শিবভোলার দেশ শিবখোলা
শিবখোলা পৌঁছলে শিলিগুড়ির অত কাছের কোন জায়গা বলে মনে হয় না।যেন অন্তবিহীন দূরত্ব পেরিয়ে একান্ত রেহাই পাবার পরিসর মিলে গেছে।
চিত্র: ধীরাজ চৌধুরী
দীর্ঘদিন পর গ্রামে আসছে শাহনূর। দীর্ঘ বললেও দীর্ঘ নয়। মাত্র দুমাস আগেও এসেছিল। ওর কাছে সময়টা একটু কম হলেও ও যার সাথে বসবাস করে তার জন্য এটা দীর্ঘ সময়।
শাহনূরের অনেক কাজ হাতে কিন্তু কিছু করার নেই । বাড়িতে আসার জন্য আনিসের মন ছুটে গেছে । কি করবে সে।
বয়স যতটা না হয়েছে দীর্ঘ অসুস্থতা তাকে শারীরিক মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে রেখেছে ।
ঢাকা বাসায় রুটিন মেনে চলতে হয় । আগে কিছুটা সময় বাইরে হাঁটাহাঁটি করতে পারতো । বাসার সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে ফট করে বাজারে চলে যেত । ছোট মাছ শাক সবজি কিনে আনতে পারতো কসাইয়ের কাছে মাংসের কথা বলতেই সে অর্ডারের মাংসের চেয়ে অনেক বেশি মাংস বাসায় পাঠিয়ে দিতো ।
আনিস মিন্তির মাথায় বাজার পাঠিয়ে দিতো তিনতলায় । জানে শাহনূর একসঙ্গে এতোগুলা হাবিজাবি বাজার দেখলে হৈচৈ বাঁধিয়ে দেবে । ছেলের বৌ কিছু বলবে না ।
শাহনূরের হৈচৈ শুনে বুঝতে পারে এগুলো অনর্থক কিনেছে ।
শাক তিনপদের এগুলো করে আনা শাক যতটা না খাওয়া হবে বেশিরভাগ পঁচে যাবে । সবজিগুলোর অবস্থাও তাই । ছোটমাছ বাড়ির ছোটরা খেতে পারে না । সেটা সমস্যা নয় ওদের জন্য মুরগি আর বড় মাছ রান্না হয় সমস্যা হলো এই দুইকেজি মলা এককেজি টেংরা কাটবে কে?
ছুটা বুয়ার মাছ কোটার কথা থাকলেও একসঙ্গে এতোগুলা মাছ দেখলে আজই কাজে ইস্তফা দিয়ে ধাপধুপ পা ফেলে চলে যাবে।
কাজের বুয়ার কাজের সময়ও শেষ।
চুপচাপ নিচের চালের দোকানে বসে থাকে । অসময়ে বাজার দেখলে শাহনূরের মেজাজ সপ্তমে চড়ে যাবে জানা কথাই। আনিসকে না পেয়ে নিস্ফল রাগটা চেপে রাখতে রাখতে নিঃশেষ হলে তখনই তিনতলায় যাবে । কারো সাথে কোন কথা না বলে মুখটা গম্ভীর করে সোজা বাথরুমে ঢুকে গোসল সেরে নামাজ শেষে একেবারে ডাইনিং টেবিলে ।
বাটিতে আজকের আনা শাক মাছের পদ থাকে সেগুলো দিয়ে পরিতৃপ্ত রসনা বিলাস সেরে মনে মনে ভাবে শাহনূরকে যতটা দজ্জাল ভাবে আসলে সে মোটেই দজ্জাল নয়।
পুত্রবধূটিও ভাল।
সবাই আনিসকে নিয়ে বেশ চিন্তিত। ওর ডায়বেটিস বেশিরভাগ সময় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। কিডনি সমস্যাও হালকা হলেও ফেলে দেবার মত নয়। নিউরো সমস্যাটা বেশ জোরালো ব্যাথা বেদনাও আছে আর বয়সটাও এসময়ে রিস্ক।
