- খাস-কলম পা | র্স | পে | ক্টি | ভ রোব-e-বর্ণ
- এপ্রিল ৩০, ২০২৩
ধর্মতলায় “ধর্মঠাকুর” আসছেন
ব্রিটিশ আমলে ধর্মতলা
ধর্মতলায় ধর্মঠাকুরের পুজো হবে আগামী ৫ থেকে ৯ মে। ৫ মে বুদ্ধপূর্ণিমা। ওই দিন ধর্মঠাকুরের উৎসব শুরু। উৎসবের শেষ, বাঙালির আর এক বৌদ্ধিক চেতনার প্রথিকৃৎ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিনে। আয়োজক “মার্গদর্শন” নামক একটি সংগঠন। এই সংগঠনটি সম্প্রতি ত্রিবেনীতে কুম্ভ মেলার আয়োজন করেছিল। ৫ থেকে ৯ মে পর্যন্ত ধর্মপূজো উপলক্ষ্যে যোগ্য, প্রকৃতি বন্দনা, ধর্মীয় আলোচনা সভা, ভোগ বিতরণ, সবই হবে। সন্ধ্যায় ভজন,কীর্ত্তন, নৃত্যের অনুষ্ঠান হবে। “মার্গদর্শন”-এর বক্তব্য, ভারতের হারিয়ে যাওয়া পার্বন, মেলার উৎস, অনুষ্ঠানস্থল খুঁজে বার করা এবং, ধর্মতলার প্রাচীন ঐতিহ্য, ইতিহাস, পূজা, উৎসবকে আবার পুনরায় ফিরিয়ে আনার জন্যই এই আয়োজন। মধ্য কলকাতার ধর্মতলায় ধর্মঠাকুরের পুজোর “মার্গদর্শন” মূল উদ্যোক্তা হলেও এই বিরাট কর্মযজ্ঞে যুক্ত থাকছে রামকৃষ্ণমিশন, ইস্কন, ভারত সেবাশ্রম, মহানির্বান মঠ-এর মতো সংগঠন। আয়োজকদের এমনই দাবি। তবে কলকাতার ইস্কনের তরফে রাধারমণ দাস জানিয়েছেন, “কলকাতার শাখা থেকে আমরা ধর্মতলার এই ধর্মঠাকুরের পূজায় অংশগ্রহণ করছি না।”
এবার আসা যাক ধর্মতলার নামের সঙ্গে ধর্মঠাকুরের সত্যি কোনও সম্পর্ক আছে কী? মধ্য কলকাতার এই জায়গাটার নাম “ধর্মতলা” হল কীভাবে? ইতিহাস ঘেটে যা জানা যাচ্ছে এই নামকরণের পিছনে অনেকগুলো ধারণা প্রচলিত আছে। রেভারেন্ড জেমস লং-এর লেখায় ধর্মতলার নামের পিছনে যে ইতিহাস পাওয়া যায় তাতে জানা যাচ্ছে, ধর্মতলার এখন যেখানে টিপু সুলতান মসজিদ রয়েছে, আগে তার পাশে একটা ঘোড়ার আস্তাবল ছিল। সেই আস্তাবলের জমিতে আরেকটা মসজিদ বানানো হয়েছিল, সেই মসজিদটি এখন আর নেই। সেই মসজিদের প্রথম কারবালার সমাবেশ হত এই মহানগরে। মহানগরে এরকম ধর্মীয় পরিবেশ ছিল বলেই জায়গাটার নাম “ধর্মতলা” হয়েছে। অন্যদিকে ডাঃ হর্নেল সাহেব এই বিষয়ে একটা পৃথক ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন, জানবাজার এলাকায় বৌদ্ধদের একটা বসতি ছিল। তারা বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান করতেন এখানে। তার থেকেই জায়গাটার নাম “ধর্মতলা” হয়েছে । “কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত” -র লেখক বিনয় ঘোষের মতেও এই এলাকায় বহুকাল আগে ধর্মঠাকুরের মন্দির ছিল। তাঁর লেখায় এই তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। তাই ধর্মঠাকুরের সঙ্গে ধর্মতলা নামের একটা নিবিড় যোগ যে আছে সেটা বলাই যায়।
