- গ | ল্প
- এপ্রিল ৩, ২০২২
হাওয়া
ছাড়া পেলেই মুক্তি মেলে না । আসক্তি না কাটলে, স্বাভাবিকভাবে চলে না গেলে ফিরে ফিরে আসতে হয়!

অলঙ্করণ: দেব সরকার
রাস্কিন বন্ডের ‘টোপাজ’ গল্পের সঙ্গে অনেকের পরিচয় আছে । হামিদা নেই কিন্তু হামিদার উপহার করা টোপাজের আংটি রয়ে গেছে এবং এক বর্ষণমুখর রাতে ন্যারেটর দেখলেন, গাছের শাখায় দোল খাচ্ছে হামিদা । সে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একটা কথা বলত—সময়ই চলে যাচ্ছে না শুধু, চলে যাচ্ছি আমি ও তুমি ।
এই গল্প সম্পর্কে জেনে আমার অনেক পুরনো একটা গল্পের (রাস্কিনের গল্পের ঠিক উল্টো) কথা মনে পড়ে গেল । সেই সময়টা অন্যরকম ছিল । গাছ, পুকুর, পাখালি, ঝোপ, বাঁশবন—সব প্রচুর ছিল ।
একদিন দুপুর বেলা, হামিদারই মতো, ষোল-সতেরো বছরের এক মেয়ে ফিরছিল তালবাগান দিয়ে । ছিপছিপে, মাখনের মতো ত্বক, বেলুনের মতো হাত, গা থেকে ঘামের মৃদু সুগন্ধ বেরোচ্ছে । আমি এখানে এসেছি বেশিদিন হয়নি । আমাদের নানা জায়গায় ঘুরতে হয় । একে মুক্তি বলে ভুল করার কোনও কারণ নেই । ছাড়া পেলেই মুক্তি মেলে না । আসক্তি না কাটলে, স্বাভাবিকভাবে চলে না গেলে ফিরে ফিরে আসতে হয়!
‘তোমাকে আগে দেখিনি কেন?’
চাপা হাসি নিয়ে মেয়েটি বলল, আগে দেখলে কী করতেন?
রসবোধ ছিল তার আর হাসি চেপে রাখলে এত সৌন্দর্য হয় আগে জানতাম না ।
বললাম, এই জায়গাটা ভাল নয়, চলো আশুত গাছের তলায় দাঁড়াই ।
‘ভাল নয় কেন?’
আমি বললাম, ও কথা থাক, তোমার নাম কী?
সে বলল, রাবিয়া ।
‘তুমি কি স্কুলে পড়ো?’
রাবিয়া আমার নাম জানতে চাইল ।
আমি বললাম, আমার নামটা সেকেলে, শুনলে তোমার হাসি পাবে ।
সে বলল, হাসব না-হয় । বলো, কী নাম?
বললাম, খোশদেল ।
‘খোশদেল আবার নাম হয় নাকি! দিলখুশ শুনেছি । সত্যিই অন্যরকম নাম ।’ এই বলে সে হাসতে লাগল ।
আমার কিছু বলে ওঠার আগে চলে গেল রাবিয়া । তার নীল ওড়না বাতাসে দুলতে দুলতে মিলিয়ে গেল । একজন লোককে আসতে দেখে আমি ঝোপের দিকে সরে গেলাম । ঝোপ থেকে সারি সারি সুপুরি গাছ দেখা যায় । সেখানকার জগতে এখনও আমার প্রবেশ অবাধ নয় । নবাগতদের স্থান সংকুলান হয় না । তাদের পুনর্বাসন মানে পুনরায় প্রান্তিক হয়ে ওঠা ।
পরদিন দুপুরে রাবিয়া আর এলো না ।
তার পরের দিন বিকালে দেখি কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে হেঁটে যাচ্ছে সে । তাকিয়ে রইলাম তার দিকে, ডাকতে পারলাম না । জীবন যায়, লজ্জা যায় না । স্বভাব যায় না ম’লে । সবই থেকে যায় । বিচারদিবসে সেই মানুষকেই তো ডাকা হবে যে মানুষটা সব রাগ-অভিমান-লজ্জা-ঘৃণা-ক্ষোভ-লোভ ইত্যাদি নিয়ে বেঁচে ছিল । এর অন্যথা হলে তো ভণ্ডুল ব্যাপার ।
সেদিন বৃহস্পতিবার । তালবাগানের কাছে এসে একা দাঁড়িয়েছিল রাবিয়া । আমি তার সামনে আসতেই সে জানতে চাইল, এতদিন কোথায় ছিলাম ।
আমি চুপ করে রইলাম ।
সে বলল, আপনার বাড়ি কোথায় বললেন না তো ।
উত্তরে বলি, অনেক দূর ।
‘এখানে কী করতে আসেন?’
একটু নাটকীয়ভাবে বললাম, যদি বলি তোমাকে দেখতে আসি, তুমি কি খুব রাগ করবে?
