Advertisement
  • কে | রি | য়া | র-ক্যা | ম্পা | স ধা | রা | বা | হি | ক
  • মার্চ ২৪, ২০২৪

ধারাবাহিক আত্মকথা: আমাদের বিদ্যানিকেতন

জাকির হোছেন্
ধারাবাহিক আত্মকথা: আমাদের বিদ্যানিকেতন

আমিত্বহীনতার বৃত্তান্ত

 
ডক্টর জাকির হোছেইন পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের ছাত্র; আর তাঁর গবেষণার বিষয় বিশেষ এক পর্বের ছাত্র আন্দোলন। কর্মজীবনে তাঁর পেশাদারিত্ব আর সাফল্য সর্বজন বিদিত। সে-সব কথার কোনো উক্তি পুনরুক্তি নেই তাঁর আত্মবৃত্তান্তে। নৃবিজ্ঞান থেকে লোকতত্ত্ব, কেন আর কীভাবে তাঁর দৃষ্টিপাতের বিষয় হয়ে উঠেছে, কোন কারণে, বহুমুখী জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি হয়ে উঠলেন এন‌ইএফ-র সর্বোচ্চ স্থপতি, তা পড়ে দেখুন এবার মুক্ত মন নিয়ে, চোখের ভেতরের চোখ দিয়ে দেখুন সমকালীন অসমের সবার পরিচিত, জনপ্রিয় আত্মীয়কে!

 
সম্পাদক। ২৪.৩.২০২৪

 

• পর্ব-২৬ •

অসম থেকে মেঘালয়, নাগাল্যান্ড থেকে অরুণাচল, সিকিম থেকে ভুটান, ত্রিপুরা, মিজোরাম সহ ৯ রাজ্য আর প্রতিবেশী অন্য কয়েকটি দেশের হাজার হাজার বিদ্যার্থী আমাদের এন‌ইএফে পড়তে আসে। তারুণ্যে, বর্ণে আর ভাষা ব্যবহারে তারা বিচিত্র। ইংরেজি, হিন্দি আর অসমিয়া তাদের কমন লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা। নিজেদের মধ্যে স্বগোত্রীয় ভাষায় কথা বলে। শিক্ষার মাধ্যম যেহেতু ইংরেজি, শিক্ষকদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগের সূত্র এই ভাষা। আবার হিন্দির লিঙ্গভেদের তোয়াক্কা না করে সহজে সহপাঠীদের আড্ডা মহলে আর্যাবর্তের ভাষাটিতেও কথা বলে। অসমিয়া শিখতেও কারো অসুবিধা হয় না; স্থানীয় ছাত্রশিক্ষকেরাও বাইরের রাজ্য থেকে আসা এসব পড়ুয়াদের বহিরাগত ভেবে এড়িয়ে যান না। আপন অভ্যাসকে সম্মান জানিয়েই প্রতিবেশী রাজ্যের সহগামী, সহপাঠীদের দৈনন্দিন খুঁটিনাটির প্রতি শ্রদ্ধাপোষণের এই নমুনা দেখে আমার মনে হয়, মাঝে মাঝে সামাজিক ক্ষুদ্রতা কোথাও কোথাও সঙ্কট তৈরি করতে চাইলেও, নতুন প্রজন্মের পারস্পরিক আত্মীয়তাবোধের সামনে হার মানতে বাধ্য হয়। পিছিয়ে যায়, অথবা স্বাভাবিক আবহ ফিরিয়ে আনে।
 

শুধু মৌখিক বড়াইয়ের বিষয় ভেবে তুলনাহীন অসমকে, আই অসমে(মা অসম) যথার্থ মর্যাদাজ্ঞাপন সম্ভব নয়। জানতে হবে তার ভাষা, জনশ্রুতি আর বহুমুখের রঙিন জনবিন্যাসকে। ভবিষ্যতে এন‌ই‌এফ এ ব্যাপারে গবেষণার গম্ভীরকে নৃবিজ্ঞান, ভূতত্ত্ব, প্রত্নতত্ব এবং ভাষাবিজ্ঞানের সাহায্য, আশা করি সাজিয়ে তুলবে। আমরা আরো বেশি বিকেন্দ্রিক হবার চেষ্টা করছি