প্রতিদিন তিনবেলা একমুঠো করে ঔষধ মুড়ির মত খেতে হয়।
সবমিলিয়ে ওকে নিয়েই ভাবনা এবং সাবধানতা বেশি।
নাকে মুখে মাস্ক নিয়ে হাঁটতে পারে না কুড়ি মিনিটের বেশি। দোকানেও বসতে পারে না। তাই বেশীরভাগ সময় বাসায়ই থাকতে হয়।
পেপার পড়ে টিভি দেখে আর কাহাতক সময় কাটানো যায়।
অথচ এই আনিসই একসময়ে সারাদেশ ছুটে বেড়িয়েছে ব্যাবসা করেছে।
মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কর্মকর্তা ছিল। সারাদিন মুক্তিযোদ্ধাদের সমস্যা সমাধানের জন্য কাজ করতো।
শারীরিক অসুস্থতার জন্য সেই কাজ আর করতে পারে না।
তাই আনিসকে নিয়ে মাসে একবার গ্রামের বাড়িতে যায়। খুব ভাল থাকে গ্রামের বাড়িতে।
ক্ষেতের চালের ভাত লাউ পাতা ভর্তা নদীর তাজা মাছ গরুর খাঁটি দুধ মাচার ঝুলতে থাকা সবজি পেয়ে খুব খুশি।
ফিরে এসে আবার একমাস খুব খুশি মনে ফুরফুরা থাকে।
শাহনূর গ্রামে এসেও আনিসকে নিয়ে বেশ ঝামেলায় থাকে। সকালে বাড়ির সামনের সড়কে গিয়ে বেশ কিছু মাছ কিনে কাউকে কাউকে দিয়ে দেয়। অনেকের কাছে এমন অঙ্গিকার করে আসে সেটা মেটাতে একটু কষ্ট হয় শাহনূরের শান্তি হয় আনিসের।
এসব কিছু মেনেই এবার আসছে শাহনূর। ওর আাসার উদ্দেশ্য এবার একটাই। সেটা হলো, স্বাধীনতার স্বপক্ষ সংস্থা থেকে মুক্তিযুদ্ধে পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে পঞ্চাশটি গল্প নিয়ে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। লেখক হিসাবে শাহনূরও আছে।
গল্পটা মোটামুটি সাজিয়ে ফেলেছে মাথায়। এটা লেখার তাড়না আছে।
টাংগাইল শহর থেকে বেশ ভেতরে আনিসের গ্রাম যাবে সেখানেই। শাহনূরের বেড়ে ওঠা এই শহরেই। এই শহরটা ছুঁয়ে ওর যত আবেগ আস্তিত্ব না ভোলা স্মৃতি।
সেই স্মৃতিকে কেন্দ্র করেই এবারের গল্প ওর। ও ছুঁতে চায় আবার সেই অমলিন গৌরব আর সুগভীর বেদনা আর কষ্টকে।
ড্রাইভারকে আগেই বলা আছে কোথায় একটু থামতে চায় শাহনূর।
ড্রাইভার জানে যাবার পথেই শাহনূরের কাঙ্খিত জায়গা।
নেমে পড়ে শাহনূর ।
টাংগাইল সার্কিটহাউজের পাশে পানির ট্যাংকের নিচে পড়েছিলেন শফিভাইয়ের অস্তিমজ্জা মাথার খুলি ।
হ্যা এটাই টাংগাইলের বধ্যভূমি ।
১৯৭২ সালের জানুয়ারির এক কুয়াশায় ঢাকা সকালে এসেছিল শাহনূর।
কলেজের বন্ধুরাও ছিল সেদিন। শাহনূর তারপর কতবার এসেছে। পঞ্চাশবার কি হয়েছে এখানে আসা।
অরক্ষিত ছিল জায়গাটা। এবার এতোটাই সুরক্ষিত যে ভেতরে ঢুকতে পারলো না শাহনূর।
গেটের গ্রিলে মাথা ছোঁয়াতেই। শফি ভাই হেসে ওঠে
– পাগলি এতোদিনেও তোর চোখের জল কমলো না। চোখ মোছ। এখন কাঁদছিস কেন?
