- কে | রি | য়া | র-ক্যা | ম্পা | স ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
- মে ২৬, ২০২৪
ধারাবাহিক আত্মকথা : আমাদের বিদ্যানিকেতন

আমিত্বহীনতার বৃত্তান্ত
নিজের হয়ে–ওঠার গল্পে এবার কী বললেন স্বাস্থ্যময় মতভেদে বিশ্বাসী ড. জাকির হোছে্ন ? আত্মপ্রচারের ঢাক পেটাতে অভ্যস্থ নন যে শিক্ষাবিদ, যাঁর হাতে বিদ্যা ফোটে, হাসি ছড়ায় নির্মীয়মাণ নক্ষত্ররা, তিনি কি ফিরে তাকাতে শুরু করলেন অর্ধশতক পেরিয়ে ? স্মৃতির শৈশবকে, স্কুলজীবনকে খোলা চোখে দেখতে চাইছেন অনন্য আর বিনম্র ভঙ্গিতে ? এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে, বারবার পড়তে হবে তাঁর জিজ্ঞাসাময় আত্মকথা।
আমাদের অকৃত্রিম আত্মীয় আর সমষ্টির নিবিড় হিতাকাঙ্খী জাকিরের উত্তরণ অবশ্যই এক উজ্ব্বল ব্যতিক্রম। চির গম্ভীর তাঁর নিত্য সহচর। ব্যস্ততা আর সংযম জাকিরের দুষ্পাঠ্য চিত্রলেখা, যেখানে পরম বন্ধুর ছায়া কিংবা ফোনের প্রবেশও থমকে যায়, সাড়া দেয় না, ওপারের কন্ঠস্বর। এ কীসের লক্ষণ ? আপোসহীন কর্মমগ্নতা আর নিষ্ঠার ? আত্মস্থ বলেই কি এতদিন এড়িয়ে গেছেন অতীতকে খুঁজে দেখবার আগ্রহ ?
সম্পাদক। ২৫.৫.২০২৪
• পর্ব-৩২ •
ব্যবহারিক দর্শন, বৃহত্তর সমাজবিদ্যা আর পুরানের শিক্ষা নিয়ে আমরা যাপনের অলিগলি দিয়ে ছুটতে ছুটতে অনেক ভাষণ দিই বটে — অতীতের সঙ্গে, স্মৃতির সঙ্গে বসবাস নয়। তাকাতে হবে সম্মুখে ছোট বড় রাস্তা দিয়ে, ছোটার পথে দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়ে উঠবে চলন্ত জনপদ, গাছগাছালি, চড়াই উতরাই, পাহাড়, নদী-উপনদী এরকম অসংখ্য ছবি। এসব কি হারিয়ে যায় ? হারায় না। চেতন অবচেতনে জেগে থাকে, আমাদের জাগিয়ে রাখে। এখানে যে কোনও মানুষের সরব অথবা নীরব ভূমিকা ট্রেনের যাত্রীর মতো, দূরে কোথাও, নিকটেও হতে পারে, নির্দিষ্ট কাজে কিংবা সফরে যেতে হচ্ছে তাঁকে। ট্রেন ষ্টেশন ছাড়তেই দৃশ্যমান জগত পেছন দিকে হাঁটতে থাকে। দৃষ্টির অগোচরে কিছুক্ষনের জন্য আড়ালে পড়ে থাকে, দগদগে স্মৃতি হলে আলাদা কথা। সঙ্গ দেয়, হাসায় অথবা কাঁদায়। ভারী হয়ে ওঠে বিরহ। আবার স্মৃতির জীবন পুরনো হলে থেকে থেকে ফিরে আসে চিন্তায়, গার্হস্থ্যের নিত্যে, অনিত্যে। এটাও জীবনের আরেক মধুর প্রাপ্তি। স্মৃতিহীন মানুষ বেঁচে থেকেও বাঁচার স্বাদ, আহ্লাদ, শোক আর বেদনা টের পায় না। জীবন পাথরের মতো বোঝার আকার নয়। সুপ্ত অথবা তরতাজা স্মৃতি নিয়ে সম্মুখে এগোই বলেই আমরা সব কাজে প্রাণ খুঁজে পাই। অতীতের সঙ্গে মিশে থাকি, অভিজ্ঞতাকেও গুরুত্ব দিই। কারণ সে আমাদের যে কোনও নির্মাণ আর অসমাপ্ত সৃষ্টির খোরাক।

এনইএফ কলেজে গবেষণারত ছাত্র ছাত্রীরা