 
কখনো বলি না, এখনো গর্বের সঙ্গে বলবার ইচ্ছে নেই, তবু বলতে ভালো লাগে–কেবল গুণ মানে, পঠন-পাঠনের চৌহদ্দিতেও নয়, অন্তরের সঙ্গে অন্তরের ঐক্য আর তার অনির্দেশিত সাধনায় আমাদের বিদ্যানিকেতন, মহা-ভারতের মহা অসমের ভাষা আর উদারতার নির্মীয়মাণ নিদর্শন হয়ে উঠছে। ভারতকে তার বৈচিত্র্য আর অখণ্ড সংস্কৃতির জন্য বিশ্ব শ্রদ্ধা করে। এ অখণ্ডতা আর মানবজমিনের বহুমাত্রিকতা চাক্ষুস করতে হলে অসমের সমতলে, তার পাহাড়ে,তার নদ-নদীর অববাহিকা জুড়ে, শতশত যে সব জনগোষ্ঠী যুগযুগ ধরে, সম্ভবত যিশুর জন্মের ১০০০ বছর আগে থেকে বসবাস করছে,কখনো উজান বাইতে,কখনো প্রতাপাদিত্য ব্রক্ষপুত্রের খরস্রোত আর অন্তরস্রোতের মতো ভাঁটি দিচ্ছে— তা নিরীক্ষণ করতেই হবে।
 

যে ভূমি আজান ফকির, শঙ্করদেব, মহাদেব, মুফিজ‌উদ্দিন হাজারিকা থেকে লাচিত বরফুকন— লক্ষীনাথ বেজবরুয়া, বিষ্ণুরাভা, জ্যোতিপ্রসাদ আগর‌ওয়াল, ভূপেন হাজারিকার মতো অসংখ্য মহাজনের জন্ম ও কর্মভূমি, সে পবিত্রভূমির নতুন অভিমুখ,নতুন পরিচিতি গড়ে তুলতেই হবে। আমরা শিক্ষাকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠান ন‌ই শুধু, অসমের নানা বর্ণ আর ভাষার, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের বিরল উত্তরাধিকারকে টিঁকিয়ে রাখতে সকলেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ

 
অসম মানে সমান নয়, সমগোত্রীয় নয়, স্বাতন্ত্র্যে আর উজ্জ্বলতায় অতুলনীয় মানচিত্র। শুধু মৌখিক বড়াইয়ের বিষয় ভেবে তুলনাহীন অসমকে, আই অসমে(মা অসম) যথার্থ মর্যাদাজ্ঞাপন সম্ভব নয়। জানতে হবে তার ভাষা, জনশ্রুতি আর বহুমুখের রঙিন জনবিন্যাসকে। ভবিষ্যতে এন‌ই‌এফ এ ব্যাপারে গবেষণার গম্ভীরকে নৃবিজ্ঞান, ভূতত্ত্ব, প্রত্নতত্ব এবং ভাষাবিজ্ঞানের সাহায্য, আশা করি সাজিয়ে তুলবে। আমরা আরো বেশি বিকেন্দ্রিক হবার চেষ্টা করছি। সামর্থ্য আমাদের সীমিত। কিন্তু ক্ষুদ্র ন‌ই, আপনার ডানা নিয়ে ছুটছি, যে ডানায় অহঙ্কারের আত্মতৃপ্তির পাখা যেন না গজায়। অসমের মতো সমৃদ্ধ, বহুধা বিস্তৃত ভূখণ্ডের বাসিন্দা বলে আমরা গর্বিত। যে ভূমি আজান ফকির, শঙ্করদেব, মহাদেব, মুফিজ‌উদ্দিন হাজারিকা থেকে লাচিত বরফুকন— লক্ষীনাথ বেজবরুয়া, বিষ্ণুরাভা, জ্যোতিপ্রসাদ আগর‌ওয়াল, ভূপেন হাজারিকার মতো অসংখ্য মহাজনের জন্ম ও কর্মভূমি, সে পবিত্রভূমির নতুন অভিমুখ,নতুন পরিচিতি আমাদের গড়ে তুলতেই হবে। আমরা শিক্ষাকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠান ন‌ই শুধু, অসমের নানা বর্ণ আর ভাষার, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের বিরল উত্তরাধিকারকে টিঁকিয়ে রাখতে সকলেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। সবার স্বাতন্ত্র আর বিচিত্র মহিমা নিয়ে এমন একটি হিতবাদী বাগান সাজাতে চাই, যেখানে কেবল গোলাপ নয়, অন্যরকম ক্যাকটাসের প্রতিবেশী হয়ে বেঁচে থাকবে, জেগে থাকবে রাশি রাশি হাসি। মাওসেতুং বলেছিলেন, শতফুল বিকশিত হোক, আমরা মাও এর রাজনৈতিক তত্ত্বের বংশধর ন‌ই, কিন্তু চিনের মহান নেতা ঐক্যের বৈচিত্র নিয়ে মে বিশুদ্ধ বাণী শুনিয়েছিলেন বিশ্বকে, তার যথাসম্ভব ইমারতের নির্মাণ অসমের পক্ষেই সম্ভব। কেননা এখানে এসে, সমুদ্রসঙ্গমে মিলিত হয়েছে অস্ট্রিক, তিব্বতি-বার্মিজ, ইন্দো-ইউরোপিয়ান, কারদাই, জনগোষ্ঠীর শাখা প্রশাখা, যাঁরা সবধরনের সঙ্কট আর প্ররোচনা— অতিক্রম করে আজ‌ও নিজের ভাষা, নিজের সংস্কৃতি জাগিয়ে রেখেছেন। এমন একটি সদর্থক, অনুকূল রাজ্য আর কোথায় আছে? ব্রক্ষ্মপুত্রের স্রোত আর হিমালয়ের পর্বতশ্রেণীর মতো খাঁড়া যাঁদের শির, শান্তিময় বসবাস যাঁদের ভাগ্যলেখা, তাঁরা এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে— কোচবিহার থেকে খাসিয়া- ডিমাসা, মিকির হিলস( কার্বিআংলং), বরাকের খাসপুর থেকে ধর্মনগর হয়ে ত্রিপুরার আনাচে কানাচে ছড়িয়ে -ছিঁটিয়ে আছেন অসংখ্য নাম আর‌ উপনামে, তাঁদের অভিজ্ঞান, স্বরচিত লক্ষণ এবং পূর্বজ রক্তের বহমান তরঙ্গের স্বীকৃতি জরুরি। জরুরি এসব জনসত্তার পূর্ণ উন্মোচন। পেশাদারি বিদ্যান্বেষণ ছাড়াও, এটা আমাদের শিক্ষা গোষ্ঠীর ( গ্রপ অব এডুকেশন) আরেক সক্রিয় অভিপ্রায়। জয় আমাদের সুনিশ্চিত। সবাইকে সহজ ভাষায়, সহজিয়া সুরে বলতেই পারি, ‘উই আর অন দ্য সেম বোট ব্রাদার্স’। হ্যাঁ, প্রতিটি জনপ্রবাহকে আমরা মূল্য দিই। তাঁদের শিকড় খুঁজে দেখতে চাই, কে কোনদিক থেকে হাঁটতে হাঁটতে যোগ দিয়েছেন অসম, অতুলনীয় সমাবেশে, তা ইউরোপের নৃবিজ্ঞান যে-ভাবে দেখেছে, আমরা কখনো সেরকম দেখব না; ইউরোপের প্রাচ্য দর্শনে, বিশেষ করে অসমের লোকতত্ত্বের সন্ধান আর ব্যাখ্যায় মিশনারি দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, আজ‌ও আছে; মুক্ত হৃদয়ে আমরা খুঁজতে চাই— কার রক্ত কার রক্তে মিশতে মিশতে গড়ে তুলেছে, এখনো গড়ছে প্রাচ্যের এই লোকতাত্ত্বিক ম্যাজিক? কীভাবে এখানকার মানুষ নিজের অজান্তে হয়ে উঠেছে বিশ্বমানব? এটা শুধু আমার স্বপ্ন নয়, যে টিম এন‌ইএফকে ঘিরে জড়ো হয়েছে, তা তার সব সদস্যের‌ই সচেতন অঙ্গীকার! পরবর্তী বিভিন্ন অধ্যায়ে, এ বিষয়ে বিশদে আলোচনার ইচ্ছে র‌ইল। জানবার চেষ্টা করব, মহাভারতে উল্লেখিত কিরাত জন, লাঙ্গল আমদানি করে এখানকার মাটি আর কৃষিসভ্যতাকে কিভাবে আলোক‌উজ্জ্বল করে তুলল, তার সবিশেষ বয়ান পেশ করতেই হবে।
 

ক্রমশ…

♦—♦♦—♦♦—♦♦—♦

 
লেখক: উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রথম বেসরকারি কলেজ গোষ্ঠী এন.ই.এফ-এর চেয়ারম্যান। গুয়াহাটির বাসিন্দা
 
আগের পর্ব পড়ুন: পর্ব-২৫

ধারাবাহিক আত্মকথা: আমাদের বিদ্যানিকেতন


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!