Advertisement
  • পা | র্স | পে | ক্টি | ভ রোব-e-বর্ণ
  • মে ২৬, ২০২৪

বিষয়, প্রকাশের অপ্রকাশিত দুঃসাহস

বাহার উদ্দিন
বিষয়, প্রকাশের অপ্রকাশিত দুঃসাহস

ক্যানভাসে তেলরং, ১৯৯৭। চৈতালি দাসের সংগ্রহ থেকে

 
প্রকাশ কর্মকার, বরাবর বেপরোয়া । অকপট । বোহেমিয়ান । এবং অপ্রিয় সত্যভাষী । প্রাতিষ্ঠানিকতার বিরুদ্ধে দ্রোহ আর আগুন-ঘষা বিদ্রুপ তাঁর নিত্য সহচর । কখনো নৈরাজ্যের প্রবল প্রবক্তা । কখনো অতলস্পর্শী মরমিয়া । স্নেহময় পিতা, দায়িত্ববান স্বামী, বিশ্বস্ত বন্ধু এবং অনুজময় হৃদয় । দিনযাপনে, বাচনভঙ্গিতে, লেখায়, বলিষ্ঠ রেখাচিত্রে, ক্যানভাসের অবয়বে, নীলিমার স্বতান্ত্রিক নির্মাণে তাঁর প্রকাশ, আত্মপ্রকাশ—ভারতীয় চিত্রকর্মের অঙ্গনে, আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, অম্লান ইতিহাস হয়ে থাকবে । ভ্যানগঁগের জীবনতৃষ্ণা (লাস্ট ফর লাইফ); মধ্যরাতে পিকাসোর একাকী নৃত্য, আত্মপ্রহার; আঁকিয়ে রবীন্দ্রনাথের ব্যাকরণহীন, দুর্ভেদ্য, দুর্বোধ্য রহস্যময়তা তাঁকে উদ্বুদ্ধ করে থাকতে পারে । কিন্তু এব্যাপারে, তাঁর তিন আত্মবৃত্তান্ত— আমি, এই আমি, ওই দিনগুলি’তে স্পষ্ট স্বীকারোক্তি নেই । সমকালীন, অন্য কোনো ভারতীয় শিল্পীর চিত্রকর্মে, শিল্পধর্মে এমন বহুমাত্রিক বলিষ্ঠতা আমাদের নজরে পড়ে না । ছবির ফর্মকে তছনছ করে শৌর্যসুন্দর, তীর্যক প্রাণবল্লভ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কিংবা নিসর্গ চিত্রে সমর্পিত সৃষ্টিতে, নৈরাজ্যের ভেতরেও আলোকিত সম্মোহন তৈরিতে অদ্বিতীয় তাঁর দক্ষতা । প্রশ্ন উঠতে পারে, পূর্বগামীদের তুলতুলে রোমান্টিকতা এবং সমকালীন নবায়নের পরিসরে, কোন যাদুবলে আত্মজৈবনিক অথচ নৈর্ব্যক্তিক, সম্পূর্ণ নিজস্ব ঘরানায় এত প্রগাঢ়, গূঢ় পারদর্শিতা আয়ত্ত করল তাঁর কব্জি ? একি শুধু ব্যক্তি প্রতিভার স্বতঃস্ফূর্ত উদ্ভাস ? না কোনো অলৌকিকের অবদান ? না পারিপার্শ্বিকের দাহ, ক্রোধ, গ্লানি, ভাঙন দেখতে দেখতে সতেজ শিল্পসত্তার, পৌরুষের এ আরেক ক্রমউত্তরণময় অভিযান ?
 
