Advertisement
  • পা | র্স | পে | ক্টি | ভ রোব-e-বর্ণ
  • ফেব্রুয়ারি ২, ২০২৫

লেন্সে পান্নার নবাবি খান্দান

প্রতীক দে
লেন্সে পান্নার নবাবি খান্দান

২৭ বছর, ভারতে, ভারতের বাইরেও, বড়ো বড়ো হোটেলে চাকরি করেছি ফুড অ্যান্ড বেভারেজ ম্যানেজারের ভারি পোস্টে। কাজ কী? খাদ্য আর পানীয় জল –  ব্যবস্থাপনার তদারকি। 

চাকরি জীবনের গোড়ার দিকে টো টো করে ঘুরে বেড়ানোর অবকাশ মিলত না, দিনরাত ব্যস্ত থাকতে হত। জলেজঙ্গলে ঘুরে বেড়ানোর আশৈশব লালিত নেশা তখন প্রায় অবরুদ্ধ।  তবু সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়তাম। কাঁধে ক্যামেরা, গায়ে নানা বর্ণের বোহেমিয়ান পোশাক, হাতে ইয়া লম্বা সিগারেটের প্যাকেট। 

বছরে একবার ছুটি মিলত, লম্বা ছুটি, তখন আমাকে আর পায় কে, বাড়িতে দিন কয়েক কাটিয়েই দে ছুট অরণ্যে, অভয়ারণ্যে কিংবা সমুদ্র ছোঁয়া নেশার মোহনা দেখা, দেখতে থাকা। অন্তত ২৫ বছর এভাবেই কেটে গেল, চাকরি  থেকে বিদায় নিয়েও অবসর যাপনের আলস্য কাবু করতে পারে নি, দুপা এখন মুক্ত বিহঙ্গ, উড়ে বেড়ায়, ছুটে বেড়ায় এক দেশ থেকে আরেক দেশে।

গোটা বিশ্বই আমার স্বদেশ; আফ্রিকার ঘনঅরণ্যের অন্ধকারে যে আলো আলোর অধিক, সেখানেও বারবার ঝলসে উঠেছে ভ্রাম্যমাণ ক্যামেরার ফ্ল্যাশ; আমিও লাফিয়ে উঠছি ব্যাঘ্র দর্শনের আনন্দে 

ন্যাশনাল জিওগ্রাফি পাশে দাঁড়িয়েছে, দুনিয়া দেখার সুযোগ  দিয়েছে বারংবার, নিজেও খরচ জোগাড় করেছি। আর এভাবেই করিঙ্গা থেকে মাসাইমারার গহিন গাম্ভীর্য অন্তত তিনবার ঘোরা হয়ে গেছে। দেখেছি ক্যামেরার চোখে নিজের দৃষ্টিকে যুক্ত করে  — বাঘ যে কত বিচিত্র, কখনো উদাসীন, কখনো সতর্ক, তা দেখবার মওকা একদম হাতছাড়া করি নি, যতদিন পা চলবে, বাঘের সঙ্গে পরোক্ষ সহবাস বজায় রাখার চেষ্টা  করব। এটা আমার অঙ্গীকার, এটাই অন্যধরনের সানন্দ মত্ততা।     

 

এই পথ চলাতেই আনন্দ 

 

দু সপ্তাহ আগে, মধ্যপ্রদেশের পান্না টাইগার রিজার্ভ দেখে এলাম। নিয়ে বড়াই নেই, তৃপ্তি অপরিসীম; বলবার যা বলবে ক্যামেরা বন্দী আলোকচিত্র। প্রসঙ্গত স্বীকার করা দরকার , পান্না টাইগার রিজার্ভের প্রাক্তন ম্যানেজার শ্রীযুক্ত মূর্তির স্বপ্ন আজ সফল, তাঁর ইচ্ছে ছিল নয়নাভিরাম জঙ্গলের পরিপূর্ণ সংরক্ষণ আর ক্রমাগত বাঘের সংখ্যা বাড়ানো। একসময় পান্না রয়্যালশূন্য হয়ে পড়ে। শ্রীযুক্ত মূর্তির কপালে তখন ভাঁজ, তাঁর একমাত্র ধ্যানজ্ঞান হয়ে দাঁড়াল, পান্নার জঙ্গলে বাঘের পুর্নবাসনের  যোগ্য পরিসর  গড়ে তোলা — বহু প্রজাতির বনজ নবাবের বংশধরদের নিয়ে এলেন অরণ্যে, তাদের বংশবৃদ্ধি ঘটতে থাকল, পর পর। যে পান্নায় একসময় একটাও বাঘ নজরে আসত না , আজ সেখানে ৭০ থেকে ৮০ টি নবাবজাদা খোশ মেজাজে ঘুরে বেড়ায়, প্রেম করে আড়ালে, একান্ত সঙ্গোপনে আর সে প্রেমের ফুটন্ত আবেগের চেহারা দেখে আমাদের আপ্লুত লেন্স প্রগাঢ় বিস্ময়ে জয়ধ্বনি দেয়জয় বৃক্ষনাথ, জয় পান্নার ব্যাঘ্রকুল। 

