Advertisement
  • গ | ল্প রোব-e-বর্ণ
  • জুন ৪, ২০২৩

নিঃসময়ের চালচিত্র

রঘাটিতে অসংখ্য মরা মানুষ আসে ছায় হতে।শবযাত্রীদের পায়ের গমগম শব্দ আর  প্রতিনিয়ত হরিবোল ধ্বনিতে কান ঝালাফালা হয়ে যায়। আগুনের জিভ লকলক করে, সমস্ত জ্যান্ত মানুষগুলোকেও খাব খাব করছে।

রাশিদুল বিশ্বাস
নিঃসময়ের চালচিত্র

অলঙ্করন: দেব সরকার

খুব গরম পড়েছে খুবই। রমজান মাস চলছে, যাকাত দিতে বান্দারা নিঃশেষিত। কোথাও একবিন্দু বৃষ্টি নেই।চারদিকে হাহাকার; আল্লাহ মেঘ দে, পানি দে … । গ্রীষ্মের দুপুরে সময়ে অসময়ে ঘুমের দৌরাত্ম্য চলে। তার ওপর রমজানের উপবাস। দুর্বল শরীরে ঝিমুনি আসা খুব স্বাভাবিক। বিছানায় ঘোড়াগোড় দিতে দিতে কখন ঘুম এসে চোখের পাতা কামড়ে ধরে বোঝা মুশকিল। হঠাৎ বাড়ির জানালার কাছে কারও গলার আওয়াজ পায় লতিফ । ঘুমটা ভেঙে গেল। ক্লান্ত লাগছিল, উঠে বসার শক্তিটুকুও সে হারিয়ে বসেছে। শুয়ে শুয়েই মেয়েকে ডাক দিল। ঝর্না, দেখ তো মা কে ডাকে। গেটের ফাঁকে চোখ রেখে কে, কী চায় জেনে নিয়ে এক দৌড়ে ঘরে আসে।বাবাকে মেয়ে জানায়, একজন লোক আস্যাছে, বুলছে ফিতরা লিবে। লতিফ মেয়েকে বলে, বুল  ফিতরা দিওয়া শেষ।  ঝর্ণা  বলে , যান এখুন, ফিতরা দেওয়া হয়ে গেলছে । মেয়ের গলা পেয়েই লতিফ ডাক দেয়, ঝর্ণা , দাঁড়াতে বুলধিনি । মনে মনে ভাবে, এটা অন্যায্য আবদার নয়, প্রতিবার রোজা শেষ হওয়ার  আগেই  ফিতরা বন্টন শেষ হয়ে যায়, নির্ধারিত ফিতরার অতিরিক্ত কিছু কিছু অর্থ দিতেই হয়, না দিলে চলে না ! গরিবের হক আদায় না করলে গুনহা লাগবে , ওপুরিতে ধরা থাকব্যা । জানালা দিয়ে তাকাতেই  অবাক হয়, চেনামুখ, মধুপুরের লসেরমুল্লা !
