Advertisement
  • ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
  • মার্চ ১৭, ২০২৪

ধারাবাহিক: পাহাড়িয়া পথে পথে। পর্ব ১৪

সার সার ট্রেকার হেঁটে যাচ্ছে সেই পথে। মাঝে মাঝে থিয়েটারের পর্দার মতো ভারী মেঘ এসে আমাদের চেতনাকে নিয়ে যায় দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে...তারপর

ফাল্গুনী দে
ধারাবাহিক: পাহাড়িয়া পথে পথে। পর্ব ১৪

অলংকরণ: দেব সরকার


ভুবন পাহাড় আর গিরিশৃঙ্গের প্রতি তাঁর দুর্ভেদ্য আকর্ষণ উৎসবমুখর করে তোলে ভূগোলের বিদ্যাযাপন । পেশা আর নেশা যখন একাকার হয়ে ওঠে, তখনই তাঁর অনুভূতিকে অন্যভাবে জাগিয়ে তোলে— ‘শেষের কবিতার’ শোভনলালের পাহাড়ের পথে পথে ঘুরে বেড়ানোর বেহিসেবিয়ানা । গন্তব্য জগতের এক শৃঙ্গ থেকে আরেক শৃঙ্গ 

♦ পর্ব ১৪ ♦

অবশেষে পথিকের অনন্ত পথ হেঁটে এসে দাঁড়ালাম প্রেক-চু নদীর পাড়ে। গায়ে তার এখনও হিমবাহের গন্ধ লেগে আছে। অভিসারকামী অস্থির পায়ে নেমে যাই অতল জলস্পর্শের কাছে। আরও ঘনিষ্ঠতার দাবি নিয়ে ইশারায় কাছে ডাকে প্রিয় গন্ধবতী নদী। সে দাবি খুব একটা অমূলক নয় কারণ বরফের তলপেট কেটে বেরিয়ে এসেছে নদী ভরা প্রমত্ত ঢেউ। পাহাড়ি আয়োজন তছনছ করে, সমস্ত প্রতিরোধ অস্বীকার করে সুর তাল ছন্দ লয়ে একটি উচ্চাঙ্গ সংগীত যেন নেমে এসেছে রঙ্গিলা বাঁশির ডাকে। নানান মাপের গোলাকার সাদা সাদা বোল্ডার পাথর নুড়ি সাজিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছে এক নৈসর্গিক সাম্রাজ্য। নদীর গতিপথ ধরে ঢেউয়ের সাথে তাল মিলিয়ে হামেশাই মেঘ উঠানামা করে ফরমাইশি পেয়াদার মতো। এমন অব্যর্থ আয়োজন দেখবার জন্য নদীর পাড়ে জঙ্গল গভীর থেকে গভীরতর হয়ে আসে। নদী পেরিয়ে এখন আমাদের পথ জঙ্গলের ছায়ায় ছায়ায়। পারাপারের জন্য একটি কাঠের সেতু বানানো হয়েছে নদীর বুকে; দেখলেই মনে হয় দোবরু পান্নার রাজ সিংহাসন যেন — অশেষ আয়োজনের থেকে অসীম আন্তরিকতা যার বেশি। হটাৎ হটাৎ কুয়াশার ছদ্মবেশে মেঘ এসে ঢেকে দেয় চরাচর, রাখালদাস-এর মতো কোন পথিক সিন্ধু সভ্যতা ভেবে আবিষ্কার করবে এই অপেক্ষায়।
 
পাইন জঙ্গল ফিরে এলো আবার। ফিরে এলো পাথরের উপর অন্তর্মুখী শ্যাওলার আলপনা। বর্ষায় জলস্তর বেড়ে গেলে যতদূর পর্যন্ত ঢেউয়ের স্পর্শ পৌঁছায় তার সাক্ষী ছড়িয়ে রয়েছে জঙ্গলে পাথরে। হিমবাহের ক্ষয়কার্যের ফলে তৈরি ভূমিরূপের যে ছবি মনের আয়নায় এতদিন আঁকা ছিল, আজ চোখের সামনে তারা এমন স্পষ্ট দাবি নিয়ে সশরীরে উপস্থিত হলে আমার ভূগোল পড়া উচ্ছন্নে যায়নি বলেই মনে হয়। সবকিছুই এখানে শান্ত অথচ কি এক অদ্ভুত অস্থিরতা !
 
