Advertisement
  • ক | বি | তা রোব-e-বর্ণ
  • আগস্ট ২৭, ২০২৩

দুটি কবিতা

মিনার মনসুর
দুটি কবিতা

বলতে ভালো লাগছে

কোনো বিশুদ্ধ কবি, শিল্পী কিংবা স্রষ্টা আর দ্রষ্টাকে সময় অথবা ভৌগলিকতা দিয়ে চিহ্নিত করা কি সম্ভব ? তাঁর সময় বোধের সঙ্গে নিঃসময়ের সম্পর্ক কতটা অবিচ্ছেদ্য ?
 
সাইবেরিয়ায় মানুষ, যখন গুহাচিত্র আঁকত, যখন মাতৃগর্ভে শিল্পের ভ্রুণ বাড়তে থাকে, সে তার মানচিত্রগত অবস্থান কতটা বুঝতে পারে?  না নিজের অজ্ঞাতসারে, স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভ্রূণ সংগ্রহ করে যাবতীয় রস; গ্রহণ করতে থাকে তার দেহবৃত্ত আর প্রাথমিক গঠন প্রক্রিয়া। বাল্মিকী থেকে রবীন্দ্রনাথ, এরকম কোনো প্রজ্ঞার ক্ষেত্রেই একথা অপরিহার্য সত্য, এই যেমন মাইকেল অ্যাঞ্জেলো, যেমন ভ্যান গগ, মাতিজ, যেমন শেক্সপিয়ার থেকে জালালুদ্দিন রুমি, দান্তে, রহস্যবাদী খলিল জিব্রান এরকম কাউকেই সময় দিয়ে সনাক্ত করা সম্ভব নয়, প্রত্যেকেই কাল আর মানচিত্রের কৃত্রিম রেখাচিত্রের ঊর্ধ্বে। তাঁদের লেখালেখির বয়স আর ক্ষেত্রভূমিকে মোটা দাগের সাহায্যে দৃষ্টিগ্রাহ্য করে তোলা অনুচিত। অসম্ভব।
 
হালের বাংলা কবিতার নিঃসঙ্গ, একক কন্ঠ মিনার মনসুর প্রসঙ্গেও অসম্ভবের এচিন্তা ক্ষীণস্বরে বেজে ওঠে, তাঁর গত কয়েক বছরের প্রকাশিত কবিতার শরীর ও আত্মার অনাড়ম্বর, উত্তরমুখী বিষয় আশয় পড়তে পড়তে।
 
