঁদের পূর্ববঙ্গের বহুমুখী উচ্চারণ আর বাক্যগঠন জেগে আছে, এখনো। গৃহীত, অর্জিত ভাষা অসমিয়া হলেও, এই এলাকার, কৃষি অধ্যুষিত বিস্তৃত অঞ্চলের অসমিয়াকরণকে পূর্ণ করতে আরো কয়েক যুগ অপেক্ষা করতে হবে। গায়ের জোরে, হুমকি দিয়ে, সন্দেহের চত্বরে আবদ্ধ রেখে তা সম্ভব নয়। মানসিক ভারতের অসম বহুবার নৈতিক দৈত্য-নৃত্য দেখেছে। একরাজ্য বহু রাজ্যে বিভক্ত হয়েছে, মূলত ভাষা গত, সংস্কৃতিগত আধিপত্যবাদী মানসিক চাপে; ইংরেজি আর অসমিয়া অসংখ্য জনগোষ্ঠীর লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কা হতে পারত, সহাবস্থানের আদর্শ পরীক্ষাগার হতে পারত উত্তরপূর্বাঞ্চলের ২ লক্ষ ৬২ হাজার ১৮৪ বর্গ কিলোমিটার এলাকা। রাজনীতির ক্ষুদ্রতা, খন্ডিত চিন্তা আর একধরণের হামবড়া অসহিষ্ণুতার বলি হয়ে গেল এক মহৎ সম্ভাবনা। দূরদৃষ্টি প্রসারিত না হলে, সংঙ্কীর্ণতার বাহুবল আরো বাড়বে।
কয়েকমাস আগে, বঙ্গীয় বংশোদ্ভূত জনপদের অসমে পরিব্রাজন আর উত্তরপূর্বাঞ্চলের নানা জায়গায় তাদের বসতিস্থাপনের ধারাবাহিক প্রক্রিয়া খতিয়ে দেখার ইচ্ছা জাগে। কেসস্টাডির নমুনারূপে আমি নিজের বংশতালিকাকে বেছে নিই। আপাতদৃষ্টিতে সহজ, সংক্ষিপ্ত, কিন্তু বাস্তবে নিজের শিখর সন্ধান অত্যন্ত সময় সাপেক্ষ আর শ্রমনিষ্ঠ কর্ম
এখানে আমার অবস্থান দৃঢ়তার সঙ্গে বলে দেওয়া প্রয়োজন। রাজনীতির চেহারা যাই হোক না কেন, অসমের ভৌগলিক ও বহুজাত সংস্কৃতির একতাকে বাঁচাতেই হবে। মানুষ কখনো বহিরাগত নয়, হতে পারে না, সে অখণ্ড, সে অবিভাজ্য; প্রাকৃতিক কারণে, দুর্যোগের শিকার হয়ে, রুটি রুজির সন্ধানে গোলকের উত্তর থেকে দক্ষিণে, পূর্ব থেকে পশ্চিমে তার পরিব্রাজন ( মাইগ্রেশন) প্রস্তরযুগ থেকে, ইতিহাসের সূচনা থেকে শাশ্বতস্রোতের মতো অপ্রতিরোধ্য; অসমসহ উত্তরপূর্বাঞ্চলে, দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ এসে জড়ো হয়েছেন। স্থানীয় আবহাওয়া, স্থানীয় ভূপ্রকৃতি, স্থানীয় নরসংস্কৃতিকে গ্রহন করে মিশে গেছেন পূর্বগামীর অভ্যাস ও আভাষে। মানসিক সংঘর্ষ হয়েছে, আবার তা কাটিয়েও উঠেছেন কালের নিয়ম মেনে, প্রধানত অস্তিত্ব রক্ষার খাতিরে। তাঁদের পরিব্রাজনের ইতিহাসের ভেতরের ইতিহাস, কাহিনীর ভেতরের কাহিনী সচরাচর আমাদের পুঁথিবিদ্যায় ঠাঁই পায় না। রাজ-রাজা, তাঁদের অনুগত প্রজা কিংবা সেনাবাহিনীর দেশান্তরের গল্প ইতিহাস খুঁজে বেড়ায়, এই সন্ধানও অর্ধসমাপ্ত, বলা উচিত অসমাপ্ত। যে-প্রান্তিক জনতা নতুন শাসকের সঙ্গে আসে, এবং প্রতিষ্ঠিত শাসকদের গৃহচ্যুত করে নবীন সমাজ, মিশ্র সমাজ আর মিশ্রিত রীতির সর্বকারক হয়ে ওঠে- তাঁদের যাপন আর কথকতার প্রতিলিপি কতটা গুরুত্ব পায় ইতিহাসচর্চার অনুশীলনে? সাবলর্টান হিস্ট্রি নিয়ে