Advertisement
  • পা | র্স | পে | ক্টি | ভ রোব-e-বর্ণ
  • মে ২১, ২০২৩

শেষ পাতাঃ অনিশ্চয়তার চিহ্ণ যখন অলঙ্কার

অমিত মুখোপাধ্যায়
শেষ পাতাঃ অনিশ্চয়তার চিহ্ণ যখন অলঙ্কার

চিত্র প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের ফেসবুক থেকে সংগৃহীত

কত সাধারণ অথচ তাৎপর্যপূর্ণ এক বিষয়, বলা যায় অতীতের বেদনার ধুলোয় ঢাকা লুকোনো জামার সুতো একের পরে আরেক খুলে বয়নের ভেতর ও বাইরেটা দেখিয়ে দিতে পারাই শেষ পাতা-কে বিশিষ্ট করে তুলেছে।

এক নামকরা বাণিজ্যসফল লেখক বাল্মীকি অগ্রিম টাকা নিয়েও আর লিখতে পারে না। সে শরীর আর মনেও অশক্ত হয়ে চলেছে। ব্যক্তিগত আঘাত, বাস্তবের চরম রূঢ়তায় সে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে বুঝি এবার নিজের জীবনের শেষ পাতার দিকে চলেছে। কিন্তু প্রকাশক, প্রতিবেশী আর প্রতিকূল সময় তাকে কিছুতে ছাড়ে না। গল্প বলতে এটুকুই আছে অতনু ঘোষের শেষ পাতায়। কিন্তু সেই লেখক বাল্মীকি ও তার চারপাশের চরিত্রের চেহারা যে ভাবে পর্দার পরিধি ছাড়িয়ে দর্শকের পরিসরে ঢুকে পড়ে তা-ই এ ছবিকে অনন্য করে তোলে। প্রতিফলিত জীবনের চেতনসহ অবচেতনকে নিপুণ ভাবে ফুটিয়ে তোলার ফলে সেটা সম্ভবপর হয়ে ওঠে। বাল্মীকির জীবন ও সৃজনের শেষ পাতায় গিয়ে লোক ও অবলোকন কোথাও গিয়ে একাকার হয়ে যায়।

এ এমন এক নাম, যা ঝলকে ও হেনরি-র The Last Leaf কে মনে পড়ায়, এই ছবির জন্য বেছে নিয়ে সাহস দেখিয়েছেন পরিচালক। কিছু দর্শকের মুখে এই নিয়ে আলোচনাও শোনা গেছে। তবে গাছের পাতার আর উপন্যাসের পাতার তফাত থাকলেও, মিলও আছে প্রতীকধর্মীতার দিক দিয়ে, সে কথা আলোচনার পরে বোঝা যেতে পারে। কেবল লেখক বাল্মীকির নয়, তার সঙ্গে আরও কিছু চরিত্ররও বিবর্তনের  ব্যাপার জড়িয়ে থাকে তাতে। কারণ এখানে সব প্রধান চরিত্রই রাউণ্ড ক্যারেক্টার, তারা সময় ও ঘটনার সঙ্গে প্রতিক্রিয়ায় ধীরে হলেও বদলে যেতে থাকে।

শেষ পাতা চলতি কোন চকমকে ছবি নয়, বরং বলা যায় মনের গহন আলো-আঁধারি গুহাপথে ধ্রুপদী চকমকি জ্বালিয়ে একের পর এক চিত্রকাঠামোর বাছাই করা জায়গায় এক সন্ধানী আগুনে আলোর স্বল্প আভাসে  শ্রেষ্ঠ শিল্পকে তুলে আনা হয়েছে, যা এই মুহুর্তে কেবল বাংলা নয়, সার্বিক ভাবেই সিনেমায় বিরল হতে বসেছে। সাধারণত যে সব দৃশ্য নিয়ে পেশীর জোর দেখান পরিচালক, সে সব প্রচলিত উপাদান ফেলে দিয়ে এত সামান্য সব জায়গায় মূল সুর গেঁথে তোলা হয়েছে, তা কেবল মুগ্ধ করে না, নানা অনাস্বাদিত পরতের পর পরতে বাড়তি মাত্রা যোগ করে চলে। কোথাও নাটকীয়তা না এনে বেশ কিছু সংঘাতের রেশ ঠিক যেখানে শেষ হয়, সেখানে আশ্চর্য পরিমিতি দেখিয়ে অনুচ্চকিত শরীরী ভাষায়, চোখের সঙ্গতে বা ক্যামেরার নড়াচড়ায় গল্পকে অতিক্রম করে বার বার শাশ্বত সত্যে পৌঁছে যান অতনু ঘোষ।