– তোমার জন্য শফি ভাই তোমার জন্য। তোমাকে ওরা কত কষ্ট দিয়ে মেরে ফেললো। কত যন্ত্রণা হলো তোমার।
–আমরা কষ্ট পেয়েছি বলেই তো তোরা স্বাধীনতা পেয়েছিস। তোরা স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তি করবি।
মাথা ঠেকিয়ে কাঁদতে থাকে শাহনূর।
ওর কাছে সব বলেছে অর্পিতাদি। শফি ভাই যখন অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে অন্তর আত্না ছিঁড়ে চিৎকার করতো। সে চিৎকারে অর্পিতাদির আত্মা কেঁপে ওঠতো ঠিক তখনি অর্পিতাদিকে ছিঁড়েখুড়ে একাকার করে ফেলতো হানাদাররা। একেক রাতে দশ পনরজন। অসহ্য যন্ত্রণায় প্রতি রাতে মরতে মরতেও বেঁচে থাকতো শফি ভাইয়ের জন্য প্রার্থনা করতে।
একদিন রাতে বাথরুমের ভেন্টিলেটর দিয়ে দেখে দুজন হানাদার বাহিনীর সৈন্য পানির ট্যাংকির কাছে শফিভাইকে টেনে হিঁচড়ে ফেলে গেল।
ভেন্টিলেটর ভেঙে বের হয়ে আসে অর্পিতাদি। কাছে এসে দেখে প্রাণহীন শফিভাই পড়ে আছে স্বাধীনতার প্রথম প্রহর দেখার আশায়।
ধরা পড়ে যায় অর্পিতাদি। পুরস্কার হিসাবে স্তন জোড়া দিতে হয়। এটাও স্বাধীনতার অর্ঘ্য ।
শেষ জানুয়ারিতেই চিঠিতে জানিয়েছিল অর্পিতাদি।
তিনি তখন বাবার নামের জায়গায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম লিখে।
কতবছর পার হলো!! তবুও শাহনূরের বুকের অতলে কি গভীর মমতা শ্রদ্ধা আর সম্মানে লেখা আছে দুজন প্রিয় মানুষের নাম!!
– এই বোকা মেয়ে এখনও কাঁদছিস চোখ মোছ। আমি তো তোর কাছেই আছিরে ঠিক তোর অর্পিতাদি যত কাছে। আমরা অল্প কিছু হারিয়ে ছিলাম তোদের বৃহৎ কিছু দেবার জন্য। দিতে পেরেছি তাতেই খুশি। তুই মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী। তুই বুকের ভেতর লালন করিস মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ছড়িয়ে দিচ্ছিস তোর সেই মন্ত্রসিদ্ধ চেতনা তো আমরাই দিতে পেরে ছিরে, এর চেয়ে বড় পাওয়া একজন শহীদদের আর কি হতে পারে রে পাগলি বোন আমার।
শোন তোদের এই পঞ্চাশের খুশিতে আমিও আছিরে।
বলেই হাসতে থাকে শফি ভাই।
সবুজ গেটের লাল বৃত্তে আঙুল দিয়ে চোখের জলে দুজনের নাম লেখে শাহনূর।
গাড়ি চলছে হঠাৎ রাস্তার পাশে ঝোপ হয়ে থাকা ঝিঙে জাংলায় চোখ যায়। অজস্র ফুল ফুটে আছে। সবুজ পাতায় ভরা গাছটাকে প্রায় ঢেকে ফেলেছে হলুদ ফুল। কি অপুর্ব যে লাগছে।
শাহনূর তাকিয়ে থাকে জাংলার দিকে। গাছের কি আনন্দ এই অজস্র ফুল নিয়ে।
ঝিঙেফুলের আনন্দেও কি মিশে আছে অর্পিতাদির আত্মত্যাগ শফিভাইয়ের জীবন দানের মহত্ব ?
শাহনূরের কলজে চিপে রক্ত বের হয় এক খাবলা…
♦–♦♦–♦♦–♦
শিবখোলা পৌঁছলে শিলিগুড়ির অত কাছের কোন জায়গা বলে মনে হয় না।যেন অন্তবিহীন দূরত্ব পেরিয়ে একান্ত রেহাই পাবার পরিসর মিলে গেছে।
সৌরেনির উঁচু শিখর থেকে এক দিকে কার্শিয়াং আর উত্তরবঙ্গের সমতল দেখা যায়। অন্য প্রান্তে মাথা তুলে থাকে নেপালের শৈলমালা, বিশেষ করে অন্তুদারার পরিচিত চূড়া দেখা যায়।
মিরিক নামটি এসেছে লেপচা ভাষার “মির-ইওক” শব্দ থেকে, যার অর্থ আগুনে পুড়ে যাওয়া জায়গা।
15:34