ভেবেছিলেন বহু দিকপাল, এব্যাপারে এগিয়েছিল, ভারত, বর্হিভারতও, কেন জানি এই মহৎ প্রচেষ্টা থমকে গেল। অসমেও, ইতিহাসকে এরকম নয়ালোকে দেখার সূচনা করেছিলেন যাঁরা, তাদের অনেকেই প্রয়াত, জেগে আছেন যেসব স্বনামধন্য, তাঁরাও কি স্তিমিত ? প্রশ্ন জাগে। এরকম প্রশ্ন তোলার কারণ, উত্তরপূর্ব ভারতে অস্ট্রিক,তিব্বতি বার্মিজ, ইন্দোইউরোপিয়ান কারদাই এবং সেমটিক বংশোদ্ভূত যেসব ছোট বড়ো জনগোষ্ঠী প্রাচীনকালের সুবিস্তৃত সময় জুড়ে এসেছিল,বসত বাড়ি গড়েছিল, মিশেছিল মাটি আর হাড়ির রেওয়াজে;আজও যারা স্বতন্ত্রভাষা, মিশ্রভাষা এবং সাংস্কৃতিক একাত্মবোধের সাধক হয়ে বেঁচে থাকতে চাইছে, তাঁদের ইতিহাসের পূর্ণরূপের নির্মাণ বা নির্মাণের সমূহ কসরত কোথায় ? বিচ্ছিন্ন,খাপছাড়া চেষ্টা হয়নি, তা নয়,হয়েছে,এসব ক্ষেত্রে বহুমাত্রীয় অধ্যয়নকে সম্মান জানিয়েই বলছি, প্রান্তিক ইতিহাস চর্চায় শরীর আর আত্মায় নবদিগন্ত খুলে দেওয়া জরুরি, প্রয়োজন বড়ো কাছারি কোচ আহোম এবং হাল আমলের বঙ্গমূলিয়া জনসত্তা, কৃষক, চা শ্রমিক, গোবলয়ের হিন্দি, রাজস্থানি জনপদের উৎসমূল আর উত্তরপূর্বাঞ্চলে তাদের পরিব্রাজনের শত শত বছরের বৃত্তান্ত, তাদের হাসি কান্নার, রক্ষক্ষরণের, অন্তর্দ্বন্দের যথাসম্ভব বৃত্তান্ত আমাদের জানতে হবে। উপকরণ আর অধ্যয়নকেন্দ্রের অভাব নেই। সমাজতত্ত্ব,নৃতত্ত্ব,ভূতত্ত্ব, যা সামাজিক ইতিহাসের নিধি আর বিধি তৈরির নির্নায়ক শক্তি উপশক্তি। এখন আমাদের নাগালে, হাত বাড়ালেই অন্ধকার জ্বলে উঠবে তিনপ্রহরের সূর্য। কয়েকমাস আগে, বঙ্গীয় বংশোদ্ভূত জনপদের অসমে পরিব্রাজন আর উত্তরপূর্বাঞ্চলের নানা জায়গায় তাদের বসতিস্থাপনের ধারাবাহিক প্রক্রিয়া খতিয়ে দেখার ইচ্ছা জাগে। কেসস্টাডির নমুনারূপে আমি নিজের বংশতালিকাকে বেছে নিই। আপাতদৃষ্টিতে সহজ, সংক্ষিপ্ত, কিন্তু বাস্তবে নিজের শিখর সন্ধান অত্যন্ত সময় সাপেক্ষ আর শ্রমনিষ্ঠ কর্ম। বাপদাদার মুখে শুনেছি, আমাদের পূর্বপুরুষের বাসছিল বাংলাদেশের এখনকার জামালপুরে। ওখানে থেকে পূর্বগামী সড়ক বেয়ে নদী, জঙ্গল, পাহাড় পেরিয়ে কোঁকরাঝাড়ের বনাঞ্চল ঘেঁষা গ্রামে এসে জীবনযাপনের ঠিকানা খুঁজে নেন। ব্রিটিশ আমলে। স্বদেশের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে এই আগমন,স্বেচ্ছায় কিংবা বাধ্য হয়ে। এরকম যাযাবরমুখী পরিব্রজনে অভ্যস্ত ছিল বঙ্গের পূর্ব, উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের হাজার হাজার কৃষক পরিবার। তাঁদের এ অভিমুখককে, বাধ্যতামূলক স্থানান্তরকে অনুপ্রবেশ বলা ঠিক নয়। কখনো ব্রিটিশের নির্দেশে,কখনো প্রবল দুর্যোগের মোকাবিলায় হার মেনে অসমে, কোচ রাজবংশী, কাছারি প্রভাবিত, অবহেলিত এলাকায় বসতি তৈরি করে সে