Advertisement
  • গ | ল্প
  • মার্চ ১৩, ২০২২

জোছনাময় ডানার শব্দ

হেদায়েতুল্লাহ
জোছনাময় ডানার শব্দ

অলঙ্করন: দেব সরকার

কমল মানিক  দুভাইকে ডেকে বললেন, আজকাল ভোরের আগে আমার ঘুম ভেঙে যায় ।
বড় কমল বলে, কোন দুশ্চিন্তা আপনাকে গ্রাস করেছে ।
ঠিক তা না ।
তবে—? মানিক তাকায় তাঁর দিকে ।
শরিফমিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন । তাঁরা সকালবেলা বাইরের বারান্দায় বসে কথাবার্তা বলছেন ।উঠোনের আমগাছে একটা দোয়েলপাখি চুপ করে বসে আছে ।সেদিকে তাকিয়ে কেমন যেন স্বগোক্তিরমতো , কদিন ধরে ডানার শব্দ শুনতি পাচ্ছি ।
ঠিক বুঝলুম না তো । কমল বলে ।
শরিফমিয়া আবার নিজের মধ্যে ফিরে আসেন, তোমাদের বোঝার দরকার নেই । যেজন্যি ডেকেছি তাই বলি । এ বছর হজে যাওয়ার নিয়েত করেছি ।
সেতো খুশির খবর । দুজনে বলে ওঠে ।
কমলের বিল্ডার্সের ব্যবসা । মানিক স্কুল মাষ্টার । কমল হয়তো এরকম কিছু আন্দাজ করে, আপনার টাকার দরকার ?
মানিক বলে, আমি দোব ।
তার কোন দরকার নেই তবে একটা পরামর্শ আছে ।
সায়াহ্নবেলায় এসে শরিফমিয়া যেন জীবনের সব লেনদেন মিটিয়ে ফেলতে চান । ইদানীং ফজরের আজানের অনেক আগে ঘুম ভেঙে যায় । ডানার শব্দ উঠোনের দিক থেকে খোলা জানালায় ভেসে আসে । তিনি বিছানায় উঠে বসেন । জানালা দিয়ে বাইরের নিঝুম চরাচরে উঁকি দেন । চাঁদের আলোয় চারদিকে ফুলের সুবাস । কিন্তু কায়া তো দূরে থাক কোন ছায়াও চোখে পড়ে না । একটা অপার্থিব শিহরণে শরীর কেঁপে যায় । আর ঘুম আসে না । বিষণ্ণতা যেন গ্রাস করে তাঁকে । কোথাও খোদার ঘরে হয়তো দেনা থেকে যাচ্ছে । আর এখান থেকে শুরু হয়েছে গল্পের অবতারণা ।
বাণীদের সঙ্গে তোমাদের কোন যোগাযোগ আছে ?  আচমকা কথাকটি বলে ছেলেদের মুখের দিকে তাকান শরিফমিয়া ।তারা দুভাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করে ।আব্বাহুজুরকে আজকে বড় অচেনা মনে হয় ।রোজকার দেখা কোন চেনা ব্যক্তি না ।বনি সম্পর্কে তাঁর ভাগনে  কিন্তু আব্বাহুজুর তার কোন খোঁজখবর করেছেন একথা মনে পড়ে না ।তারা একটু অবাক হয় ।
বিস্ময়ের ধাক্কা কেটে কমল ধাতস্থ হয় ।তবু মনে হয় তাঁর মুখে অগাধ রহস্যের মুখোশ ।সে কোন তল না পেয়ে বলে, এই তো কদিন আগে বাণী আমার কাছ থেকে পঞ্চাশ বস্তা সিমেন্ট নিয়ে গেছে ।দোতলা তুলবে তাই ।
ভালো কথা ।আনমনা হয়ে বলেন ।
ইতিমধ্যে চা এসে গেছে ।তিনজনে চায়ে চুমুক দিচ্ছে এমন সময় মানিক বলে,বনির সঙ্গে কোন দরকার আছে ?
আগে তোমাদের সাথে কাজের কথা সেরে নি ।
দুজনে আগ্রহ ভরে তাকায় ।তিনি চায়ের কাপ নামিয়ে বলেন, সোহাই বাজারে পেট্রোল পাম্পে পাশে ষোলো কাঠা জমির দাম এখুন কত হবে ?
