- ন | ন্দ | ন | চ | ত্ব | র
- মে ৩০, ২০২২
কানে সিরোপা শৌনকের
তরুণ বাঙালি তথ্যচিত্র নির্মাতা পেলেন গোল্ডেন আই

দিল্লির বাঙালি তরুণ পরিচালক শৌনক সেন তাঁর অল্ দ্যাট ব্রিদস ( All That Breathes) এর জন্য কান চলচ্চিত্র উৎসবের সেরা তথ্যচিত্রের পুরস্কার গোল্ডেন আই (L’OEil D’Or or ‘Golden Eye’) পেলেন ।
দিল্লির থেকে দূরের দেহাত ওয়াজিরাবাদের দুই ছেলে মহম্মদ সাউদ আর নাদিম শেহজাদ এক পরিত্যক্ত বেসমেন্টে কষ্টকর কাজ করে জীবিকা চালায়,অথচ তারা আহত বা অসুস্থ পাখি,বিশেষ করে পরিযায়ী কালো-চিল দেখলেই তাকে উদ্ধার করে সেবা ও যত্ন দিতে উদ্যোগী হয়ে ওঠে।
শৌনক সেন এখানে ফ্লাই-অন-দ্য-ওয়াল পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন । এই পদ্ধতিতে নিবিড় ভাবে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে মানুষ,পশুপক্ষী ও পরিবেশের পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হয় দৃশ্য শব্দ ও অন্যান্য উৎসের সহযোগে ও অনুভবের গভীরতায় পৌঁছনো যায়।
তাঁর ক্যামেরা-চোখ ঘটনাপ্রবাহ অনুসরণ করে দেখায় কেমন করে মহম্মদ সাউদ আর নাদিম শেহজাদ ঠাণ্ডা জলের মাঝে জলাশয়ে সাঁতরে আহত পাখিদের তুলে আনে । তারপর ওষুধ দিয়ে ক্ষত সাফাই করে,পট্টি বাঁধে আর খেতে দেয় কত যত্ন ও ভালোবাসায় । দরকার মতো তাদের স্নান করায়,নজর রাখে অন্যান্য দিকেও ।
ফের অন্যত্র খোঁজ পেলেই নতুন পাখি তুলে আনতে ছোটে । সাম্প্রদায়িক অশান্তি, নিরাপত্তার ঝুঁকি বা অর্থের অভাব ঠেকাতে পারে না এমন প্রাণের টানের কাজ ।
শৌনকের এই ৯০মিনিটের মর্মস্পর্শী দ্বিতীয় চিত্র-প্রতিবেদন সাফল্য পাবার আগে শৌনক তাঁর প্রথম তথ্যচিত্র Cities of Sleep(২০১৬) করেও সাড়া জাগিয়েছিলেন, যেখানে রাতের দিল্লিতে শোবার ঠাঁই খোঁজার অভিযান আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছিল । উচ্চ প্রশংসিত হয় সেই কাজও ।
বিভিন্ন মাধ্যমে সত্যি কথা,তথ্য, আলোচনা বা চাক্ষুষ বর্ণনা যেখানে নানা শাস্তি ও অত্যাচার ডেকে আনছে,সেই আবহে এ ছবি বাড়তি প্রশংসা পেয়েছে,বিশেষ করে অন্যান্য তথ্যচিত্রের পরিচালকদের কাছ থেকে । শৌনক বলেছেন যে নিশ্চিত ভাবেই এ ছবি পরিবেশ ও মানুষ-পাখি নিয়ে হলেও,তিন বছর ধরে কাজ চালাবার সময়ে রক্তাক্ত বর্তমানের ছোঁয়া পেতেই হয় । তাই তাঁর মনে হয় এ তথ্যচিত্রের সমালোচনায় কূটকৌশল ব্যবহার করে সতর্ক ভাবে প্রতিক্রিয়া জানানো হবে ।
গত বছর কানে দেখানো তথ্যচিত্র ‘ ইনভিজিবল ডেমনস’ এর পরিচালক রাহুল জৈন বলেছেন, কেন তথ্যচিত্রের পরিচালকদের এত সতর্ক হয়ে বিষয় দেখাতে হবে ও কেমন করে দেখাবে তা ভাবতে হবে ! এ যেন একটা সাপ নিজেকে খেয়ে ফেলছে!…তবে এটাও ঠিক যে কেউ গুলি বা ছুরি খেতে বা তার সৃষ্টির প্রদর্শন নাকচ হতে দেখতে চাইবে না ।
২০১৬ সালে কানে বিশেষ উল্লেখ পাওয়া তথ্যচিত্র ‘দ্য সিনেমা ট্রাভেলার্স’ এর পরিচালক শার্লি আব্রাহাম বলেছেন,ভিন্নমত জানানো কোনও দেশপ্রেমিকের অন্যতম পবিত্র দায় । কোনও সৃষ্টিরই তা থেকে সরে যাওয়া উচিত নয়,বরং যা বলা যায় না,তাকে সৃজনের ভাষার মোড়কে বলা উচিত ।
শৌনকের এই তথ্যচিত্রকেই সেরা হিসাবে বেছে নেওয়ার কারণ হিসেবে ‘ল’ওয়েল ডি‘অর’-এর ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ‘এ পুরস্কার এমন এক ছবিকে দেওয়া হয়েছে যা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে এই ধ্বংসাত্মক দুনিয়ায় প্রতিটি জীবনের মূল্য রয়েছে এবং প্রতিটি ছোট পদক্ষেপই গুরুত্বপূর্ণ । ক্যামেরা হাতে তুলে নিয়েও আপনি একটি পাখির জীবন বাঁচাতে পারেন । একটি ছোট চেষ্টা সার্বিক ভাবে না-হলেও,নির্দিষ্ট একটি ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলতে পারে’ আর্থিক মূল্যে এই পুরস্কারের সঙ্গে শৌনকের ঝুলিতে এসেছে ৫,০০০ ইউরো । ভারতীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ৪.১৬ লক্ষ টাকা ।
এই তথ্যচিত্রের বিশেষত্ব এই যে নিজেদের মনের চাহিদা ও সচেতনতা থাকলে যে অভাবী শ্রেণির মানুষ হয়েও এমন কাজ কোনও প্রচার বা যশের লোভ ছাড়াই একান্ত নিজেদের মতো করে করা যায়,তা তুলে ধরতে পেরেছে । এরা জীবনযাপনের অঙ্গ বলে,পৃথিবীবাসের দায় হিসেবে ও আত্মীয়তার ভালোবাসায় নিত্যদিনের কাজে জুড়ে নিয়েছে এই বাড়তি প্রচেষ্টা । যান্ত্রিক সভ্যতার চাপ,লোভের ভার,হতাশাজনক পরিবেশ ও আলস্যের হাতছানি এড়িয়ে এমন কাজ তাদের আলাদা করেছে । যেখানে নিজেদের জীবন বিপন্ন হতে পারে,সেখানে তা বাড়তি প্রশংসার দাবি রাখে ।
সব মিলিয়ে আশার কথা যে টম্ব অব স্যান্ডস বা রেত সমাধি-র মতো উপন্যাস বা অল দ্যাট ব্রেদস এর মতো তথ্যচিত্র যে সীমানার বাইরে গিয়ে আপন স্বর ছুঁড়ে দিতে পারছে তা আলোর ইশারা দেয় ।
❤ Support Us