- খাস-কলম পা | র্স | পে | ক্টি | ভ প্রচ্ছদ রচনা
- অক্টোবর ২, ২০২২
কল্লোলে কোলাহলে জাগে এক ধ্বনি
শারদীয় উৎসবকে কেন্দ্র করে বাঙালির যে বাৎসরিক নবজাগরণের পর্ব ছিল এটাকে ধরে না রাখতে পারলে আমাদের সংস্কৃতি বিজাতীয় প্রভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে

এক সময় শারদীয়া দুর্গাপূজা বাঙালি জীবনে ছিল বার্ষিক নবজাগরণ । পুজো উপলক্ষে বাঙালির শিল্প সাহিত্য কলা ছাড়াও বাঙালির ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও একটা বিশেষ ঢেউ উঠত । সাহিত্যের সে ধারা আজ মুদ্রণ মাধ্যমের সাহায্যে টিকে থাকলেও উৎসব উপলক্ষে আগে যে বিশেষ গানের উৎসারণ ঘটত, সেটা আজ আর নেই, তবে সংগীত উৎপাদনের মাত্রা বেড়েছে অনেকগুণ বেশি । যে অর্থে পুজো ছিল বাঙালির সৃজনের অন্যতম উপলক্ষ, এটা সে অর্থে আজ আর বোধহয় নেই । এমনিতে পুজোর সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কিত প্রথানুগ আগমনী গানের একটা ধারাবাহিকতা ছিল । গত শতকের চার-পাঁচের দশকে ওই ধারা থেকে সৃজনশীল আধুনিক গানের শক্তিশালী ধারার আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল, যার মধ্যে ছিল আগমনী গানের স্নিগ্ধ অনুরণন । হীরেন বসু, নিতাই ঘটক, তুলসী লাহিড়ী প্রমুখ সংগীত স্রষ্টা ছাড়াও কাজি নজরুল ইসলামের এ ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ । হীরেন বসুর ‘আজি শঙ্খে শঙ্খে মঙ্গল গাও, জননী এসেছে দ্বারে’, আজ আগমনী আবাহনে, কি সুর উঠেছে বেজে-‘ এসব পদের মধ্যে প্রাচীন আগমনী গানের রেশ ছিল ।
একবিংশ শতকে ঐতিহ্যটা একেবারে মুখ থুবড়ে পড়ল । কী ছিল সেই গান, তাও আজ ইতিহাস । পুজো উপলক্ষে সে গানের স্মৃতি রোমন্থনও নিয়ে আসে এক অপরিসীম আনন্দ । এ গানের আবেদনে সাড়া দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও —
কল্লোলে কোলাহলে জাগে এক ধ্বনি
অন্ধের কণ্ঠের গান আগমনী
সেই গান মিলে যায় দূর হতে দূর
শরতের আকাশেতে সোনা রোদ্দুর …
প্রকৃতির পরিবর্তনের সঙ্গে মিল রেখেই চন্দনী গায়ে সেই অন্ধ গায়ক কুঞ্জবিহারীর কন্ঠের উঠত আগমনী গান।
কবিগুরুর শৈশবে কী কী আগমনী গান শোনা যেত এর নমুনা আমরা পাইনি, তাঁর গানে অনুষঙ্গ হিসেবে আগমনী এসেছে বেশ কয়েকবারই । শান্তিদেব ঘোষ কবিকৃত রাগ রাগিনীর একটি তালিকার উল্লেখ করে বলেছেন, কবি এ তালিকায় ‘আগমনী’কেও স্থান দিয়েছেন । এ সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, এ হল বাংলার নিজস্ব সুর: ‘সুর দুটি অশাস্ত্রীয় হলেও গুরুদেব এদের অন্য রাগরাগিণীর মত সমান মর্যাদা দিয়ে গেছেন, একটুও অবহেলা করেননি’।
