- খাস-কলম পা | র্স | পে | ক্টি | ভ রোব-e-বর্ণ
- মার্চ ৫, ২০২৩
শ্যাওলার চলনভাষ্য
অতনু ঘোষের দশম সিনেমা “আরও এক পৃথিবী” আদতে কী বলতে চায়, তা নিয়ে শুরু থেকেই নানা রকম ভাষ্য ও ব্যাখ্যা আসার বিরাম নেই। সেখান থেকেই এই সৃজনের সার্থকতার নমুনা মিলতে পারে। গল্প যে আদৌ আর চলচ্চিত্রের অভিজ্ঞান নয় ! চলমান চিত্রমালার মাঝে নাগাড়ে বয়ে চলা ইঙ্গিত বুঝে, পর্দা জুড়ে বয়ে যাওয়া বার্তা থেকে নিতে হবে তার নির্যাস। সিনেমার আধুনিকতা সেখানেই। তাই যে নির্মাণ ঘিরে নানা মুনির নানা মত, তা যে বহুমাত্রিক নিজস্বতার পরিচয় দেয় তা বলা যেতে পারে।
এ এক মরমী অভিযাত্রার আলেখ্য, যেখানে নানা প্রান্তের নানা ধরনের জীবনের স্রোত পরস্পরকে ছুঁয়ে যায় পথের বিচিত্র বাঁকের মোড়ে। না দেখা হলে যে সম্পর্ক আর অভিঘাত জন্মই নিতে পারত না। নৈহাটির যে এগারো বছরের বালিকা ছিন্ন পরিবার ও তথাকথিত আদর্শ নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগে আর প্রতিরক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে বড় হয়, সেই তরুণী প্রতীক্ষা আজ বিভুঁইয়ে বিব্রত। উত্তর কলকাতার ক্লাবের পুজোর টাকা নিয়ে কেটে পড়ে অচেনা পৃথিবী দেখতে গিয়ে ভবঘুরে হয়ে পড়া শ্রীকান্ত মুন্সী লুকিয়ে থাকতে থাকতে বিদেশের এক কানা খালে ভাঙা নৌকার ভাঙা জীবনে এক অনায়াস আস্ততার সন্ধান দেয় আজ অসহায় মানুষকে। প্রতীক্ষার বর অরিত্র ছোটবেলায় বাপ-মাকে হারিয়ে অবহেলা সয়ে দেশ ছেড়েছে। সে পশ্চিমের বিত্তের বিভ্রান্তিতে আর অনিশ্চয়তায় কোথায়, বা আদৌ বেঁচে আছে কিনা, তা কেউ জানে না! আর আয়েষা প্রতারিত এবং পরে অতিমারির শিকার হয়ে কর্মচ্যুত, সে নীরবে যে কোনও পন্থায় নিজের ব্যবস্থা করে নিতে পিছপা নয়। এদের প্রত্যেকের আশ্রয়, জীবনদর্শন আর পৃথিবী সম্পর্কে ধারনা আলাদা আর স্বাভাবিক কক্ষপথে তা মেলার কথা নয়। তা হলে কী দেখা করিয়ে দেয় এদের?
যা তাদের মিলিত করে তা এই চলচ্চিত্রের আরেক গভীর বিষয়, তা হলো অস্বাভাবিক এক সময়। তাই স্বচ্ছল আধুনিক যাপনের খোঁজে অরিত্র আসে লন্ডনে আর বিয়ের কিছু দিন পরে তার কাছে সংসার পাততে আসে প্রতীক্ষা। ট্যাক্সিচালকের ভদ্রতা বা সস্তার হোটেলের ব্যবস্থা কাজে দেয় না। তখন হঠাত করে যোগাযোগহীন প্রতীক্ষার সঙ্গে দেখা হতেই আয়েষা সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। প্রাথমিক দ্বিধা এবং তার পরামর্শ নিতে অনিচ্ছা থাকলেও শেষে তার কাছেই আশ্রয় নেয়। বেনারসের রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে ফেসবুকের বন্ধুকে বিয়ে করে লন্ডনে পালিয়ে আসা আয়েষার বিয়ে না টিকলেও সে পেশা সংক্রান্ত পরামর্শ দিয়ে সামলে নিচ্ছিল। অতিমারি তাকে বেকার করে দিতেও সে হাল ছাড়ে নি। পেট আর ছাদ টেকাতে গিয়ে সে পিচ্ছিল পথে নেমেছে, কিন্তু বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে অতি অনিশ্চয়তায় আছে। তার অন্য ছেলেদের সঙ্গে সময়-যাপন, নৈশ-আসরে নাচা বা কার্বোহাইড্রেট বর্জন করে স্বাদু প্রোটিন বেছে নেওয়া তাই প্রতীকী হয়ে ওঠে। অথচ সে আশ্রয় বা সাহায্য করতে সব সময় রাজি। যেমন আগ বাড়িয়ে পরামর্শ ও সহায়তা দিতে পার্কের বেঞ্চ থেকে গলা বাড়িয়ে দেয় ভবঘুরে ভায়োলিন-বাদক শ্রীকান্ত মুন্সী। অজানা জীবনের প্রতি শাশ্বত টান আর অনিশ্চিত বর্তমানের যুগলবন্দী তার ভায়োলিনে সুর পায়।
অস্বাভাবিক সময় যদি এক দিক হয় “আরও এক পৃথিবী”র, তা হলে মূল চরিত্রদের অস্বাভাবিকতাও আরেক লক্ষণীয় দিক। অরিত্র ছেলেবেলায় মা-বাপের দুর্ঘটনায় মৃত্যুকে স্বাভাবিক বলে মেনে নিতে পারে নি। পেছনে যাদের হাত আছে বলে সে সন্দেহ করে তাদের পরবর্তী ব্যবহারও আঘাত দিয়ে কঠিন করে তুলেছে তাকে। তাই সে স্বজনের কথায় কান দেয় না, নিজের সিদ্ধান্ত অবলীলায় নেয়, এবং কাজের জগত ছাড়িয়ে আশু সমৃদ্ধির টানে পা বাড়াতে পারে। প্রতীক্ষা আরও এক রকম বিশৃঙ্খলা আর অনিশ্চয়তায় ভোগে তার পেটের টানে অপরাধী হওয়া বাবা আর তা সইতে না-পেরে সেই সংসার ছেড়ে চলে যাওয়া মায়ের তিক্ত সম্পর্কের টানাপড়েনে। সে জীবনের ভিন্ন মানে খোঁজে, বাপের কাছ থেকে গোপনে গুলি চালাতে শিখে প্রস্তুত হয়। আয়েষার বিষয়ে আগেই বলা হয়েছে, সে ক্রমে ক্রমে অস্বাভাবিকতার স্রোতে গা ভাসিয়ে সময়কে আদৌ পরোয়া করে না আর। আনন্দ দিয়ে আনন্দ পেতে আর প্রতিকূলতার মাঝেও হাত বাড়াতে তার দ্বিধা নেই তাই। আর শ্রীকান্ত মনে পড়িয়ে দেয় অতনুর আগেকার “রূপকথা নয়” এর পিতৃস্থানীয় চরিত্রে রূপ দেওয়া সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতি। সেখানেও পার্কের বেঞ্চে ঘটে ঘটনা ও মেলে তার ব্যাখ্যান এবং মিলিত হওয়া মুখেদের সাহায্যে সক্রিয় হয় মানুষটি। সেই সিনেমার নায়িকাও পরে নিজে সমাধান করে তার সমস্যার। আরও বিশদে বলার সুযোগ থাকলে বলা যেত যে অতনু ঘোষের একেকটি ছবি যেন পরেরটিতে যাবার এক পর্যায়, তাই অনেক মিল ও বিবর্তন খেয়াল করা যায়। এই চরিত্রগুলো যদি এমন না হতো, তা হলে সংকটের লগ্নে তারা অমন ভাবে সম্মিলিত হয়ে নিজেদের ভূমিকা পালন করতে পারত কী?