এ ছবির অনেক চরিত্রের মধ্যে অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সময় নিজে। রাজনীতি-উত্তর আর্থিক নাগপাশের জালে পৃথিবী কি রকম ঋণের দশায় বন্দী তার কথা বলা হয় শিল্পিত ভাষায় যেখানে বেদনায় আর্ত হয়ে ওঠে মন, দর্শক নিজের চারপাশ চিনে নিতে পারেন। আর বেশ কিছু চরিত্র প্রাণপণে লড়ে চলে তাদের নিজের মতো, সে-ও বড় আকর্ষণীয় বিবরণ। তার ফলে ঋণের আবর্ত একমাত্রিক থাকে না, জটিল হয়ে এক সার্বিকতায় পৌঁছয় এবং শেষে জীবনের গভীর দর্শনে আশ্রয় নেয়। তখন চকিতে একেবারে শুরুর দিকে সূত্র হিসেবে দেওয়া আন্দ্রেজ স্যাপকোস্কি-র কথাটি মর্ম স্পষ্ট হয়ে যায়ঃ “ We enter the world as a minute part of the life we are given, and from then on we are ever paying off debts.”

এ সবের পাশাপাশি চলে স্ত্রীর খুনে চরম আঘাত পাওয়া লেখক বাল্মীকির রক্তঝরা দিনমালার বিবরণ, যা বহন করে তার স্ত্রীর উচ্চাশা আর পণ্যপৃথিবীর প্রলোভনে পড়া জীবনের বিষাক্ত পরিণতি। সারস্বত জগত তাকে ভুলে গেছে, বা আর তার কাছ থেকে পাওনা কিছু নেই বুঝে সরিয়ে দিয়েছে। কেউ আর তার সোফাকে গর্বিত করতে এসে বসে না। কেবল গোপন কেচ্ছা উগরে দেবার সম্ভাবনা অনুমান করে প্রকাশক অগ্রিম টাকা দিয়ে পেছনে লেগে থাকে।

কিন্তু বাইরের পৃথিবীর বড় ঘটনা নয়, প্রাণ সঞ্চার করতে আদর্শ হলো ছোট এবং তুচ্ছ উপাদান, যা চরিত্রের চারপাশে রয়েছে। তাই আমরা দেখি দিন শুরু করা  কাজের  লোকের চোখে বরং মমতা আছে, উদ্বেগ আছে, পড়শীদের কাছে বাতিল লেখক এক উৎপাত ছাড়া কিছু নয়। কেউ তার বর্তমান অবস্থার কারণ জানতে বা বিশেষত পুরুষরা সহানুভূতি দেখাতে রাজি নয়। এই সব সামান্য ব্যাপার ও হাসপাতালে যাবার ঘটনা বুঝিয়ে দেয় যে প্রকাশক তথা লেখা-আদায়কারী যা-ই বিরূপ মন্তব্য করুক, আদতে সে মনে ও দেহে ফুরিয়ে চলেছে। তখনি দর্শকের আগ্রহ বাড়ে এই বিপর্যয়ের কারণ জানার জন্য। এখানে তার লেখক ও ব্যক্তিসত্তা একে অপরকে ক্রমাগত ভেঙে গড়ে মানুষটির নির্যাস তুলে ধরে।