কবির ‘গানভঙ্গ’ কবিতায় শরৎপ্রাতে আগমনী, বিজয়ার গানের উল্লেখ আছে । আরও একটি গল্পেও ভিখারিণী গায়িকার কন্ঠে আগমনী গানের উল্লেখ আমরা পাই। আর ‘আমার রাত পোহালো শারদপ্রাতে’ গানটিতে ‘বিদায়গাথা আগমনী‘ কেমন মায়াময় আবেশ ছড়িয়ে দেয় । উল্লেখ করতে হয় ‘আকাশবীণার তারে তারে জাগে তোমার আগমনী’র আবেদনের কথা । এ যে আমাদের একেবারে প্রাণের গভীরে (আমার নয়ন ভুলানো এলে) এসে ছুঁয়ে যায় ।
লৌকিক স্তর থেকেই আগমনী গানের উত্তরণ ঘটেছে রাগ রাগিনী ঘেঁষা বিশেষ এক বর্গের সংগীতে, যেখানে আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে সংযোগ ঘটেছে নান্দনিকতার । প্রক্রিয়াটি প্রণালীবদ্ধভাবে বাংলার সাংস্কৃতিক রাজধানী কলিকাতায় ঘটলেও পূর্ববঙ্গ এবং এর সম্প্রসারিত বঙ্গভূমিতেও এ প্রক্রিয়া সচল ছিল যার নিদর্শন খুঁজলে পাওয়া সম্ভব ।
অষ্টাদশ-উনবিংশ শতকে বৈঠকি চালের গানের মধ্যেও অসংখ্য আগমনীর পদও রচিত হয়েছে, আর, রামপ্রসাদ-কমলাকান্তর আগমনী-বিজয়া তো বাংলাকে মাতিয়েই রেখেছিল। সে সঙ্গে দুর্গোৎসব উপলক্ষে রচিত বৈঠকি গানের (আগমনী বিষয়ক) মধ্যে ছিল ললিত, বিভাস আর রামকেলি রাগের প্রত্যক্ষ ছোঁয়া। এ গান যে পূর্ববঙ্গ পশ্চিমবঙ্গ পেরিয়ে আসামের বরাক উপত্যকা পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল এ ইতিহাস রচনা হবার অপেক্ষায় । রাজ্যশ্বর মিত্র কলকাতার উপকণ্ঠে রেলগাড়ির কামরায় শোনা আগমনী গানের কথা বলেছেন । এরকম অজস্র গান আজও ছড়িয়ে আছে বাংলা ভাষাঅঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে, আমাদের বরাক উপত্যকা এর বাইরে নয় । রাজ্যেশ্বর মিত্রর শোনা গানটির একটি কলি এরকম—‘ওই দেখো মেনকারাণী/তোমার উমা ওই আসিছে…।‘ এরকম অজস্র গান এদিকেও প্রচলিত ছিল ।
এটা অবশ্যই স্বীকার্য, লৌকিক স্তর থেকেই আগমনী গানের উত্তরণ ঘটেছে রাগ রাগিনী ঘেঁষা বিশেষ এক বর্গের সংগীতে, যেখানে আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে সংযোগ ঘটেছে নান্দনিকতার । প্রক্রিয়াটি প্রণালীবদ্ধভাবে বাংলার সাংস্কৃতিক রাজধানী কলিকাতায় ঘটলেও পূর্ববঙ্গ এবং এর সম্প্রসারিত বঙ্গভূমিতেও এ প্রক্রিয়া সচল ছিল যার নিদর্শন খুঁজলে পাওয়া সম্ভব । সংগীত গবেষক রাজ্যেশ্বর মিত্র বলেছেন আগমনী গান ‘মঙ্গল কাব্যে’র ধারা থেকেই উৎসারিত । কবি ভারতচন্দ্রের একটি আগমনী পদে প্রকৃতই এর নিদর্শন পাওয়া যায় । এমনই একটি আমার পিতৃদেবের কণ্ঠে শুনেছি—‘কী হে নিরুপম শোভা মনোরম/ হরগৌরী এক শরীরে ।