নিচে কী এত ভূগোলের কচকচানি, কাব্যি-কথকতা হচ্ছে এমন কৌতুহল দমন করতে না পেরে মেঘের পর্দা সরিয়ে পাইন জঙ্গলের মাথায় হঠাৎ উঁকি দিল বরফের পান্ডিম পাহাড়। ক্যামেরা তাক করে লেন্স জুম করতেই পাহাড় যেন ম্যাজিকের মতো আছড়ে পড়ল চোখের পর্দায়। চোখ কচলিয়ে পাহাড় থেকে চোখ নামিয়ে রাস্তায় পা ফেলতেই কাদামাটিতে সেঁধিয়ে গেলাম প্রায় ফুট কতক। জঙ্গলের আগাছা, পাইনের শিকড় এবং কাদামাটির উপর ইয়াক মিউল হেঁটে গিয়ে এমন গুরুপাক বানিয়েছে যেন ত্রাণের বারোয়ারী খিঁচুড়ি। এহেন প্রাকৃতিক আয়োজনের উপর কাদামাখা পায়ে হাঁটতে হাঁটতে নদীর পশ্চিম পাড় ধরে আমরা কোনওক্রমে এগিয়ে চলেছি। দূর থেকে মনে হয় নদীর বুকে কেউ যেন বোল্ডার দিয়ে মোজাইক করেছে। তারই মধ্যে সমস্ত পাথুরে আস্ফালন অস্বীকার করে রণক্লান্ত এক বিদ্রোহীর মত বিবর্ণ একা একটি পাইন গাছ দাঁড়িয়ে আছে স্বমহিমায়। এমন পাথুরে রাস্তায় ট্রেকাররা সহজেই বোল্ডারকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যেতে পারে কিন্তু পিঠে বোঝাই করা মালপত্রের পাহাড় নিয়ে মিউল ইয়াকগুলো এগোতে পারে না। তাছাড়াও খুরের নিচে লাগানো লোহার নাল পাথরের ধাক্কায় খুলে গেলে ওদের কষ্ট আরও বেড়ে যায়। মালবাহক ছেলেগুলো নিজেদের পিঠের পাহাড়কে পাথরের উপর কিছু সময় নামিয়ে রেখে মিউলগুলোর একটু সুবিধা করে দিতে কাজে লেগে পড়ে সাত তাড়াতাড়ি। এই অবসরে অদূরে একটি উঁচু পাথরের উপর লাফিয়ে উঠে সবাই নিজেকে শাহরুখ খান ভাবতে শুরু করে দিলে। আমি সাজিয়ে নিলাম পাথরের উপর পাথর চাপিয়ে ক্রেয়নের দিক নির্দেশ— অতীতের পথ ধরে ভবিষ্যৎ হেঁটে আসবে এই ভাবনায়।
 
এতদিনের পরিচিত নুড়ি-পাথর-বন্ধুদের পিছনে ফেলে নদীর এগিয়ে যাওয়ার কষ্ট আমি বুঝি। জীবনে কিছুমাত্র কষ্টের মূল্য না চুকিয়ে মানুষও সামনে হতে পারে না। তবুও সামনে এগোতে হয়। এগিয়ে যাওয়াই জীবনের নিয়ম। অবশেষে দূর থেকে দেখা সেই রাজ সিংহাসনের মতো কাঠের ব্রিজের উপর এসে যখন দাঁড়ালাম নিজেকে রাজা দোবরু পান্না বলেই মনে হলো। এই সেতুটি ভারতীয় বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের জওয়ানরা বহু পরিশ্রম করে বানিয়েছে। অবশ্য বর্ষায় জলোচ্ছ্বাসে এর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না, তখন নদী পারাপার খুবই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। প্রতি বছর এই ব্রিজ নির্মাণ করা নিয়মের মধ্যেই পড়ে।আমরা সেই মচমচে ব্রিজের উপর হাতের লাঠি দিয়ে ঠকঠক আওয়াজ করতে করতে উঠে এলাম নদীর পূর্ব পাড়ে। ব্রিজের উপর ক্ষণিক দাঁড়িয়ে কাঁচের মতো স্পষ্ট পবিত্র সেই জলের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম, যমুনা থেকে জলঙ্গি পর্যন্ত সমতলের প্রতিটি নদীর এমন দুরবস্থার পেছনে কার স্বার্থ দায়ী ? শয়তানের ক্ষমতার লোভ নাকি আমাদের উদাসীন অজ্ঞতা?
 