মিনারের বয়স কত, কোন দশকের কবি তিনি, কখন কাদের সান্নিধ্যে এসে তাঁর অনুশীলনের, প্রস্তুতির আরম্ভ, কার সঙ্গে তাঁর কবিতা ভাবনার নিবিড় আত্মীয়তা— এসব বিষয় নিয়ে বলবার, ভাববার মূঢ়তা দূরে সরিয়ে আগামীর দৃষ্টিতে তাঁর শিল্পাঞ্চলের নির্মানকে খুঁজতে হবে। পাঠকের অনুভূতিকে তাৎক্ষণিতা থেকে বিমুক্ত করে পাঠকতার বিজ্ঞাপনহীন পর্যবেক্ষণে একান্ত মনোসংযোগ জরুরি। ভাবতে আর বলতে ভালো লাগছে, মিনারের সময়ে আমরা বেঁচে আছি, আমাদের সমসাময়িকতাকে প্রাণিত করছে তাঁর কবিতা এবং কবিতা বিষয়ক গদ্য, তাঁর সংহত চিন্তা এবং সংযত বাচনভঙ্গি। এরকম সুস্নাত পরিসর সবসময় গড়ে ওঠে না; জনপ্রিয়তা কিংবা মোহাচ্ছন্ন মুগ্ধতা কোনো কবিকেই উচ্চতার স্থায়ী আসন দেয় না, জীবদ্দশায় অনেকেই মিথ হয়ে ওঠেন, তাঁদের গল্পকথা আমাদের দৃষ্টিকে বিভ্রান্ত করে দেয়, কিন্তু এগোলে, পরিণত ব্যক্তিত্বকে কবির ভেতরে, তাঁর বাক্যলাপে খুঁজলেই একসময় ধেয়ে আসে ভুলে যাওয়ার প্রবণতা। তাৎক্ষণিক চিত্তপ্রিয়তা এক অর্থে কবি ও কবিতার শত্রু, জনজাগরণের মঞ্চ তাঁকে ব্যবহার করে, জাগৃতির মেয়াদ শেষ হলেই অপ্রাসঙ্গিকতা রেহাই দেয় না কবিতা কিংবা যে কোনো শিল্পের নারী পুরুষকে। আশা করি, এরকম সঙ্কট মিনারকে কখনো স্পর্শ করবে না, কেননা তাৎক্ষণিকের কবি নন তিনি, কবিত্বের নবিবোধও নেই তাঁর। শিল্প, নান্দনিকতা, নিঃসময় আর কালহীন কাঙ্খিত যাত্রা তাঁকে তাড়া করে। হক কথা বলতে কী, মিনার তাঁর কোনো কোনো পূর্বগামী আর সমগামীর মতো জনপ্রিয়তার খরস্রোতে, প্রত্যাশিত ক্ষণস্রোতে হেলান দেননি কখনো, সামাজিক দ্রোহের নির্দেশ গত শতাব্দীর শেষ পর্বের বহু ঘটনা বিচলিত করেছে, ক্রুদ্ধ করেছে তাঁকে, সে ক্রোধকে যথাসম্ভব আত্মস্থ করে ক্ষমতামত্ততার মোকাবিলা করেছেন, নিষেধাজ্ঞার কোপে বিদ্ধ হয়েছেন, রক্তাক্ত চিন্তার প্রতিমা নির্মাণে কবিতার শর্তকে অক্ষত রেখে; ভাষা আর বিষয়কে ছড়িয়ে দিয়েছেন ভৌগলিক সীমা আর কালের বাইরে। এসংযম, এই নিরপেক্ষ উগ্দীরণ মিনারকে শক্তি দিয়েছে, একাকিত্ববোধে আক্রান্ত হতে দেয়নি। তাঁর জেদ আর প্রতিস্পর্ধা বাড়িয়েছে, জনপ্রিয়তার মোহকে এফোঁড় ওফোঁড় করে আত্মশক্তি আর আত্মনিয়োগের মানচিত্রকে বিস্তৃত, আঞ্চলিকতা মুক্ত, দূষণমুক্ত পরিসর উত্তীর্ণ হবার শিক্ষা দিয়েছে। ধ্রূপদিয়ানা আর রোমান্টিক স্পর্শকাতরতার দুরূহ, কোলাহলহীন স্বপ্নসত্যের দিকে পা পা করে হাঁটতে বাধ্য করেছে। আর এই পথেই নিঃশর্ত, আপোসহীন দাবি, একমাত্র সচেতন বিদগ্ধ পাঠকই তাঁর মননের, তাঁর যুক্তি ও বিবেকের বিচ্যুতিহীন, স্বাভাবিক বন্ধু। মিনার তাঁর প্রত্যাশিত বন্ধুদের খোঁজ কতটা পেয়েছেন, আদৌ কি পেয়েছেন, এ নিয়ে সংশয়হীন নই। মিনারকে বুঝতে হলে মনস্তত্ত্বের অবারিত দরজার ক্রমোনির্মাণ দরকার। প্রয়োজন ক্রিকালদর্শী ইতিহাস চেতনা আর কাব্যতত্ত্বের বহুত্বময় সাধনা। কবিতার এরকম শ্রুতিপ্রাঙ্গন সহজলভ্য নয়। সামন্ত্রবাদী, কৃষি ভিত্তিক আর সাম্প্রতিকের পুঁজিমুখী সমাজকে মুক্ত প্রান্তর, মুক্ত প্রতিষ্ঠান রচনার আশায় আরো কিছুকাল অপেক্ষা করতে হবে। মিনার কিংবা জয় গোস্বামীর কিংবা জয়দেবের কবিতার সত্য আর নান্দনিক শর্তকে বুঝতে হলে আমাদের অর্জনের ঋদ্ধতাকে বাড়াতে হবে আরো, ছুটতে হবে পূর্ব থেকে পশ্চিমে, কাঙ্খিত স্বপ্নের পথে পথে । যে পথের শুরু আর শেষ নেই কোনো।