অথচ এমন যে বিধ্বস্ত লেখক ও স্বামী, তার জীবনের পরশে অন্য আরও কিছু পরাস্ত প্রাণ জেগে উঠতে থাকে। যেমন মহিলা অনুলেখক মেধা, যাকে ঋণ আদায়কারী শৌনক নিয়োগ করে পাওনা লেখা শ্রুতিলিখন করে আদায়ের জন্য। শৌনক আর মেধার সম্পর্কও বিশিষ্ট, ঋণ আদায়ের সময় বাড়িয়ে মানবিকতার পরিচয় দেওয়ায় বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে! মেধা তার ভেঙে পড়া দাম্পত্যর হতাশা কাটিয়ে এই অনুলিখনের কাজকে আঁকড়ে ধরে। মেধার আন্তরিকতা একটু করে যেন বদলে দিতে থাকে লেখককে। আর মেধা ফিরে পেতে থাকে মনের জোর। বাল্মীকি তার স্ত্রীর হত্যার কারণে, মেধা ভাঙা সংসারের জন্য আর শৌনক নিজের ব্যাক্তিগত ঋণ ও টাকার প্রয়োজনে আশ্চর্য বাঁধনে আটকা পড়ে। প্রথম দু’জনের রসায়ন বাড়তি নিশ্চিন্ত করতে থাকে শৌনককে, ফলে সে তার প্রেমিকা দীপার সঙ্গে সম্পর্কে সহজ অথচ বেপরোয়া হতে পারে। আবার রহস্যময় ভাবে চন্দনা নামে যে আকর্ষণীয় মেয়েটি  বাল্মীকিকে ম্যাসাজ দিতে আসে, তখন দু’জনেই চোখে মুখে মেধার কাছে অন্য রকম হয়ে ওঠে। শেষ দৃশ্যে চন্দনার সেই প্রার্থিত বস্তুটি দেওয়া এবং শেষশয্যায় সাজিয়ে দেওয়ার সময় বোঝা যায়, সে-ও কেমন চোখে দেখত বাল্মীকিকে। এমনকি যে বালকটি  খাবার দিয়ে যায়, শেষে দেখা যাবে তারও কেমন টান জন্মে গেছে বাল্মীকির প্রতি। হতশ্রী ঘরে রোজ কে যুঁই ফুল দিয়ে সুবাসিত করে, সেই রহস্যের উত্তরও থাকে তার কাছেই। এই ব্যাপারটি আরও সুবাসিত করে বাল্মীকির হতমান চরিত্রের অন্দরকেও।

আবার এই সব বদ্ধ পরিবেশ থেকে বাল্মীকি যখন বাইরে বেরোয়, এক আজব ব্যাপার ঘটে। দর্শকের চোখ কিছু আরাম পায় বটে, কিন্তু বাল্মীকির বিপর্যয়ের গভীরতা হঠাৎ বেড়ে যেতে থাকে। রাতের রাস্তায় তার পা বেসামাল নয়, বেমিল। হাত নাড়ানোয় সব কিছুকে তুচ্ছ ভাবার ভঙ্গী বুঝিয়ে দেয় যে কোনও কিছুতেই তার আর যায় আসে না! সহজে মরার উপায় নেই বলেই বুঝি এখনো টিকে আছে সে! তাই সে যখন বহুতলের ছাদে যায়, আত্মহত্যা করার জন্য যায়। আর যে কারণে করতে পারে না, তা হলো লিফটে ওঠার সময় বাচ্চা মেয়েটির সান্নিধ্য, বদ্ধ ছাদের আলোয় তার সঙ্গে আঙুল ছোঁওয়ার খেলার মায়ায়। ঘরে মদ খাওয়ার থেকে অনেক বেশি অভিঘাত হানে আবারও বাইরের দৃশ্য, অতীতমুখী পানশালার ভয়াবহ নিঃসঙ্গ আবহ! সবুজে ভরা ময়দানে ক্যামেরা গেলে আবার মুক্তির আশ্বাস মিলিয়ে গিয়ে  অতীতের গাঢ় ক্ষত থেকে নতুন করে রক্তপাত হয়। কারণ বাল্মীকি সেখানে স্ত্রীর অন্তিম শয়ানের জায়গাটিতে যায়, নির্মম ভাবে ঘাস ছিঁড়ে ফেলে, যাতে চিহ্ণ মুছে না যায়, এবং সে নিয়মিত তা করে। ফলে এ ছবিতে ক্যামেরা যতই চাক্ষুষ রেহাই দিতে চায়, চিত্রনাট্য তত বদ্ধ দেওয়ালের চেয়েও বেশি বিষাদের উপাদান স্পষ্ট করে তোলে। তবু ময়দানের নানা দৃশ্যে এঞ্জেলোপউলসের মহিমা টের পাওয়া যায়, এক বিগতস্পৃহ নায়ক তার শরীরজোড়া খেদ ক্ষোভ যন্ত্রণা আর রাগ নিয়ে সবুজ মাঠ আর নীল আকাশকে হেয় করে তোলে। প্রতিটি ঘাসের ডগা ছেঁড়ার ভঙ্গি, ঠোঁটের নড়া আর বেরিয়ে আসা মাটিকে স্পর্শের মাঝে প্রকাশ পায় তার ব্যথা। আরও বড় কথা এই যে পরে যখন মেধাকে নিয়ে সে ময়দানে যায়, তখনও একই তীব্রতায় কাজগুলি সারে, যেন তর্পণের নিয়ম মানছে সে!

