- গ | ল্প রোব-e-বর্ণ
- জানুয়ারি ৮, ২০২৩
অনন্যোপায়
একটু কোহলিত তরলিত না হলে এক পালকের পাখীটি থাকা যাবে না, এমন একটা নিরুপায় নিশ্চেষ্টতায় হাতটিকে গ্লাসসই করে থাকে...

–”কী রে বউকে আনলি না ?”
ঝলমলে বেলুন ফুল-টুল দিয়ে সাজানো হলঘরটায় ঢুকতে না ঢুকতে প্রশ্ন উড়ে এলো। প্রশ্ন নয়। প্রশ্নাবলী। স্প্লিন্টারের মতো ঝাঁকে ঝাঁকে।
–”আরে, একা না কি? বউ কই?”
–”যাস্সালা! সুজ্যো কোনদিকে উঠলো বে! বউ ছাড়া তুই!”
সব প্রশ্নের উত্তর হিসেবে সে একটা বোকাটে ন্যাতানো হাসি ঠোঁটের ডগায় ঝুলিয়ে রেখে সন্তর্পণে চেয়ারে বসলো। বাস্তবে সে আদৌ বোকা নয়। কোম্পানির ঘ্যামা অফিসার হিসেবে রইসি কেতাদুরস্ত পাবলিক। কিন্তু নিজের শহরের বন্ধু সম্মেলনে এই মুহূর্তে তাকে দেখলে সদ্য গ্রাম থেকে মহানগরে আসা থতমত ক্যাবলাটে লোক মনে হতে পারে। তবে, খুব নজর করলে বোঝা যাবে, আসলে এইসব অপ্রস্তুত মুদ্রা, ক্যাবলা গাঁওয়ার ভঙ্গি তলায় তলায় তার নাকের ভাঁজে, চোখের তলায় লেপ্টে আছে অনিচ্ছার ক্লান্তি । হাতে পায়ে বিনবিনে ঘামঘাম অস্বস্তি, যেন এই পিয়্যোর পার্টি ফিউম, বন্ধুসঙ্গ, বাকুমবুকুম কথার ফেনায় ডিসেম্বরের শেষ তারিখেও তার গরম লাগছে !
বস্তুত, সম্বচ্ছর স্যুটেড বুটেড থাকতে থাকতে অফিস থেকে ফিরলে স্যান্ডো আর মদ্র-লুঙ্গীর সুখটুকু ছাড়া সব কিছুতেই আজকাল ক্লান্তি লাগে তার । অন্তরঙ্গ গৃহকোণটি ছাড়া, ছোট্ট বর্গাকৃতি ঝুলন্ত বারান্দার ফুলেল টব-শোভা ছাড়া কিছুই তাকে তেমন টানে না । কিন্তু বউকে বোঝায় কে ! সোনালী তরলে অভ্যস্ত অন্যমনস্ক ছোট্ট চুমুক দিতে দিতে একটা ক্লিষ্ট হাসি হাসলো সে । বউ তো তার পার্টিমুখো পার্লারমুখো আধুনিকা, না ! হাহ্ ! সে আবার বউকে আনবে কী ! পার্টির নামে বউ নেচেই আছে ।
বলা ভালো বউই তাকে এনেছে।
এসব কথা থোড়ি বলা যায়। –”কীরে, মিসেস আসেনি”-র ক্যাজুয়াল প্রশ্নে তাই ক্লান্ত হেসে সে চোখের ইঙ্গিতে বউ দেখায়,
“ওই তো”–
বলতে বলতেই দেখে বউ তার আর এক বন্ধুর প্রায় কন্ঠলগ্না হয়ে ঝুলেই পড়েছে। সে আবারো হাসে। অনন্যোপায় ইলাস্টিক হাসি। গালের মাসল ব্যথা ব্যথা করে।
–”ম্যাডাম, এদিকেও একটু নজর দেবেন”
বউ একে ছেড়ে ওর গায়ে ঢলে পড়লো। বিউটি-ন্যাপ দেওয়া সতেজ চোখে কাজল-কটাক্ষ।
এইসব ঝোলাঝুলি, দোলদুলুনির ছোট ছোট ছবি, বিলোল যৌবনঝিলিক সে দূর থেকে দেখে। এবং, শোনেও।
“বয়স তো কম হল না, বুক পাছা দেখানোর বাই-টা আর গেলোনা। পারেও বাবা!”