ওই জমি বিক্রি করে হজে যাবেন নাকি ?  বিব্রত গলায় বলে কমল ।
তা এক রকম ।মৃদু হাসেন তিনি ।
জমি বেচতে হবে না ।আমরা তো বলেছি যা লাগে দিতে পারব ।মানিক বলে ।
তোমাদের টাকার দরকার নেই ।
আমরা কোন অসৎপথে আয় করি নি ।কমলের গলায় প্রতিবাদ ।
আমি কি সেকথা বলেছি  ?
তবে ?
হজের জন্যি লিখে দোব ,টাকাপয়সার তরে না ।হজের টাকা আমার তিল তিল করে
জমানো আছে ।চাকরির সময় একপাশে সরিয়ে রেখেছি ।
কাকে লিখে দেবে?  তাঁর স্ত্রী নূরজাহান বেগম সন্দেহ গলায় বলেন ।কখন তিনি খালি কাপ নেওয়ার জন্য পাশে এসে দাঁড়িয়ে আছেন ।
সেকথা উহ্য থাক ।সময়ে জানতি পারবে ।
কমল মানিক আরো ধন্দে পড়ে যায় ।সোহাই বাজারে একতিল জায়গা নেই ।যা মেলে তার আকাশছোঁয়া দাম । রাশভারি শরিফ মিয়ার মুখের ওপর কেউ কিছু বলতে সাহস পায় না ।তারা অপেক্ষা করে, দেখা যাক না শেষ পর্যন্ত কী হয় ।
ছেলেদের সাথে কথাবার্তা বলে মোপেড নিয়ে বাজারে বেরিয়ে যান ।সুভাষ মুহুরির সঙ্গে পাকাপাকি সব সেরে ফেলতে হবে ।জোছনাময় ডানার শব্দ তাঁকে বড় উতলা করে তুলেছে ।
দুপুরবেলা খেতে  বসেছেন, নূরজাহান মুখে আঁচল চেপে বলেন, আজকাল তোমার মতিগতি বোঝা ভার ।
কেন, এ অধমের কী দোষ ! একটু লঘু কণ্ঠস্বর তাঁর ।সুভাষ মুহুরির সঙ্গে সব ঠিকঠাক করে মেজাজ ফুরফুরে ।
ছেলেদের সামনে না হয় গোপন করলে কিন্তু আমাকেও কি আলাদা করতে চাও?
আহা এমন কথা বলছ কেন ?
শ্বশুর তোমার নামে সব সম্পত্তি লিখে দিয়েছে বলে যা খুশি তাই করবে ?
গুম হয়ে গেলেন ।উতলা মনের কোণে যে বেদনার সৃষ্টি তাতে যেন আঘাত পেলেন । এই সময় সিঁড়িতে কার পায়ের আভাস । বড় বৌমা রোজি বোধহয় পান নিয়ে আসছে । তাঁদের কথাবার্তা আর এগোয় না ।
দিবা নিদ্রার আগে অন্য এক ঘোর নামে । মনজুরার মনে কত অভিমান জমে আছে তা কে জানে ।আজকাল সেসব যেন তাঁর ভেতর বড় বেশি ডানা মেলছে । বাড়ির লোকজন ভাবছে তিনি হয়তো কোন রহস্য খেলায় মেতেছেন । আসলে পূর্ব পুরুষের মায়াজাল থেকে মুক্ত হতে চাইছেন ।
এখান থেকে জামিরগাছি দশ কিমি । রোববার সকাল সকাল সেখানে সশরীরে পৌঁছুতে মনজুরা যেন ভুত দেখার মতো চমকে ওঠে,ভাইজান তুমি !
কেন আসতে নেই ?
এতদিন বাদে মনে পড়লো যে ।
কোন রাগ নেই । খোঁচাটা হজম করে নেন ।জীবনের প্রান্তভাগে এসে অন্য এক মোড়ে হাজির হয়েছেন । মৃদু হেসে বলেন,তুই ঠিক বলেছিস । দরকার পড়েছে বলেতো এসেছি ।
কী দরকার ? মনজুরার গলা যেন কঠিন শোনায় ।
একটু বসতে দিবি নে ? এতদিন পরে এলুম ।
যতোই অভিমান হোক, তিনি বড় ভাই ।এ কথায় সে লজ্জা পায়, হ্যাঁ হ্যাঁ ভেতরে এস ।
যত্ন করে তাঁকে ঘরে বসায় ।তারপর বলে,বস ।তোমার জন্যি চা নাস্তা করে আনি ।
সেসব পরে হবে ।আগে শোন ।বাণী কই ?