বাহার উদ্দিন । ২৭.০৮.২০২৩

 
 

চক্রব্যুহ

অভিমন্যু জানতো না তাতে কী, আপনি তো জানতেন সব! মহাভারত যাঁকে ত্রাতা বলে জানে আপনার অভিন্ন হৃদয় সেই মহান সারথি— যাঁর অঙ্গুলি হেলনে খাণ্ডবদাহন হলো, কুরু-পাণ্ডবের রক্তে রচিত হলো অন্য এক মহাভারত— তাঁরও অজানা ছিল না কিছুই। সর্বোপরি, মাথার ওপর ছিল ভগবৎ-ছায়া। তার পরও কী অবলীলায় যে ছিল আপনার ছায়াসঙ্গী সেই গাণ্ডীবও অবাধ্য হলো। খড়কুটোর মতো উড়ে গেল দেবদত্ত অব্যর্থ অস্ত্রশস্ত্র যতো। তুচ্ছ রাখাল বালকের হাতে লুণ্ঠিত হলো আপনার যত শৌর্য ও সম্ভ্রম।
 
অভিমন্যু অর্বাচীন, কিন্তু আপনি তো কৃষ্ণসারথি, সব্যসাচী ! (আপনার কর্ণযুগল স্বাক্ষী) জগদ্বিখ্যাত একটি মহাকাব্য লেখা হয়ে গেছে আপনার উছিলায়।
 
বলুন কীই-বা ফারাক তবে ?
 

যে-নামের ওপর মহাভারতের আভূমিলুণ্ঠিত বন্দনা ঝরে পড়ে— আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা জন্ম-জন্মান্তরের সব ব্যথা ও বঞ্চনা ভুলে সুপেয় জলের মতো পান করে যাঁর চরণামৃত সুধা— দেখো, মহাপ্রস্থানের পথে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে তাঁর অপ্রতিরোধ্য রথখানি। পার্থসারথি মন্দিরের বেয়াড়া বলদও মাড়িয়ে যায় তাঁকে !
 
কর্মেই তোমার অধিকার— কেবল কর্মেই তোমার অধিকার— আহা, এ গূঢ়তত্ত্ব আপনার চেয়ে ভালো কে আর জানে! কুরুক্ষেত্র সাক্ষী কর্মের করোটি আর রক্তস্রোতে আপনিই তো ঢেকে দিয়েছেন মহাভারতের জটিল মানচিত্র।
এখন কূলে একা বসে আছেন, কোথায় ভরসা !
 

পেছনে ফেরার কথা ভাবছেন? ওসব ভাবা-টাবার কাজ যুধিষ্ঠিরের ওপর ছেড়ে দিন– পথের কুকুরও যার ওপর ভরসা রেখে ঠিক পার হয়ে যায় স্বর্গ ও নরকের জটিল গোলকধাঁধা। আপনার তো ছিল কেবল গাণ্ডীব আর এক কৃষ্ণ বাজিগর। সব পাখি ওড়ে গেছে। পড়ে আছে কেবল জংধরা খাঁচা।
 
খাঁচার আবার কিসের এতো মরা-বাঁচা !
 

পার্থসারথি মন্দিরে যথারীতি উপচে পড়বে জনতার ভিড়। পাঁঠার করুণ মুণ্ডখানি ঘিরে ক্রমেই উদ্দাম হয়ে উঠবে পাণ্ডার খড়্গ-নৃত্য। বেয়াড়া বলদেরা দাপিয়ে বেড়াবে মন্দিরের চারপাশ। মুহুর্মুহু উলুধ্বনি হবে। ঘণ্টার শব্দে প্রকম্পিত হবে আসমুদ্রহিমাচল।
 
