Advertisement
  • কে | রি | য়া | র-ক্যা | ম্পা | স ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
  • জুন ২৫, ২০২৩

ধারাবাহিক আত্মকথা : আমাদের বিদ্যানিকেতন

জাকির হোছেন্
ধারাবাহিক আত্মকথা : আমাদের বিদ্যানিকেতন

বয়স ৫৬+,দীর্ঘাঙ্গ, নির্মেদ পুরুষ।  গুয়াহাটির এনইএফ গ্রুপ অফ কলেজের  প্রতিষ্ঠাতা। ভারতের শিক্ষা মহলে, কর্মঠ আর প্রবল আত্মবিশ্বাসী বলে সুপরিচিত। মাইনিং নিয়ে লেখাপড়া করতে গিয়েছিলেন হায়দ্রাবাদের ওসমানি বিশ্ববিদ্যালয়ে। খুচরো বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে ১৯৮৯-য় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ। পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নিয়েও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি তখন তাঁর হাতে, চাকরি নিয়ে নিরুদ্বেগ, চিন্তা-ভাবনা অন্যরকম।

কোকরাঝাড়ে বাড়ি যাওয়ার বদলে সোজা হাজির মহানগর গুয়াহাটিতে। গন্তব্য নির্দিষ্ট, লক্ষ্যও স্পষ্ট, স্বাধীনভাবে ব্যবসা করবেন, শুরু হল  লড়াই আর আত্মত্যাগ, গড়ে তুললেন ভাড়া বাড়িতে কলেজ ফর করেসপণ্ডেন্স, সঙ্গী জনৈক বন্ধু, মূলধন যৎসামান্য।

কালক্রমে বাড়ল আত্মবিশ্বাসের মানচিত্র, তৈরি হল একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। স্মৃতির ওই প্রাথমিক লড়াই, এক লড়াকুর স্বপ্ন, জীবন দর্শন আর নিজের পারিবারিক কাহিনি  শোনালেন বহুমুখী বিদ্যানিকেতনের স্থপতি ও চেয়ারম্যান জাকির। আমিত্বহীনতার এ এক অসাধারণ বৃত্তান্ত।

প্রসঙ্গত জানালেন, কিছু সংখ্যক প্রত্যাশা কীভাবে জড়ো হচ্ছে বুকের অতলে এবং ব্রহ্মপুত্রের উত্তরপাড়ের বিস্তীর্ণ এলাকায় কোন লক্ষ্য নিয়ে নির্মাণ করবেন আয়ুর্বেদিক কলেজ ও হাসপাতাল— কেন তাঁর নির্মাণের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গকে জড়াতে চাইছেন প্রচারবিমুখ শিক্ষাদরদী এবং তাঁর স্বপ্নময়তা আর আত্মবৃত্তান্তের পর্ব থেকে পর্বান্তরে জাগ্রত কোন গল্পসত্য আর সংশয়হীন চিত্তের বিত্ত—দিলখোলা ভঙ্গিতে এসব আত্মবিশ্বাসী ছবি তুলে ধরলেন

 

আ¦ ত্ম ¦ ক ¦থা

— প্রথম পর্ব —

আমার বয়স বেশি নয়, কমও নয়, বয়সের ভার নিয়ে চিন্তিত নই, চিন্তার অবকাশ কোথায়, পঠন-পাঠনে কেটে যায় দিন, যাপনের অনেকটাই  ব্যস্ত থাকতে হয় বহুমুখী ক্যাম্পাসের কাজেকর্মে, শুধু প্রশাসন নিয়ে নয়, প্রশাসনের বাইরে পাঠ্যসূচি নির্মানের পরীক্ষা-নিরীক্ষায়ও। এরকম ব্যস্ত থাকি বলেই পেছন দিকে, নিজের দিকে, পরিবারের সব দায়-দায়িত্বের দিকে তাকানোর ফুরসত নেই। তবু যতটা সম্ভব, সমাজ ও পরিবার নিয়ে ভাবি, ভাবতেও হয়।

