- খাস-কলম পা | র্স | পে | ক্টি | ভ রোব-e-বর্ণ
- জুন ২৫, ২০২৩
হিসেবি ছকে কিস্তিমাত ! মহাজোটের আড়ালে কার স্বার্থসিদ্ধির গোপন অঙ্ক ?

২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে এবার বিজেপি যদি জিতে যায় তাহলে ২০২৯ এর লোকসভা দেশে আর হবে কি না তা নিয়ে ২৩ জুনের পাটনার বিজেপি বিরোধী মহা জোটের মেগা বৈঠকে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আবার ওই বৈঠকের শেষে রাহুল গান্ধি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সীতারাম ইয়েচুরি,এম কে স্ট্যালিন, নীতিশ কুমার, মেহেবুবা মুফতিকে বলতে শুনেছি, “আমরা ঐক্যবদ্ধ।” আবার কেন্দ্রের অধ্যাদেশের বিরুদ্ধে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের পাশে কংগ্রেস সত্যিই দাঁড়াবে কি না তা নিয়ে পাটনার বৈঠকে কংগ্রেসের প্রতি খড়্গ হস্ত হয়েছেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল। বৈঠক শেষে প্রেস কনফারেন্স শুরু হওয়ার আগেই পাটনা ছেড়েছেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল ও পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ভগবন্ত সিং মান। এখানেই শেষ নয়, পাটনার বৈঠকের শেষে ওই রাতেই আম আদমি পার্টি রীতিমতো চিঠি লিখে জানিয়েছে, কংগ্রেস কেন্দ্রের অধ্যাদেশের বিরুদ্ধে ও আম আদমি পার্টির পক্ষে যদি সমর্থনের কথা স্পষ্ট করে না জানায় তাহলে শিমলার বৈঠকে কংগ্রেস থাকলে কেজরিওয়ালের পার্টি যাবে না।
এদিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই জোটের জন্য “একের বিরুদ্ধে এক” প্রার্থী সারা দেশে দেওয়ার ফর্মুলা দিয়েছেন, যদিও জানা গেছে, পাটনার বৈঠকে মমতার “একের বিরুদ্ধে এক” প্রার্থী দেওয়ার ফর্মুলা নিয়ে আলোচনা তেমন গুরুত্ব দিয়ে হয়নি।
এখন প্রশ্ন বিজেপির বিরুদ্ধে এই জোট কি বৃহত্তর স্বার্থে হতে চলেছে না কি অরবিন্দ কেজরিওয়াল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁদের দলগত স্বার্থের কথা চিন্তা করে জোট গঠনের শর্ত দিচ্ছ?
এই প্রশ্ন খুব স্বাভাবিক কারণেই উঠছে অরবিন্দ কেজরিওয়াল এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অদ্ভুত জোট গঠনের শর্তের জন্য। প্রশ্ন হচ্ছে কংগ্রেসকে কি জোটের বাইরে রেখে জোট করতে চাইছেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়? কংগ্রেস এখনো একক শক্তিতে বিজেপির বিরুদ্ধে লোকসভা নির্বাচনে ৩০০ র কাছাকাছি আসনে লড়াই করে এটা কি অরবিন্দ কেজরিওয়াল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভুলে গেছেন? না হলে কেন বিজেপি বিরোধী জাতীয় জোটের বৈঠকে