/ শ্বেত পিতকায় রাঙা দুটি পায়/ নিছনি লইয়া মরিরে ।‘ ষষ্ঠীর প্রদোষ কালে বিল্ববৃক্ষমূলে হরগৌরীর অধিষ্ঠান এ ছোট্ট পদটিতে এত সুন্দর ভাবে চিত্রিত হয়ে আছে ।
তেমনি আরেকটি পদ শুনতাম যেখানে শরতের আগমনে পতিগৃহে দুঃখিনী উমা পিতৃগৃহে যাবার জন্য ব্যকুলতা বর্ণিত হয়েছে। আর পাঁচটা বাঙালি মেয়ের মতোই বৎসরান্তে উমার এ অনুভূতি। সে তো আর স্বর্গের দেবী নয়, আমাদের ঘরের কন্যা। তাঁর মনে পুঞ্জিভূত হয়েছে অভিমান। এও এ লেখকের পিতৃদেবের কণ্ঠে শোনা গান (পদকর্তার নাম সনাক্ত করা সম্ভব হয়নি)—
‘পঞ্চঋতু হল গত শরৎ আগত
দুঃখিনী জননী বুঝি কাঁদিতেছে অবিরত।’
দুঃখের কথা বলার আর কাউকে না পেয়ে অগত্যা উমা সংসার বিবাগী ভোলানাথকেই অনুযোগ করে বলছেন, ‘মায়ে আমা হারা হয়ে, বাঁচে কী পরান লয়ে’।
রামপ্রসাদ কমলাকান্ত-গিরিশ ঘোষের পদে আমরা পাষাণ হৃদয় হিমালয়ের কাছে মা মেনকার অনুযোগের কথাও শুনেছি। ভাঙেড়া ভিখারী স্বামীর ঘরে কন্যাকে পাঠিয়ে তিনি নিশ্চিন্তে রয়েছেন, এটা মায়ের প্রাণে সইছে না। পূজা মণ্ডপে বাবার কণ্ঠে উচ্চারিত একম একটি পদ—
“শুন শুন গিরিবর, রজনী প্রভাতে স্বপন দেখিনু
উমা আসিয়াছে ঘর।
উমা আসিয়া শিয়রে বসিয়া,
কহিছে কাতর স্বরে, ‘বরষা উতরি, গেল গো জননী, নিলে না আমারের ঘরে,
(মাগো) ভুলে কি গিয়েছ মোরে’? ”
এ গানে স্বপ্নভঙ্গের পর্বটি বড়ই করুণ—
‘জাগিয়া উঠিয়া উমা না দেখিয়া
হয়েছি কাতর অতি
সহে না সহেনা বিরহ যাতনা,
আনো মোর হৈমবতী, আনো মোর উমা সতী।‘
এ রকম গীতের সংখ্যা অজস্র, যার অনেক কিছুই হারিয়েও গেছে । এ সব গানের পদকর্তা নিরূপন করা আজ দুরুহ হয়ে পড়েছে । বাংলার তৃতীয় ভুবনে যিনি এ গানের ভাণ্ডারী-সংগ্রাহক এবং রচয়িতা, বলা যায় একচ্ছত্র অধিপতি — সেই স্বাধীনতা সংগ্রামী যতীন্দ্রমোহন দেবলস্করের জন্মের ১২২ বছর এবং প্রয়াণেরও ৩১ বছর অতিক্রান্ত । ১৯৪৩, ৪৪, ৪৬, ৪৭, ৪৮ সালে সিলেটে রামকৃষ্ণ মিশন সেবা প্রতিষ্ঠানের মহারাজ স্বামী সৌম্যানন্দজি, শিলচরে স্বামী পুরুষাত্মানন্দজি ছাড়াও বিশিষ্ট শিলচরের বিশিষ্ট আইনজীবী হেমচন্দ্র দত্তর উৎসাহে যে আগমনী গান তিনি একাধিক আসরে পরিবেশন করেছিলেন এটা এ ভুবনের সংগীত ঐতিহ্যে এক বিশেষ যুগান্তকারী ঘটনাই, এ ইতিহাস আজ বিস্মৃতির দিকে চলেছে । এ প্রসঙ্গে একটি চিঠির উল্লেখ করছি । সিলেট থেকে লিখেছেন স্বামী সৌম্যানন্দজি (২৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৪ সালে):