নিজের আদিবাড়ি, আত্মীয়-স্বজন, পুরনো গ্রাম আর হয়ে-ওঠার শৈশবও আমাকে ঘন ঘন ছুঁয়ে যায়। শরীরে ঐতিহ্যবাহী, ফৌজি পরিবারের রক্ত, এ রক্তের ঢেউ অস্বীকার করি কী করে? অবকাশের মুহুর্তে, দিনে কিংবা রাতে, চোখ বন্ধ করলেই চলন্ত ট্রেন থেকে দেখা, পেছনে ধাবমান ছবির মতো ছেলেবেলা সামনে চলে আসে; আমাকে আমারই গল্প শোনায়, গল্প বলিয়ে নেয়, এসব গল্পের নায়ক কেবল আমি নই, আমার গ্রাম, আমার পূর্বপুরুষ,আব্বা-আম্মা, আমার প্রতিবেশী সবাই বিরতিহীন পার্শ্বচরিত্র হয়ে ওঠেন।

আত্মবৃত্তান্ত কখনো বলব বা লিখব ভাবিনি, এ পর্যন্ত বহু বন্ধু আর স্বজনের আবদার এড়িয়ে গেছি, এবার আর পারলাম না, একবছর পেছনে লেগে থাকলেন একজন সুহৃদ, আমার মতোই গ্রামে তাঁরও জন্ম, প্রাথমিক লেখাপড়াও গ্রামে। যখন গ্রাম ছেড়ে শহরে আসি তখন  নতুন পরিবেশে, নতুন করে জন্মাতে হয়,তখনও আমার পোশাকি আচরণে জন্মগ্রামের চিহ্ন লেগে থাকে। তার মানে, আমাদের মতো যাঁদের দেহে হেলে চাষীর গন্ধ ছড়িয়ে থাকে, উর্বরা শক্তি জোগায় গ্রামীন অভ্যাসে, স্মৃতির সফরে বারবার যারা অরণ্যে, বৃক্ষতলে নদীর পাশে ফিরে আসি, আসতে বাধ্য হই এবং গাঁ গেরামে, গ্রামীন লোকালয়, শত শত বছরের নিবিড় ঐতিহ্য টিঁকিয়ে রাখি তাদের পূর্বস্মৃতির অক্ষয় হামেশা জেগে রয়।

আমি একজন সাধারণ শিক্ষাকর্মী কিংবা সংগঠক, আমার হয়ে-ওঠার সাংগঠনিক প্রক্রিয়াকে তাকত  দিয়েছে প্রথমত গ্রাম। দ্বিতীয়ত আমার আব্বা-আম্মার সান্নিধ্য। তৃতীয়ত পূর্বপুরুষের জীবন-ঘষা  আবহমান ঐতিহ্য। সচেতন হলে, যে কেউ তাঁর ইহকর্মে এই প্রবাহ আবিষ্কার করবেন, নিজের সত্যাসত্যকে এইভাবেই খুঁজবেন। প্রতিটি জীবনই, আমি বিশ্বাস করি সত্যের পরীক্ষাগার। বহু পরীক্ষার পর ব্যক্তিমানুষ সত্য আর লক্ষ্যের দিকে দৃষ্টিপাত করার সুযোগ খোঁজে। আমি কোনো মহৎ কীর্তি স্থাপন করি নি, করবার কোনো বাসনা নেই। আরও দশজন যেরকম বেঁচেবর্তে থাকবার চেষ্টা করেন, নিজেকে যথাসম্ভব শৃঙ্খলাবদ্ধ আর সুসংগঠিত করবার পরিসরে সামাজিক কিংবা ব্যক্তির বিস্তৃতি দেখতে চান, আমিও তেমনি শিক্ষার কাঠামো-পরিকাঠামো গড়ে তুলবার প্রক্রিয়ায় নিজেকে জড়িয়ে, কয়েকশো বছরের অতীতকে, প্রান্তিক মানুষকে খুঁজছি। এটাই আমার বিনীত সাধনা। গোটা সমাজের অশ্রুমোচন আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এরকম স্বপ্ন কি দেখি ? স্বপ্ন দেখার চোখ তৈরি হলে, সে চোখকে আরো সুদূরপ্রসারী, সুদূরের পিয়াসি করে তোলা দরকার। আজ এই প্রয়োজনটুকু বুঝি, সবসময় বোঝার চেষ্টা করি। এরকম বাস্তবতাময় ভাবাবেগের জনক অবশ্যই আমার  বাবা, বাবার স্বপ্নময়তাকে গৃহকোণে, গৃহের বাইরে বিস্তৃত করার সমস্ত কৃতিত্ব আমার গর্ভধারিণী, স্তন্যদায়িনী মায়ের। আমার রক্তে, শিরা-উপশিরায়, দেহের মাংসখণ্ডে তাঁদের শ্রম আর অশেষ ত্যাগ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, আশা করি তা থাকবে।