পূর্ব পাড়ে পাহাড়ের চড়াই উঠে এসেছে প্রায় বুকের কাছাকাছি, তাই যথেষ্ট পরিমাণ শ্বাসের বায়ু সে দাবি করে এখন। কিন্তু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কাছে সব কষ্ট ম্লান হয়ে আসে। এমন নৈসর্গিক পথের দু’পাশে এবং চলমান রাস্তার উপর বড়ো বড়ো পাথর ফুটে আছে মাশরুমের মতো। প্রকৃতি এখানে আশ্চর্য শিল্পীর মতো খুলে রেখেছে তার শিল্পচর্চার পাঠশালা। পাথরের গায়ে অদ্ভুত-দৃশ্য বডি-পেইন্টিং বানিয়ে চারুকলা সাজিয়ে রেখেছে ক্লান্ত পথিকের পথ চেয়ে। সমতলের চাওয়া পাওয়া নিয়ে মানুষের ক্ষুদ্র অভাব অভিযোগ, এই পাহাড়ের বিশাল নন্দনতত্ত্বের সামনে লজ্জায় কোথায় হারিয়ে যায় খুঁজে দেখতে ইচ্ছে করে !
 
পথের বাঁক ঘুরতেই এক আশ্চর্য নালার সামনে এসে পড়লাম। দেখে মনে হল ডাইনোসরের ডিমের খোঁজ পাওয়া গুজরাতের সেই গ্রামটিতে এসে পড়েছি। মাটি খুঁড়লেই যত্রতত্র সেখানে খুঁজে পাওয়া যায় অত্যাশ্চর্য ডিম। এখানে নালার ভেতর বানের তোড়ে ভেসে যাওয়া মাটি ক্ষয়ে গিয়ে ডিমের মতো গোল গোল পাথর বেরিয়ে এসেছে নদী মঞ্চের গায়ে গায়ে। পথের বালাই নেই, শুধুই পাথর। সঙ্গে যোগ হয়েছে কুজ্ঝটিকার মতো ঘন কুয়াশা। নদীর বালি এখানে আশ্চর্য রকম ভাবে সাদা এবং জলের ধারা খুবই ক্ষীণ। ঝুরো ঝুরো বালি পাথর মাটি টপকে সাবধানে হেঁটে নদী পেরোতে হয়।
 

নদী অববাহিকা এমনই একটি আশ্চর্য মহীরুহ, যেন একটি পরিবারের অজস্র ডালপালা বেয়ে উঠতে উঠতে পরিচিত উত্তরসূরিদের পর এবার পূর্বসূরীদের চিনে নেওয়ার পালা। নদীর জল যেমন ঠান্ডা তেমন তার দাঁত নখের ধার। তবু হাঁটু পর্যন্ত পা ডুবিয়ে বসে থেকে ঠাণ্ডাকে পাল্লা দিতে আমাকে কে আটকায়