প্রকাশের জীবনবোধে অলৌকিক চেতনার জায়গা নেই । সাকার ও নিরাকারের অস্তিত্ব, বা প্রাচীনাশ্রয়ী অতীন্দ্রিয়বাদ তাঁর কাছে মূল্যহীন । যা কিছু লৌকিক, মানবিক, যা স্পর্শযোগ্য, দৃশ্যযোগ্য সবই তাঁর ইহজাগতিকতাবোধের অবিচ্ছেদ্য শরিক । দারিদ্র্যে ঘেরা, ছায়াহীন শৈশব—অল্পবয়সে বাবা-মায়ের মৃত্যু, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আস্ফালন, চারপাশে দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের আর্তনাদ, দাঙ্গার আগুন, যে আগুনে ভস্মীভূত বাড়িঘর, দেশভাগ, বিশ্বজুড়ে মহাযুদ্ধোত্তর ভাঙন—ট্র্যাজেডির পর ট্র্যাজেডি, পারিবারিক দায়িত্ব সামলাতে ভারতীয় ফৌজে চাকরি, ওখানেও অসহ্য অনাচার এবং বাড়িতে পালিয়ে এসে রুটি-রুজির খোঁজে হন্যে হয়ে ছুটতে থাকা—এরকম অসংখ্য ঘটনা আর ব্যক্তিগত দুঃখবোধ তাঁকে সম্ভবত ক্রুদ্ধ, দ্রোহপ্রবণ, উচ্ছৃঙ্খল, ভাঙনমুখর করে তোলে । প্রকাশ কর্মকার বিশেষ কোনো অঞ্চলের, যুগের প্রতিনিধি নন, তিনি সর্বকালের, সব দেশের নাগরিক । তাঁর সত্য ভাষণের ঝুঁকি কারো কারো অপছন্দের কারণ হতে পারে, কিন্তু তাঁকে উপেক্ষা করা যায় না । বিশ্বাসের দৃঢ়তা, নান্দনিক দক্ষতা আর স্তর থেকে স্তরে তাঁর উত্তরণ, শিল্পবিশ্বের দরবারে তাঁকে বসিয়ে রাখবে অত্যুচ্চ অত্যুজ্জ্বল আসনে । প্রকাশের ছবি আর তাঁর অন্তর ও বাহিরকে বুঝতে হলে তাঁকে তাঁর সময় ও হয়ে-ওঠার ওই প্রেক্ষাপটেও খুঁজতে হবে । জানতে হবে সমসাময়িক গল্প কবিতার বল্গাহীন অশ্বারোহী সুনীল-উৎপল, শক্তি-সন্দীপন- জ্যোতির্ময়- দীপক- তারাপদ- বেলাল এবং তাঁদের অগ্রজ নীরদ মজুমদার, কমলকুমার, গৌরকিশোর, অহিভূষণ—এরকম আরো অনেকের তারুণ্যের, সৃজনশীলতার স্বভাবকে । বুঝতে হবে নষ্ট-বিনষ্ট হতে হতে, আগুনে পুড়তে পুড়তে ভস্ম হবার আগেই তাঁদের ফিরে আসার বৃত্তান্ত । ভবঘুরে, চরম উচ্ছৃঙ্খল, বিষণ্ণ, দুধর্ষ, দারিদ্র্য-ক্লিষ্ট হয়েও যাঁরা হেরে যাননি, ব্যস্ত থেকেছেন অক্লান্ত ভাঙন আর নির্মাণে, অনেকটাই যুদ্ধজয়ী বীরের মতো ।
লেখার জন্য, আঁকার জন্যই তাঁরা অর্জন করেছেন আত্মপ্রহারের দুঃসাহস । এখানে সংশয় নেই, প্রশ্ন আছে, সংহার নেই, অস্তিত্বে জড়িয়ে আছে সঙ্ঘবদ্ধ অভিপ্রায় । আত্মহত্যার, অবসাদের অসুখ নেই, তাঁদের উল্লাসে, নিয়ম ভাঙায়, প্রাতিষ্ঠানিকতা বিরোধী কটাক্ষে জীবনের বেঁচে থাকার জয়গান হামেশা তীব্র । কখনো বা অধরা, কর্কশ ।
 
ক্ষুদ্র পরিসরে, ওইসব সমবেত প্রতিদ্বন্দ্বীদের দিনযাপনের, বন্ধুত্বের গল্প বলা সম্ভব নয় । প্রকাশই যখন আপাতত আলোচনার বিষয়—তাই তাঁরই জীবন-ঘেঁষা কয়েকটি রোমাঞ্চকর ঘটনা স্মরণ করিয়ে দেওয়া জরুরি ।
 