তাকে শুনিয়েই বললো কি? ঘাড় না ঘুরিয়েই সে মনে মনে টিপ্পনিকারকে চিনে নেয়। এই মেয়েটা একটু ঠোঁটকাটা। কিরকম কট কট করে কথা বলে। তা এতোই যখন স্পষ্টবাদী, সরাসরি বউকেই বলে না কেন!
সে কী করতে পারে! জেনানা জমানা ভাই, একটু এদিক থেকে ওদিক হলে এই তোমরাই তো বধূনির্যাতন হচ্ছে বলে ঝাঁপিয়ে পড়বে বোনটি।
এইসব ভাবনা অবশ্য তার শরীরে কোনো হেলদোল ঘটায় না। সে চুপচাপ চেয়ারটাতে আগের মতোই আলগাভাবে বসে থাকে। ছোট্ট পানীয়তে খুব ধীরে ধীরে তিন চার আলগোছ সিপ্ দেয়। এমনিতে মদ টদ সে বিশেষ খায় না। তবে ক্লাব কালচার তো। একটু কোহলিত তরলিত না হলে এক পালকের পাখীটি থাকা যাবে না, এমন একটা নিরুপায় নিশ্চেষ্টতায় হাতটিকে গ্লাসসই করে থাকে।
তাদের বাচ্চা টাচ্চারাও এখন বড়ো হয়ে গেছে। ঠোঁটের ওপরে গোঁফের রেখা কারো কারো বেশ গাঢ়। মেয়েগুলোকে দেখলে সব মেঘ মডেল বালিকা মনে হয়।
তাদের মেয়েটাও এতো বড়ো হয়ে গেছে! ল পড়ে এখন কর্পোরেট হাউজে চাকরি করছে। ভাবলেই কেমন কুয়াশা ঘনায়। কেন যে বউ চাইলোই না মেয়ে তাদের কাছে থেকে লেখাপড়া করুক!
অফিশিয়াল কেতাদুরস্ত স্বামীটির হাত থেকে অপ্রস্তুত চামচ ছিটকে যায়। কিরকম যেন ঘামঘাম গরম লাগে থার্টিফার্স্ট নাইটের জমজমে শীতেও।বারোটা বাজার আগেই সে বাই-বাই করে গাড়ি স্টার্ট দেয়।
কেমন খাতা বই কিনে দিতো।
পেরেন্টস টিচার মিটিং-এ একবারও যেতে পারতো না বলে বউ মুখ ঝামটা দিতো।
সরস্বতী পুজোয় শাড়ী পড়ে মেয়ে যখন বলতো,
দেখতো বাবা, ঠিকাছে?
সে চমকে বলতো,
আইব্বাপ! এ তো লেডি!
আর মেয়ে তার গায়েই হিহি হেসে গড়িয়ে পড়তো।
খিলখিল হাসিতে সুখ সুখ মেদুর ভাবনা থেকে কার্পেট-মাটিতে ফেরে সে।
বেসামাল হয়ে বউ অন্যের বর, মানে তারই জনৈক বন্ধুর গায়ে তরলটি ফেলেছেন। জামারই এক্সটেনডেট পার্ট আঁচল টাইপের একটা জিনিস দিয়ে বন্ধুর বুকের জামার কাছটা মোছার চেষ্টা করছে বউ। যত না চেষ্টা, ভঙ্গী তার চেয়েও বেশী। দুরে বন্ধুর বউটি বিরক্ত ভাবে তার বউয়ের দিকে খরচোখে তাকিয়ে আছে।
এই সব সময় তার চোঁওও করে সবকটা গ্লাস ফাঁকা করে দিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সে তো আদ্যন্ত ভদ্দরলোক, না! তায় আবার উচ্চ পদস্থ সরকারী চাকুরে। ইচ্ছের গলাতেও দামী বকলস। কাজেই চুপচুপ দেখিনি শুনিনি সখী টাইপ মুখ করে থাকতে হয়।
সে জানে, এই বন্ধুরা, যারা তার বউকে নিয়ে গলিতললিত ভাব দেখাচ্ছে, তারাই বাড়ি গিয়ে নিজেদের বউকে তার নাম করে করে বলবে,
“সসাল্লা নপু মাল মাইরি! বুকঝোলা বুড়ীবেশ্যার মতো বউটা স্সালা আমাদের গায়ে ঢলে পড়ছে, কোনো কন্ট্রোল নেই। ওই বউকে আবার ও মাথায় তুলে রেখেছে!”