এখানে এত কথা বলবার কারণ, ফেলে আসা দিনগুলির রাতগুলিকে ভুলে থাকা সম্ভব নয়, ‘আমি’কে চেপে রেখে যা বলেছি, বলবার চেষ্টা করেছি, তাতে চালচিত্রের আভাস যতটা না প্রকট, তার চেয়ে অনেক বেশি ধূসর, ধোঁয়াটে আমার শৈশব, স্কুল জীবন, কলেজ জীবনের দুরন্ত প্রবাহ। সে সব কথা এবার বলতে হবে। ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাতে হবে ডানদিকে, বাঁ দিকে। যে গ্রামে আমার কিংবা পূর্ব পুরুষের জন্ম, সে গ্রামের ইতিকথা, জলছবি, জনছবি কিছুই বলা হয়নি। ভাঁড়ারে রসদের অভাব নেই। বলতে হবে, যে স্কুলে প্রাথমিক লেখাপড়ার আরম্ভ, সে স্কুলের বয়ান ছুঁতে পারিনি। পার্শ্ব চরিত্রের অনেকেই জাগ্রত ছবির মতো ক্যানভাসে রং ছড়াচ্ছেন এখনো, তাঁদের সঙ্গকথা, উহ্য হয়ে আছে। গ্রামের পাঠ শেষ করে গ্রামীণ উচ্চ বিদ্যালয়ের পরিবেশ, সহপাঠী আর বিদ্যাদাতাদের চালচলনও এ লেখায় ফুটে উঠল না। কারণ কী? আমার অক্ষমতা ? কতটা, কীভাবে বলব, বলা উচিত না অনুচিত, এসব ব্যাপারে সংশয়ে আটকে আছি। ব্যক্তিকতা মুখ্য হয়ে উঠলে আত্মবৃত্তান্ত যান্ত্রিক, ক্লিশে, এককতাময় হতে বাধ্য। সৃজনধর্মী যেকোনো লেখার ক্ষেত্রেই একথা নির্মম সত্য।

ফরাসি লেখক ওনারে দে বালজাক
জীবনী কিংবা আত্মজীবনী, ওই ছেলেটির বালজাকের সঙ্গে পরিচয়, কথাবার্তা, আর তাঁদের প্রথম দেখার অভিজ্ঞতার মতো কেবল বর্ণনাময়, ভাষণময় যদি হয়ে ওঠে, তা হলে সেটা কারো কাজে আসে না। নিছক ব্যক্তি বিশেষের জীবনসর্বস্ব প্রাণহীন বস্তুর মতো পড়ে থাকবে। কেউ ছুঁয়ে দেখবে না। আত্মকে ফিরে দেখা সহজ কথা নয়, মানুষের ‘আমি’ আর আত্মতার বাইরের দুনিয়াটাকে খোলা চোখে, খোলা মনে দেখাটাও জরুরি
ফরাসি লেখক বালজাকের কাছে একবার এক তরুণ হাজির হয়ে বলল, ‘আমাকে লিখতে শেখাবেন?’ কীভাবে লিখব, বাতলে দেবেন রাস্তা ?’ বালজাক মনোযোগ দিয়ে ওকে শুনলেন। তাড়িয়ে দেননি। উৎসাহ জুগিয়ে বললেন, ‘এই যে তুমি আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছ, কথা বলেছ, এসব লিখে নিয়ে আসবে। তোমার কসরত দেখে বুঝতে পারব, তোমাকে দিয়ে লেখা হবে, কি হবে না ।’ তরুণটি প্রবল উৎসাহ নিয়ে বাড়ি ফিরল। পরদিন যথাসময়ে বালজাকের বাড়িতে সে উপস্থিত । হাতে আইকনিক লেখকের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ, তার পরিচয় আর সংলাপের লিখিত বয়ান। বালজাক পড়ছেন। পড়তে পড়তে মুখমণ্ডলের, চোখের ভাষা বদলে যাচ্ছে । মেঘ জমছে আকাশে। এই বুঝি গম্ভীর ফেটে পড়েন। ছেলেটি স্তব্ধ। বালজাককে দেখছে, দেখেই যাচ্ছে—নিঃশব্দে । ভেবেছিল, নিজের স্তুতি আর প্রশস্তির বিবরণ পড়ে খুশি হবেন জনপ্রিয় লেখক । ঘটল যা, তা অপ্রত্যাশিত। বালজাক বিরক্ত। লেখাটি পড়া শেষ করে ছেলেটির দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘ওই যে সেদিন, আমার বাড়ি আসার সময় তোমার দু চোখ কি বন্ধ ছিল ? অন্য কাউকে দেখনি ? কিছুই নজরে পড়েনি ? পথচলতি মানুষ, যানবাহন, পথের পাশের গাছপালা, রাস্তার খানাখন্দ, সবই গরহাজির কেন তোমার লেখায় ? লেখাটা হয়নি। ভুল লিখেছ। ভুল বকেছ। আসা যাওয়ার পথে নিজের বাইরে, আমার বাড়িতে এসেও আমাকে ছাড়া বাড়তি কিছুই তোমার দৃষ্টিগোচর হয়নি ! এভাবে লিখলে চলবে না, ব্যর্থতা তোমাকে ঘিরে ধরবে, লেখা ছেড়ে অন্য পেশার পেছনে ধাওয়া করতে হবে। ‘ ছেলেটি তার লেখার দুর্বলতা বুঝতে পারল।
জীবনী কিংবা আত্মজীবনী, ওই ছেলেটির বালজাকের সঙ্গে পরিচয়, কথাবার্তা, আর তাঁদের প্রথম দেখার অভিজ্ঞতার মতো কেবল বর্ণনাময়, ভাষণময় যদি হয়ে ওঠে, তা হলে সেটা কারো কাজে আসে না। নিছক ব্যক্তি বিশেষের জীবনসর্বস্ব প্রাণহীন বস্তুর মতো পড়ে থাকবে। কেউ ছুঁয়ে দেখবে না। আত্মকে ফিরে দেখা সহজ কথা নয়, মানুষের ‘আমি’ আর আত্মতার বাইরের দুনিয়াটাকে খোলা চোখে, খোলা মনে দেখাটাও জরুরি। তা হলে যা বলছি, বলতে চাইছি, সে কথা বলাটার প্রয়োজনীয়তা চারপাশের সহযাত্রীদের বোঝাতে পারব, নিজেও বুঝতে শিখব, আত্মকথা লিখবার কারণ কী? আত্মপ্রচার ? না আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রশ্ন করা- কীভাবে এতদূর আসা হল, সঙ্গী-বেসঙ্গী কারা ছিল, পথ চলার লক্ষ্য কী? এ পর্যন্ত এটুকু বলার সাহস পেয়েছি যে, আত্মপ্রচারের ঢাক ঢোলে ভেসে যাওয়া আমাকে দিয়ে হবেনা, বলার কথা অকপট বলতে হবে। দৃষ্টি ছড়িয়ে, নিজেকে ছাড়িয়ে সম্মুখে যেতে হবে।

আইন মন্ত্রকের তত্ত্বাবধানে, আইআইটি গুয়াহাটি এবং ন্যাশেনাল ল ইউনিভার্সিটি আয়োজিত এক সম্মেলনে এনইএফ এর আইন শাখার ছাত্র ছাত্রীরা
এনইএফ-এর গন্তব্যে নড়ন চড়ন নেই। যা করবার তা করতে হচ্ছে। স্বেচ্ছাসেবী ট্রাস্ট । আমি তার শাখা প্রশাখার মতো হাত পা বাড়িয়ে দিয়েছি। চোখ সামনে, অতএব পেছন দিকে তাকাবার ফুরসত নেই। এ সুযোগও বন্ধ। মনে মনে বলতে হয়, আসমাঁ সে আগে আসমাঁ ভি হ্যায়। আকাশের ওপারে আকাশ, সে আকাশে যেতে হবে। উড়তে হবে। যথাযোগ্য জ্ঞান চাই, পালকশূন্য ডানার উড়বার শক্তি কোথায় ? ডানার মতো ডানা আমাদের দরকার। জরুরি তার উদীয়মান শক্তির সঞ্চয় আর সঞ্চালন। এরকম স্বনির্ভর, স্বতন্ত্র বিশ্বাস গড়ে তোলা যেমন আবশ্যক, তেমনি অপরিহার্য স্মৃতির ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নিজেকে, নিজের চারপাশকে ফিরে দেখার অভ্যাসের সংহত, বিনম্র নির্মাণ ।
ক্রমশ…
♦—♦♦—♦♦—♦♦—♦
লেখক: উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রথম বেসরকারি কলেজ গোষ্ঠী এন.ই.এফ-এর চেয়ারম্যান। গুয়াহাটির বাসিন্দা
আগের পর্ব পড়ুন: পর্ব-৩১
❤ Support Us