- ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
- ডিসেম্বর ১৭, ২০২৩
ধারাবাহিক: পাহাড়িয়া পথে পথে।পর্ব ২
অনিশ্চয়তার পথে নেমেই মানুষ বুঝতে পারে প্রকৃতির বিশ্বরূপের সামনে তাঁর অনুতম অস্তিত্বের স্বরূপ...
অলঙ্করণ: দেব সরকার
ভুবন পাহাড় আর গিরিশৃঙ্গের প্রতি তাঁর দুর্ভেদ্য আকর্ষণ উৎসবমুখর করে তোলে ভূগোলের বিদ্যাযাপন । পেশা আর নেশা যখন একাকার হয়ে ওঠে, তখনই তাঁর অনুভূতিকে অন্যভাবে জাগিয়ে তোলে— ‘শেষের কবিতার’ শোভনলালের পাহাড়ের পথে পথে ঘুরে বেড়ানোর বেহিসেবিয়ানা । গন্তব্য জগতের এক শৃঙ্গ থেকে আরেক শৃঙ্গ
আমার যখন বছর দুই কি তিন বয়স, চেহারার প্রয়োজনীয় বৃদ্ধি ছিল চোখে পড়ার মতো কম। রোগক্লিষ্ট চেহারায় হাত-পাগুলি নরম এবং লিকলিকে রোগাটে। পাতলা গড়নে উচ্চতা এবং ওজনের অনুপাত স্বাভাবিকের থেকে বেশ খানিকটা কম। বাকি চেহারা থেকে মাথাটা একটু বড়। ঠিক যেন যশুরে কৈ ! দৃশ্যমান বুকের পাঁজরের হাড় ঠেলে পেট বেরিয়ে এসেছে বেলুনের মতো। ডাক্তারের পরামর্শে রিকেটের লক্ষণ। চিন্তা বাড়লো বাবা-মায়ের। ঠাকুমা বললে পেঁচোয় পেয়েছে; এ নাকি পেঁচোয় পাওয়া রোগ। এমন রোগে শরীরের বাড় কম হয়, দাঁত উঠে দেরিতে, রাতে ভালো ঘুম হয় না, হাড় ক্ষয়িষ্ণু এবং নরম। খাবার খেলেও গায়ে লাগে না। ক্যালসিয়াম এর পুষ্টিগুণ শরীর চুঁইয়ে পৌঁছায় না অস্থিমজ্জায়। সুষম খাবার এবং মূলত সূর্যের আলো থেকে পাওয়া ভিটামিন ডি-এর অভাবে এই রোগ। শিশুদের যে দুধ সাদা দাঁত ওঠে তার বদলে আমার প্রথম দাঁতগুলি ছিল কালচে এবং ভাঙাচোরা।
জীবনের প্রথম আঠারোটা বছর দেশবাড়ির মাঠে ঘাটে অফুরন্ত জল মাটি রোদ হওয়া গায়ে লাগিয়েও ঘাটতি পূরণ হয়নি কোনোদিন। আজ এই যৌবন বয়সেও সেইভাবে চেহারা ফিরলো না কোনোদিন। সেকেন্ডারি ক্লাস পর্যন্ত চেহারা বেঁটে খাটো থাকলেও উচ্চতা একটু বেড়েছিল বয়ঃসন্ধির বিকেলে। রোগভোগে ক্লান্ত চেহারায় ঘাটতির এই অভিশাপকে আমি পুষিয়ে নিয়েছি পাহাড় পথের প্রয়োজনীয় দৈহিক ওজনের আশীর্বাদ রূপে। হাড় মাংস এতদিনে বুঝে নিয়েছে প্রখর জেদের থেকে বড়ো কিছু নেই।
কলেজ থেকে ফেরার পথে একদিন দেখি গ্রামের বাইরে হাসপাতালের মাঠে বিস্তর তাঁবু পড়েছে। লম্বা চওড়া চেহারা, কদম ছাঁট চুল, ঠোঁটের উপর পুরু আস্তরণের জমকালো গোঁফ, পায়ে ভারী মিলিটারি জুতো আর জলপাই রঙের পোশাকের এই ভিন দেশী লোকগুলোকে দেখতে গেটের বাইরে বেশ জমজমাট ভিড়। তারা নিজেদের মধ্যে কী কথা বলে কেউ বোঝে না