পান্নার স্মৃতিযাপন কি একা করব? না তাঁর সঙ্গে জুড়ে দেব সবার কাঙ্ক্ষিত আগ্রহকে? একাকিত্বে আস্থা নেই, যা আমার, তা সকলের হয়ে উঠুক, এটাই বিনীত প্রার্থনা, এই পথ চলাতেই সমূহ আনন্দ।    

 

ওয়াচ টাওয়ারের নীচে ডোরাকাটা গম্ভীর 

 

ভোর সাড়ে পাঁচটা, কোনো মতে দুটো সোয়েটার একটা জ্যাকেট এবং বাঁদর টুপিটুপির আদলের মাফলার জড়িয়ে সাফারি জিপের পেছনে গিয়ে বসলাম, তাপমাত্রা তখন প্রায় ছয় ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। 

এমপিটি লজ থেকে মধ্যপ্রদেশের পান্না জাতীয় উদ্যানের প্রধান গেটের দূরত্ব কুল্লে দু মিনিট।  প্রায় আট দশটা গাড়ির পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম আমরা।  গাইড আমাদের কাগজপত্র চেকিং করিয়ে নিলেন ঠিক সাড়ে টায় , গেট খুলতেই গাড়ি এগিয়ে চলল।  জিপিএস লোকেশনট্র্যাকার হাতে ধরিয়ে দিলেন ড্রাইভার, মানে কোনো  সাইটিং থেকে দুঃসংবাদের খবর এলেও গাড়ি জোরে ছোটানো অসম্ভব। 

তাযাই হোক চিতল হরিণ, সাম্বার হরিণ দেখতে দেখতে ছুটছি গতকালের চেনা রাস্তা দিয়েই। 

পিপারিটোলা পার হলেই ডান দিকে, নতুন মিষ্টি জলের কৃত্রিম পুকুর। বিপজ্জনক রাস্তা বেয়ে উপরে উঠছি,   রাস্তার মধ্যিখানে পৌঁছাতেই গাইড আর ড্রাইভার নদীর নীচের দিকটা দেখতে আরম্ভ করলেন, চোখ দিয়ে কী যেন  খুঁজছেন। 

নদীর আশেপাশে, নীচে কোনো কিছুই দেখা যাচ্ছে না, শুধু কয়েকটি কুমির শুয়ে আছে।  কুয়াশাচ্ছন্ন স্যাঁতস্যাঁতে ঠান্ডা, সবই আবছা দেখাচ্ছে।  আমার কাঁধে  দুকেজি ওজনের ক্যামেরা, বের করার সাহস হলো না। পাঁচ থেকে সাত মিনিট দাঁড়িয়ে আবার সোজা পথ চলা শুরু।   

কিছুদূর এগলেই অনেকটা গ্রাসল্যান্ড, এখানে গতকাল ১৪ টি কুমির দেখতে পাই, তারই পাশ ঘেঁষে, বাঁ দিক দিয়ে  বেরিয়ে ব্রেকফাস্ট আর টয়লেট জোনোর সামনে এসে দাঁড়ালাম। দীর্ঘ লাইন পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্ত্রের  ময়লা ঝেড়ে সবে সাফারি জিপের সামনে এসে দাঁড়িয়েছি, ঘড়ঘড় আওয়াজে মনে হল, যেন মোটর রেস হচ্ছে, ঠিক এভাবেই দৌড়াচ্ছেন ‘তিনি’।  