বাবার পূর্ব পুরুষ এককালে বেলুচিস্তানের বাসিন্দা ছিলেন। যোদ্ধার জাত। মুঘল আমলে, তাঁর  পূর্বপুরুষ(তাঁরই লেখা পারিবারিক নথি অনুসারে) বেঙ্গল সুলতানের ফৌজি বাহিনীর চাকরি নিয়ে বাংলায় চলে আসেন। চেঙ্গিস খানের বংশধর বলে তাঁদের আত্মগৌরব ছিল। মুঘল আমলেই ভারতে প্রবেশ। পরে পূর্ববঙ্গে চলে এলেন। স্থায়ী বসতি স্থাপন করলেন বৃহত্তর জামালপুর জেলায়, সুখনাগারি গ্রামে। বিস্তর জমিজমা আর প্রতিপত্তির অভাব ছিল না। কিন্তু ঐ সুখ কপালে সইল না, কৃষক বিদ্রোহে যোগ দিয়ে গোটা পরিবার ব্রিটিশের চক্ষুশূল হয়ে ওঠেন। বাধ্য হয়ে বংশানুক্রমিক ভিটে ছেড়ে, জমিজমা ছেড়ে; ১৯০১ সালে, গোয়ালপাড়া জেলার কোকঝাড়ের পাশে, জঙ্গলাবৃত ঘোড়ামারা গ্রামে নতুন বসতি গড়লেন। এলাকা তখন চাষযোগ্য নয়। জমি আছে, কিন্তু চাষবাসের অযোগ্য। চারদিকে বন্য পশু, পোকা-মাকড়ের উপদ্রব। প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রায়ই ধেয়ে আসে। বন্যায়  ডুবে যায় বনজ জমি , সে জমিকে দুরস্ত করে, জঙ্গল আবাদ করে চাষের উপযোগী বানিয়ে তুললেন আমার আব্বা সিকন্দর আলির পূর্বগামীরা। নিজ দেশের এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে এসে, সে অঞ্চলেরই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠলেন তাঁরা। খাদ্যাভ্যাস,পোশাক আশাক বদলায়নি তাঁদের, ধীরে ধীরে স্থানীয় ভাষার প্রভাব পড়ল জীবন-যাপনে, বাচনভঙ্গিতে। আদি আত্মপরিচয় কখনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। স্থান বদলের সঙ্গে সঙ্গে কালক্রমে পূর্বস্মৃতি ফিকে হতে থাকল।  ধূসর স্মৃতি নিয়ে নতুন বসত ভূমিতে শিক্ষা প্রসারে মনোনিবেশ করলেন তাঁরা।

আব্বা বেশিদূর লেখাপড়া করার সুযোগ পাননি, আর্থিক অনটন, রাস্তাঘাটের আকাল থামিয়ে দিল। স্কুলে চাকরি নিতে বাধ্য হলেন। বাড়ির অদূরে স্কুল। ছাত্রদের বড়ো অংশই এলাকার বাসিন্দা। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সন্তান। বই নেই, স্লেট নেই। স্কুলের শক্তপোক্ত বাড়ি নেই। স্বাধীনতার নামে দেশ দু-টুকরো। দেশভাগের পর ভিটে-বাড়ি আঁকড়ে থাকলেন কারো কারো পিতা-মাতা। কেউ কেউ ওপারে গিয়ে উদ্বাস্তু বনে গেলেন। এও এক সঙ্কটকাল। সব দিক থেকেই প্রতিকূল পরিস্থিতি।  গুজব বাড়ল। বাড়ল  অবিশ্বাসও। এরকম আবহেই শিক্ষা প্রসার আর উন্নততর কৃষি পদ্ধতিতে বেঁচে থাকার রসদ খুঁজে পেলেন আমার আব্বা। বিয়ে করলেন তখনকার গোয়ালপাড়ার বৈঠামারি গ্রামের ক্লাস এইট উত্তীর্ণ মহিলা জাহেরা বেগমকে। দেহের ছায়ার মতো,বাবার নিত্য সঙ্গী  তিনি। নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। লেখা-পড়ার মূল্য জানতেন। রান্না-বান্না, পরিবারের দেখা-শুনো আর আমাদের পড়তে বসানোর সব দায়িত্ব তাঁর কাঁধে। আমরা পিঠোপিঠি চার ভাই-বোন। আমি সবার বড়ো।