 
বেলা তিনটে নাগাদ বিস্তীর্ণ এক ডাঙ্গা ডহরের মতো সমতল জায়গায় পৌঁছে আমাদের আশ্চর্যের আর সীমা রইল না। এমন দৃশ্য চাক্ষুস করে প্রায় সকলেরই পাগল পাগল অবস্থা। কোন অ্যাঙ্গেলে এমন দৃশ্য ক্যামেরায় বন্দি করতে পারলে জীবন সার্থক কারোর জানা নেই। কালো কালো বোল্ডারের উপর বাদামি শ্যাওলার আলপনা এবং তাকে ঘিরে মরচে পড়া লাল রংয়ের পাতা-গুল্মের বাহার স্বর্গের নন্দনকানন কেও পাল্লা দিতে পারে, এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস। যতদূর চোখ যায় চীন দেশের কুনমিং শহরের রক গার্ডেনের মতো শুধুই পাথর আর কাঁটা-গুল্মের জঙ্গল নজরে আসে। কুয়াশার দাপটে চারপাশ অস্পষ্ট হলেও বোঝা যাচ্ছে সামনে পেছনে একশো মিটারের মধ্যে কোন পাহাড় নেই। গর্জন থামিয়ে নদীও সরে গেছে দূরে। মায়া বিভ্রমের মতো পথ ভোলানো এমন স্বর্গের পথে হাঁটতে হাঁটতে মিনিট পনেরোর মধ্যেই কুয়াশার সদর দরজা খুলে গেলো। গোটা তিনেক বড় বড় কিচেন ছাউনি চোখে পড়তেই সঙ্গী সাথীরা উদ্বাহু হয়ে চিৎকার করতে করতে দৌড় লাগালে স্বপ্ন পূরণের পথে।
 
থানসিং ক্যাম্পে (১২৯৪৬ ফুট) যখন পৌঁছালাম তখন বেলা সাড়ে তিনটে। অর্থাৎ আট কিলোমিটার হাঁটতে সময় লাগলো প্রায় ছয় ঘন্টা। ক্যাম্প সাইটটি বেশ ছিমছাম। মেলা ময়দানের মত বিস্তৃত মাঠে রঙ বেরঙের প্রজাপতির মতো টেন্ট খাঁচানো হয়েছে ট্রেকারদের অপেক্ষায়। ওপাশে টিনের ছাউনি দেওয়া বড় বড় পাথরের ঘর। মচমচে কাঠের উপর হেঁটে যাওয়া বারান্দার দুপাশারী ছোট ছোট রুম। প্রচন্ড ঠান্ডা থেকে রক্ষা পেতে ঘরগুলি টিনের আস্তরণ দিয়ে মুড়ে ফেলা হয়েছে। কিচেন ঘরটির ভেতর জ্বলন্ত আগুনের পাশে গাইড ট্রেকার মালবাহক নির্বিশেষে সবাই ঘিরে দাঁড়িয়েছে একটু উষ্ণতার খোঁজে। আমাদের দলের সদস্যদের এখনও পর্যন্ত কোনও খবর নেই। রুকস্যাক থেকে খান কতক গরম কাপড় গায়ে চাপিয়ে লেয়ারিং বাড়িয়ে নিলাম। ঠান্ডা খুব দ্রুত তলিয়ে যাচ্ছে হিমাঙ্কের নিচে। যেটুকু প্যাক লাঞ্চ এবং শুকনো খাবার সঙ্গে ছিল তাই দিয়ে পেটকে একটু সান্তনা দিলাম। সৌরভ, নিরুপমা, আকাশ অক্ষয়, ডাক্তার দম্পতি, অর্পণ, অতীন’দা, ব্রতীন’দা, সপ্তর্ষি  সবাই একে একে এসে পৌঁছালো ক্যাম্পে। আজ রাতে আমার তাঁবু সঙ্গী হলেন রথীন’দা। ট্রেক শেষের এইসব ক্লান্ত রাতের ডিনারে খিঁচুড়ি আলুভাজা আর ডিমের অমলেট খেলে গায়ে বল বাড়ে কিনা আমি জানিনা কিন্তু পেটের তৃপ্তিতে মনোবল বাড়ে সুনামির ঢেউয়ের মতো। সারারাত জেগে জেগে যে অসংখ্য রবীন্দ্রনাথ আর লালন ফকিরের গান গেয়েছি আপন খেয়ালে তার হিসাব একমাত্র নির্জন রাতই বলতে পারবে।
 