 আবার অনুলিখনপর্ব চলার মাঝে বা ঘরে কথার মাঝখানে লেখকের বাচনে ঝলক দিয়ে ওঠে ট্রাজেডির মহাসত্য, যা আবার চকিতে মনে পড়িয়ে দেয় দস্তয়েভস্কি, মানিক, জীবনানন্দ, দেবেশ রায় থেকে সমরেশের কথা। বাল্মীকির যে সব বই দেখানো হয়, তাতে তাকে খুব বড় মাপের লেখক হিসেবে তুলে ধরা হয় না। অতনু তার সাম্প্রতিক ছবিগুলির মতো এখানেও অতীতচারণা করেন নি। তাই অন্য সূত্র হিসেবে প্রকাশকের বয়ানও তাকে বাণিজ্যসফল লেখক বলে। কিন্তু চোখের সামনে তার কথা বলার মাঝে আচমকা সুর বদলে, বিষয় পাল্টে তীব্রতায় চলে যাওয়া কিছু বিখ্যাত বিদেশি অভিনেতার কথা মনে পড়িয়ে দেয়। বিশেষ করে ডাস্টিন হফম্যানের মতো সংলাপ চালু রেখে আত্মস্থ হয়ে গভীর উচ্চারণ করা বা আন্তরিক উপদেশ দিতে গিয়ে শ্লেষ উগরে দেওয়া দেখায় যে ভেতরে সে অতি চিন্তাশীল সংবেদী শিল্পী, যে সময় ও আঘাতের সঙ্গে ক্রমাগত আত্মসংঘর্ষে  পরিণত হয়ে চলেছে। প্রথমে যাকে অনিচ্ছুক অলস মনে হয়, তাকে ক্রমে ধড়িবাজ, ইচ্ছাকৃত ভাবে কথার খেলাপ করা লোক, তারপর পাগল, স্নায়ুরোগী ইত্যাদি বলে মনে হতে থাকে। অথবা এক মাতাল যেন ক্রমশ নেশায় ডুবে অপদার্থ ও অসামাজিক হয়ে পড়েছে, প্রতিবেশিসহ সকলকে সে উত্যক্ত করে চলেছে! প্রথম যে দিন শৌনকের বাক্যবাণের চোটে সে নিজের বাবার বিরক্ত হয়ে চড় মারার কথা বলে, মনে হয় শৌনককে উদ্দেশ্য করেই সে কথা বলেছে। অথচ উপস্থিত দুজনকেই চমকে দিয়ে সে বলে, কি হলো, লিখুন! এবার উপন্যাসের বয়ান সে বলা শুরু করে, মনে হয় সে মেনে নিয়েছে ব্যাপারটা। অথচ পরের দিনই তা স্রেফ কেটে দিতে বলে! এই সময় থেকেই তার সংলাপ আর উপন্যাসের বয়ান ধন্দে ফেলে দিতে থাকে। কোনটা মন্তব্য আর কোনটা বইয়ের লেখা তা ধরা মুশকিল হয়। ফলে এক বহুমাত্রিকতা ও তা থেকে উত্তেজনার মুহূর্ত তৈরি হতে থাকে। সে কখনো ধমকায়, আপনার মতলবটা কী? কেটে পড়ুন, নইলে ক্ষতি হয়ে যাবে, মন্তব্যে মিশে থাকে সজাগ পুরুষ অথচ অভিভাবক। তারপরে মেধার মন পড়তে পেরে তাকে ধমকের সুরে আত্মনির্ভর হতে বলে।