আমার জন্ম, ১৯৬৭ সালের ১ অক্টোবর। কোকরাঝাড় থেকে ৬ কিলোমিটার ভেতরে, ঘোড়ামারা গ্রামে। আব্বা তখন স্কুলের প্রধান শিক্ষক। আমার পরের ভাই ২৬ বছর বয়সে মারা যায়।  ভাইয়ের মৃত্যু নিঃশব্দে হজম করলেন আব্বা। ভেতরে অযুত অশ্রু আর বাইরে কৃষিকাজের  ব্যস্ততা ও ছাত্র পড়ানোর দায়িত্ববোধ দিয়ে ঢেকে রাখলেন পুত্র হারানোর শোক । আমিই তখন মা-বাবার ভরসার অন্যতম নয়নমণি। আমার তিন বোন অল্প-বিস্তর লেখাপড়া করেছে। বিয়েশাদি করে তারা এখন পুরো সংসারী।

পূর্ববঙ্গের ভূমিহীন, দরিদ্র হাজার হাজার পরিবার কখনো স্বেচ্ছায়, কখনো  সরকারের আমন্ত্রণে, উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে পূর্ববঙ্গ থেকে আসামের সমতলে, ঝুঁকিপূর্ণ  নদী তীরে এসে বসতি স্থাপন  করতে থাকেন। তাঁদের সংখ্যা বাড়াতে প্রশাসনের বিস্তর উৎসাহ ছিল । ১৮৮০ সালের পর গ্রামীণ  মধ্যবিত্তের একাংশ ছোটোখাটো  ব্যবসায় জড়িয়ে, নদীপথে  চরাঞ্চলে  যাওয়া-আসা শুরু করেন, আসামে স্থায়ী বসবাসও গড়ে তোলেন তাঁরা। দুঃসহ  পরিবেশ। বন্যা, বৃষ্টি, নদী ভাঙনের মোকাবিলা করে চরাঞ্চলকে চাষের জমিতে রূপান্তরিত করতে থাকা এসব কৃষকের  শ্রম, নিষ্ঠা আর  স্থানীয় পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ঝুঁকি অতুলনীয়। বিশাল জনপদ।  প্রথমে অনাবাদী এলাকায়  যাযাবরের মতো চর এলাকায়  বাস করতেন। জঙ্গল কেটে জমিকে কৃষিযোগ্য করে তুললেন। হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়া প্রবল বন্যা তাঁদের সর্বস্ব ছিনিয়ে নিত। বাধ্য হয়ে তাঁরা অন্যত্র, নদীপাড় থেকে দূরে, অপেক্ষাকৃত  নিরাপদ বনাঞ্চলে আশ্রয় নিতেন। এঁদের সংখ্যাবৃদ্ধিতে জমি, ভাষা ও সংস্কৃতি  হারানোর ভয় জেগে ওঠে স্থানীয় জনজাতিদের মধ্যে। অহেতুক আশঙ্কা বাড়িয়ে দেয় উস্কানি।  বাধ্য হয়ে ব্রিটিশ সরকার শিক্ষিত মধ্যবিত্তের চাপে লাইন প্রথা চালু করল। ছিন্নমূল, প্রান্তিক কৃষক চর অঞ্চল ও জঙ্গলের নির্দিষ্ট এলাকার বাইরে বসবাসের অধিকার হারাল। তবু  কৃষিভিত্তিক জনস্রোতকে রোখা যায়নি। ভাষা ও সংস্কৃতি  খিদের চেয়ে বড়ো নয়। তার জ্বালা সব আবেগকে লোপাট করে দেয়।  জীবিকার তাড়া  হার মানিয়ে দেয় জাতি পরিচিতির সত্তাকে। অসমে গত ২০০ বছর আগে থেকে নদীপথ ধরে উজান বেয়ে  যে সব কৃষক  আর ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী নিম্ন আসামের জেলায় জেলায় এসে  বসবাস শুরু করেন, তাঁদের বড়ো অংশই পরিচিতির গরিমা বিসর্জন দিয়ে স্থানীয় স্তরে  মিশে যেতে চেয়েছেন। বাংলা বিসর্জন দিয়ে অসমিয়া ভাষাকে  মাতৃভাষা ও যোগাযোগের ভাষা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। বাড়িতে বাংলা, বাইরে অসমিয়া ব্যবহারে প্রায় সকলেই অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন। পিতৃপুরুষের পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যাভ্যাসকে বর্জন করতে পারেননি। আদি বসবাসস্থলকেও ভুলতে পারেননি।  