ওদিকে মিস্তিরির সঙ্গে আছে ।
এবার আমি হজে যাচ্ছি ।
সে তো খুব ভালো খবর ।
শুধু একথা বলার জন্যি আসি নি ।
তবে ? মনজুরা তাঁর দিকে একটু অবাক চোখে তাকায় ।
শরিফমিয়া একটু চুপ করে মনে মনে গুছিয়ে নেন অনেক দিনের এলোমেলো কথা ।তারপর ধীরেসুস্থে বলতে থাকেন ।
সব শুনে প্রবল ভাবে মাথা নাড়ায় মনজুরা আর তার দিকে অসহায় ভাবে তাকিয়ে থাকেন তিনি ।
একটু পরে মুখ খোলে মনজুরা,আব্বাহুজুর যেখানে বঞ্চিত করেছেন সেখানে তুমি দাতা সাজতি এসেচ ?
তাহলি আমার কী হবে ?
তোমার হজে যাওয়া আমি কি আটকাচ্ছি ?
আটকাচ্ছে তো ।
কেন ?
ওই যে ডানার শব্দ—-আমার ঘুম ভেঙে যায়—-।
বুজলুম না তো ।
মনজুরার বিয়ের পর করিম শেখ সমস্ত সম্পত্তি একমাত্র ছেলের নামে লিখে দেন ।শ্বশুরের ভাবনা ছিল তাঁর কষ্টার্জিত ধনে ভাগ বসাবে জামাই—পরের ছেলে ।এসব তিনি গোপনে সমাধা করেছিলেন ।কিন্তু এক ঝগড়ার মুখে ফাঁস করে দেন নূরজাহান ।আব্বাহুজুর তখন আর নেই ।এ তো শুধু বঞ্চনা নয় বাপের বাড়ি  থেকে তার অস্তিত্ব মুছে ফেলা ।অভিমান ভরে তাকিয়েছিল ভাইজানের দিকে । কিন্তু শরিফমিয়ার নীরবতা ভয়ানক আশ্চর্য করেছিল তাকে ।
অনেকক্ষণ কারো মুখে কোন কথা নেই । তখন বনি এসে হাজির । আব্বা বেঁচে  নেই । বাড়ির কাজ সব তাকে দেখাশুনো করতে হয় । রাজমিস্তিরির কাছে ছিল এতক্ষণ । ঘরের ভেতর ঢুকে বলে,মামুজান যে—-!
আয়,কাছে এসে বস ।
তারপর খবর কী মামুজান ? তাঁর পাশে বসতে বসতে সে বলে ।
তোর মায়ের কাছে এসেছি ।
সে তো ভালো কথা ।
কিন্তু তোর মা তো রাজি হচ্ছে না ।
ব্যাপারটা কী ?
আবার সব খুলে বলেন শরিফমিয়া ।সোহাই বাজারে পেট্রোল পাম্পের গায়ে জমিটা দানপত্র করতে চান কিন্তু তার মা রাজি হচ্ছে না । এখন তার মতামত কী ?
সেও মাথা নাড়ে ।মায়ের ওপর কী বলবে ?
সবাই চুপচাপ । বনির দিকে তাকিয়ে, হঠাৎ তিনি নাছোড়বান্দার মতো বলে ওঠেন, আমার একটা শেষ কথা আছে ।
বলুন ।
ভাই বোনকে না যদি মামা ভাগনেকে দানপত্র করে ?
মা ছেলে পরস্পরের মুখের দিকে তাকায় ।এমন কথা তাদের ভাবনায় ছিল না ।একটু যেন বিভ্রান্ত হয় ।তাছাড়া সম্পর্কের এই অঙ্ক খেলায় মনজুরা একটু নরম হয় । বাপ ভায়ের সঙ্গে তার যে মান অভিমানের বৃত্ত, সেই পরিধির ভেতর নিজের ছেলেকে ঢোকাতে চায় না । সে আত্মসমর্পণের মতো বলে, বনির আব্বা নেই । তুমি এখন আমাদের গার্জেন । সেই মতো কাজ কর ।
অশ্র্রু সজল হয়ে ওঠেন শরিফমিয়া । পুণ্যযাত্রার প্রয়োজনীয় পাথেয় যেন জোগাড় করে নিলেন ।
এরপর শুরু হয় গল্পে আরেক অনুচ্ছেদ যা শুধু ল্যাটিন আমেরিকান গল্পকারদের হাতে নয়, এখানেও ঘটে ।
আর সেই ডানার শব্দ নেই । হজ যাত্রার কাজ মসৃণভাবে এগোচ্ছে । তবু এক ভোরে ঘুম ভেঙে যায় । দরজায় খটখট শব্দ । বাইরে জোছনা আর নেই । তবু অস্পষ্ট আলোয় এক ছায়ামূর্তি মাথায় তার ঘোমটা । শরিফমিয়া অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন,তুমি কে গা ?