এক সময় স্ত্রী রোশনির কথা সে একটু বলতে থাকে, বোঝা যায় কোন মর্মান্তিক ক্ষত বেসামাল করেছে তাকে। সেই প্রসঙ্গে বিশ্বসাহিত্যের নানা কথা আসে। খুন হবার আগের দিন তুমুল ঝগড়ার কথাও গোপন করে না সে। ছবির অন্যতম গভীর সংলাপ থাকে এখানে। বাল্মীকি আত্মগত ভাবে বোঝায় কেমন করে অতি প্রিয় দাম্পত্যে এক সময় অপরের একটি দুটি দোষ বড় হয়ে উঠতে থাকে, যা ঢেকে দিতে চায় সম্পর্কের বাকি দিক। ট্রাজেডির অমোঘ বীজের কথা চমকে দেয় মেধাকে, কারণ সে-ও ভুক্তভোগী! সে আরও চমকে যায় তার ধীর উপলব্ধি থেকে যে আদতে বাল্মীকি এখনো আরেক রকম জীবন যাপন করে চলেছে রোশনির সঙ্গে। ঘরের টেবিলের মাঝে তাজমহলের মূর্তি, রোশনির ছবি আর আলোচনা আলোআঁধারির সঙ্গে মিশে সেই যাপনেরই কথা বলে চলে। এক রাতে বাল্মীকি বলে, আজ আরেকটু পরে খুন হবে রোশনি! এত বছর পরেও সে যে কত সম্পৃক্ত হয়ে আছে! এইখানে এসে বাইরে বা ভেতরের পৃথিবীর মূল্য যে তার কাছে কত টুকু তার আভাস যেন মিলতে থাকে। তার পরেও চারপাশের চাপ কমে না, এতটাই, যে তাকে বলতে হয়, রোশনিকে এখন আর দেখতে পাই না আমি!  এই আত্মিক হাহাকার এড়িয়ে এই সময়ের মানুষ থাকে কী করে! হাহাকার তাই নানা ভাবে ছড়িয়ে আছে শেষ পাতায় এবং সেই সূত্র টেনে বলা যায় যে এখানে স্ত্রী প্রেমিকা বান্ধবীর অবস্থান কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে তার এক চোরাভাষ্য বয়ে গেছে সমান্তরালে। রোশনি তাই বুঝি আর কারও একক নারী হয়ে থাকে না, প্রতীকী হয়ে ওঠে অনিবার্য ভাবে।

