- কে | রি | য়া | র-ক্যা | ম্পা | স ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
- মার্চ ৩১, ২০২৪
ধারাবাহিক আত্মকথা : আমাদের বিদ্যানিকেতন
আমিত্বহীনতার বৃত্তান্ত
জগতের গহীনে অনুভব করতে হবে নিজের অস্তিত্বের অর্থ আর সদর্থক ভূমিকা। যেখানে প্রশ্নের অবকাশ আছে, প্রশ্ন তুলতে হবে, আমি কী করছি, কেন করছি…
• পর্ব-২৭ •
সংশয় আর সিদ্ধান্তহীনতাকে প্রশ্রয় দিতে নেই। প্রকৃতি, তার গতি,তার অভিমুখ আমাকে শিক্ষা দিয়েছে, জীবন নামের বিশাল পাঠশালায়, পড়তে পড়তে, তার লিপিপাঠ অভ্যাস করতে করতে ব্যবহারিক দর্শনের অনুশাসন মানতে হবে, যা বিধিবদ্ধ নয়, আবার শৃঙ্খলাহীনও নয়, সমস্ত শৃঙ্খল ভেদ করে ভেতর থেকে বাইরে বেরিয়ে জগৎকে খুঁজতে হবে, জগতের গহীনে অনুভব করতে হবে নিজের অস্তিত্বের অর্থ আর সদর্থক ভূমিকা। যেখানে প্রশ্নের অবকাশ আছে, প্রশ্ন তুলতে হবে, আয়নার সামনে হামেশা দাঁড়িয়ে বোঝা জরুরী যে, আমি কী করছি, কেন করছি, আমার শুরু কোথায়, কোন সীমান্তে আঁকতে হবে সাময়িক অথবা স্হায়ী বিরতি চিহ্ন। নিজেকে প্রশ্ন করার কসরত সম্ভবত রপ্ত করেছি শৈশবে, পরিবেশ আর প্রতিবেশীকে দেখতে দেখতে। এরকম, বস্তু আর বিষয়কে দেখার অনুশীলন থেকে অর্জিত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে, কালক্রমে বুঝতে পারি, যে-কোনো পরিকল্পনা রচনার আগে, তার রূপরেখা, সীমারেখা আঁকতে হবে। পারাপারের নৌকা পেয়ে গেলাম আর ওপারে যাওয়ার জন্য পাটাতনে পদযুগল বসিয়ে দিলাম, এই ধরনের বায়বীয়, স্বপ্নহীন ঝুঁকি জীবন মেনে নেয় না। আকাশের অবস্থা দেখতে হয়, ঝড় উঠবে কিনা; ভাবতে হয় নদী স্রোতশক্তি আর মাঝির হাল ধরার শক্তি। এরকম ভাবনাকে যারা গুরুত্ব দেয়, তাদের মাঝগাঙে ডুবে যাওয়ার বিশেষ আশঙ্কা থাকে না; নদীর ওপারে, স্বপ্ন তৈরির জমিতে যখন যেতেই হবে, তখন সংশয়কে প্রশ্রয় দেওয়ার অন্য নাম ভাবনাহীনতা। আমি বিনম্র, মহাপ্রকৃতির কাছে কৃতজ্ঞ, এ পর্যন্ত না ভেবে এমন কোনো প্রকল্প শুরু করিনি, যার নৌকা নড়বড়ে, নদী বেসামাল এবং আকাশ মেঘলা। দ্বিতীয়ত, এনইএফ-এর ৯ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এমন একটিও খুঁজে পাব না, যার শুরু থেকে সমাপ্তিলগ্ন পর্যন্ত সংশয়ের ছায়া পড়েছে; সিদ্ধান্তগ্রহনে প্রশ্রয় পেয়েছে নিদ্রাহীন ভাবনাচিন্তা। কাজ শুরু করার আগেই, খতিয়ে দেখেছি নৌকার বহনক্ষমতা, সহযাত্রীদের সাহস আর মাঝির আত্মশক্তির দৃঢ়তা। ভাবতে ভালো লাগছে, আমাদের প্রকল্প শুরু হয়েছে, চড়াই উৎরাই পথ বেয়ে ছুটতে ছুটতে সমতল, মসৃন জমি খুঁজে পেয়েছে; এই স্রোত আজও অব্যাহত।