সাম্প্রতিককালে কলকাতা নিয়ে যাঁরা গবেষণা করছেন তাঁদের অনেকেই মনে করেন, ধর্মতলা নামের সঙ্গে গ্রামবাংলার উপাস্য দেবতা ধর্মঠাকুরের একটা নিবিড় সম্পর্ক আছে। এই ধর্ম ঠাকুর আসলে রাঢ় বাংলার দেবতা। এই দেবতার কোনও রূপ বা আকৃতি নেই। একটা সিঁদুর মাখানো পাথরের টুকরোকেই ধর্মঠাকুর মনে করে পূজা করা হয়। প্রধানত বাউড়ি, বাগদি, হাড়ি, ডোম সম্প্রদায়ের মানুষেরা এই ধর্মঠাকুরের উপাসক। কথিত আছে একদল নিম্নবর্গের মানুষ জানবাজার অঞ্চলে অনেক আগে বসবাস করতে। তাঁরা ধর্মঠাকুরের পুজো করতেন, ধর্মঠাকুরের একটা মন্দিরও বানিয়েছিলেন এই নিম্নবর্গের মানুষেরা। পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর লেখায় এই ধর্মঠাকুরের মন্দিরের কথা পাওয়া যায়, তার মানে তিনিও দেখেছিলেন সেই ধর্মঠাকুরের মন্দির। বিনয় ঘোষ লিখেছেন, এখানে মহাসমারোহে ধর্মঠাকুরের পুজো হত, গাজন হত, মেলা বসত – সব মিলিয়ে একটা জমজমাট উৎসব এখানে চালু ছিল।
এবার “মার্গদর্শন” ধর্মতলার সেই জমজমাট উৎসবের হারিয়ে যাওয়া মেজাজকেই ফিরিয়ে আনতে ৫ দিনের এই নয়া পার্বণের আয়োজন করছে।
ধর্মতলাকে সামনে রেখে উৎসবের আয়োজন করা হলেও মূল পূজা হবে পার্ক স্ট্রিটের উল্টো দিকে রাজস্থান মাঠে। মোট চারটি মাঠ ব্যবহারের অনুমতি নেওয়া হয়েছে সেনাবাহিনীর কাছ থেকে। মেলা বসবে শহিদ মিনারেও। চাওয়া হয়েছে পুলিশের অনুমতি। উদ্যোক্তারা বলছেন, ধর্ম অর্থ সত্য। সেই সত্যের পুজোই তাঁরা করতে চলেছেন। তাই শুধু হিন্দুদের জন্য নয়, মুসলমান, শিখ, জৈন সব সম্প্রদায়ের মানুষকেই এই ধর্মঠাকুরের পূজায় যোগ দেওয়ার জন্য আবেদন জানিয়েছি ।
সুকুমার রায় তাঁর কবিতায় লিখেছেন…. “হলদে সবুজ ওরাং ওটাং ,ইঁট পাটকেল চিৎ পটাং/মুশকিল আসান উড়ে মালি, ধর্মতলায় কর্মখালি/ চিনেবাদাম সর্দিকাশি, ব্লটিংপেপার বাঘের মাসি”
সুকুমার রায়ের লেখা পরে মনে হয়, এটাই আসল আজকের কলকাতার ধর্মতলা। ধর্মতলা নামের পিছনে ধর্মঠাকুরের উপস্থিতি থাকলেও সুকুমার রায়ের ধর্মতলার বর্ণনার সঙ্গে আজকের ধর্মতলার অনেক, অনেক মিল পাওয়া যায়। কী নেই ধর্মতলায়? আর সেই বৈচিত্রের ধর্মতলায় আবার “মার্গদর্শন”-এর উদ্যোগে আয়োজিত চলেছে সর্বধর্ম সমন্বয়ের লক্ষ্যে হারিয়ে যাওয়া “ধর্মঠাকুর”-এর পূজা। কলকাতায় ধর্মও থাকে ধর্মতলায়ও তার নিজের জায়গায় থাক, নিজের মতো করে যেমনটি আছে ঠিক তেমন ভাবেই।
❤ Support Us