আমারে চিনতি পারলে না ভাই ? মেয়েলি কণ্ঠস্বর ।
কিন্তু এ সময়ে—-? এবার চিনতে পারেন তিনি ।
বিপদের আবার সময় অসময় কী?
ঠিক আছে, ভেতরে এসে বস ।
শরিফমিয়া আর সালামতমিয়া এক সময় বিডিও অফিসে কাজ করতেন ।রিটায়ারের পরও দুজনের বন্ধুত্ব অটুট ছিল ।তবে সংসারের চাপে আর নিয়মিত যোগাযোগ হয়ে উঠতো  না । বেশ কয়েক বছর আগে ক্যান্সারে মারা যান সালামত মিয়া । শেষ সময়ে শরিফমিয়ার হাত ধরে কিছু বলার চেষ্টা করেছিলেন তিনি । সেসব কথা অস্পষ্ট হলেও বন্ধু কী বলতে চাইছে তা বুঝতে অসুবিধে হয় নি শরিফমিয়ার । সালামতমিয়ার বাড়িটা সোহাই বাজার পেরিয়ে জিরাকপুর । বাজারে যত কাজ । তা পেরিয়ে ওদিকে আর যাওয়া হয় কই! তিনি একটু লজ্জা পান । ইদানীং  পুণ্য অর্জনের জন্যে আবার আকাঙ্খা বেড়েছে । খোঁজ নিতে পারলেন কই ,——খোঁড়া ছেলে আর বিধবা মহিলার কীভাবে দিন কাটছে?
সালামতমিয়ার স্ত্রী রাহিলা বেগমের সেই চেহারা আর নেই । কয়েক মাস আগে বোধহয় শেষ দেখা । ছেলের জন্যে সবে বাড়ির সামনে জেরক্সের দোকান খুলেছে । ওদিকটা বেশ জমজমাট হচ্ছে । একটা নতুন কেজি স্কুলও  চালু হয়েছে । মা ও ছেলের মুখে তখন কী উৎসাহ !
দুচার কথার পর সব কিছু ভেঙে বলে রাহিলা । মুখে তার হতাশা আর যন্ত্রণার ছাপ । ইতিমধ্যে বাড়ির লোকের ঘুম ভেঙে গেছে । তারা একে একে  কখন এসে দাঁড়িয়েছে চারপাশে । কমল হাই তুলতে তুলতে বলে, আপনি থানায় যান নি ?
বড়োবাবু বলেন, এ ব্যাপারে তাঁদের কিছু করার নেই ।
মানিক বল, পঞ্চায়েত প্রধান—?
সে তো অনেক কথা !
এলাকার উন্নতি চাই নইলে বেকার ছেলেরা কোথায় যাবে ? বিশেষ ধনী ব্যক্তি হাতেম তাই এলাকায় একটা রাইস মিল করতে চায় । জায়গাটা তার খুব পছন্দ । এখান থেকে বাইরে চাল সা্প্লাই দিতে বেশ সুবিধে । কাছাকাছি বর্ডারও আছে।
কমল মৃদু গলায় বলে, কোন ক্ষতিপূরণ দেবে না ?