বুঝতে দেরি হল না, কী ঘটতে যাচ্ছে! শুধু আমরা নইসবকটা সাফারি ভেকেল পড়িমড়ি করে ছুটতে আরম্ভ করল। কোনোমতে চলন্ত জিপের ওপরের রড টা জড়িয়ে আমরাও ছুটছি, যেকোনো মুহূর্তে অঘটন ঘটতে পারে, হাত ছিটকে পড়লেই সটান নীচে। যথাসম্ভব মেরুদণ্ড শক্ত করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, জিপের উপর ভরসা রেখে  গতির সঙ্গে তাল রেখে ছুটতে হচ্ছে। এরকম অবস্থায় মনের তোলপাড়, দুর্বোধ্য নয়। প্রায় ১৫ মিনিট পর যখন গন্তব্যে পৌঁছালাম, নজরে পড়ল — ২০ থেকে ২৫ টি সাফারি জিপ দাঁড়িয়ে আছে। ডানদিকে একজন গম্ভীর, সুন্দর, স্বাস্থ্যবান চেহারা, হেঁটে যাচ্ছেন বেপরোয়া।  

যাত্রীদের চাপা চিৎকার, শাটারের আওয়াজ তখন তুঙ্গে। গাইড ড্রাইভারকে  গাড়ি ঠিক অ্যাঙ্গেলে দাঁড় করানোর নির্দেশ দিলেন। বিচিত্র অভিজ্ঞতা, আচমকা যানচালক  জিপটিকে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে নেমে পড়লেন, দেখাদেখি আমরাও লাফিয়ে লাফিয়ে নীচে নেমে এলাম।

শরীরের সব কলকব্জা নড়ে গেছে, সর্বত্র ব্যথা, নিজেই নিজের গা টিপছি, চোখ থেমে নেই, এদিকেওদিকে ছুটছে। আর ওই সুদর্শন ভদ্রলোক প্রায় আধ ঘন্টা জুড়ে চারপাশ নিরীক্ষণ শেষে, একটি ওয়াচ টাওয়ারের সামনে এসে দাঁড়ালেন।   

সবার চোখ তখন সামনের দিকে ঝুঁকে আছে।  জিপচালক কলধ্বনি দিয়ে আমাকে বললেন, ‘দাদা পিছে দেখিয়ে আমি প্রথমে ওঁর কথায় কান দিইনি, তারপর দেখতে পেলাম, আমাদের আগেআগে আসা জিপের যাত্রীরা পিছনের দিকে তাকিয়ে, হা হু  করে আনন্দ জিগিরে মশগুল।  

সবার দৃষ্টি তখন পিছনে ছুটছে যে মহোদয় কিছুটা দূরে বসে আছেন, তাঁর যমজ ভাই তাঁর দিকেই এগিয়ে আসছে। তখন কারোর, আমারও আর কিছু বলবার জো নেই, সবাই  বিস্ময়ে অসাড়। ডানদিকে না বাঁদিকে তাকাব, কিছুই ভেবে পাচ্ছি না। হাতটাও নিঃসাড়। 

জীবনে এই প্রথম কোনও সাফারিতে এসে দুই ভাইকে একসঙ্গে দেখার সুযোগ হল। পরে জানতে পারি, প্রথম যে ভদ্রলোককে দেখেছি কদিন আগে তার রোমহর্ষক বাহাদুরিতে একটি বাজে ঘটনা ঘটে  গেছে। কেন ঘটল, কেউই ঠিকঠাক বলতে পারলেন না।  দুই ভাইকে নিয়ে আমাদের প্রায় এক ঘন্টা কেটে গেল। 

এটা অবশ্য, অতি অবশ্যই, আমার ক্যামেরা যাপনের অন্যতম সেরা  টাইগার সাইটিং। এশিয়া আর আফ্রিকার, ভারতের মধ্য, পুর্ব ও পশ্চিমের কত অরণ্যে, অভয়ারণ্যে ক্যামেরা হাতে, লেন্সের ভেতর দিয়ে, বাইরে থেকে ভেতরে আরো ভেতরে সারি সারি বাঘ দেখবার সুযোগ হয়েছে কিন্তু, পান্নার ব্যাঘ্র মহিমা, এই তালিকায় আলবাত শীর্ষে।   

♦·♦♦·♦♦·♦–♦·♦♦·♦♦·♦

লেখক, বিশিষ্ট আলোকচিত্রী। বাইরে বোহেমিয়ান, ভেতরে অতন্দ্র প্রহরী।


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!