- কে | রি | য়া | র-ক্যা | ম্পা | স ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
- মে ৫, ২০২৪
ধারাবাহিক আত্মকথা : আমাদের বিদ্যানিকেতন

আমিত্বহীনতার বৃত্তান্ত
আত্মতার আমিত্বকে, সবরকমের অহংবোধকে স্বাভাবিক ভাষায়, সহজিয়া বাক্য আর শব্ধবন্ধে কীভাবে অবরুদ্ধ করে রাখা সম্ভব, তার অননুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বিদ্যাপতি ড. জাকির হোছেনের আত্মকথা। অটোবায়োগ্রাফি বলতে আমরা বুঝি, জীবন মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা, ছুঁটতে থাকা ঘটনাপ্রবাহের পুঞ্জিভূত অনুভূতি, স্ব-নির্মানের কাহিনী আর সন-তারিখের ভিড়ে এককের উপলব্ধি। জাকির প্রথা ভেঙ্গে লিখছেন জীবনচর্যার কাব্য। আর তা কোন্ নিভৃত, সংযত কৌশলে, এর নমুনা দেখুন তাঁর ‘আয়ুবেদিক চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় ও হাসপাতাল’ নির্মাণের প্রতিস্তরের অপূর্ব বিবরণে।
সম্পাদক। ০৫.০৫.২০২৪
• পর্ব-৩০ •
সহজ ভাষার, সহজ কথা, সংক্ষেপে বলতে পারি না, আমার এ- এক সমস্যা, কারণ কী, খতিয়ে দেখিনি, হতে পারে লেখার অভ্যাস নেই, হতে পারে এদিক থেকে যতটা তালেবর হওয়া দরকার, তা আমার অর্জিত নয়, বিভিন্ন বিষয়- আশয়, যেমন ভূগোল বিদ্যা, সামাজিক নৃবিজ্ঞান, ইতিহাস, ব্যবহারিক বিজ্ঞান সম্পর্কে লেখাপড়া সীমিত। এই দেখুন, ধারাবাহিক আত্মবৃত্তান্তের ২৯ পর্বে, আমাদের নির্মীয়মান আয়ুর্বেদিক কলেজ ও হাসপাতালের কানেকটিভিটির কথা বলতে গিয়ে তুরা, শিলং ও খাসিয়া পাহাড়ের সঙ্গে বড়পেটার কঁদমগুড়ির সহজ সংযোগের প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেছি। সংক্ষেপে বিষয়টি বলতেও পারিনি।
বড়পেটা আর মেঘালয়ের পারস্পরিক দূরত্ব মেনে নিচ্ছি। কিন্তু ওই চির মনোহরের সঙ্গে নিম্ন অসমের অমিলের চেয়ে মিল অনেক বেশি। ভাষিক ও জাতিবৈচিত্র্য এক রকম না হলেও বঞ্চভাষী, অসমিয়া, রাজবংশি, বরো, রাভা, কোচ জনগোষ্ঠীর খাদ্যভাসের মধ্যে বিশেষ পার্থক্য নেই। বড়পেটা হয়ে, কদমগুঁড়ি ছুঁয়ে, পূর্ব দিকের লখিমপুর, গোয়ালপাড়ার দিকে এগোলে পাহাড়ি জনবসতির গন্ধ নাকে এসে লাগবে। লখিমপুরের কিছুটা আগেই, রাস্তা গারো পাহাড়ের দিকে ছুটে গেছে। আঁকাবাকা পথ। এদিকে সেদিকে, সেদিকে এদিকে রাজবংশি, গারো, বঙালি ও আসমিয়াদের বসতি। সবাই একসঙ্গে পাশাপাশি থাকে। উসকানি প্রবণ এলাকা ভাবলে ভুল হবে, সাধারণ কৃষক আর ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা হাতে হাত, বেঁধে-বেঁধে চলে, যে-কোনো দুর্যোগে, প্ররোচিত মুহূর্তেও একে-অন্যের পাশে দাঁড়ায়, যখন পরোচনা, কুমন্ত্রণা এসে ফাটল ধরাতে চায়, সামরিক উত্তেজনা অতিক্রম করে তারা ধারাবাহিক সহ-অবস্থানে মাথা পরস্পরের বুকে হেলিয়ে দেয়, স্বার্থের হিসেব কষে না, জড়িয়ে ধরে শান্তিপূর্ণ বসবাসের সত্যকে। সত্যের শতকে।