তা নিয়ে কোথায় যাবো ? এখানে আমার অসহায় ছেলে দোকান দিয়েছে । তাছাড়া ওর বাপের নিজের হাতে তৈরি করা ভিটে । এখানে যে মরতে চাই । একদল ছেলে ছোকরা রাতদিন হুমকি দিচ্ছে তাই তো এলাম—।
কথাগুলো বলে রাহিলা এবার থামে । তারপর অসহায়ভাবে তাকায় । বেশ কিছুক্ষণ কেটে যায় । চারপাশের নীরব মুখগুলো যেন তার উত্তর জানিয়ে দেয় ।
রাহিলা চলে গেলে কমল মুখ খোলে, আমি ব্যবসা করি । আপনি নিজেকে এর মধ্যে জড়াবেন না ।
মানিক বলে, স্কুলের চাকরি হলেও পানিতে বাস করে কুমিরের সাথে লড়াই আমাদের সাজে না ।
ইদানীং তাঁর ধোঁয়াশাযুক্ত মতিগতি নিয়ে ছেলেরা সব সন্দিহান । তাছাড়া ভাগনেকে দানপত্র করায় পরিবারের চক্ষুশূল । তাদের কথা আবার অমান্য করা ? উঠোনে নেমে তিনি পায়চারি করতে থাকেন । স্মৃতিপটে অনেক কথা ভেসে এলেও নীরবে পশ্চিম আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন । সকালে সূর্যের দিকে পিঠ করে অনেক দূর অবদি এখান থেকে দেখা যায় ।
বেশ কয়েকদিন কেটে যায় । সময় এগিয়ে আসছে । হজের পাশপোর্ট হাতে পেয়েছেন । প্লেনের টিকিট বাকি । আবার এক গভীর রাতে ঘুম ভাঙে কী সে । ওসব কিছু না । আর কোন দেনার কথা মনে পড়ে না । হয়তো শোনার ভুল । নিজের মনকে সান্ত্বনা দেন । কিন্তু আবার যে জোছনার সঙ্গে ভেসে এল ঘরে । স্বস্থি পাচ্ছেন না । উঠে গিয়ে খোলা জানালায় দাঁড়ান । আর তখন তিনি টের পান শুধু শব্দ নয় এক ছায়ামূর্তি বিশাল ডানা মেলে চকিতে তাঁর উঠোন ছেড়ে কোন অদৃশ্য লোকে মিলিয়ে যায় । সারারাত এক অপার্থিব ঘোরের মধ্যে কেটে যায় ।
সকালে উঠে তিনি ভাবতে থাকেন,রাতের স্বপ্ন কী ইঙ্গিত দিয়ে গেল ? অনেক চিন্তার মধ্যে একটা কথা বার বার ভেসে ওঠে । মৃত্যু শয্যায় একজনের আকুল আবেদন কি শুধু কথার কথা ?এ জগতে তার কোন মূল্য নেই ? কিন্তু একা তিনি কি করতে পারেন ? বাড়ির লোক সব বিমুখ হয়ে আছে । তিনি কি একবার হাতেম তাই সাহেবের সঙ্গে দেখা করবেন ? ছেলেরা কি রাগ করবে ? তিনি তো কোন দ্বন্দ্বের মধ্যে যাবেন না । তার আগে রাহিলার সঙ্গে দেখা করতে হবে । বেচারা বড়ো ভেঙে পড়েছে । বাড়ির লোক সবাই জেগে ওঠে নি । তিনি মোপেড নিয়ে বেরিয়ে পড়েন ।
রাহিলার বাড়ির কাছে এসে তাঁর চক্ষু চড়ক গাছ । এত তাড়াতাড়ি হয়তো এসব কল্পনা করেন নি । রীতিমতো যে ধ্বংসের আয়োজন । কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না । তখন চোখে পড়ে জটলার মধ্যে দাঁড়ানো নেতা গোছের ছেলেটা তাঁর চেনা না ? মোপেড থেকে নেমে একটু এগিয়ে, হ্যাঁ, চাঁদপুর গাঁয়ের দিনুর ছেলে । দিনু সোহাই বাজারে সব্জি বিক্রি করে । বাপের চটিতে মাঝে মধ্যে বসে ছেলে । তিনি হাত ছাউনি দেন,বাবা রবি,শোন ।
তারও ভালো মুখ চেনা । সে এগিয়েএসে বলে,কী কাকা ?
হাতেম তাই সাহেব এখানে আসবেন ?
কোন দরকার আছে ? আমরা তাঁর হয়ে কাজ করি ।
তিনি চুপ করে চারদিকে ভালো ভাবে আরেক বার তাকান। ছেলে ছোকরাদের একটা বড়ো জটলা পাশে বুল ডোজার।কমল মানিকের কথা মনে পড়ে । নিজেকে সংযত করে বিনীত ভাবে বলেন,তিনি তো দিন দুনিয়ার মালিক । অগাধ পয়সা আছে । তাঁর কি জায়গার অভাব হবে ?
কাকা,আপনি কি বাগড়া দিতে এসেছেন ? রবি গম্ভীর হয় ।
কী যে বল ! আমার লোক বল অর্থ বল কোথায় ?
তবে—-?
বিধবা আর এতিমের সম্পত্তি তো !তিনি যদি দয়া করেন ।
ক্ষতি পূরণের কথা শোনেন নি ?
কিন্তু তাই কী সব ?
কেন ?
