Advertisement
  • কে | রি | য়া | র-ক্যা | ম্পা | স ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
  • এপ্রিল ২১, ২০২৪

ধারাবাহিক আত্মকথা : আমাদের বিদ্যানিকেতন

জাকির হোছেন্
ধারাবাহিক আত্মকথা : আমাদের বিদ্যানিকেতন

আমিত্বহীনতার বৃত্তান্ত

 
ব্রহ্মপুত্রের উত্তরপাড়ে, বড়পেটার কাছাকাছি জনপদ ঘেঁষা, মুক্ত ক্যাম্পাসে গড়ে উঠছে প্রাচীনতম, আবহমান মহিমার আধুনিকায়িত বিদ্যানিকেতন আর ভেষজ চিকিৎসার সামগ্রিক চিকিৎসালয়।  এটাই হবে অসমের বেসরকারি উদ্যোগে নির্মিত প্রথম আয়ুবেদিক কলেজ। সরকারি কলেজ স্থাপিত হয়েছিল ১৯৪৮ সালে। তখনই প্রশাসনিক আধিকারিক আর সংগঠকের বুঝতে পারেন যে ভেষজ ভান্ডার ছড়িয়ে আছে উত্তর পূর্ব ভারতের জলে ও জঙ্গলে। গুয়াহাটি বা অন্যান্য এলাকাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে পারে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার স্বর্ণখচিত, অতুলনীয় প্রতিষ্ঠান। 

 
সম্পাদক। ২১.০৪.২০২৪

 

• পর্ব-২৯ •

সামাজিক নৃতত্ত্ব আর সাধারণের, ইচ্ছাপূরণের স্বপ্নে অবশ্যই ঘোষিত, অঘোষিত, দৃশ্যত বা অদৃশ্য সংযোগ থাকতে পারে। একথা গ্রাহ্য করা জরুরি, বিশেষ করে শিক্ষা সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানের নিমার্ণে। আমরা অসমের বিভিন্ন জেলায়, একাধিক বিদ্যানিকেতন তৈরির আগে চিহ্নিত এলাকার জনবিন্যাস, যোগাযোগময়তা ও অন্যান্য প্রয়োজনীয়তা খতিয়ে দেখি, রীতিমত সমীক্ষা চালিয়ে সিদ্ধান্ত নিই, এই এলাকায় প্রস্তাবিত প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললে ছাত্র-ছাত্রী আর অভিভাবককে সমর্থন কতটা মিলবে। আর্থিক দিকটাও খেয়াল করি।
 
গুয়াহাটি আর নঁওগার জনবিন্যাসের চেহারা আমাদের পরিচিত। ছাত্র ছাত্রীদের চাহিদা সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান সীমিত হলেও প্রাথমিক প্রয়োজন খুঁজে দেখবার অভ্যাস রপ্ত করেছি। এন ই এফ ল’ কলেজ প্রতিষ্ঠার বহুপূর্বে জরিপ করে দেখেছি, আইন সংক্রান্ত পঠন-পাঠনে সরকারি আর বেসরকারি উদ্যোগের মধ্য পার্থক্য বিস্তর। সরকারি কলেজ ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়েও আইন পড়ানো হত। সার্বক্ষণিক শিক্ষকের অভাব ছিল। যাঁরা বিভিন্ন আদালতে, মূলত গুয়াহাটি হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করতেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে, কটন কলেজে, বি বরুয়ার মহাবিদ্যালয়ে আইন পড়াতেন। প্রত্যেকেই মেধাবী, খ্যাতিমান আইনজীবী। কেবল ছাত্রদের নিয়ে ব্যস্ত থাকার অবকাশ ছিল না তাঁদের। যেমন অত্যন্ত গুনী, ইতিহাস সচেতন মানুষ ছিলেন মকরম আলী লস্কর। প্র্যাকটিস করতেন হাইকোর্টে, পেশাগত প্রসার থমকে যায়নি কখনো। রাজনীতি, দেশভাগের পরিণতি নিয়ে তাঁর জ্ঞান ছিল সীমান্তহীন। সন্ধ্যার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়াতেন। দিনে হাইকোর্টে প্র্যাকটিস। তাঁর মতোই বিদ্যাদর্শী আর আইন-বিশেষজ্ঞ ছিলেন আব্দুল মহিব মজুমদার। সুপুরুষ। অসমের সর্বকালের অন্যতম সেরা আইনজীবী। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল মহন্ত, অকালপ্রয়াত স্বরাষ্টমন্ত্রী ভৃগু ফুকনদের শিক্ষক এবং অসম চুক্তির খসড়ার স্রষ্টা। তিনি তখন পূর্ণ আইনমন্ত্রী, তখনকার প্রধানমন্ত্রী রজীব গান্ধীর নির্দেশে অসম-চুক্তির ড্রাফট তৈরি করেছিলেন আব্দুল মহিব । স্বচ্ছ ব্যক্তিত্ব।

