- গ | ল্প রোব-e-বর্ণ
- ডিসেম্বর ৩১, ২০২৩
জয় ভীম
দিবাকরবাবু আজকাল সৌজন্য বিনিময়ের শুরুতেই ‘জয় ভীম’ বলেন। এমনকি মোবাইলে কল রিসিভ করে সঙ্গে সঙ্গে বলেন, ‘জয় ভীম’। উল্টো দিক থেকে অনেক সময় প্রশ্ন আসে,’দাদা, জয় ভীম’ মানে ? তখন সুযোগ আসে দিবাকরের, বুঝিয়ে বলেন জয় ভীম বলার কারণ । ভীম আসলে আম্বেদকরের ডাক নাম। পুরো নাম ভীমরাও রামজী আম্বেদকর। আম্বেদকর অনুগামীরা তাই বলে থাকেন — ” জয় ভীম, জয় ভারত”। অর্থাৎ, ভীমের জয় হোক, ভারতবর্ষের জয় হোক।
দিবাকরবাবু স্কুলজীবন থেকেই বড়ো হয়েছেন একটু ভিন্ন ভাবে। কুসংস্কারমুক্ত হবার প্রথম পাঠ বাবার কাছেই। তিনি ছিলেন জনপ্রিয় শিক্ষক। দিবাকরবাবুর স্কুলজীবন কেটেছে মাশালদিঘি গ্রামে। গ্রামের অধিকাংশই দরিদ্র, নমঃশূদ্র সম্প্রদায় ভুক্ত এবং কৃষিজীবী। পরিবারগুলো উদ্বাস্তু জীবনযন্ত্রণার ভারে ভারাক্রান্ত ছিলো। এদের মধ্যে দিবাকরবাবুর পরিবারই ছিলো স্বচ্ছল ও শিক্ষিত। আধুনিক চিন্তাচেতনায় অনেকটা এগিয়ে।
দিবাকরবাবু যখন ক্লাস এইটে, তখন থেকে আম্বেদকরের নানান বই পড়তে থাকেন। বই পেতেন গ্রামের এক ডাক্তারবাবুর কাছে। সেই থেকেই তার আম্বেদকর প্রীতি। দেশে জাতপাতের মতো অমানবিক প্রথা তাকে কষ্ট দিতে থাকে। বর্ণ বৈষম্যের উদ্গাতাদের বিরুদ্ধে তার চরম ঘৃণা জন্মায়।
পড়াশুনা শেষে তিনি কলেজে শিক্ষকতার কাজ শুরু করেন, পাশাপাশি লেখালেখিও করেন দৈনিক পত্রিকায়। সেইসঙ্গে সকাল-বিকাল মিলিয়ে কলেজের প্রায় চল্লিশ জন ছাত্র পড়াতেন। লেখালেখি ও সাংস্কৃতিক কাজও করতেন মন দিয়ে। আর মনে মনে স্বপ্ন দেখেন বাবাসাহেব আম্বেদকরের সমাজতান্ত্রিক ভারত গড়ার। বিশেষ করে বর্ণ বৈষম্যহীন ও জাতপাতহীন সমাজ গড়ার।
সময় যতো এগোতে থাকে, দিবাকরবাবু তত বুঝতে পারেন ভারতবর্ষের ইতিহাস। আর্য-অনার্যদের লড়াই। বহিরাগত আর মূল ভারতীয়দের সংগ্রাম। এই সংগ্রামের মধ্যে দিবাকরবাবু কখন নিজেকে আষ্ঠপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলেছেন তা নিজেই জানেন না। এর থেকে তিনি মুক্তিও চান না। তিনি হাজার হাজার অস্পৃশ্য, নির্যাতিত, দলিত জাতির মুক্তি চান। এই কঠোর সংগ্রামে তিনি একাকীত্ব বোধ করলেও মানসিক শান্তিতে আছেন। নিজের মধ্যেই সেই আনন্দ খুঁজে পান। নিপীড়িত জনগণের জন্য কাজের আনন্দ লেগে থেকে চোখেমুখে।
আম্বেদকরের আদর্শে অনুপ্রাণিত দিবাকরবাবু একদিন দেখা করতে যান তার পুরনো বন্ধুর বাড়ি। বন্ধুটি পেশায় ডাক্তার। চিকিৎসায় একটু নামডাক হয়েছে। নাম আশিস বিশ্বাস। বাড়ি গাজোলের শিক্ষকপল্লিতে।
— আশিস, বাড়ি আছিস?