ওদের সতীলক্ষ্মী বউরাও হ্যাহ্যা করে হাসবে, বলবে,
–”ওইসব ছোট ছোট জামা কী করে বর কিনে দেয়, বুঝি না বাবা!’
–”লজ্জাও করে না এতো ছোট জামা পরে পা পেট বুক দেখাতে!”
অথচ, এরা সব ওই উইমেন্স লিব টিব করে। স্বাধীনতা-প্রগতি-মুক্তি টুক্তি নিয়ে ধড়াদ্ধড় প্রবন্ধ কবিতা নামিয়ে দিয়ে পটাপট ফটাফট হাততালি পায়। কিন্তু নিভৃত গৃহাঙ্গনে এরাই, জাস্ট এরাই স্বামী স্ত্রী মিলে তার বউটার কাপড় খুলে নেবে।
–”কি গো খাবে না ? আমার কিন্তু খিদে পেয়ে গেছে।”
–” হ্যাঁ হ্যাঁ। চল।”
শশব্যাস্ত হয়ে সে উঠে দাঁড়ায়। তার অস্বস্তিকে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে টিপিক্যাল পার্টিবিভঙ্গে কনুই ধরে ঝুলতে ঝুলতে বউ খাবার জায়গায় পৌঁছোয়। সানুনাসিক সুরে
ও বাবা ! কী খাব ! খেলেই তো ক্যালোরি গেইন– বলতে বলতে হাত ঝাড়তে থাকে।
অদুরে নেক্সট জেনারেশনের টিপ্পনী ভেসে আসে
“বীচ!”
সে তাড়াতাড়ি একটু বেবি নান, একটু চানা বাটোরা, একটা লেগপিস বউয়ের প্লেটে সাজিয়ে দেয়। চেয়ার খুঁজে বউকে বসায়। বউয়ের সানুনাসিক “আরো একটু স্যালাড আনো না গোওও”-র দাবী মেটায়।
আর, ইত্যবসরে বউয়ের ছোট্ট আঁটো পোষাকের শাসন না মেনে বুক আরো উপচিয়ে পড়ে, মসৃণ লেগপিসটি দৃশ্যমান হয়। তামাম জনতা উকি-টম ঝুঁকি-টম হয়ে মুচকি মুচকি হাসতে থাকে।
অফিশিয়াল কেতাদুরস্ত স্বামীটির হাত থেকে অপ্রস্তুত চামচ ছিটকে যায়। কিরকম যেন ঘামঘাম গরম লাগে থার্টিফার্স্ট নাইটের জমজমে শীতেও।
বারোটা বাজার আগেই সে টাটা বাই-বাই করে গাড়ি স্টার্ট দেয়।
কেমন দিশেহারা রাগে আনচান করে শরীর। গীজারের জল গরম হবার তোয়াক্কা না করেই ঝপঝপ ঝপঝপ জল ঢালতে থাকে মাথায়। জলজল পায়ে ধুপধাপ বাথরুম থেকে বেরোয়।
আর দেখে–
একেবারে ছোট্ট মেয়ে হয়ে এনামেলখসা লিপস্টিক মোছা ধ্যাবড়ানো কাজলে ফ্যাশনদুরস্ত বউটা গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছে। যেন অবুঝ সবুজ শিশুকন্যাটি তার। মাতাল আদুরে-ঠোঁট মেয়েটাকে লেপকম্বলের ওমে জড়িয়ে দিতে দিতে টপটপ অনন্যোপায় জল পড়ে। ভালো করে গা-মাথা মোছেনি বোধহয় লোকটা !
♦♦ ♦♦ ♦♦
❤ Support Us