 
আইন কলেজের ক্ষেত্রে তা নয়, সমগোত্রীয়, সমধর্মী অন্যান্য বিদ্যানিকেতনের নির্মাণে, পাঠসূচি তৈরিতে, শিক্ষক নির্বাচনের বাস্তবের সত্যকে সব সময় নিকটস্থ হয়ে দেখবার চেষ্টা করি। নির্মায়মাণ আর্যুবেদিক কলেজ ও আয়ার্বেদীয় চিকিৎসার বহুমুখী হাসপাতাল গড়তে গিয়ে আমরা একই পথ, একই ইতিবাচকতার আপোসহীন অনুসারী

 
তাঁর বাবাও ছিলেন আইনজীবী। দেশভাগের পর, বিমলা প্রসাদ চালিহার মন্ত্রিসভার সদস্য। তাঁর নেতৃত্বে তৎকালীন কাছাড়ের জনশক্তি রায় দেয়, বরাক উপত্যকা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে সংযুক্ত হতে চায় না। মুসলিম লিগ কটাক্ষ আর কটূক্তি ছড়িয়ে দেয়, সিলেট যাবে গণভোটে, কাছাড় যাবে লাথির চোটে। লিগ পন্থীরা মুখস্থ বুলির মতো সমবেত আওয়াজ তোলে, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান। বরাকে এসে ভড়কে যায় তাদের হুমকি আর গায়ের জোর। মহিব মজুমদারের বাবা মতলিব ছিলেন ভবিষ্যত দ্রষ্টা। গণভোটে সিলেট-কাছাড়ের একাংশ ভূখন্ড পূর্বপাকিস্তানে যোগ দিল বটে, আবার তারই মানব-জমিন ভারতীয় মানচিত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে, পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তূদের ত্রাণ আর আশ্রয় দাতা হয়ে অসমের সঙ্গে জুড়ে রইল। অসম-আন্দোলনের অতিরিক্ত চাপ থেকে অসমকে খানিকটা নিষ্কৃতি দিয়েছিলেন আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাসম্পন্ন প্রাক্তনী আব্দুল মহিব।
 
মন্ত্রী আর দক্ষ আইনজীবীর ভূমিকায় তাঁকে আমরা দেখেছি। পেশাগত ব্যস্ততা সার্বক্ষণিক বিদ্যাদাতার পরিসর থেকে তাঁকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। হাফিজ রশিদ আহমেদ চৌধুরীর ক্ষেত্রেও একই ভাগ্যচক্রের খেলা দেখবার সুযোগ হয়েছে। আইন পড়িয়েছেন শিলচরে, গুয়াহাটিতে, নাইজেরিয়ার সোকোতো বিশ্ববিদ্যালয়ে। অভিজ্ঞ আর প্রাণবন্ত ব্যক্তিত্ব। তাঁর পক্ষেও আইনের সবসময়ের শিক্ষক হয়ে-ওঠা সম্ভব হয়নি। আমরা তাঁর কাছে ঋণী। আমাদের ল কলেজের অন্যতম উপদেষ্টা  হিসেবে তাঁর নৈতিক আর জরুরি সমর্থন বিনম্র করে দেয়।
 