পঁচিশ-তিরিশ বছর আগের কথা, বাপের সঙ্গে ঝামেলা করে আরসাদ ঘর ছাড়ে । বাপে তাড়িয়ে দেয় , বউ ছেলে নিয়ে কোথায় মাথা ঢাকবে খুঁজে বেড়াতে বেড়াতে আশ্রয় পায় কালিতলার মরঘাটিতে ।এটা শ্মশানের স্থানীয় নাম।শ্মশানঘাটের তীর ঘেষা জায়গাগুলোতে নিভূইরা ঘর তোলে,  সংসার পাতে , বংশবৃদ্ধি হতে থাকে। এতেই কারো কারো জীবন চলে যায় ।মরঘাটিতে থাকতে বুকের পাঁটা লাগে। দিনরাত মরা পোড়ার গন্ধে টেকা দুষ্কর, রাতজুড়ে ভূতপ্রেতের মুঠো মুঠো ভয় তটস্থ করে রাখে । মাথা গোঁজার ছায়াটুকু যার নেই, তাকে তো ওইটুকু সহ্য করতেই হবে।এখানেই তালপাতার ছাওনিতে মাথা লুকায় আরসাদ। মাথায় ছায়া থাকলে কী হবে, কায়া মানে না পেটের জ্বালা । সারাদিন কাজ  খুঁজে হন্যে হয়ে ঘুরে ফেরে, সন্ধ্যায় খালি হাতে বাড়ি ফেরে । ধুঁকতে ধুঁকতে ঝিম মেরে বসে থাকে সবসময়। একদিন আরসাদ দেখে, মরা পোড়াতে আসা শবযাত্রীদের ফেলা খয় ছেলে খুটে খুটে খাচ্ছে । বুক চিরে শ্বাস আসে বাপের, ছেলের জন্ম দিয়েছে, খেতে দিতে পারে না , তাকে সব মুখবুঁজে সহ্য করতে হয়। ঘরে ঢুকে গড়াগড়ি কাটতে থাকে, কী করবে, কোথায় যাবে বুঝে উঠতে পারে না । কাটা মুরগির মতোই ছটফট করতে থাকে । হাতে একটা টাকা নাই ,কী করবে, বউ বাচ্চার মুখে খাবার তুলে দেবে ! হঠাৎ  চোখে পড়ে ছেলের হাতে কয়েকটা পয়সা । আর কিছু জানতে চায়নি, উঠে এক ঝটকায় ছেলের মুঠিতে আঙুল গলিয়ে পয়সা বের করে নেয় । সোজা হাঁটা দেয়, ছেলে তখন শ্মশানের মাঠে শুয়ে হাতপা ধাপড়াতে থাকে, আমার পয়সা দে, আমার পয়সা দে । ততক্ষণে আরসাদ কুশাবাড়িয়ার মোড়ে ।
বাড়ি ফিরে বউয়ের হাতে পোয়া খানিক গমের আটা তুলে দেয়।জলে ফুটিয়ে দলা করে খেলে খানিকটা রেহাই মেলে ! একবার খেয়ে দিন কাবার করে দেওয়া যায় । চোখ পড়ে ছেলের দিকে , বাঁশবাতার ছাওনি দেওয়া ঘরের মেঝেতে শুয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে , সারা গায়ে শ্মশানের কালো কালো ছায় ! ছেলেকেও বুঝি আগুনে ঝলসে দিয়েছে কারা,  হাত বুলিয়ে ছায় ঝেড়ে দিতে দিতে একসময় ডুকরে কেঁদে ওঠে আরসাদ, আল্লাহ কুন পরীক্ষা  লিছ তুমি ! দুনিয়ায় সব কাজ কি আসমানে গায়েব হয়ে গ্যাল ! আমি কী করনু আল্লাহ, ছেলের হাতের সামান্য পয়সা কাঢ়্যা প্যাটের জ্বালা মিটাছি ! তারপর বুকের মধ্যে দুইহাঁটু গুঁজে বসে থাকে ; কতক্ষণ বসেছিল, সে জানে না ।
চালের বস্তা মাথায় তুলে বইতে বইতে আরসাদ ক্লান্ত , তবু দিনের শেষে বাড়ি ফিরে ভাতের গন্ধে আবেশ লাগে, দু’চোখে ঠিকড়ে পড়ে স্বপ্ন। সন্ধ্যার কালো আকাশে ধোঁয়া আর মরা পোড়ার গন্ধকে ভেদ করে ঝাকে ঝাকে বাতাস ছুটে আসে। ছোট্ট ঘরের কোণে কোণে ভরিয়ে দেয় ভালোবাসা, আর নতুনের আগমন বার্তা
মরঘাটিতে অসংখ্য মরা মানুষ আসে ছায় হতে।শবযাত্রীদের পায়ের গমগম শব্দ আর  প্রতিনিয়ত হরিবোল ধ্বনিতে কান ঝালাফালা হয়ে যায়। আগুনের জিভ লকলক করে, সমস্ত জ্যান্ত মানুষগুলোকেও খাব খাব করছে। মাঝে মাঝে আরসাদের মনে হয়,  হিন্দু হয়ে জন্মালে মরা পুড়িয়ে রোজগার করা যেত । অন্তত ডোমেদের সাথে একাকটু হাতে হাত দিলে দুমুঠো ভাতের জন্য দোরে দোরে ঘুরতে হত না।  মুসলমান হয়েই যত জ্বালা, এ শ্মশানের দেশে  কুন কাজ পাই ন্যা । শ্মশানের শরীর লাগোয়া থাকতে থাকতে একসময় সে ভাবে, পুরো পৃথিবীটায় বুঝি বা আস্ত শ্মশান ! যেখানে প্রাণ শেষ হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন,  নতুন প্রাণের স্পন্দন জাগে না !