 
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে মনে হলো আমার কলকাতার ফ্ল্যাটের জানালায় পান্ডিম পর্বতকে কেউ যেন পর্দার মতো টাঙ্গিয়ে দিয়ে গেছে। পান্ডিম যেন এখন আমাদের পরিবারেরই একজন সদস্য। পাহাড়ের মাথায় বরফের গায়ে ধোঁয়া ওড়ে ভাত ফোটা বাষ্পের মতো। অপেক্ষায় বসে না থেকে পায়ে ভারী বুট জুতো গলিয়ে বেরিয়ে এলাম টেন্টের বাইরে। দেখি সপ্তর্ষি ক্যামেরা নিয়ে কারসাজি শুরু করে দিয়েছে। নদী এখান থেকে খুব দূরে নয়। ক্যাম্প থেকে সামান্য দূরে বেশ কয়েকটি যন্ত্র এবং মেশিনপত্র দেখে কৌতুহল পায়ে হেঁটে বুঝতে ভুল হলো না এটি একটি আবহাওয়া পরিমাপের স্টেশন। পেশাগত জীবনে এইসব যন্ত্রের সঙ্গে আমার দৈনন্দিন ওঠাবসা। ব্রাশ করতে করতে নদীর পাড়ে এসে দাঁড়ালাম। নদী অববাহিকা এমনই একটি আশ্চর্য মহীরুহ, যেন একটি পরিবারের অজস্র ডালপালা বেয়ে উঠতে উঠতে পরিচিত উত্তরসূরিদের পর এবার পূর্বসূরীদের চিনে নেওয়ার পালা। নদীর জল যেমন ঠান্ডা তেমন তার দাঁত নখের ধার। তবু হাঁটু পর্যন্ত পা ডুবিয়ে বসে থেকে ঠাণ্ডাকে পাল্লা দিতে আমাকে কে আটকায়!
 
আজ পথের তেমন তাড়া নেই, তাই কাজকর্ম দ্রুত সেরে ফেলবার তাগিদও নেই। থানসিং (৩৭০০ মিটার) থেকে আজকের গন্তব্য লামুনে (৩৯৬০ মিটার)। পথের দূরত্ব মাত্র চার কিলোমিটার তাই সময়ের কোন বাঁধাধরা নিয়ম নেই, পৌঁছালেই হলো। ঢিলেমির এমন খাসা একটি অবসরে আমার যেন কুর্মা অবতারের পুনর্জন্ম হইলো। অনেক ট্রেকার থানসিং থেকেই মাঝরাতে রওনা দিয়ে সামিট পুশ করেন কিন্তু আমরা আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পাহাড়ের সান্নিধ্যে আরও একটা বাড়তি দিন কাটিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিলাম। নিজেদের উপর অনেক যত্ন আপ্যায়ন এবং খাতিরের সুবিচার করে অবশেষে বেলা সাড়ে দশটা নাগাদ আমরা লামুনের পথে রওনা দিলাম।
 
সামিট ক্যাম্প হিসাবে থানসিং অথবা লামুনে উভয়েই কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। লামুনে থেকে সামিট অ্যাটেম্পট করলে সুবিধা এই যে যথেষ্ট পরিমাণে বিশ্রাম নিয়ে পরদিন ঘন্টা দুয়েক এগিয়ে থেকে শুরু করা যায়। লামুনের পথে শুরুতেই পড়লো বাধা। বেশ চওড়া একটি নদী পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে। না তাকে লাফিয়ে টপকানো যায়, না তো এই সাতসকালে কোমর ডুবিয়ে পারাপারের ইচ্ছে আমাদের আছে। অবশেষে গাইডের কেরামতিতে আমাদের এই যাত্রায় সাপও মরলো লাঠিও ভাঙলো না।
 