অরবিন্দ কেজরিওয়াল দিল্লি সরকারের ক্ষমতা খর্ব করার জন্য কেন্দ্রের অধ্যাদেশে কংগ্রেসকে সমর্থন করতেই হবে বলে দাবি করছে? দিল্লিতে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে প্রার্থী দিয়ে সরকার গঠন করব, পাঞ্জাবে বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের সঙ্গে লড়াই করে কংগ্রেসকে পরাজিত করে সরকার গড়ব, আবার বিজেপি যখন চাপে ফেলবে তখন সেই কংগ্রেসের কাছে সাহায্যের নামে জুলুমবাজি চালাবো এটা কোন রাজনীতি? আর জোটের বৈঠকে থাকার জন্য এই বিষয়টা কোনও একটি দলের শর্ত হতে পারে? প্রশ্ন উঠছে এই বিজেপি বিরোধী জোটটা অরবিন্দ কেজরিওয়াল চাইছেন তো? তিনি কেন বলছেন শিমলার জোটের বৈঠকে যাবেন না? একক শক্তিতে তিনি লড়বেন বিজেপির বিরুদ্ধে? না কি কৌশলে জোটের থেকে কংগ্রেসকে সরানোর চেষ্টা করছেন কেজরিওয়াল? কেজরিওয়াল কি মনে করেন, কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে জাতীয়স্তরে বিজেপি বিরোধী জোট গড়া যায়? এম কে স্ট্যালিন কিন্তু সেটা মনে করেন না, সেটা তিনি ২৩ জুন পাটনার বৈঠকে জানিয়েও দিয়েছেন। এমনিতেই কেজরিওয়ালের বিজেপি বিরোধীতা নিয়ে জাতীয়স্তরে রাজনৈতিক দলের মধ্যে প্রশ্ন আছে। এখন এই প্রশ্নটা আরো প্রকট হচ্ছে, যখন দেখা যাচ্ছে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের দল বিবৃতি দিয়ে বলছেন, অধ্যাদেশ নিয়ে কংগ্রেস তার অবস্থান স্পষ্ট না করলে শিমলার ১২ জুলাইয়ের বৈঠকে কংগ্রেস থাকলে আম আদমি পার্টি যাবে না। তাহলে আম আদমি পার্টি কি বিজেপির হাত ধরবে আড়ালে, কৌশলে? আম আদমি পার্টি কি ভুলে গেছে, ১২ জুলাই শিমলার বিজেপি বিরোধী জোটের বৈঠকের আহ্বায়ক কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে! শিমলায় বৈঠক ডাকার কারণ ওই রাজ্যের শাসন ক্ষমতায় আছে কংগ্রেস।
এবার আসা যাক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের “একের বিরুদ্ধে এক” প্রার্থী দেওয়ার ফর্মুলায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই ফর্মুলা বাংলা, কেরল, দিল্লি, পাঞ্জাব সহ দেশের প্রায় সব রাজ্যে চলবে না।
প্রথমেই আসা যাক পশ্চিমবঙ্গের প্রশ্নে। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল এই মুহূর্তে বাংলার ২০১৯ এর লোকসভা ফলের দিকে তাকালে দেখা যাবে ৪২টি লোকসভা আসনের মধ্যে তৃণমূল ২২টি আসন পেয়েছে, বিজেপি পেয়েছে ১৮টি আসন, কংগ্রেস পেয়েছে ২টি আসন।