এ ছবিতে না শুনলে বোঝা যাবে না সংলাপ কোন তীক্ষ্ণতায় যেতে পারে। লেখকদের হার মানিয়ে দিয়েছেন অতনু তার অন্তর্ভেদী শাণিত কথার চোরাটানে। অজস্র ফ্রেম আছে যা আবার ভাষাতীত। যেমন মেধার নিজের হাতে মাতাল লেখকের ভিজে জামাকাপড় ছাড়িয়ে দেওয়ার দৃশ্য,  সম্পর্ক আজও কোথায় যেতে পারে এবং দুটি চরিত্রকে কতটা বাঙ্ময় করে  তুলতে পারে তার উদাহরণ। কিন্তু আমার মনে হয়, তার ঠিক পরের অংশও সমান গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে সেই শারীরিক অভিঘাতে কাঁপে মেধা, আধোচেতন আধাশায়িত বাল্মীকির পাশে বসে নীরবে কিন্তু ভীষণ ভাবে শিহরিত হয়। স্বল্প আলোয় নারীর একান্ত মুহূর্তের এমন উদ্ভাস অনেক বার্তা দেয়। এমন অনেক মুহূর্ত আছে এ ছবিতে। স্বামীর  সঙ্গে মেধার হাতাহাতির মাঝে কাজের মহিলা ছাড়িয়ে দেওয়ার পরে বিছানায় কান্নার দৃশ্যে সে হঠাত মহিলার সহানুভূতির হাত সরিয়ে দিয়ে বলে ওঠে, আমি ঠিক আছি! এই মনের জোর সে কোথা থেকে পেল, তা বুঝতে কষ্ট হয় না। তার চাহনির তীব্রতা, ঘাড় ফেরানো বলে দেয় এত নেতির মাঝেও জেগে ওঠা ইতিবাচক দিকগুলো। এ ছবির জোরের জায়গা এমন সব দৃশ্য। তা ছাড়া বাল্মীকি যখন মেধার পিঠে মাথায় হাত দেয় বা কটূক্তি করে, বার বার তা একাধিক সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিতে থাকে। রহস্যময়তার এই মোড়ক আগাগোড়া ব্যবহার করে অতনু চরম উন্মোচনের জন্য তৈরি করেন দর্শককে। একেবারে চূড়ান্ত লগ্নে যখন সদ্য ধাক্কা খাওয়া শৌনক আপাত-ঘনিষ্ঠতায় দেখে দু’জনকে, সে ফেটে পড়ে প্রায় যা তা বলতে থাকে। এই অপ্রত্যাশিত অপমান বাল্মীকি তো বটেই, মেধাও নিতে পারে না। তাই বাকি কাজের জন্য মরিয়া হলেও, মেধাকে ছাড়াই এগোয়। শেষ অভিঘাত নিতে না পারায় যে পরিণতি হয়, তা বুঝিয়ে দেয় যে একমাত্র মেধা ছাড়া কেউ বোঝে নি লেখক মানুষটিকে! তবু তার মাঝেই সে আত্মসম্মান বজায় রেখে যায়। বাইরের আকাশের দৃশ্যে শুরু হয় যে ছবি, তা বাইরের জগতেই শেষ হয়, যেখানে এই ঘটনায় হেলদোল থাকে না। কিন্তু দর্শকের চোখে জীবনের অসহায় চেহারা পরিপূর্ণতা পায়। আর এটা বলার যে কাউকে কিন্তু ডুবিয়ে যায় না বাল্মীকি। প্রত্যেককে বিষয়গত ও মনোগত ভাবে উজ্জীবিত করে যায়। এ এক আশ্চর্য মানুষের প্রতিবেদন হয়ে ওঠে যে নিজে পোড়ে কিন্তু মৃদু সুবাসে জোড়ে কাছে আসা মানুষকে। তাই মৃত্যুর দৃশ্যে অপরূপ এক মহানতা জন্ম নেয় এমন অসময়ের গল্পেও। অতনুকে প্রশংসা করতেই হয়, ক’টি ছবি এমন ভাবে শেষ হতে পারে! তাই বলছিলাম শেষ পাতা অনেক ভাবেই প্রতীকী হয়ে উঠতে পেরেছে।

এ ছবিতেও সাব-প্লট দু’টির ব্যবহার ছাড়া মূল বিষয়টি খোলসা হতে পারত না। তাই  শৌনক কেবল ঋণ আদায় করতে নয়, প্রেমিকা দীপা, এমনকি দুই পরিবারসহ উপস্থিত। তার সূত্রে অনুগৃহীত মেধা সরাসরি সাহায্য করতে আসে, মেধার পারিবারিক সংকটও আসে সঙ্গে। যেন আস্ত সময় ঢুকে পড়ে তাদের সঙ্গে। আগের আলোচনার সাপেক্ষে দু’টি দৃশ্য এখানে বলার। বিবাহ বিচ্ছেদের চূড়ান্ত পর্বে আধিকারিক যখন জানতে চান কোন ভাবে বিয়ে বাঁচানোর উপায় আছে কিনা, তখন জবাবের চেয়ে স্বামী স্ত্রীর মুখের ভাব যেন এক সামাজিক বিষন্নতার ও অনিশ্চয়তার দলিল হয়ে ওঠে। অন্য দিকে শৌনকের সব সময়ের উদ্বেগ ফুটে ওঠে মুদ্রা ছুঁড়ে ভাগ্য জানার চেষ্টায়। সে নাকি ভাগ্যবান, কঠিন পরিশ্রমের পরে একটু হলেও প্রেমিকার সঙ্গে হেসে কথা বলতে পারে, তার সহকর্মী বলে। আমরা দেখি সে সস্তার হোটেলে যেতে পারে, দক্ষিণ ভারতীয় সস্তার দোকানে খেতে যেতে পারে, কিন্তু তবু সহজ স্বয়ম্ভর হতে চাওয়া বুদ্ধিমতী দীপার সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হতে পারে না। দীপা কার বাইকে চড়ে শাড়ির ব্যবসার খোঁজে গেল, খুব ভোরে উঠে লুকিয়ে তা দেখার দৃশ্যও গুরুত্বপূর্ণ। তার ঠিক পরেই আরেকটি একেবারে অন্য রকম দৃশ্যে সে যখন স্পষ্টতই হতাশ, ফোন করে মেধার সঙ্গে কিছুটা সময় কাটাতে চায়। কিন্তু কিছুতে সুবিধে না হওয়ায় সে যে আক্ষেপ প্রকাশ করে সে-ও বুঝি এই সময়ের আরেক অভিজ্ঞান। নির্দয় সময় খোলা মনে কোনও সান্নিধ্য দিতে চায় না। এত অসহায় শৌনককে আর কোন দৃশ্যে লেগেছে কি?