গোপালপাড়া থেকে ধুবড়ি, ধুবড়ি থেকে মানকাছর পর্যন্ত হাজার হাজার বছর জুড়ে একই স্রোত বইছে। কোথাও সবল, কোথাও ক্ষীণ। কোথাও কোলাহলময়। গরিমাময়। চেহারার তারতম্যও ধীরে ধীরে লঘু হয়ে যাচ্ছে। এ স্রোতের শুরু আর শেষ কোথায়, সাকিন কোথায়, বলা কঠিন, আমরা শুধু এইটুকু বলতে পারি, প্রস্তর যুগ থেকে বা তারও আগে থেকে নদী আর পাহাড়ের কোল ঘেঁষে যাযাবর, আর কৃষিজীবী জনপদ সমতলে এসে জড়ো হয়েছে। একাংশ পাহাড়ি অঞ্চলের বসবাস এখনও ছাড়তে পারেনি। টিলা, উঁচু জমি, আদিম-অনাদিম বাসিন্দারা ভাঙন প্রবন এলাকায় মিশ্র অভ্যাস নিয়ে জেগে আছে, বিনিদ্র নদীর মতো। গ্রাম নামেও ছড়িয়ে আছে তাদের যাপনের মিশ্র কাব্য। এই যেমন, গারো পাহাড়ের নিম্নভূমিতে ফুলবাড়ি নামের যে অঞ্চল আছে, তার জনপদ প্রধানত বঙ্গভাষী। আবার ভারত- বাংলাদেশ সীমান্তের ওপারে, একই নামের আরেকটি অঞ্চলে বাস করেন, বাঙালি, গারো ও অন্যান্য সম্প্রদায়।
এলাকাটি সম্ভবত বৃহত্তর ময়মনসিং এর অন্তর্গত। পাহাড়ি জনজাতির আদব-কায়দা এখানে সংহত, সুরক্ষিত। বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন আদিবাসীর সংস্কৃতির সংরক্ষণে খুবই সতর্ক। গড়ে তুলেছে সংগ্রহশালা, আর গবেষণা কেন্দ্র। এক সময় এ কেন্দ্রের মহাপরিচালকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল কবি রফিক আজাদকে। রফিক যত্নশীল, স্নেহ প্রবণ মানুষ। গবেষনা কেন্দ্রে পড়ে থাকতেন। সন্ধ্যার পর তার গৃহে জমে উঠত আড্ডা আর ভোজন পর্ব। রফিক আজাদের সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। জনমুখে শুনেছি, দিলখোলা মানুষ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই করেছেন। ১৯৭১-এর পর ঢাকায় চলে গেলেন। বাংলা একাডেমীর ডেপুটি পরিচালকের পদ ছিল তাঁর। বেহিসেবি, হঠাৎ চাকরি ছেড়ে দিলেন। তাঁকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। রফিক তাঁকে আপা সম্মোধন করতেন। ‘রফিক ভাই’ -এর ব্যবহারিক জীবনের শৃঙ্খলাহীনতা সহ্য করে তাঁকে ময়মন সিং-এর জনজাতীর গবেষণা কেন্দ্রের সর্বোচ্চ পদে বসিয়ে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যোগ্য কন্যা।