১৯৬৯-৭০ । প্যারিসের চিত্রপাঠ চুকিয়ে, ইউরোপ ঘুরে দেশে ফিরেছেন নির্মীয়মান, উদীয়মান চিত্রকর । দুরন্ত, প্রাণচঞ্চল তরুণ, ঘরে বসে, নিজের সামনে দাঁড়িয়ে, নিভৃতে ছবি আঁকার পাত্র নন । চাই তাঁর উত্তেজনা, সবসময় হইচই এবং লাগামহীন বন্ধুসঙ্গ । শুরু করলেন চিত্রমেলা । প্রধান উদ্যোক্তা নিজে । পেছনে গৌরকিশোর আর অহিভূষণের ‘উসকানি’। এই প্রথম খোলাবাজারে চিত্রকরদের আঁকিবুকি আর অল্পদামে ছবি বিক্রির সূচনা।
 

রেখাচিত্র, ১৯৮৯।সুদীপ বন্দোপাধ্যায়ের সংগ্রহ থেকে

দ্বিতীয় দুঃসাহ, ময়দানে মুক্ত মেলার আয়োজন। এখানেও তিনি প্রধান সংগঠক। প্রতি শনিবার মেলা বসছে। কবিতা পড়ছেন কবিরা, ছবি আঁকছেন শিল্পীরা । অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে চলে আসছেন সাগরময় ঘোষ, খালাসিটোলা থেকে লেখকদের লেখক কমলকুমার। সবার ভিড়ে বিঘোষিত স্বাতন্ত্র্য চাই প্রকাশের । অতএব মেলার গোড়ার দিকে আচমকা একটি চমক ।
 
একসময় উদ্বাস্তুর মতো আহেরিটোলায় থাকতেন। ওখানেই ৬৬ সালে বিশাল আয়তনের একটি ছবি আঁকেন। ওই ছবি নিয়েই এবার মুক্ত মেলায় ঢুকবেন । এত বড়ো ছবি একা নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। তবু কসরতের শেষ নেই। ঠিক হল ছবিটি দুটি সরু বাঁশে দুদিক থেকে বাঁধা থাকবে। তারপর দুজন কাঁধে নিয়ে ময়দানের দিকে রওনা দেবেন। পেছনে হাঁটবে কয়েকজনের মিছিল। সবার সামনে প্রকাশের খালাসিটোলার বন্ধু ইব্রাহিম পতাকা উঁচিয়ে লেফট-রাইট করতে করতে হাঁটবেন। সঙ্গে তাঁর ব্যান্ড পার্টির ৭ সদস্য। দলের শেষ প্রান্তে গলায় গাঁদাফুলের মস্ত মালা জড়িয়ে এগোতে থাকবেন স্বয়ং শিল্পী আর তাঁর দুই বন্ধু রমেশ ও নিতাই। এবার প্ল্যানমাফিক শনিবার বিকেলে, কে সি দাসের দোকানের সামনে থেকে মিছিল এগোচ্ছে। ময়দানের দিকে। সামনে ব্যান্ড বাজছে। দেখতে দেখতে পথচারীরাও মিছিলে পা মেলাচ্ছেন। মিছিলটি মুক্তমেলার চত্বরে ঢুকতেই সবাই তাজ্জব। হুড়োহুড়ি চারদিকে, ছোটাছুটি। কেউ কেউ হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলেন । তালগোল পাকানো ভিড়ে ঘামে ভিজে একাকার প্রকাশ । গলায় ঝোলানো গাঁদাফুলের মালা ছিন্নভিন্ন। অহিভূষণ ছুটে এসে তাঁর মোটা বপু কাত করে জড়িয়ে ধরলেন।
 
তখনো ভিড় তাঁকে ধাওয়া করছে। তাল সামলাতে না পেরে হঠাৎ তিনি পড়ে গেলেন। দেহের ওপর বৃহৎ ভারী ছবি। নিচে পড়ে গিয়েও চিত্রকর হাসছেন। তাঁকে ঘিরে হাসছে, তাঁর মুখে উপচে পড়ছে ক্যামেরার ক্রমাগত আলো। ইব্রাহিমের ব্যান্ডপার্টিও থেমে নেই, অনবরত জয়ধ্বনি বাজিয়ে যাচ্ছে।
 