ভাই বোন বাবা মা মিলিয়ে আমাদের পাঁচ জনের অনটনের সংসার। দিদি দু’ক্লাস আগে, ভাই দু’ক্লাস পরে আর আমি মাঝে। আমাদের এলাকায় তখন ভালো ইস্কুল ছিল না। আমরা পড়তে যেতাম দূর গ্রামে। অজয় নদের পাড়ে ছিল আমাদের ইস্কুল। আসা যাওয়া মিলিয়ে সেও প্রায় ১৫ কিমি পথ। মাঝখানে মারণ হাইওয়ে। ভাঙাচোরা একটিমাত্র সাইকেল নিয়ে আমাদের টানাটানি। কোনোদিন আমি চালাই দিদি পেছনে আবার পরের দিন উল্টোটা। সাইকেলে চালাতে খুব দম লাগে। বুকের শ্বাস লম্বা হয়ে আসে। কিন্তু এইভাবে পরাধীন শেকলে বাঁধা পড়ে তো আর বন্ধুদের সাথে সাইকেল রেস হয় না ! দিদি কলেজে উঠে গেলে স্বাধীনতা লাভের পর জঙ্গল নদী মাঠ ঘাট সব যেন গোগ্রাসে গিলতে গিলতে সাইকেলে চড়ে টোটো কোম্পানির মতো ঘুরে বেড়িয়েছি। প্রতি রোজের এই অভ্যাস নিশ্বাসের জীবন বীমা হয়ে জমা পড়েছিল হয়তো।
পড়াশোনায় আমি সবসময় ভালো ছিলাম। অন্তত লোকে তাই বলে। স্কুলের দুটি বোর্ড পরীক্ষায় চোখ ধাঁধানো রেজাল্ট হলো। দৈবক্রমে ভূগোল নিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হলাম সুদূর টি ডি বি কলেজে। কয়লা খনির এই মায়াবী রানীগঞ্জ আমার প্রথম স্বপ্নের শহর। শুরুতে হোষ্টেল পাইনি। বাড়ি থেকে ডেলি প্যাসেঞ্জারি করে যাতায়াত। মিশ্র সংস্কৃতির এই শহর মূলত হিন্দিভাষী। খুব দ্রুত সবকিছু মানিয়ে নিয়ে রপ্ত করে ফেললাম। বাঙালি মার্কা উচ্চারণের যে সে হিন্দি নয়; দৈনিক ব্যবহারে একেবারে চোস্ত হিন্দি বলিয়ে হয়ে উঠলাম। কলেজ থেকে ঘরে ফেরার পথে একদিন দেখি শীতকালীন বিকেলের অস্পষ্ট আলোয় আমাদের গ্রামের বাইরে হাসপাতালের মাঠে বিস্তর তাঁবু পড়েছে। লম্বা চওড়া চেহারা, কদম ছাঁট চুল, ঠোঁটের উপর পুরু আস্তরণের জমকালো গোঁফ, পায়ে ভারী মিলিটারি জুতো আর জলপাই রঙের পোশাকের এই ভিন দেশী লোকগুলোকে দেখতে গেটের বাইরে বেশ জমজমাট ভিড়। তারা নিজেদের মধ্যে কী কথা বলে কেউ বোঝে না। অনেকের মাথায় সত্তরের নকশাল আমলের স্মৃতি ফিরে এলো। কেউ কেউ প্রমাদ গুনলেন কিছু একটা ভয়ানক ঘটতে চলেছে। জঙ্গলমহল এলাকায় মাওবাদী প্রবেশের সম্ভাব্য গুজব ছড়িয়ে পড়লো। এরা হয়তো তারই আন্ডার কভার অপারেশন করতে এসেছে। এই মিলিটারি ক্যাম্পকে উপলক্ষ করে হাসপাতালের গেটের বাইরে জমে উঠলো বেশ খানিক অস্থায়ী দোকানপাট। ঘুগনি-মুড়ি, চাটমশলা, পান-বিড়ি ডিমের পোচ, অমলেট, ব্রেড টোস্ট, রুটি তরকারি ইত্যাদি। মিলিটারি লোকগুলো এইসব খাবার খেলো কিনা আমি জানিনা কিন্তু গ্রামের লোক সকাল-সন্ধ্যা ভিড় করে বেশ খানিক হুজুক সাবাড় করলে বটে ! কাছে যেতেই বুঝলাম সিআরপিএফের ট্রেনিং চলছে। একটি পেল্লাই সাইজের আর্টিফিসিয়াল রক ক্লাইম্বিং দেওয়ালের খাঁজ বেয়ে বেয়ে জওয়ানরা উঠছে আর নামছে। তাদের কোমরে বাঁধা লম্বা লম্বা