একারনে  বহুমাত্রিক দুর্যোগ তাঁদের রেহাই দেয়নি। যে অসমকে কৃষিযোগ্য করে তুলেছেন, সে অসমের  চড়াই উৎরাই  জমি চাষবাস আর ফসল  দিয়ে শস্য শ্যামলা  ভূমিতে  বদলে দিয়েছেন, সে জমির পূর্বগামী বাসিন্দার একাংশের রাজনীতি আর বিভ্রান্তি আজও তাঁদের  প্রতি সুবিচার করতে অভ্যস্ত নয়। অবজ্ঞা, ঘৃণা, সন্দেহের কবলে  চরবাসী জনপদ যেন চিরবন্দী। কৃষিজীবী বাঙালি নিজেদের নওঅসমিয়া পরিচয়ে শনাক্ত করেছেন, স্থানীয় স্রোতে মিশে যেতে চেয়েছেন, অসমিয়া জাতিসত্তা প্রয়োজনে তাঁদের ব্যবহার করেছে, কিন্তু মানসিক পরিসরের দরজা খুলে দেয়নি। বিষয়টি ভাষাগত নয়। মূলত রাজনীতিক। রাজনীতিই সমাজকে নাচায়। নাচের অনুশাসন বেঁধে রাখে। একক সংখ্যাগরিষ্ঠ নয় বলেই   বর্ণবিভাজিত, বর্ণময় অসমিয়া জনগোষ্ঠীকে আত্ম বিলুপ্তির ভয় তাড়া করে। শহরে বাঙালি, মারোয়াড়িদের নিয়ে এরকম সন্দেহ, ভীতি তৈরি হয় না। ব্যবসা-বাণিজ্য পুরোটাই  মারোয়াড়িদের হাতে, চাকরি-বাকরি এককালে নাগরিক বাঙালি  নিয়ন্ত্রণ করত। বাঙালি কিংবা মারোয়ারি সম্প্রদায়  অসমের বৃহত্তর  জাতিগঠনের স্রোতে মিশে যেতে চায়নি। কেবল ধর্মীয়  পরিচিতি আর সংখ্যাগতভাবে অনাগ্রাসী বলেই হিন্দিভাষীরা লাগাতার অনাচারের শিকার নয়। বাঙালি হিন্দু স্থায়ী উদ্বাস্তু।  মারোয়াড়িরা মূলত বণিক সম্প্রদায়।  শিকড়চ্যূত হয়েও পূর্বপুরুষের ভিটের প্রতি টান ও আগ্রহ তাঁদের অব্যাহত ।  এক্ষেত্রে নওঅসমিয়া কিংবা বঙ্গভাষী প্রান্তিক কৃষকের কোনো পিছুটান নেই। এমনও বহু মানুষ আছেন , যাঁরা  পূর্ব পুরুষের ভিটে বাড়ি, স্মৃতিচিহ্ন খুঁজে দেখার তাগিদ কখনো অনুভব করেন না।বাংলা ভোলেন নি, খাদ্যাভ্যাস ভুলতে পারেন নি, এখনও পূর্ববঙ্গীয় স্বর লেগে আছে কথ্যভাষার সংলাপে, পূর্বস্মৃতি বলতে এইটুকুই– দেশ বলতে অসম, ভারত, মাতৃভাষা বলতে  অসমিয়া। সংস্কৃতি বলতে লোকজ কালচার।  উৎপাদন বলতে   ১২ মাস জোড়া খাটুনির ফসল।  দুর্গম পথেই তাঁদের জীবন নাচে, হৃদয় নাচে।  তাঁরা বেঁচে থাকেন মেন-মেড দুর্যোগের মোকাবিলা করতে করতে, প্রকৃতি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠলেই  থেমে থাকে না লড়াই, সদয় হলেও মনোভাবে বিশেষ কোনো বদল ঘটে না। যে জনপদ চড়াই-উৎরাই ঘটনা আর ইতিহাসের অনেকানেক নির্মাণের কখনো নিঃশব্দ, কখনো সরব আর সজল সাক্ষী হয়ে থাকে, তাঁদের পূর্বস্মৃতি আর পূর্বস্থলের  দিকে তাকানোর ফুরসৎ কোথায়? আমারও ছিল না, ছিল  না আব্বার, ছিল না ভাইবোন ও প্রতিবেশীদের।