 
আমরা এসে পড়েছি কাঞ্চনজঙ্ঘা রেঞ্জের গর্ভ গৃহে। ডান হাতে খাড়াই পান্ডিম আর বাম হাতে প্রেক-চু নদীর এই লামুনে উপত্যকায় বামন জাতীয় কাঁটা গুল্মের গাছ (dwarf trees), নব্বই ডিগ্রী খাড়া ঢালের পাহাড় (Cliff), জমাট বাঁধা এবং গলে যাওয়া বরফের পুনরাবৃত্তি (freeze and thaw), স্থায়ী এবং জমাট বরফ-মাটি (permafrost) পেরিগ্লেসিয়ার ভূমিরূপের (periglacial landforms) সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। এই অঞ্চলে একসময় হিমবাহের গতি প্রকৃতির প্রামাণ্য দলিল হিসেবে ‘U’ আকৃতির উপত্যকা সুস্পষ্টভাবে চোখে পড়ে। কালচে বাদামী, ধূসর খয়েরী এবং মরচে লালের বাহারি গুল্মের পাতায় সমগ্র উপত্যকা জেগে উঠেছে গোধূলির অস্তমিত রাগে। রাস্তা এখন প্রায় সমতল বলা যায়। কাঁটা ঝোপের মধ্যে এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে ইয়াক মিউলগুলো দল বেঁধে অথবা একা একা ঘাস চেবাতে ব্যস্ত, কেউবা প্রেমের অভিসারী পথে। হটাৎ দেখি অক্ষয় বাবু লম্বা লম্বা পা ফেলে থানসিং এবং লামুনের মধ্যে ছুটোছুটি করছে। আমরা এখন দলবেঁধেই হাঁটছি। এগিয়ে যাবার অথবা পিছিয়ে পড়ার টানাপোড়েন নেই। এরই মধ্যে একটি জায়গায় পাথরের উপর পাথর সাজিয়ে শয়ে শয়ে ক্রেয়ন কেউ যেন খেলার ছলে বানিয়ে রেখেছে। এই দৃশ্য উপেক্ষা করে এমন সাধ্যি কোনও পথিকের নেই। গাইড এবং মালবাহক ছেলেগুলি পাশেই উবু হয়ে শুয়ে ভিটামিন ডি সংগ্রহ করে নিচ্ছে গায়ে। আমরাও হৈ-হৈ করে পিকনিকের মেজাজে মাটিতে লুটোপুটি দিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লাম আকাশের দিকে চেয়ে। এখানে কবি প্রকাশক এবং সম্পাদক ব্রতীন সরকার মহাশয় তার নব্য নির্মিত চায়ের দোকান জনগণের উদ্দেশ্যে খুলে দিলেন পান্ডিম পাহাড়কে সাক্ষী রেখে। আমরাও ফিতে টিতে কেটে, বিনামূল্যে চা-পান করে, পা ছড়িয়ে গল্প করে ইয়াকসম সাচেন জঙ্গলের দুশ্চিন্তাকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে জীবন উপভোগ করে নিলাম কানায় কানায়।
 

 
লামুনেতে (৩৯৬০ মিটার) নদীর একদম পাড়ে একটি বিশালাকার পাথরের গায়ে তাঁবু পড়ল আমাদের। সামনে কোনও কিছু উঁচু দেখলেই আমার মন সেখানে সশরীরে না পৌঁছানো পর্যন্ত শান্তি পায় না। এ এক অদ্ভুত বাতিক ! উঁচুতে উঠে নিচের দিকে তাকালে নিজেকে পাখির মতো মনে হয়। ডিনার সেরে বহু রাত পর্যন্ত চলল প্রয়োজনীয় খাবার দাবার সাজ পোশাকের চেক লিস্ট মিলিয়ে নেওয়া। একদিকে নদীর হুঙ্কারে কান পাতা দায় ! আজ ভোর রাতেই আমরা অভীষ্ট গন্তব্যের পথে রওনা দেবো। কাউন্ট ডাউন শুরু…
 

ক্রমশ…

 
আগের পর্ব পড়ুন:

ধারাবাহিক: পাহাড়িয়া পথে পথে। পর্ব ১৩


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!