— হ্যা, কে? ও দিবাকর ! আয়, ভেতরে আয়।
— জয় ভীম!
— আশিস বলে,’ হুঁ ‘।
আশিস জানে, দিবাকর আজকাল সব জায়গা জয় ‘ভীম বলা’ শুরু করেছে। এটা যখন সে বলে তখন বেশ গৌরবের সঙ্গে বলে, এটাও আশিস লক্ষ করেছে। কিন্তু আশিস ‘জয় ভীম’ বলতে পারে না কাউকে। তিনি যদি পাল্টা দিবাকরকে ‘জয় ভীম’ বলতো তাহলে মারাত্মক খুশি হতেন তিনি। যাক, এসব নিয়ে বিশেষ চিন্তা করে না দিবাকরবাবু।
সে জানে এই সমাজের লোকেরা এমনই। প্রায় চার হাজার বছর ধরে প্রজন্মের পর প্রজন্ম গোলামি করে আসার ফল এসব। শিক্ষার আলো এদের ঘরে পৌঁছালেও চেতনার আলোক স্পর্শ করেনি এদের এখনো। অন্ধকারেই নিমজ্জিত এরা। দাসত্ব মুক্তির জন্য লড়াই করা যেনো এদের কাছে মহা পাপ
— বসার চেয়ার এগিয়ে দিয়ে আশিস বলে, কী মনে করে দিবাকর?
— একটি অনুষ্ঠান আছে। তাই তোর কাছে —
— আম্বেদকর নিয়ে তোরা তো আজকাল ক্ষেপি উঠেছিস।
আশিসের এ-কথায় মোটেই অপ্রস্তুত হয় না দিবাকর। সে জানে এই সমাজের লোকেরা এমনই। প্রায় চার হাজার বছর ধরে প্রজন্মের পর প্রজন্ম গোলামি করে আসার ফল এসব। শিক্ষার আলো এদের ঘরে পৌঁছালেও চেতনার আলোক স্পর্শ করেনি এদের এখনো। তাল তাল অন্ধকারেই নিমজ্জিত এরা। দাসত্ব মুক্তির জন্য লড়াই করা যেনো এদের কাছে মহা পাপ।
— দিবাকর ঠাণ্ডা মাথায় উত্তর দেয়, ‘ক্ষেপি উঠিনি আশিস।’ এটা প্রয়োজন। বাঁচার জন্য প্রয়োজন। গোলামি আর কতদিন করবো আমরা? এবার রাজা হতে হবে। গুরুচাঁদ ঠাকুর বলেছেন না, “যে জাতির রাজা নেই। সে জাতি তাজা নেই।।” কী মারত্মক কথা রে আশিস ! তুই কি কোনোদিন এসব কথার তাৎপর্য খুঁজবি না ?
— আসলে কি জানিস, মাঝে মাঝে তোদের নানা অনুষ্ঠানগুলোতে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সময়ের অভাবে যেতে পারি না।
— এই অজুহাতই সর্বনাশ করলো রে আমাদের !
— কেনো ?
— সময় কারও হয় না। সময় করে নিতে হয়। আমি আজ আঠাশ বছর ধরে সময় করে নিয়েই আন্দোলন করছি। নির্যাতিত মানুষদের বিলাসিতা করা মানায় না আশিস। আমাদের সামনে কেবল লড়াই আর লড়াই।
— আবার কবে আছে তোদের অনুষ্ঠান?
— কী যা তা ‘তোদের অনুষ্ঠান, তোদের অনুষ্ঠান’ বলছিস ? অনুষ্ঠানগুলো তোরও। তুই কি ভুলে গেলি তোর বাবাকে বাজারের মধ্যে ‘সিডিউল কাস্ট’ বলে গালি দিয়েছিলো একদল। মনে পড়ে রে ? তোর স্কুল-শিক্ষক ভাইকে তোদের বাড়ির পুরোহিত বলেছিলো, ‘কোটার মাল’। এত কিছুর পরও তোরা বসে থাকিস কী করে ?
— আমি আসলে একাত্ম হতে পারিনি তো তাই।
— ওটা মনে করেই ঘরে বসে থাক। যে যাই বলুক, তোদের ভাই গণ্ডারের চামড়া।
— আশিস নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, দেখ ভাই, তাই বলে আমাদের ধর্মকে তো নষ্ট করতে পারি না।
— ধর্ম ?