আমার সহযোদ্ধারা

ঘটনাচক্রে, কৃষিজীবনের  বাইরে যখন শহরের–গুয়াহাটির -বাসিন্দা হতে হতে হল, একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের  নির্মাণ আর সামাজিক কাজে জড়িয়ে পড়লাম, যখন এক দেশ থেকে আরেক দেশে  যাতায়াত শুরু হল, তখনই প্রতিবেশী বাংলা দেশে  পূর্ব পুরুষের ভিটে- বাড়ি দেখে  আসার শখ  জাগল। জানতে ইচ্ছে হল, আমরা কোথায় ছিলাম, কীভাবে জামালপুর থেকে কোকরাঝাড়ে এসে পড়লাম, তার দীর্ঘ কাহিনি খতিয়ে দেখতে কয়েকবছর আগে অনেক খোঁজাখুজির পর হাজির হলাম জামালপুরের গ্রামে। এখন বর্ধিষ্ণু এলাকা।  গৃহ বিন্যাস , জন বিন্যাস  বদলে গেছে। সব নতুন নতুন রাস্তা-উপরাস্তা, বড়ো বড়ো সড়ক হয়ে ঢাকার দিকে, কুষ্টিয়ার দিকে, বরিশাল, চাঁটগা ও সিলেট অভিমুখে ছুটছে। ছুটছে ভাষা, উপভাষা। পিতৃভূমি কোকরাঝাড় ও আমার অধুনা বাসস্থল গুয়াহাটির সঙ্গে এসব রাস্তা  ও  বাংলাদেশি  শহরগুলোর দূরত্বে ভাষার রূপান্তর ছাড়া জনবিন্যাস ও গৃহ বিন্যাসের বিশেষ তফাৎ কোথায়? সবই একই মানুষের শ্রম আর সাধনার সৌভাগ্য ছোঁওয়া বৈশিষ্ট্য।

চোখ খুলে গেল অন্যভাবে। শাখা-প্রশাখায় ছড়িয়ে থাকা আত্মীয়-স্বজনদের খুঁজছি। খুঁজে বের করতে বেগ পেতে হোল না। কেউ কেউ বড়ো শিল্পপতি, ঢাকার নাগরিক জীবনে অভ্যস্ত। কেউ কেউ  বাপ-ঠাকুরদার ভিটে জড়িয়ে গ্রামের জীবন-যাপনে মগ্ন। তাঁদের মগ্নতায় তাৎক্ষণিক বিরতি এঁকে  দিয়ে কয়েকদিন শহরে, গ্রামে মজায় কাটল। শিকড় আবিষ্কারের এ এক অপূর্ব, নিবিড়তম আনন্দ। ভুলি নি। ভুলব না।

লেখক, গুয়াহাটির এনইএফ শিক্ষাগোষ্ঠীর চেয়ারম্যান

 

ক্রমশ…

 


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!