এই রাজ্যে তৃণমূল ও বিজেপির সঙ্গে কংগ্রেস ও সিপিএম এর মূল রাজনৈতিক লড়াই। এই মুহূর্তে গরু,কয়লা,বালি পাচার ও চাকরি বিক্রি নিয়ে সমাজে ও আদালতে তৃণমূল যে অবস্থায় আছে তাতে সিপিএম, কংগ্রেস তৃণমূলের বিরুদ্ধে রাজনীতির অস্ত্র অনেকটাই প্রস্তুত করে রেখেছে। তৃণমূল বিরোধীতার জায়গায় ২০১১ সালের তুলনায় এখন অনেক ভালো অবস্থায় পশ্চিমবঙ্গে রয়েছে সিপিএম, কংগ্রেস। তৃণমূল গরু,কয়লা,বালি পাচার এবং চাকরি বিক্রি ইস্যুতে বাম-কংগ্রেস বিরোধীতার মুখে পড়ে অনেকটাই বিপর্যস্ত। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখনও দিনরাত রাজনৈতিক কারণে পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস ও সিপিএমকে আক্রমণ করে চলেছেন। তৃণমূল বিরোধী যে কোনও আন্দোলনে রাজ্যের শাসকদলের পুলিশ ২০১১ সাল থেকে ২০২৩ সালের এই মুহূর্ত পর্যন্ত আগ্রাসী মনোভাব নিয়েই সিপিএম, কংগ্রেসের আন্দোলনকে স্তব্ধ করতে বদ্ধপরিকর। পঞ্চায়েত নির্বাচনেও যে পরিমাণ সন্ত্রাস শাসকদলের তরফে করা হচ্ছে সেই আক্রমণের কেন্দ্রবিন্দুও সেই সিপিএম, কংগ্রেস। এমন কি পাটনায় যেদিন কংগ্রেসের সঙ্গে তৃণমূল বিজেপি বিরোধী বৈঠক করছে তখন মুর্শিদাবাদের রানীনগরে কংগ্রেস নেতা ও প্রার্থী কুদ্দুস আলীর বাড়িতে তৃণমূল আক্রমণ চালায় বলে কুদ্দুস আলী নিজে অভিযোগ করেন তৃণমূল নেতা ও ব্লক সভাপতি শাহআলম সরকারের বিরুদ্ধে। এমন কি পাটনার বৈঠকের পরের দিন শনিবারও তৃণমূলের বিরুদ্ধে ওই রানীনগরে কংগ্রেস ও সিপিএমের উপর হামলা চালানোর অভিযোগ ওঠে। এই ঘটনায় শনিবার সিপিএম রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম সিপিএম সমর্থকদের নিয়ে এবং কংগ্রেস একত্রে রানীনগরে পথ অবরোধ করেন। গোসাবার আরএসপি প্রার্থীকেও শনিবার তৃণমূল মারধর করে। চিকিৎসার জন্য এই আরএসপি প্রার্থীকে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে আসা হয়। মেরে হাত ভেঙে দেওয়া এই আরএসপি প্রার্থী অভিযোগ করেন, তৃণমূলের তরফে তাঁকে প্রার্থী পদ প্রত্যাহারের জন্য প্রাণনাশের হুমকি দেয়া হয়। এই ঘটনাগুলো ২০১১ থেকে রাজ্যে তৃণমূল শাসনে সিপিএম, কংগ্রেসের বিরুদ্ধে আক্রমণের খণ্ডচিত্র। এ ছাড়াও তৃণমূলের বিরোধী দল কংগ্রেস ও বামফ্রন্ট ভাঙানোর ঘটনাতো আছেই। সদ্য সাগরদিঘির একমাত্র বাম সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী বায়রন বিশ্বাসকে তৃণমূল ভাঙিয়ে নিয়েছে। এর পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কি করে ভাবতে পারেন ২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচনে সিপিএম, কংগ্রেস নিজেরা বিজেপির বিরুদ্ধে প্রার্থী না দিয়ে নিজেরা আত্মত্যাগ করে রাজনৈতিকভাবে শহিদ হয়ে তৃণমূলকে বাংলায় লোকসভা নির্বাচনে জেতার রাস্তা পরিস্কার করে দেবে?