… “শিলচরে রামকৃষ্ণদেবের জন্মোৎসবোপলক্ষে আপনার স্বরচিত ও সুবিন্যস্ত পদকীর্তন শ্রীশ্রী গৌরীলীলা শুনিয়া খুব আনন্দিত হইলাম। দক্ষযজ্ঞ, গৌরীলীলা ইত্যাদি বিষয়ে কীর্তন এই অঞ্চলে বোধহয় আপনিই আরম্ভ করেন। বহুকাল পুষ্ট আমাদের ভাবধারা আপনাদের চেষ্টায় রূপায়িত হইয়াছে। আমার বিশেষ ইচ্ছা এই সব দেবীলীলা রহস্য দেশে দেশে প্রচারিত হয়…“।
যতীন্দ্রমোহনের দেবীলীলা, আগমনী গানের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের এ পরিচয় স্বামীজি এখানে তুলে ধরেছেন । ওই চিঠিতেই তিনি তাঁকে সিলেটে সংগীত পরিবেশন করার জন্য আমন্ত্রণ করেন । সেই আসরের স্মৃতি ধরে রাখার মতো কেউ তো আজ থাকার কথা নয় । এ সময়ের বিশিষ্ট সংগীত বোদ্ধাদের মধ্যে যাঁরা এ গানের স্বরূপ উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন এরাও আজ আমাদের মধ্যে নেই । অনুজপ্রতীম কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য আগ্রহ ভরে এ আগমনী গানের খবর নিয়েছিল এবং কলকাতার ‘তারা বাংলা’ চ্যানেলে যতীন্দ্রমোহনের গানের কয়েকটি কলিও উচ্চারণ করেছিল । কথা ছিল গানগুলো উদ্ধার করা হবে, কিন্তু তা আর হয়ে উঠল না, বরাক উপত্যকার গৌরবের আগমনী গানের সম্ভার বাংলার অন্যভুবনের শ্রোতার কাছে তুলে ধরা আর হল না । এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, কালিকাপ্রসাদের পরিবারেও আগমনী গানের চর্চা ছিল । ওই পরিবারের শ্যামাপদ ভট্টাচার্য নিজেও আগমনী পর্বের গান রচনা করে গেছেন যার কিছুটা কালিকার সৌজন্য আমাদের শোনার ভাগ্যও হয়েছে ।
এ গানের মধ্যে বরাক উপত্যকার একটা অন্তরঙ্গ ইতিহাস নিহিত রয়েছে যে-ইতিহাস আমাদের নির্বাসিতা ভূমিকে আবহমান বাংলার ঐতিহ্যের সঙ্গে গেঁথে রেখেছে। এ ভুবন নিয়ে বিখ্যাত কবিতাটিতে কবিগুরু লিখেছিলেন– ‘ভারতী আপন পুণ্য হাতে, বাঙালির হৃদয়ের সাথে, বাণীমাল্য দিয়া, বাঁধে তব হিয়া…’। সেই অচ্ছেদ্য বাঁধন ছিন্ন করার শক্তি আজ ঘরেবাইরে সক্রিয়। শারদীয় উৎসবকে কেন্দ্র করে বাঙালির যে বাৎসরিক নবজাগরণের পর্ব ছিল এটাকে ধরে না রাখতে পারলে আমাদের সংস্কৃতি বিজাতীয় প্রভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে, যার কিছু কিছু লক্ষণ আজ একেবারে সুস্পষ্ট ।
❤ Support Us