দড়ি। নিচ থেকে কেউ ওদের বিলে দিচ্ছে। অন্যদিকে আরেক দল জাল বেয়ে উঠছে আর নামছে অহরহ। হরেক রকমের কসরৎ আর মিলিটারি ট্রেনিং দেখার এমন সুযোগ আমার প্রথম জীবনে ঘটেছিল। একটু গা ঘেঁষাঘেঁষি করতেই এক জওয়ানের সাথে পোক্ত হিন্দিতে আলাপ জমলো। সেও প্রাণ খুলে বললে তার রাজস্থানের দেশ গ্রামের কথা বিবি বাচ্চার কথা। বেশ একটা জাতীয়তাবোধের ছলাৎ অনুভব বুকের মধ্যে বেজে উঠলো। সেদিন কোনও নতুন স্বপ্নের বীজ বোনা হয়েছিল কিনা, আজকের ফসলের গায়ে তার স্বাক্ষর খুঁজলে হয়তো পাওয়া যাবে।
গ্রাম মফস্বল থেকে সরাসরি মহানগরে এলে একটা বড় রকমের সাংস্কৃতিক ঝটকা লাগে। পদে পদে ঠকতে ঠকতে আবেগ অনুভূতি মানবিকতা সব পেছন দরজা দিয়ে পালায়। লুকিয়ে লুকিয়ে ফেলা চোখের জলের হিসাব একমাত্র ঈশ্বর হয়তো রাখেন। এমন পরিস্থিতিতে লন্ডনে বসে রবীন্দ্রনাথের লেখা একটি চিঠি আমাকে খুব ভাবায়— “এ দেশে এসে আমাদের সেই হতভাগ্য বেচারা ভারতভূমিকে সত্যি সত্যি আমার মা বলে মনে হয়। এদেশের মতো তার এত ক্ষমতা নেই, এত ঐশ্বর্য নেই, কিন্তু আমাদের ভালোবাসে। আমার আজন্মকালের যা-কিছু ভালোবাসা, যা-কিছু সুখ, সমস্তই তার কোলের উপর আছে। এখানকার আকর্ষণ চাকচিক্য আমাকে কখনোই ভোলাতে পারবে না —আমি তার কাছে যেতে পারলে বাঁচি। সমস্ত সভ্যসমাজের কাছে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত থেকে আমি যদি তারই এক কোণে বসে মৌমাছির মতো আপনার মৌচাকটি ভরে ভালোবাসা সঞ্চয় করতে পারি তা হলেই আর কিছু চাই নে।” এমন দরদি কথামালাই তো আমাদের গোপন আঘাতে প্রলেপ এঁকে দেয়। এইসব বাণী উপদেশের কাঁধে জীবনের গুরুভার চাপিয়ে দিয়ে মানুষের জীবনে একটু প্রশান্তি আসে বৈকি। যাইহোক, একপ্রকার নিরুপায় হয়েই এম.এ. পড়তে আমি কলকাতায় এলাম। উঠলাম বালিগঞ্জ ক্যাম্পাসের কাছেই একটি মেস বাড়িতে। কমবেশি আমরা সকলেই জানি ভূগোলে এক্সকার্শন বা শিক্ষামূলক ভ্রমণের একটি বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। বইয়ের পাতা থেকে বেরিয়ে এসে সরেজমিনে মাঠে নেমে জ্ঞানচক্ষু দিয়ে না দেখলে ভূগোল শেখা যায় না। এর আগে বহুবার বাঁকুড়ায় মামাবাড়ি বেড়াতে গিয়ে দূর থেকে দেখে এসেছি কোড়ো পাহাড়, শুশুনিয়া পাহাড়, বিহারীনাথ পাহাড়ের তীব্র আবেদন। কিন্তু এই প্রথম একা একা বাড়ি থেকে বহুদূরে একদল সহপাঠী মিলে সামান্য সঞ্চয়ের ঝুলি কাঁধে মাস্টারমশায়ের সঙ্গে সিকিম এবং উত্তরবঙ্গের পথে রওনা দিলাম। কোনও সমুদ্র নয়, মরুভূমি নয়, একেবারে সটান পাহাড়ের পথে। সেই আমার জীবনে প্রথম দেবপ্রতিম হিমালয় দর্শন।
আগের পর্ব পড়ুন:
❤ Support Us