কেবল আপনিই হাঁটু ভেঙে থাকবেন পড়ে মহাপ্রস্থানের পথে।
 

চারটিই দরোজা। তিনটি তার বেদখল হয়ে গেছে। জরায়ুমুখ বন্ধ করে উধাও হয়ে গেছেন জন্মদাত্রী। (‘তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি/বিচিত্র ছলনা-জালে,/হে ছলনাময়ী’) সম্মুখে গর্জমান কুরুক্ষেত্রের তরল অন্ধকার। হয়ত সেখানেই ওত পেতে আছে গোপালক দস্যুদল– যাদের উদর থেকে অবিরাম ঝরে পড়ছে ক্ষুধা ও বঞ্চনার ক্রুদ্ধ লালা। গাণ্ডীব বিগড়ে গেছে। তার চেয়েও বিশ্বস্ত আর লক্ষ্যভেদী যে দুটি চোখ তারাও বিমুখ আজ। অসূর্যম্পশ্যা যাদব নারীরা লুট হয়ে গেছে আগেই। তাহলে আর কীই-বা থাকলো বাকি ?
 
চলুন হে পার্থ, সামনেই যাওয়া যাক !
 
 

সন্ধ্যা কি সত্যিই লাফিয়ে পড়েছিল

কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা থেকে পিয়ারলেসে ফেরার পথে মা ফ্লাইওভার থেকে আচমকা লাফিয়ে পড়েছিল সন্ধ্যা। এক মুহূর্ত আগেও গাড়ির পেছনের সিটে পাশাপাশি বসে ছিল তারা। সে আর সন্ধ্যা। অবাঙালি মুসলিম যুবক নিজামউদ্দিনের হাতে ছিল স্টিয়ারিং। হঠাৎ জোরে ব্রেক কষেছিল সে। সন্ধ্যা কি তাকে কিছু বলেছিল ?
 
পশ্চিমের আকাশে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মতো লালচে ছোপ দেখে তার মনে পড়লো, তারা সম্ভবত গোধূলি নিয়ে কথা বলছিল। মওকা পেয়ে রবীন্দ্রনাথও ঢুকে পড়েছিলেন দুজনের মাঝখানে! তিনি গুনগুন করে গাইছিলেন: ‘গোধূলি গগনে মেঘে ঢেকেছিল তারা…।’ সেটাকে যদি গোধূলি বলি আমাকে বলতেই হবে যে মুহূর্তটা ছিল ভয়ংকর। যুগপৎ সুন্দর এবং ভয়ংকর। অকস্মাৎ গাড়ির দরজা খুলে সম্মোহিত সন্ধ্যা কি তবে গোধূলি দেখতেই নেমেছিল ?
 
তা সে নামতেই পারে। এতে খানিকটা প্ররোচনাও থাকতে পারে প্রেমিক কবির। কিন্তু লাফিয়ে পড়ার জন্য যা যা আলামত লাগে সন্ধ্যার আচরণে তেমন কিছু ছিল বলে তো মনে পড়ে না। মুখ্যমন্ত্রী তো কবিতা লিখতেই পারেন। বইমেলার মঞ্চে একসঙ্গে তাঁর একডজন বইয়ের মোড়ক উন্মোচনও চলতে পারে দীর্ঘসময় ধরে। আমি কি বলেছিলাম, প্রসঙ্গ যখন কবিতা আর বই, বাঙালির পাতে সবই মানানসই !
 
ঘড়ির কাঁটা পেছনে ছুটতে থাকে। সারা দিন সারা রাত…তার আগের রাত…আগের রাতের আগের রাত…তারও আগের অনেকগুলো রাত আর দিন… দিন আর রাত সব ওলটপালট করার পর নিশ্চিতভাবে মনে হলো, এই কদিনে তার সঙ্গে যা যা ঘটেছে তাতে তারই তো লাফিয়ে পড়ার কথা পৃথিবীর ভীষণ বিপজ্জনক কার্নিশ থেকে। কিন্তু সন্ধ্যার তো এসব জানার কথা নয় !
 
সন্ধ্যা কি সত্যিই লাফিয়ে পড়েছিল? — জোড়াসাঁকোর তাপস হয়ত জানে।
 

♦—♦♦—♦♦—♦♦—♦

 

লেখক পরিচিতি : কবি, প্রাবন্ধিক ও গল্পকার। ঢাকার বাসিন্দা

  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!