থ্রিলার নয়, গোয়েন্দা-গল্প নয়, রহস্য-রোমাঞ্চ নয়, কেবল আইডিয়া বা ধারণার গল্প নয়, ভৌগোলিক সফরের গল্প নয়, সেই অর্থে ভালোবাসার গল্প নয়, উধাও হয়ে যাওয়া নায়কের সন্ধান নয়, কিছু অসম্পর্কিত মানুষের জেগে ওঠার বার্তা ছাপিয়েও এ সত্যিই এক অন্য পৃথিবীর সূত্র দেখানোর গল্প
এই যে এতগুলো আলাদা কক্ষপথের মানুষ মিলে লড়ছে সময়ের সঙ্গে, এবং এটা যে কোনও পরিবার বা সম্পর্কিত গোষ্ঠীর বিষয় নয়, সেই প্রস্তুতিও কিন্তু অতনুর ঠিক আগের সৃজন “বিনিসুতোয়” দেখিয়ে দেয়। মাঝ তিরিশের দুই তরুণ তরুণীর রিয়ালিটি শোয়ের অডিশনে দেখা হবার পর থেকে তাদের জুড়েই গাঁথা হয় সামগ্রিক এক টানাপড়েন,যার চোরা টানে চরিত্রগুলোর পর্দা খুলতে থাকে পরতের পর পরতে আর ছদ্ম চঞ্চলতার সৌন্দর্যে ভরে যায় পর্দা। অর্থাৎ সুতোর বাঁধন আগেই খুলে ফেলতে পেরেছেন পরিচালক, তাই সেই চোখেই দেখতে হবে পরের এই নির্মাণকে। এখানে স্বভাবতই সুতোহীন সম্পর্ক আরও গভীর। কারণ এক পৃথিবী থেকে অন্য পৃথিবীতে ছিটকে পড়া চরিত্ররা প্রথমে নিজেদের সংসার থেকে আলাদা ও পরে সামাজিক বৃত্ত থেকে পৃথক হয়ে গেছে, যার একটু আভাসমাত্র ছিল “বিনিসুতোয়”।
এ ছবির আরেক বিষয় হলো অসুখের কালের সমান্তরালে বয়ে চলা সমস্যার অপূর্ব এক ভাষ্য। টামসেন কোর্টনি-র “ফোর ফিট আণ্ডার” থেকে লণ্ডনের পথবাসী অসহায় মানুষের পরিচয় নিয়ে যে সৃষ্টির চলা শুরু, তা এক স্বকীয় সাদামাঠা রীতিতে বলেছেন অতনু। থ্রিলার নয়, গোয়েন্দা-গল্প নয়, রহস্য-রোমাঞ্চ নয়, কেবল আইডিয়া বা ধারণার গল্প নয়, ভৌগোলিক সফরের গল্প নয়, সেই অর্থে ভালোবাসার গল্প নয়, উধাও হয়ে যাওয়া নায়কের সন্ধান নয়, কিছু অসম্পর্কিত মানুষের জেগে ওঠার বার্তা ছাপিয়েও এ সত্যিই এক অন্য পৃথিবীর সূত্র দেখানোর গল্প, যা সব ছাপিয়ে অস্বাভাবিক সময়, প্রতিকূলতা, মনের অসুখ, অপরাধ-জগতকে অস্বীকার করে বেঁচে থাকার বিবরণ। তাই অন্য চোদ্দটি দেশের ভেসে চলা গৌণ চরিত্রও এখানে গুরুত্বপূর্ণ, এবং আশ্রয়দাত্রী কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা, বাড়িওয়ালি শ্বেতাঙ্গ কর্ত্রী থেকে পথচলতি লোক, শ্রীকান্তর পথিক বন্ধু যে ধর্ষিতা ও মৃত মেয়ের প্রতি কেবল সহমর্মিতায় কেঁদে মানুষের পরিচয় দেয়, তারাও মনে থেকে যায়। তাই যখন শ্রীকান্তর মুখে লণ্ডনের কম করে দশ হাজার আশ্রয়হীন মানুষের কথা ওঠে, অবাক লাগে না। বরং চমকে উঠি শুনে যে সেই মানুষটি ঘর ছেড়েছে কেবল তার শরৎচন্দ্রীয় নামটির মাহাত্ম্য অনুভব করবে বলে! অতি কঠিন পরিস্থিতিতেও প্রতীক্ষা তার বাবাকে ফোন করার সময় আওড়ে ওঠে শৈশবের কবিতা! ওই লড়াই করার কবিতা আর তার অস্ত্রশিক্ষা মিলে যায় কোথাও। আর শ্রীকান্তর মুখে অহরহ ফোটে দার্শনিক কথা, কবিতা সাহিত্যে তা মাখামাখি হয়ে থাকে। অন্যান্য চরিত্রের মুখেও থাকে তেমন সংলাপ যা চিত্রণকে অন্য মাত্রায় নিয়ে যায়। অন্যান্য সংলাপও এত স্বাভাবিক যে অভিনয় টের পাওয়া যায় না।