মহেন্দ্র মোহন চৌধুরী, আব্দুল মহিব মজুমদার এবং হাফিজ রশিদ আহমেদ চোধুরী

এতক্ষণ যাঁদের কথা বললাম, তাঁদের মতো জ্ঞানময়, বাস্তবতাময় শিক্ষকদের শুধু আইন পড়িয়ে ভাত জুটবে না, পেশাগত সরঞ্জামও দরকার। যা নিয়ে মনে ও মননে তাঁরা ধনী, তাঁদের সংস্পর্শে এসে আমাদের নির্ধন স্বভাবও বদলে যায়, বিশ্বাসের বাস্তবকে দিক দেখায়।
 
কেবল আইন কলেজের ক্ষেত্রে তা নয়, সমগোত্রীয়, সমধর্মী অন্যান্য বিদ্যানিকেতনের নির্মাণে, পাঠসূচি তৈরিতে, শিক্ষক নির্বাচনের বাস্তবের সত্যকে সব সময় নিকটস্থ হয়ে দেখবার চেষ্টা করি। নির্মায়মাণ আর্যুবেদিক কলেজ ও আয়ার্বেদীয় চিকিৎসার বহুমুখী হাসপাতাল গড়তে গিয়ে আমরা একই পথ, একই ইতিবাচকতার আপোসহীন অনুসারী।
 
ব্রহ্মপুত্রের উত্তরপাড়ে, বড়পেটার কাছাকাছি জনপদ ঘেঁষা, মুক্ত ক্যাম্পাসে গড়ে উঠছে প্রাচীনতম, আবহমান মহিমার আধুনিকায়িত বিদ্যানিকেতন আর ভেষজ চিকিৎসার সামগ্রিক চিকিৎসালয়। নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, এটাই হবে অসমের বেসরকারি উদ্যোগে নির্মিত প্রথম আয়ুবেদিক কলেজ। সরকারি কলেজ স্থাপিত হয়েছিল ১৯৪৮ সালে। তখনই প্রশাসনিক আধিকারিক আর সংগঠকের বুঝতে পারেন যে ভেষজ ভান্ডার ছড়িয়ে আছে উত্তর পূর্ব ভারতের জলে ও জঙ্গলে। গুয়াহাটি বা অন্যান্য এলাকাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে পারে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার স্বর্ণখচিত, অতুলনীয় প্রতিষ্ঠান। তবু কেন জানি, বহুজাতিক সংস্থা অসমে এই ধরনের কলেজ তৈরিতে মনোসংযোগ করেনি। কাঁচা রসদ নিয়ে গেছে এখানকার বনাঞ্চল আর রসালো জমি থেকে। ব্যবসা করেছে সর্বভারতীয়, বহু দেশীয় বাজারে। আমরা শুরুতেই নানা স্তরে সমীক্ষা চালিয়ে সম্ভাবনা খতিয়ে দেখি এবং সিদ্ধান্ত নিই, বড়পেটা আর হাউলির মধ্যস্থল কদমগুঁড়িতে স্বপ্নের বাস্তবায়ন সম্ভব। কারণ, সংযোগের নিরিখে এলাকাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হাইওয়ে, জাতীয় সড়ক ও উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা তাকে প্রাণচঞ্চল করে তুলছে।
 