খিলখিল করে হেসে উঠল সে । এমন হাসিতেই বোধ হয় চু্নি পান্না ঝরে । নিখুঁত সাজানো ধবধবে দাঁত, লাল ঠোঁট, লম্বা চুল কানের পাশ দিয়ে মুখের ওপর এসে পড়েছে ।
সে বলল, আপনি কী করেন?
‘মানে, আমার উপার্জন কত জানতে চাও?’
হাঁ করে তাকিয়ে রইল রাবিয়া ।
‘এ সব নিয়ে ভেবো না । তোমার বাড়িতে কে কে আছেন ?’
রাবিয়া বলল, আমি আর আমার মা ।
‘আব্বা, ভাই, বোন কেউ নেই?’
‘না’ বলে গুম হয়ে রইল সে ।
তার চোখে দুঃখ ফুটে উঠেছে । সে যে একা, এই কথা তাকে মনে হয় অনেক দিন কেউ মনে করিয়ে দেয়নি । বিশাল উঁচু উঁচু তালগাছের নিচে রাবিয়াকে একটা শিশুর মতোই মনে হল ।
সে আমার গায়ের কাছে সরে এলো । তার ঘামের সঙ্গে ইউক্যালিপটাসের হালকা গন্ধ মিশে রয়েছে । বসন্ত সবে এসেছে, রোদ তাও বেশ প্রখর । রাবিয়ার কপালে ঘাম জমে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে ।
আচমকা তার ডান হাত ধরে বললাম, কাল এই সময় একবার আসতে পারবে, রাবিয়া?
সে হাত ছাড়িয়ে নিল না, কোনও আলাদা উত্তেজনাও দেখা গেল না, শুধু মাথা নেড়ে বলল—আসব ।
রাবিয়া চলে যেতে উদ্যোগী হলে পিছন থেকে তার হাত চেপে ধরে বললাম, এই টোপাজ বসানো আংটিটা আঙুলে একবার পরে দেখো তো ।
সে বিস্ময় প্রকাশ করে বলল, এ আংটি কোথায় পেয়েছেন?
‘এটা আমার মায়ের । খুব শখ ছিল আমার বউকে পরিয়ে দেবেন ।’
রাবিয়া অবাক হয়ে বলল, কেন, তিনি নেই?
‘নেই, নেই, আমরা কেউ নেই গো…’
কাল এসো—বলে আমি মুখ ঘুরিয়ে নিলাম । রাবিয়া আর কথা বাড়াল না, ধীরে ধীরে চলে গেল । শিরশির করে বসন্তের বাতাস বইতে লাগল । তালগাছের ভারী মাথা চওড়া পাতার ভারে দুলে উঠল। নাড়াওয়ালা মাঠে রোদ আরও ছড়িয়ে পড়ল আর কয়েকটি মেঠো পোকা ডানা ছুঁড়ে দিয়ে মাটির গর্তের মধ্যে আশ্রয় নিল । জোড়া ঘুঘু দূর কোনও গাছের ডালের ফাঁকে বসে সাংসারিক কথা সেরে নিচ্ছে বলে সামান্য আওয়াজ হল । আশেপাশে মানুষজন নেই ।
পরদিন দুপুরে তালবাগানে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েছিল রাবিয়া । পরনে ছিল সাদা সালোয়ার আর সেই নীল ওড়না । বাম হাতের আঙুলে জ্বলজ্বল করছিল টোপাজ বসানো আংটি । বারবার ঘাম মুছে যাচ্ছিল সে । চারদিকে তাকিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে সে কি একটু ভয় পেল? মায়ের কাছে কী বলে এসেছে সে? বেলুনের মতো হাত বারবার মাথায় উঠছে-নামছে । ক্রমশ তার মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে ।
ঝোপের ওপার থেকে আমি সবই দেখেছি ।
রাবিয়া চলে গেল ।
মাস তিনেক পরে পশ্চিম মাঠের ধানজমির পাশে জামবাগানের কাছে রাবিয়ার সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে গিয়েছিল । আমি এড়িয়েই যেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সে আমার পথ আটকে দাঁড়াল ।
তার মুখে রাগ; বলল, এরকম করলেন কেন ?
রাবিয়াকে ভয় দেখানোর জন্যে ওর সামনেই অদৃশ্য হয়ে গেলাম । তারপর কালো বেড়ালের রূপ ধরে এলাম, ফেউ হলাম, বেঁজি, চড়ুই পাখি, খরগোশ হয়ে তাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করলাম ।
ঠায় দাঁড়িয়ে রইল রাবিয়া । মিষ্টি রাবিয়া ।
তারপর একটা ঝড়ো হাওয়া হয়ে তার চুল ওলোটপালট করে দিয়ে বয়ে চললাম দূর থেকে দূরে । আমার হাওয়ার শরীরে বেজে উঠল ‘খোশদেল! খোশদেল!’ আর কয়েক ফোঁটা জলকণা ভেসে রইল আমার ভেতরে ।
❤ Support Us