আরেকটি ঘটনা। ১৯৯৩। বাবরি মসজিদ ধ্বংস করার প্রতিবাদে, ভারতীয় সমাজের বন্ধন অটুট রাখতে অযোধ্যায় দেশের নানা প্রান্তের লেখক-কবি-চিত্রকর, সংগীতশিল্পীদের সমাবেশ ডেকেছে ‘সহমত’। ১৩ আগস্ট কলকাতা থেকে রওনা দিলেন বিজন চৌধুরী, পৃথ্বীশ গঙ্গোপাধ্যায়, অমিতাভ দাশগুপ্ত, সন্দীপ সরকার, এবং প্রকাশ। সঙ্গী সেরিনা হোসেন আর এই লেখক। অনুষ্ঠান সূচি আগেই ঠিক হয়ে আছে। ১৪ আগস্ট মাঝরাতে, ঠিক ১২টায় সরযূ নদীতীরে বেজে উঠবে নেহরুর (১৯৪৭ সালের) ঐতিহাসিক ভাষণ—বিশ্ব যখন নিদ্রমগ্ন, স্বাধীনতার স্পর্শে প্রবল উৎসাহ নিয়ে ভারত জেগে উঠছে।… ১৪ আগস্ট, যথাসময়ে কলকাতার প্রতিনিধি দল ট্রেন থেকে নামলেন। নেমেই ভিড়ঠাসা স্টেশনে অপ্রত্যাশিত কাণ্ড ঘটিয়ে দিলেন প্রকাশ। পরনের বারমুডাটাই শুধু যথাস্থানে ঝুলছে। বাদবাকি সব পোশাক খুলে সারা দেহে ভস্ম মেখে একটি রিকশায় উঠে দাঁড়িয়ে চালককে তাঁর হুকুম, চলতে রহো। পথচারীরা হতবাক। কেউ কেউ করজোড়ে নমস্কার করছেন। অযোধ্যায় নবাগত সাধু তাঁদের আশীর্বাদ করে যাচ্ছেন। বিকেলে ঘুরতে বেরিয়েও এই একই বেশভূষা। রাত ১০টা থেকেই সরযূ নদীর তীরে অনুষ্ঠান শুরু। গায়ে সন্ন্যাসীর পোশাক, কপালে স্ব-অঙ্কিত রক্তাক্ত গোলাকার বৃত্ত। সভাস্থলে ঢুকতেই তাঁকে ঘিরে হইচই আর কৌতূহল। সাধু ভ্রূক্ষেপহীন। মঞ্চে বসে আছেন। ঠিক ১২টায় রেকর্ডে নেহরুর ভাষণ বেজে উঠল। ঠিক তখনই ত্রিশূল হাতে বিভিন্ন আখড়ার একদল সাধুর প্রবেশ। কণ্ঠধ্বনিতে জয় সিয়ারাম। নেহরুর ভাষণ থমকে গেল, ঘোষিত অনুষ্ঠান ভেস্তে যাবার উপক্রম, প্রকাশ তাঁর আসনে তখনো দিব্যি বসে আছেন। অচেনা সাধুকে দেখে, সামনে এসেই কয়েকজন সুঠামদেহী ত্রিশূলধারীর প্রশ্ন, আপ কোন হ্যায় মহারাজ, কাহা কে রহনেওয়ালে। মাথায়, দাড়িতে হাত বুলিয়ে ‘ওম শান্তি’ বলে প্রকাশের হুঙ্কার, বঙ্গালকে।
 