একসময় কাজ জুটতে থাকে। একজন মানুষ ফেরেস্তা হয়ে হাজির হয়। মোড়ের ওপারে বিশাল চালের ব্যবসায়ী তাকে দোকানে কাজ দেয়। লরি থেকে চাল নামানো, ভ্যানে করে দোকান দোকান চাল পৌছে দেওয়া। কুইন্টাল কুইন্টাল চালের বস্তা মাথায় তুলে বইতে বইতে আরসাদ ক্লান্ত হয়ে যায়,  তবু দিনের শেষে বাড়ি ফিরে ফোটা ভাতের গন্ধে আবেশ লাগে, দু’চোখে ঠিকড়ে পড়ে স্বপ্ন। সন্ধ্যার কালো আকাশে ধোঁয়া আর মরা পোড়ার গন্ধকে ভেদ করে ঝাকে ঝাকে বাতাস ছুটে আসে। ছোট্ট ঘরের কোণে কোণে ভরিয়ে দেয় ভালোবাসা, আর নতুনের আগমন বার্তা । আব্বা ডাকার মানুষ বাড়ে ক্রমশ…।
হঠাৎ দুর্ঘটনায় আরসাদ একটা পা হারায়,  দোকানের মালিক তার সংসার চালানোর দায়িত্ব নেয়।দিন গড়িয়ে যেতে থাকে, কিংবা থমকে যায়! আরসাদ আর সুস্থ হতে পারে না।
ইতিমধ্যে সংসার বড়ো হয়েছে। কে জানত, এমন ঘটনায় তার উপার্জন বন্ধ হয়ে যাবে ! সংসার চলতে চলতে ঝিমিয়ে পড়ে। ছেলে পাউরুটির দোকানে, ইট ভাটা কাজ করে বাপকে সাহায্য করতে থাকে। স্ত্রী পাকা লোকের বাড়িতে  ঘর মোছার কাজ করে। চুপি চুপি নাকি ফিতরাও তোলে, পরে ছেলে জানতে পেরে মাকে একদিন মাথার কসম দেয়, ফিতরা লিবা না। আমি কাজ করি, সক্ষম পরিবারে ফিতরা লিয়া পাপ জান না ? লোকের কাছে হাত পাতছে জানলে আরসাদও কষ্ট পাবে। সময় চলে যায় এইভাবে আরসাদের মারা গেছে, আত্মীয়-স্বজন বুঝিয়ে তাকে গ্রামে নিয়ে যায়, চাচারা নিজের জমিতে ঘর করে দিয়েছে। কিছুদিন পরে পায়ে ক্যানসার হয়ে আরসাদ দুনিয়া ছাড়ল। পরিবারের সব দায়িত্ব গিয়ে পড়ে ছেলের ওপর।  আরসাদের ছেলে  দাদোর পয়সায় ব্যবসা গেড়ে বসে। পাড়ার মুখে লম্বা পাকা দালান তোলে। বেশ নামডাক হয়।
— বাপ ফিতরা দিবেন ন্যা ? লোকটি জিজ্ঞেস করে। বিভোর ঘুমে লতিফ ডুবে আছে। অতীতের ঘুমে, দুঃখের চাদড় জড়ানো স্মৃতি; লোকের দোরে কাজ করা, চায়ের দোকানে পানি দিয়ে আসা, চেয়ে খাওয়া , মায়ের ফিতরা আদায়, মাঠে গোবর কুড়ানো, উরান জমিতে ধান কুড়ানো, আলু কুড়ানো। আর শ্মশানে; খয়, পয়সা…  তৌবা তৌবা ! জিভ কাটে লতিফ । তখনও আগন্তুকের দিকে তাকিয়ে থাকে, ভাবনায় জড়িয়ে থাকা কাফন খুলে বেরোতে পারে না, শরীর অসাড়  হয়ে আসে। বৃদ্ধ আবার বলে, তাহালে দশটা টাকা দিবেন ন্যা বাপজি ?