বলার মতো এ ছবির অসাধারণ পরিমিত ও দীপ্ত আবহসঙ্গীত, অন্তর্ভেদী চিত্রগ্রহণ আর সজাগ দক্ষ সম্পাদনা। আবহ বুঝি দৃশ্যের গভীরতা মেপে শব্দসঞ্চার করে। ক্যামেরা যে কত লুকোনো অভিব্যক্তি চিনিয়ে দিতে পারে তা এখানে দেখে বুঝতে হবে। ঢালাই কারখানার ছাঁচ বানানো, শৌনকের সঙ্গে তার বাবার ঝগড়ার অতি ছোট অংশ, পোশাক পালটে দেবার মতো কিছু জায়গায় সম্পাদনা সঠিক অভিঘাত আনতে খুব সাহায্য করে। সোমনাথ কুন্ডু ও রাম চন্দ্র রজ্জাকের মেক-আপ অসাধারণ। বিশেষ করে গোটা ছবিতে মধ্যবিত্ত সত্তা আরোপ করতে এবং বাল্মীকির পোশাক নিখুঁত ভাবে ঠিক করতে তাঁরা সফল।

কালার গ্রেডিং যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় পরিচালক কী বোঝাতে চান, আর তখনই মনে পড়ে ঋণ আদায়কারী শৌনকের বাবা, যে মানুষটি চলচ্চিত্রে কালার গ্রেডিং-এর কাজ হারিয়েছেন ডিজিটাল যুগে, তার চরিত্রটিও বাড়তি গুরুত্ব পায়। এও বলার যে প্রতিটি অন্য চরিত্রকেও অতনু সমান ভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। আর গান, স্বকণ্ঠে গাওয়া দুই মূল চরিত্রের গলায় গান আরও সফল করেছে এ ছবিকে। বাড়ির পাশে আরশিনগর- লালনের এই গানও যথাযথ।

দ্বিধাহীন ভাবে এক কথায় অসামান্য ছবি অতনু ঘোষের শেষ পাতা বড় পর্দায় না দেখলে  আপাততুচ্ছ খুঁটিনাটি, ঘরোয়া উপাদান, তার দরজা জানলা মায় দেওয়াল, বাইরের আধো আলোর গলি, নিতান্ত সাধারণ খাবার দোকান আর বিশেষ জায়গায় পড়া আলোর পাশাপাশি সবুজে ভরা মুক্তির মাহাত্ম্য টের পাওয়া যাবে না। আর শেষে সেই প্রতিক্রিয়ার কথা না বললে চলবে না, যেখানে অন্য দৃশ্যের কাক তাড়ানোর মতোই প্রতিবেশি লোকটির উচ্চারণে রাজনৈতিক ভাবে দেখে নেবার হুমকির জবাবে প্রথমে তেড়ে যাওয়া ও পরে বারান্দায় এসে ওপরের আড্ডার লম্বা কথার মাঝে চেঁচিয়ে ভেংচি কেটে ছড়া বলার জায়গাটিঃ

ধিন তাকের ব্যাটা তিন তাক, তোর মা রেঁধেছে পুঁইশাক?

তুই দিতে থাক, আমি খেতে থাকি! … …

বলতে জানলে যে অসময়েও প্রতিবাদের সুর তোলা যায়, তা বড় সুন্দর ভাবে ফুটে উঠেছে এখানে।

♦–♦–♦♦–♦–♦


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!