ভারত- বাংলাদেশের সমান্তরাল দুই ফুলবাড়ির নামকরণের ইতিহাস আমার জানা নেই। মনে হয়, ওপার থেকে ব্রহ্মপুত্রের পাড় দিয়ে উজান বেয়ে কৃষিজীবী বাঙালি অখণ্ড অসমে এসে বসতি স্থাপন করে। তখনই পূর্বস্মৃতিকে টিকিয়ে রাখতে এলাকার নাম দের ফুলবাড়ি। নামটি খুব কমন। শিলিগুড়ির নিকটস্থ একটি গঞ্জের নাম ফুলবাড়ি। সীমান্ত এলাকা। বঙ্গের ফালাকাটায়ও এ নামের একটি গ্রাম রয়েছে। এখানকার বাসিন্দারা প্রধানত বাংলাদেশ থেকে আগত কৃষিজীবী আর মৎস্যজীবী। শুনেছি, বরাক উপত্যকার কাটিগড়া অঞ্চলেও, বরাকতীরের ছোট এক গ্রাম ফুলবাড়ি বলে পরিচিত। স্থানীয় বাসিন্দাদের শতাংশ বাঙালি, পেশা তাঁদের কৃষি।
কৃষিজীবীরা খুবই স্মৃতিকাতর। তাড়া খেয়ে, অন্যান্য দুর্যোগের কবল থেকে মুক্ত হতে গিয়ে এক এলাকা ছেড়ে অন্য কোনো নিরাপদ এলাকায়। বসবাস গড়ে তুলবার নিত্যতা তাঁদের সঙ্গী, ঠিক একইভাবে পূর্বস্মৃতি, পূর্বনাম জাগিয়ে রাখবার প্রচেষ্টাও বাঁচিয়ে রাখেন, অস্টিক জন গোষ্ঠীর মধ্যে এই ঝোঁক সম্ভবত বেশি। এতক্ষণ যে-সব অঞ্চল, মিশ্র রক্তের যে-সব জাতি, উপজাতির কথা বললাম, তাঁদের যাপনে, জাগরণে, স্মৃতির প্রভাব স্তিমিত হলেও, তার শিখা নিভু নিভু প্রদীপের মতো বেঁচে থাকে।
কবি মহম্মদ ইকবাল রিকনস্ট্রাকশন অফ ইসলামিক থট, বক্তৃতা মালার শুরুতেই বলেছিলেন, প্রতিটি প্রাণ, এমনকি কীট পতঙ্গও তাদের জন্মের পর থেকে মুত্যু পর্যন্ত কিছু একটা হতে চায়। মানুষের এ আকাঙ্খা আরো বড়ো বড়ো, আরো মহৎ। সে শুধু নিজে হয়ে-উঠতে চায় না, যেখানে অন্যকে, প্রতিবেশীকে সঙ্গে নিয়ে বেঁচে বর্তে থাকতে ভালোবাসে, যেখানে সীমান্ত নেই। নেই পেছন দিকে তাকিয়ে থাকবার ভুল রোমান্টিকতা। দায়বদ্ধতা আর যৌথ বসবাস তার অন্তরের ধর্ম। আমি এই যৌথতার জগতে নগণ্য প্রাণী
অসমের সব অঞ্চলে ঘুরে বেড়ানোর আমার সুযোগ হয়নি। অবসর কোথায়? এনই এফ-এর কাঙ্খিত নির্মান আমার যাপনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছে। সাংগঠনিক কাজকর্মের আওতা ক্রমশ বাড়ছে। গুয়াহাটি, বড়পেটা, কোকরাঝাড়সহ ভাটি অসমে প্রায়ই চক্কর দিতে হয়, ঘুরতে ঘুরতে দেখতে পাই, বিচিত্র সব জনপদের গতিশীলতা, শিক্ষার প্রতি তাঁদের আগ্রহ, আর সংস্কৃতি রক্ষার ঐকান্তিক লড়াই। কবি মহম্মদ ইকবাল রিকনস্ট্রাকশন অফ ইসলামিক থট, বক্তৃতা মালার শুরুতেই বলেছিলেন, প্রতিটি প্রাণ, এমনকি কীট পতঙ্গও তাদের জন্মের পর থেকে মুত্যু পর্যন্ত কিছু একটা হতে চায়। মানুষের এ আকাঙ্খা আরো বড়ো বড়ো, আরো মহৎ। সে শুধু নিজে হয়ে-উঠতে চায় না, যেখানে অন্যকে, প্রতিবেশীকে সঙ্গে নিয়ে বেঁচে বর্তে থাকতে ভালোবাসে, যেখানে সীমান্ত নেই। নেই পেছন দিকে তাকিয়ে থাকবার ভুল রোমান্টিকতা। দায়বদ্ধতা আর যৌথ বসবাস তার অন্তরের ধর্ম। আমি এই যৌথতার জগতে নগণ্য প্রাণী। এ কথা আগের তুলনায় বহু বেশি অনুধাবন করছি। শিক্ষার নাবায়ন আর নির্মাণে এ আত্ম-উপলব্ধীকে ঘিরে কারিগরি বিদ্যাকেন্দ্র বহুমুখী আইন মহাবিদ্যালয়, নার্সিং, ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান গড়েছি, এবার চিকিৎস্য পরিষেবার ব্যতিক্রম ধর্মী হাসপাতাল আর শিক্ষা ক্যাম্পাসের পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে চাইছি। মাথা নুইয়ে স্বীকার করছি, সমাজ আমার পাশে আছে, বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করছে, প্রায় বিনা প্রতিরোধে জমি ছেড়ে দিচ্ছে।
আমাদের কানেকটিভিটি সর্বগ্রাহ্য, সহজলভ্য। নদী, বনাঞ্চল, পাহড়ের প্রতিবন্ধকতা নেই, নেই দুরারোগ্য ব্যাধির অসহিষ্ণুতা। যে কোনো অঞ্চলের, মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশের, মেঘালয় থেকে মিজোরামের, প্রতিবেশী পশ্চিমবঙ্গের ছাত্রছাত্রীরা, সহজের রাস্তা পেরিয়ে বড়পেটার কাদমগুঁড়িতে পৌঁছে যাবেন। যোগ্য চিকিৎসক, যোগ্য নার্স, যোগ্য শিক্ষক আর শিক্ষাকর্মীরা আমাদের আমন্ত্রণে সাড়া দিচ্ছেন। অবকাঠামো, পরিকাঠামো প্রস্তুত। পাঠ্যসূচিও তৈরি। এবার উদ্বোধনী- ঘণ্টা বাজলেই শুরু হবে সর্বপ্রাণের, সর্বনামের পরিষেবার উৎসব, অপেক্ষা করছে পঠন-পাঠনের উচ্ছ্বাস আর মানুষের স্বাস্থ্য রক্ষার প্রাচীন, প্রাচীনতম চিকিৎসা পদ্ধতির সব ধরনের রত্ন প্রসবের প্রত্যাশা।
আমাদের আশু চিকিৎসা ক্যাম্পাসে গাছ থাকবে, উন্মুক্ত মাঠ থাকবে, জলাশয় থাকবে, আশা করি বালখিল্য আচরণ, শৃঙ্খলাহীনতা, বহিরাগত হস্তক্ষেপের জায়গা হবে না, প্রশ্রয় পাবে না। কোনো রকমের আকাল, খরা আর অনুশাসনের চোখ রাঙানি। যা কিছু সহজ, সময়ের উপযোগী, প্রকৃতিজাত এবং বৈষম্যহীন এবং কর্মসংস্থানময়, সে রকম ব্যবস্থা আর ব্যবস্থাপনা নির্মাণ করতে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ। সমাপ্তিমুখী মেডিক্যাল কলেজের খামতি আর যৌথ প্রয়াসের কোথায় কোথায় ঘাটতি, কোথার কোথায় স্বাতন্ত্র, তা তলিয়ে দেখতে কয়েকদিন, কয়েকমাস আগে আমি সন্ত্রীক তুরস্কে, আজারবাইজানে, পরে একা বাংলাদেশেও ছুটে গেছি। ওঁরা সেকেলে হাকিমি বিদ্যার [ইউনানি] নবায়ণকে কীভাবে সুনির্দিষ্ট, সুচিহ্নিত গন্তব্যে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছেন, তা পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ হয়েছে। এ বিষয়ে বিশদভাবে লেখা জরুবি। পাশাপাশি উত্তর ও পশ্চিম, পূর্ব আর দক্ষিণ ভারতে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা বিদ্যার অবস্থান কী, তার সমূহ প্রতিবেদন পেশ করবার ইচ্ছে রইল। আমিন।
ক্রমশ…
♦—♦♦—♦♦—♦♦—♦
লেখক: উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রথম বেসরকারি কলেজ গোষ্ঠী এন.ই.এফ-এর চেয়ারম্যান। গুয়াহাটির বাসিন্দা
আগের পর্ব পড়ুন: পর্ব-২৯
❤ Support Us