শিল্পীকে লেখা শিল্পীর চিঠিপত্র

অর্জুন সিং তখন কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রী। তাঁর এ-সভায় আসার কথা। সাধুদের উৎপাত, অনভিপ্রেত প্রবেশ দেখে পুলিশ জেগে উঠল। দ্রুত পরিস্থিতি আয়ত্তে নিয়ে এল। প্রকাশ বসে থাকলেন। পরদিন ধীরে ধীরে সরযূ নদীর তীর জুড়ে সূর্য যে আলো ছড়াল, বিকেলে যে প্রশান্ত রং ছড়িয়ে সে অস্ত গেল — অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছি — পরে ওই প্রশান্তি, ওই আভাই প্রকাশের নীলিমার নৈরাজ্যকে তছনছ করে বারবার ফিরে আসছে প্রকাশের নিসর্গ চিত্রে। কয়েক বছর আগে, ক্যালকাটা পেন্টার্সের ৫০ বছরকে ঘিরে আইসিসিআর-এর প্রদর্শশালায় শিল্পীদের যে যৌথ প্রদর্শনী হয়, সেখানেও প্রকাশের একটি অসাধারণ, বিস্ময়কর ছবি দেখার সুযোগ হয় আমাদের। অদ্ভুত সংরাগ ছড়াচ্ছে অস্তগামী সূর্য। জলেও তার প্রতিবিম্ব। পাশেই খানিকটা বেঁকে গিয়ে হেলান হীন অবস্থায় একটি পরিণত খেজুর গাছ বিন্যস্ত পাতা নিয়ে ছাতার মতো দাঁড়িয়ে। গাছের নিচে পাকা ধানের ঘনবদ্ধ পাতা। এসব কীসের প্রতীক? নৈরাজ্যের না সংহত চিন্তার? কার আশ্রয়? বোধির না ভাঙনের? সময় উত্তীর্ণ শিল্পীর ঋদ্ধ জীবনবোধের নয় কি? রহস্যময় ব্যঞ্জনায় সম্ভবত তিনি জানিয়ে দিতে চেয়েছেন, তাঁর শিল্পচর্চার উত্তরণের, ধারাবাহিক বিস্তারের নিদর্শন— যেখানে নিয়মভাঙার শৈলী নিয়েও তিনি আত্মস্থ, প্রকৃতিস্থিত।
 

কাগজে মিশ্র মাধ্যম, ১৯৬৬

 

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, দেশ ভাগ আর বহু রকমের নেতি আর দুঃসময়কে অতিক্রম করে সর্বাত্মক ইতিবাচকের সঙ্গে বসবাস করেছেন প্রকাশ। তীর্যক বিদ্রূপ, ক্রোধ, ব্যঙ্গ, পাশাপাশি স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে দিচ্ছেন রূপকে, অবয়বে, খুশির রং ব্যবহারে । অঙ্গসর্বস্বতার চাইতে দৃষ্টিতে, যে বাহ্যিক উপদ্রব, যাকে কেউ কেউ একধরনের অনুশাসনহীনতা, চিন্তার নৈরাজ্য বলেছেন— তা কখনো নিরর্থক হয়ে উঠবার সুযোগ পায়নি তাঁর খুদে-বড়ো ক্যানভাসে, অঙ্কনমগ্ন শক্তিতে

 
সম্প্রতি, গ্যালারি গোল্ড-এ প্রকাশের [৭ – ১২ মে, ২০২৪] ৫২টি ছোটো – বড়ো, ছবি প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন গৌতম দাস, চিত্রকর্মের আত্মায়। ১৯৬৬ থেকে জীবনের শেষলগ্ন পর্যন্ত আঁকা ছবির সংগ্রহ এবং চিঠি ঘিরে প্রদর্শনী। সঙ্গে প্রকাশিত হয় শিল্পীকে নিয়ে কয়েকজন গুণীর স্মৃতিচারণ আর ছবি বিষয়ক কথাবার্তা। আরেকবার জানা গেল, প্রকাশের সঙ্গে কে কীভাবে তাঁরা মেলামেশা করেছেন, ছবিতে প্রকাশিত চিত্রকর ভারতীয় এসব শিল্পচর্চার বৃত্তান্তে কেন ইতিহাস হয়ে থাকবেন, কোথাও তাঁর অপূর্ব সৌহার্দ্য আর দুঃসাহস ছড়িয়ে আছে, অবিস্তৃত পরিসরে প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন সংযুক্ত লেখকরা। ভালো লক্ষণ । তার মানে, প্রকাশ কর্মকারকে আমরা ভুলিনি, ভোলা সম্ভব নয়, তবু একটি প্রশ্নময় আক্ষেপ, তার প্রায় ৬৪ বছরের চিত্র-সৃষ্টির পরিপূর্ণ সংগ্রহের সাকিন কোথায়, কার হেফাজতে, অদৃশ্য হয়ে আছে প্রথম দিককার বড়ো বড়ো চিত্রতল। এসব বেপরোয়া ভাঙ্গা-গড়ার অসংখ্য নিদর্শনের, খানিকটা উদ্ধার, প্রতিলিপিও হলেও খুবই দরকার । প্রজন্মের শিল্পীরা তাহলে বুঝতে পারবেন, নানারকম ভাঙনের পথ দিয়ে, ভাঙন আঁকতে আঁকতে, রবীন্দ্রনাথের সচেতন চিত্রচর্চার ঝুঁকি আত্মস্থ করে, পরে কবির অন্তহীন রহস্যময়তা উড়িয়ে দিয়ে, আমাদের পূর্বগামী বিস্ময়, রেখে গেছেন শক্তিমান কব্জির চিহ্ন। প্রকাশদার স্নেহ-ধন্য চিত্রকর সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় যুগোত্তীর্ণ চিত্রকরের বহু ছবি অনুকরণযোগ্য নিষ্ঠায় লালন করছেন ব্যক্তিগত সংগ্রহ শালায়। গৌতমের হাত সুদীপের হাতে এসে জড়ো হয়েছে । আমাদের প্রার্থনা, এই সৌভাগ্য আরো বিস্তৃত হোক।
 