সাহেবের যেমন জায়গা পছন্দ করার অধিকার আছে তেমনি ওদের ক্ষতি পূরণ না নেওয়ার অধিকার  তো আছে ।
আপনি দেখছি বহুত ক্যাচাল লোক । রাগে গর গর করে রবি । তারপর হাত ইশারা করে চেঁচিয়ে বলে,চালাও পানসি বেলঘরিয়া—-।
ক্রোধেগর্জন করে জেগে ওঠে যন্ত্র-দানব । রবি ওদিকে এগিয়ে যায় । শেষবারের মতো শরিফ মিয়া পিছু ডাক দেন,রবি শোন—।
অনেক বাজে কথা শুনেছি আর না—। সে দাঁড়ায় না ।
আমাকে অন্তত হজে যেতে দাও । তার পেছনে ছুটতে ছুটতে বলেন ।
আমরা কি না করেছি । বিরক্ত রবি বলে ।
কিন্তু ওই যে ডানার শব্দ—-আমার  ঘুম ভেঙে যায়—-
বুলডোজার এগিয়ে আসছে । তার ভয়ানক গর্জনে শরিফমিয়ার কথাগুলো সব চাপা পড়ে যায় ।
রবির পেছনে ছুটতে ছুটতে তিনি বোধহয় বেসামাল হয়ে পড়েন । এক মহাজাগতিক তাড়না তাঁর বাহ্য জ্ঞান লুপ্ত করে । ওদিকে দীর্ঘ প্রতীক্ষায় অস্থির যন্ত্র-দানব ক্ষোভে মানুষের হাত থেকে ছিটকে বেরিয়ে যেতে চায় । ব্রেক কষে তাকে ঠিক সময়ে থামাতে পারে না চালক ।
এরপর যা ঘটে তা ল্যাটিন আমেরিকান গল্পকাররা লেখেন নি । কারণ তা যাদু না আবার বাস্তবও না । কিন্তু অবিশ্বাস করা যায় না ।
কিছুক্ষণের জন্যে জ্ঞান ফিরেছে তাঁর । গভীর জোছনা রাত । নার্সেরা ওদিকে কার্ডবোর্ডের আড়ালে ঢুলছে । এমন সময় ডেটল স্যাভলনের গন্ধ মুছে আতর আর লোবান কে ছড়িয়েছে । আবার সেই পরিচিত ডানার শব্দ । ঘাড় ঘুরিয়ে তাকান । হাসপাতালের গরাদহীন জানালায় ছায়ামূর্তি । তিনি একটু  বিব্রত বোধ করেন । কাঁপা গলায় বলেন,আমার দেনা কি এখনও রয়ে গেছে ?
ছায়ামূ্তি তাঁর মাথার কাছে এসে দাঁড়ায় । তারপর বলে,আমি সেজন্যে আসি নি । আপনি যে নিয়েত করেছেন—
তাকে থামিয়ে দিয়ে তিনি বলেন,এখনো তো প্লেনের টিকিট বাকি ।
তার আর দরকার নেই ।
কেন ?
সেই ছায়ামূর্তি এগিয়ে এসে সস্নেহে তাঁর কপালে পুণ্য চুম্বন এঁকে দেয় । তারপর পরম মমতায় বুকেপিঠে হাত বুলিয়ে বলে,আপনার নিয়েত ভোরের আজানের মতো পবিত্র আর শুকতারার মতো উজ্জ্বল ।
কী যে বলেন ! ভয়ানক লজ্জা পেয়ে যান তিনি ।
আমি একফোঁটা বাড়িয়ে বলছি না । আপনি স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করেছেন । তাই তো খবর দিতে এলাম । আপনার সব কিছু কবুল হয়েছে ।
শরিফমিয়া আবার এক ঘোরের মধ্যে ডুবে যান । ছায়ামূর্তি হাসপাতালের জানালা থেকে ডানা মেলে কোন অদৃশ্য লোকে উড়ে যায় । ওদিকে সাদা ধবধবে বিছানায় শুয়ে নিজেকে ভারশূন্য মনে হয় তাঁর । তিনিও ডানা মেলতে পারবেন যেন । আতর আর লোবানের খুশবু আরো তীব্র হয় । রাত নিস্তব্ধ মধুর আর জোছনা শীতল । তিনি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েন । কোন জাগতিক দায় আর তাঁকে জাগাতে পারবে না ।

 

♦♦–♦♦–♦♦


❤ Support Us
error: Content is protected !!