—থামেন চাচা বলেই লতিফ  নুইয়ে পড়া গতরে শক্তি যোগাতে চেষ্টা করে, এক ছুটে বেরিয়ে যায় বাইরে, বলা কওয়া নেই, আগন্তুকের হাত দুখান চেপে ধরে, কিন্তু কিছুই বলতে পারে না ! পুরো শরীর থরথর করে কাপতে থাকে। একশোটা টাকা বের করে বুড়োর হাতে দিতে গিয়েও দিতে পারে না;  নার্ভাস হয়ে যায়, যার কাছে চালের ব্যাগ নিয়ে রোজ চাল আনতে যেন লতিফ, যার দেওয়া চাল ফুটিয়ে  তাদের সংসার চলত, যার দেওয়া কাপড়ে মায়ের ইজ্জত ঢাকত, যার দেওয়া কাজ করে বাপ লোকের সামনে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল, তাকে ফিতরা দেবে !
বৃদ্ধ আপন মনে ট্যাকে হাত দিয়ে খুচরো পয়সা ঘেটে গুনতে থাকে, একমুঠো খুচরো টাকা পয়সা হাতে নিয়ে বলে, নব্বইটাকা পুঁজছে না বাপ ! দু’টাকা কম হল।
— চাচা, আমি লতিফ ! আমাকে চিনতে পারছ ন্যা ? আরসাদের বেটা । তোমার দুকানে আব্বা কাজ করত । আমি যাতুক চাল আনতে । বাড়ির চাল বাদেও একমুঠ করে চাল আমাকে দিতে, চিবিয়ে খাতে। তোমর ব্যাবসার কী হল ? ফিতরা নিচ্ছ ক্যানে ! কথাগুলো বলার জন্য লতিফের পেট ফুলে ওঠে । কিন্তু কিছুই বলতে পারে না,  গলার কাছে একথোকা বাতাস ঢেউ খেলে ওঠানামা করতে থাকে । শেষে লজ্জা পাবে , বা টাকা না নিয়ে চলে যাবে! তাই-ই হল, আসরের আযান কানে আসে, বৃদ্ধ আর দাঁড়ায় না । হনহন করে হাঁটা দেয় সোজা । লতিফ অপলক তাকিয়ে দেখে; বৃদ্ধ  লসেরমুল্লা লাঠি হাতে খটখট করতে করতে সোজা পুকুরের পাটাল হয়ে উঠে যায় ওপারে । আর, সে বেগুনি রঙের নোটটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, নিজের আড়ালে গুম হয়ে যায় অনেকক্ষণ, দুপুরে সারাক্ষণ।
♦♣—♦♣  ♦♣—♦♣  ♦♣—♦♣

  • Tags:
❤ Support Us
Advertisement
2024 Debasish
Advertisement
2024 Debasish
Advertisement
error: Content is protected !!