ক্যানভাসে তেলরং, ১৯৬৯। কালীকৃষ্ণ গুহর সংগ্রহ থেকে

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, দেশ ভাগ আর বহু রকমের নেতি আর দুঃসময়কে অতিক্রম করে সর্বাত্মক ইতিবাচকের সঙ্গে বসবাস করেছেন প্রকাশ। তীর্যক বিদ্রূপ, ক্রোধ, ব্যঙ্গ, পাশাপাশি স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে দিচ্ছেন রূপকে, অবয়বে, খুশির রং ব্যবহারে । অঙ্গসর্বস্বতার চাইতে দৃষ্টিতে, যে বাহ্যিক উপদ্রব, যাকে কেউ কেউ একধরনের অনুশাসনহীনতা, চিন্তার নৈরাজ্য বলেছেন— তা কখনো নিরর্থক হয়ে উঠবার সুযোগ পায়নি তাঁর খুদে-বড়ো ক্যানভাসে, অঙ্কনমগ্ন শক্তিতে । প্রবল ঝর্না যেমন আছড়ে পড়ে পাহাড়ের ওপর থেকে নীচে, এবং সমতলে এসে কখনো খরস্রোতা, কখনো অন্তলীন হয়ে ওঠে, হতে থাকে, শিল্পীর প্রকাশের প্রতীক, প্রতিমা, আর রং ব্যবহারের কষাঘাতও প্রখর বেগে তেমনি ঘা দেয় আমাদের দৃষ্টি পার মর্মে । শিল্পশর্তে তাঁর আপসহীন আস্থা, তাঁর ব্যক্তিত্বের উত্তরণ আর উর্ধ্বারোহন বিশুদ্ধ মূল্যায়ণ দরকার । আমাদের বিশ্বাস, দেশের ভেতরে, বাইরে এরকম অভিপ্রায় স্তরে স্তরে ব্যক্ত করছেন শিল্পকলার প্রচারহীন কারিগর গৌতম ।
 

চিত্র প্রদর্শনীর দুই উদ্যোগতা

প্রকাশের সমসাময়িক হুসেন, তৈয়ব মেহতা, সুজা, আকবর পদুমসি, রাজাকে নিয়ে, আমরা গর্ববোধ করি । এ ব্যাপারে কলাপ্রাঙ্গনের নেপথ্য উদ্যোগ যথার্থ । দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর শিল্পচর্চায়, প্রকাশ কর্মকার নিজেই নিজের আমৃত্যু এবং মৃত্যুহীন প্রতিদ্বন্দ্বী–পিকাসো কিংবা হুসেনের মতোই আদীম উদ্দাম অশ্বারোহী, একথা ভুলে থাকা কি সম্ভব ? সঙ্গত ? সময় প্রকাশকে ফিরিয়ে আনবে, ফেরাবে তাঁর আপসহীন আর ক্যানভাসের সংলাপকে ।


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!