— তোরা তো হিন্দু ধর্মের বিরুদ্ধে বলিস।
— তোর ধারণা বড্ড ভুল। আমাদের লড়াই যে কোনো ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে। আদিম যুগের অন্ধকার থেকে মানুষ আজ আলোয় আসতে পেরেছে ধর্মকে অস্বীকার করেই। আর তুই যাকে নিজের ধর্ম বলে মনে করছিস, সেই ধর্মের গোড়ারা তোকে ব্রাত্য অস্পৃশ্য ঘোষণা করেছে। এটা শুনিস নি, পেরিয়ার রামস্বামী নাইকার বলেছেন,”যে ধর্ম তোমাকে নীচ, হীন করেছে; লাথি মারো সেই ধর্মকে।”
আশিস চুপ করে যায় দিবাকরবাবুর কথায়। সে জানে তার বন্ধু দিবাকরকে বেশি ঘেঁটে লাভ নেই। কারণ এ অঞ্চলের সবার মতো আশিস ডাক্তারও জানে দিবাকরবাবু প্রচুর পড়াশুনা করেন। যুক্তিবাদী এই লোকটিকে হারাবার যো নেই।
এবারের ১৪ এপ্রিল বাবাসাহেব আম্বেদকরের জন্মজয়ন্তী উদযাপন অনুষ্ঠানে কদুবাড়ি জয়শ্রী লজের সামনে এসে হাজির। ওখানে মঞ্চ বেঁধে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। আশিসকে দেখেই দিবাকরবাবু বলেন, ‘জয় ভীম’।
— আশিস বললো, আজ হাসপাতালের ডিউটি সেরে তড়িঘড়ি করে আসলাম অনুষ্ঠান দেখতে।
— ভালো করেছিস।
— এত মানুষ?
— আমাদের সব মানুষ যদি ‘জয় ভীম’ বলে পথে নামতো, তাহলে তোর বাবা বা ভাইদের মতো আর কেউ আমাদের গালাগাল করতে সাহস পেতো না। আমাদের লোকগুলো আম্বেদকরের রেখে যাওয়া সংরক্ষণের সুবিধাভোগ ক’রে আর দিনরাত ব্রাহ্মণ্যবাদের গোলামি করে।
আম্বেদকর জয়ন্তীর অনুষ্ঠান শুরু হলে আশিস ডাক্তার চুপ করে সব শুনতে থাকে। বক্তাদের জ্ঞানগর্ভ আলোচনা শুনতে শুনতে সে শিহরিত হয়। নিজেকে অনেক বোকা আর অধম লাগে তার। আম্বেদকর সম্পর্কে এইসব কথা তাকে আগে কেনো বলেনি কেউ। সে অনুষ্ঠানে বসে হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতে পারে, কেন তার বন্ধু দিবাকরবাবু ড. বি. আর আম্বেদকরের এত ভক্ত এবং মানুষ দেখলেই ‘জয় ভীম’ বলে।
অনুষ্ঠানের একেবারে শেষে সঙ্গীত পরিবেশন করবে সঙ্গীত শিল্পী পরেশ হালদার। গত বছর দলিত সাহিত্য সম্মেলনের আসর বসেছিলো মালদা শহরে টুরিস্ট লজে। সবাই দারুণ প্রশংসা করেছিলো পরেশ হালদারকে। পরেশ যেই কণ্ঠ ছেড়ে শুরু করেছে মঞ্চ থেকে —”বাবাসাহেব ডাক দিয়েছেন, আয় রে ছুটে আয়/ শোষিত-বঞ্চিত-নিপীড়িত ভাই তোরা বদলা নিবি কবে?” গোটা অনুষ্ঠান স্থল টগবগ করতে থাকে। আশিস উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়ে। সমাপ্তি সঙ্গীত শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে আশিস ডাক্তার গলা ফাটিয়ে শুরু করে— ” জয় ভীম “।
— সকলে সমস্বরে আশিস ডাক্তারের সঙ্গে গলা মিলিয়ে কদুবাড়ি কাঁপিয়ে বলতে থাকে —” জয় ভীম”।
♦—♦♦—♦♦—♦
❤ Support Us