বাংলার কংগ্রেস ও সিপিএম নেতৃত্ব প্রশ্ন তুলছে “একের বিরুদ্ধে এক প্রার্থী দেওয়ার এই তৃণমূলের ফর্মুলা আসলে বিজেপি বিরোধীতার নামে বিনা বাধায় ২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচনে বাংলায় তৃণমূলের একাধিপত্য বজায় রাখা
মমতার এই “একের বিরুদ্ধে এক” ফর্মুলা বাংলা, কেরল, পাঞ্জাব,দিল্লি সহ দেশের কোনও রাজ্যের জন্যই কার্যকর হবে বলে রাজনৈতিক অভিজ্ঞরা মনে করেন না। তাঁদের মতে, বাংলায় তৃণমূলের প্রধান প্রতিপক্ষ সিপিএম, কংগ্রেস। কেরলে বাম- কংগ্রেস প্রতিপক্ষ, পাঞ্জাবে আম আদমি পার্টি ও কংগ্রেস প্রতিপক্ষ, দিল্লিতেও আম আদমি পার্টি ও কংগ্রেস প্রতিপক্ষ।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যথেষ্ট রাজনৈতিক সচেতন। তিনি বুঝেছেন, ২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচনে তাঁর দল স্বস্তিতে ভোট লড়তে পারবে না। অনেক অভিযোগ তাঁর দলের বিরুদ্ধে আছে। তাঁর দলের মহাসচিব থেকে শুরু করে বিধায়ক, যুবনেতা, তাঁর সরকারের আধিকারিকরা নিয়োগ দুর্নীতিতে অভিযুক্ত হয়ে জেলে। গরু পাচারের অভিযোগে বীরভূমের বেতাজ বাদশা অনুব্রত মণ্ডল কন্যাসহ জেলে। কয়লা, গরু ও নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কেও ইতিমধ্যে সিবিআই, ইডি জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তাই ২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচন এবার খুব নিশ্চিন্তে করতে পারবে না তৃণমূল। তাই বিজেপি বিরোধীতার শর্তে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কৌশলে “যে রাজ্যে যে দল শক্তিশালী সেই রাজ্যে একের বিরুদ্ধে এক” প্রার্থী দেওয়ার ফর্মুলা চালু করে দুর্নীতির অভিযোগে বাংলায় লোকসভা ভোটের বৈতরনী পার হওয়ার চেষ্টা করছেন। এই “একের বিরুদ্ধে এক”, ফর্মুলা বাম, কংগ্রেস যদি মেনে নেয়, বাংলায় লোকসভা নির্বাচনে যদি এই ফর্মুলা মেনে প্রার্থী দেওয়া হয়, তাহলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল বাংলায় ২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচনে প্রথম এবং খুব স্বাভাবিক ভাবেই অন্য কোনও দলের প্রার্থী বিজেপির বিরুদ্ধে না থাকায় বিজেপি বাংলায় দ্বিতীয় শক্তি হয়ে যাবে। এই প্রসঙ্গে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর রঞ্জন চৌধুরী বলেছেন, “বাংলায় আমরা তৃণমূলের বিরুদ্ধে এবং বিজেপির বিরুদ্ধে লড়ছি।” সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী বলেছেন, “বিজেপির বিরুদ্ধে আমাদের দেশজুড়ে লড়াই আর বাংলায় তৃণমূল আর বিজেপির বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই।”
এই পরিস্থিতিতে যার যেখানে শক্তি বেশি সেখানে সেই দল প্রার্থী দেওয়ার তৃণমূলের কৌশলী ফর্মুলা চালু করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অরবিন্দ কেজরিওয়াল চাইছেন নিজেদের রাজ্যে নিজেরা একাধিপত্য বজায় রাখতে এবং বিজেপিকে দ্বিতীয় স্থানে নিজেদের রাজ্যে পৌঁছে দিতে।
বাংলার কংগ্রেস ও সিপিএম নেতৃত্ব প্রশ্ন তুলছে “একের বিরুদ্ধে এক প্রার্থী দেওয়ার এই তৃণমূলের ফর্মুলা আসলে বিজেপি বিরোধী জোটের ফর্মুলা নয়, বিজেপি বিরোধীতার নামে বিনা বাধায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচনে বাংলায় একাধিপত্য বজায় রাখা, বিজেপিকে দ্বিতীয় স্থানে বসিয়ে রেখে কংগ্রেস আর সিপিএমকে সাইনবোর্ডে পরিণত করার সুচারু কৌশল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই ফর্মুলায় বাংলার বাম-কংগ্রেস নেই।”
❤ Support Us