বড়পেটা অসমের অন্যতম প্রাচীন আর ঐতিহ্যময় শহর। এখান থেকে নির্বাচিত হতেন অসম আর কেন্দ্রের মন্ত্রী ফখরুদ্দিন আলী আহমেদ। রাষ্ট্রপতির আসনে বসিয়ে তাঁকে সম্মান জানিয়েছে মহাভারত। এ অঞ্চলের আরেক জননেতা ছিলেন আতাউর রহমান। বাগ্মী আর স্বপ্নদ্রষ্টা। বিমলা প্রসাদ চালিহার মৃত্যুর পর বৃহত্তর বড়পেটার সন্তান মহেন্দ্র মোহন চৌধুরী মুখ্যমন্ত্রী হয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন অসমকে। রত্নগর্ভা বরপেটার ঐতিহ্যে গড়ে উঠেছেন বহু ব্যক্তি প্রতিভা। তাঁদের সরাসরি স্পর্শ এখনো অনুভব করে হাউলি কদমগুঁড়ি সহ আশেপাশের বহু গোত্রীয়, বহু ভাষিক জন গোষ্ঠী। সমৃদ্ধ, ভাঙনহীন এলাকা। বহ্মপুত্র থেকে কিছুটা দূরে।
 
ধীরস্থির মহানদ এখানে অন্তঃস্রোতা, প্রশান্ত। পূর্ব থেকে পশ্চিমে ছুটে গেছে। গোয়ালপাড়া হয়ে, ধুবড়ি হয়ে, মানকাছর হয়ে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশে, ওপরে হিমালয়ের সারি সারি গিরিশ্রেণী, গারো পাহাড় ও অন্যান্য খুদে বড়ো পর্বত। অর্ধেক ঘন জঙ্গল আর সমতলের ছবির মতো, নিপুন শিল্পীর বিস্তৃত ক্যানভাস । বেকি, মানাহ, পহুমারা, কালাদিয়া, পাল্লা, নাকান্দা, মারা চালুখোওযা, বেলেঙ্গি সহ কত নদী উপনদী এলাকা দিয়ে যেত যেতে হঠাৎ এসে ঝাঁপ দিয়েছে ব্রহ্মপুত্র, কোথাও আবার উত্তর থেকে দক্ষিণে, ব্রহ্মাপুত্র থেকে বেরিয়ে প্রকৃতিকে উর্বর করে তুলেছে, বাড়িয়ে দিয়েছে সবুজায়নের বিত্ত আর বৃত্তকে। নদী মাতৃকতার চির প্রবাহকে।
 
গুয়াহাটি বিমান বন্দর থেকে কদমগুঁড়ির নৈসর্গিক অবস্থানের দূরত্ব ৯৬ কিলোমিটার।  কাজিরাঙা থেকে ২৯৪ কিলোমিটার, গারো পাহাড় থেকে ১৭৭ কে এম, মানস জাতীয় পার্ক থেকে কুল্লে ৪১ কে এম, শিলিগুড়ি থেকে ৩২৬ আর আলিপুরদুয়ার থেকে ১৮৮ কিলোমিটার। কখনো দূরে, কখনো অদূরে বরপেটা- কদমগুঁডির মানচৈত্রিক, সহজগম্য অবস্থিতি মুগ্ধ করে দেয় আমাদের। এ জন্য নির্বিঘ্ন, কোলাহলহীন কদমগুড়িকে আমরা মহাভারতীয়, বৈদিক শাস্ত্রীয় চিকিৎসা ও পঠন-পাঠনের নির্ভরশীল প্রাঙ্গন হিসেবে বেছে নিয়েছি। এলাকার অন্যান্য বৈশিষ্ট পরে আরো বিশদভাবে বলা প্রয়োজন। বলতে হবে আমাদের সুচিভিত্তিক আয়োজনের বৃত্তান্ত।
 

ক্রমশ…

♦—♦♦—♦♦—♦♦—♦

 
লেখক: উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রথম বেসরকারি কলেজ গোষ্ঠী এন.ই.এফ-এর চেয়ারম্যান। গুয়াহাটির বাসিন্দা
 
আগের পর্ব পড়ুন: পর্ব-২৮

ধারাবাহিক আত্মকথা : আমাদের বিদ্যানিকেতন


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!