সংলাপহীনতাও এ ছবির সম্পদ। অনেক দৃশ্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে আপ্পূ প্রভাকরের চিত্রগ্রহণের সুনির্বাচিত কোণে ও বিন্যাসে, বিশেষ করে শেষ বার যখন স্বামীর ফ্ল্যাটে প্রতীক্ষা যায়, তখন নানা জিনিস পাওয়া, ড্রয়ার থেকে যত্নে রাখা নতুন ফ্ল্যাটের চাবি মেলা ইত্যাদি অনেক ইঙ্গিত দিয়ে রাখে। মনস্ত্বত্বের তাড়নায় চলা চরিত্রদের কাজের নীরব ব্যাখ্যা ছাড়াও অতি দক্ষতার সঙ্গে গল্পকে এগিয়ে নেওয়া হয়েছে কোন বাড়তি দৃশ্য না রেখে, যেখানে সুজয় দত্ত রায়ের সম্পাদনা বিরাট অবদান রাখে। প্রতীক্ষার ওপরে ক্যামেরা ও সম্পাদনা সমান নজর রাখায় একটি ভিন্ন রকম ও সংযত নতুন চরিত্র উপহার পাওয়া গেল। আর স্রেফ তাকানোর মাধ্যমে কৌশিক গাঙ্গুলি নিজেই আরেক পৃথিবী তৈরি করেন। ভাঙ্গা জলযানে দাঁড়িয়ে যে ভাবে শ্রীকান্ত প্রতীক্ষাকে বারংবার উৎসাহ ও নির্দেশ দেয়, আয়েষাকে বোঝায়, তার পরে চুড়ান্ত গোলাগুলির দৃশ্য আর তেমন অবিশ্বাস্য লাগে না। এ ছাড়া পালাবার বা বাঁচার আর উপায়ও বা কি ছিল? আর শেষের ওই গান যে অমন দৃশ্যের পরে আসতে পারে এবং মানানসই হয়ে উঠতে পারে তা এক অভিজ্ঞতা। সব কয়টি গান ভালো, কিন্তু শেষেরটি সেরা। আবহসঙ্গীত নিয়েও দারুণ সঙ্গত করতে পেরেছেন দেবজ্যোতি মিশ্র।
নায়ক-নায়িকা লড়াই জিতে পালাবার সময়, যখন ভাগ্নীকে কল্পিত ধারাভাষ্যের উপসংহার দেয় শ্রীকান্ত, তখন তার মহাজাগতিক আনন্দ আর সাধুসুলভ তৃপ্তি দেখে মনে হয় মারি-উত্তর দেশের রামকৃষ্ণ বুঝি বা! আবার মনে পড়ে “রূপকথা নয়” এর পিতৃস্থানীয় চরিত্রে রূপ দেওয়া সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কথা। সারা সিনেমা জুড়েই কিন্তু এই মন কেমন করা দোদুল্যমানতার চিত্রকাঠামোয় ঝিলিক মারে আশাভরসা আর দাঁত চেপে পাল্টা সংঘাতের ভাষ্য।
এ ছবির আরেক বিষয় হতে পারে আজকের এই মারি-দীর্ণ সময়ে দেশকাল নিরপেক্ষ ভাবে আধুনিক সাহসী নারী কেমন ভাবে নিজের ভূমিকা বদলে নিতে পারে। এতদিন ধরে জানা ছিল বিয়ের পরে বিদেশে গিয়ে মধ্য বা নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়েরা ভিন্ন পরিবেশে নাকাল হয়, ঠকে যায়, অত্যাচারিত হয়ে অন্যের সাহায্য নিয়ে ফিরে আসে, মারাও পড়ে। এখানেও প্রায় সকলে প্রতীক্ষাকে বলে যে স্বামী তাকে এড়াতে চায়, তাই পালিয়েছে, এখন দেশে ফিরে যাওয়াই ভালো। প্রতীক্ষা তা মানে না, সে এই রহস্যের শেষ দেখে ছাড়বে, এমন এক চরিত্রই সফল ভাবে গড়ে তুলেছেন অতনু। সেখান থেকেই কি এই সময়ের এক নতুন চলচ্চিত্রের শুরু নয়? কারণ তার পর থেকে যা যা ঘটে চলে সবই তো তাকে ঘিরে, এবং দেশ তথা বিদেশের ভেসে চলা শ্যাওলার মতো অজস্র মানুষ কমবেশি নানা ভাবে ঠেলা দিয়ে এগিয়ে দেয় তাকে। সব চরিত্র মিলে তখনই তো প্রতীকী হয়ে ওঠে শিকড়ছেঁড়াদের মহামিলন, যেখানে ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে আসে সাথিরা, এবং দুঃসময়ের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারে “আরও এক পৃথিবী”।
♦—♦♦—♦♦—♦
❤ Support Us