সঙ্গী আর সহযোগীদের কাউকেই ভুলিনি। দূরশিক্ষা কর্মসূচির শুরুতে যে বন্ধু, বেঙ্গালুরুর যে সহপাঠী যোগ দিয়েছিল, সেও আমার চিত্তে এখন দোলা দেয়। মাঝপথে ছেড়ে দেয় বটে, কিন্তু এনইএফ এর ভিত্তিশালায় তারও দেহ মনের সায় তো ছিল। সে যখন চলে গেল ছেড়ে, মাঝপথে, ভেঙে পড়িনি। শ্রম আর উদ্বেগ বেড়েছে, অর্থসঙ্কট দেখা দিয়েছে, একা লড়াই করার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে, জানতাম কী করব, কেন করব, কারা আমাদের উপভোক্তা, প্রতিটি প্রশ্নের সমাধান করে, অর্জন করেছি আরও দশ হাতের সাহায্যে। লক্ষ্য ঠিক ছিল বলেই একটি প্রতিষ্ঠান খানিকটা স্বনির্ভর হলেই সমগোত্রীয় আরেকটি নির্মাণের জমি খুঁজতে বেরিয়ে পড়েছি। এজন্যই বৃত্তান্তের চলতি কিস্তি লিখতে বসে নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিতে হল, সংশয় আর সিদ্ধান্তহীনতাকে আমল দিইনি, কখনো নিজেকে দুর্বল ভাবিনি, শক্তিহীন মনে হয়নি। এই যে বরপেটায় বহুমুখী আয়ুর্বেদ কলেজ গড়তে গিয়ে ভাবিনি কখনো পারব না। সবসময় এই আত্মসংলাপ শুনতে হচ্ছে, তা হল আমি পারব, আমাকে পারতে হবে। ঘোষিত, নির্ণীত সিদ্ধান্তকে বাস্তবের জমিতে, বিশ্বাসের বাস্তবে রূপান্তরিত করা দরকার। স্বীকার করছি, কঠিন কাজ। দুর্গম পথ। জমি; অর্থ সংগ্রহ নিয়ে সমস্যা দেখা দেবে, দিয়েছে, সমাধান করে নিয়েছি। ইতিমধ্যেই ফাউন্ডেশনের সব কাজ সম্পূর্ণ। এবার বাড়ি উঠবে, আকাশের দিকে তাকাবে। ব্যক্তির সঙ্গে সমষ্টি যোগ দেবে, প্রশাসনও হাত মেলাবে, স্তরে স্তরে আশা করি গড়ে উঠবে পূর্ব-ভারতের প্রথম ; বৃহত্তম বেসরকারি আয়ুর্বেদিক হাসপাতাল। বিহার থেকে অরুণাচল আর দক্ষিণ পূর্বের মিজোরাম পর্যন্ত আয়ুর্বেদীয় চিকিৎসার কোনো প্রতিষ্ঠান নেই।
গ্রিকো-আরব যৌথ বিদ্যা, যাকে আরবরা ইউনানি চিকিৎসা বলত, ভারতে যার পরিচয় হেকিমি বিদ্যা তার যোগ্য প্রতিষ্ঠান নেই পূর্ব ভারতে। হাকিম আজমল খান, গ্রিকো আরব চিকিৎসা বিদ্যার আধুনিক জনক হয়ে চিরঞ্জীব হয়ে থাকবেন। বিদ্যাধর দূরদ্রষ্টা ছিলেন আজমল খান। অন্যতম স্বাধীনতা যোদ্ধা। তার সংগ্রামের অস্ত্র ছিল, মুক্তচিন্তা, মুক্তশিক্ষা। গড়ে তুলেছিলেন জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং হাকিম চিকিৎসা শাস্ত্রের ( হামদরদ) গবেষণাগার ও বিশ্ববিদ্যাকেন্দ্র। আজমল খান জানতেন, হামদরদ চিকিৎসার মূলসূত্র আয়ুর্বেদ। ভারত থেকে গ্রীস হয়ে, আরব ইরান হয়ে আবার তা হিন্দুস্তানে ফিরে আসে। এই ধরণের চিকিৎসা বিদ্যার দিগন্ত খুলে যায় মধ্যযুগীয় আরব, ইরান ও মধ্য এশিয়ায়।
আমাদের, আমাদেরই ভারতীয় এ বিদ্যাকে, বিদ্যার অনুশীলনকে, গবেষণাকে বহুকাল গুরুত্ব দিইনি আমরা, ঔপনিবেশিকতার চক্করে পড়ে, ইউরোপের লেজ ধরে। আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রেকে উড়িয়ে দিচ্ছি না, তার আধুনিক নির্মাণ আর বিস্তারকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে এবং পাশাপাশি যে চিকিৎসা বিদ্যার ( আয়ুর্বেদ) এত রূপান্তর ঘটেছে, একথাও বলা দরকার। আমরা আমাদের সীমিত সামর্থ্য নিয়ে আধুনিকতম হাসপাতাল ও কলেজ গড়তে চাইছি। এখানেও সিদ্ধান্তহীনতা নিস্ক্রিয়। সক্রিয় নিঃসঙ্কোচ অঙ্গীকার।
ক্রমশ…
♦—♦♦—♦♦—♦♦—♦
লেখক: উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রথম বেসরকারি কলেজ গোষ্ঠী এন.ই.এফ-এর চেয়ারম্যান। গুয়াহাটির বাসিন্দা
আগের পর্ব পড়ুন: পর্ব-২৬
❤ Support Us