এলাকাকে চাষবাসের, মৎসউৎপাদনের অধিকতর যোগ্য ভূজমিন বানিয়ে তোলেন। এরকম পরিব্রজনের আরম্ভ কখন, কোন পরিস্থিতিতে, তার লিখিত, প্রামাণ্য তথ্য কোথায়? আধুনিক নৃতত্ত্ব, যাকে আমরা সামাজিক নৃবিজ্ঞান বলে নির্দিষ্ট সঙ্গায় বেঁধে রাখি, সে কেন আমাদের শিকড় সন্ধানের পরিসর আর অবকাশ খুঁজে পায় না? গুজব আর রটনার সামনে মাথা নুইয়ে দিয়ে সংঘর্ষের ভয়ঙ্কর ডেকে আনার নৃশংস খেলায় আমরা মেতে থাকব? প্রশ্ন নিয়েই, সম্প্রতি আমি আমাদের জিপিএস অ্যানসেসট্রি টেস্ট করিয়েছি। দেখা গেল বিস্ময়কর তথ্য আর আমার পূর্বপুরষের পরিব্রজনের ১৩৫৩ বছরের আশ্চর্য ইতিহাস। ডিএনএ পরীক্ষায় উঠে এল, ৬৭১ খ্রীষ্টাব্দে বংশানুক্রমে, আমরা ছিলাম কম্বোডিয়ার বাসিন্দা,ওখানকার স্তুয়েং ত্রায়িং শহর, স্তুংত্রেং, সামেয়াক্কির আশপাশে কোথাও। ওখান থেকে অজ্ঞাত কারণে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার লাউস হয়ে মায়ানমারের লাভোটা আইওয়াদিতে খ্রীষ্টপরবর্তী ১৪৭৪ পর্যন্ত একই রক্তজাত বংশের খোঁজ মেলে। মায়ানমার থেকে এ রক্তের সন্তানসন্ততি উজান বাইতে শুরু করে। পৌঁছে যায় বিশাখাপত্তনমে, সেখান থেকে পদব্রজে কিংবা সমুদ্রপথে সিন্ধুপ্রদেশে। তারপর আবার ভাঁটি দিয়ে চলে আসে ছত্তিশগড়ে। ছত্তিশগড়ের বাসনা থেকে প্রবেশ করে বঙ্গভূমিতে। বসবাসের মেয়াদ অন্তত ৬০০ বছর। পলাশিযুদ্ধের পর ভাগ্যলিপির বিপর্যয় দেখা দেয়। প্রায় ৪০০ বিঘার জমিদারি ছিনিয়ে নিতে চায় সামন্তবাদীরা, ব্রিটিশের সঙ্গে রিসেটেলমেন্ট হবার পরেও সংঘর্ষের বিরতি নেই। ১৯০১ সালে, আমরা দেশান্তরী হয়ে নিজভূমে পরবাসী হয়ে উঠলাম। তখন থেকেই কোকরাঝাড়ের বাসিন্দা। বাবার পেশাজীবন থেকে মৃত্যুজীবন ওই জমিতেই। ঘটনাচক্রে আমি, আমার স্ত্রী,ছেলে মেয়ে,পুত্রবধুর ঠিকানা গুয়াহাটির হাতিগাঁও এ। সবাই আমরা অনজানা সফরের অভিযাত্রী। জীবনের চিরস্থায়ী প্রবাহ আমাদের এগিয়ে দিচ্ছে। ছুটছি। সাঁতার কাঁটছি পরম রহস্যময়ের নির্দেশে। অন্যদের কথা বলার মতো সংগৃহীত তথ্য নেই হাতে, শুধু এইটুকু বলতে পারব,জীবন আর জীবিকার তাগিদ উত্তরপূর্বাঞ্চলের সব রাজ্যে, বিশেষ করে নদী আর কৃষিসভ্যতার অসমে এসে নিউলিথিক পিরিয়ড থেকে, এ পর্যন্ত মিশে গেছে শতশত জনপদ। বঙ্গীয় বংশোদ্ভূত জনগোষ্ঠী এই স্রোতের এই মহামিলনের সর্বশেষ স্থায়ী আর ক্রমবর্ধমান বিকাশের বিভাজনহীন, প্রত্যাশাময় সহযাত্রী। তা কীভাবে, কোন পরিপ্রেক্ষিতে -তার মামুলি চিহ্ন একেঁ রাখব। বিশদ তথ্য ও তত্বকথা পরে বলব, অবশ্যই।
ক্রমশ…
♦—♦♦—♦♦—♦♦—♦
লেখক: উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রথম বেসরকারি কলেজ গোষ্ঠী এন.ই.এফ-এর চেয়ারম্যান। গুয়াহাটির বাসিন্দা
আগের পর্ব পড়ুন: পর্ব-২৪
❤ Support Us