- দে । শ প্রচ্ছদ রচনা
- নভেম্বর ৪, ২০২৫
আজ থেকেই রাজ্যে শুরু ‘এসআইআর’। বাড়ি-বাড়ি যাচ্ছেন বিএলওরা, আপাতত বন্ধ অনলাইন ফর্ম পূরণের ব্যবস্থা। বিরোধিতায় পথে নামছেন মমতা-অভিষেক
আজ থেকে রাজ্যের প্রত্যেক নাগরিকের ঘরে ঘরে পৌঁছে যাবেন নির্বাচন কমিশনের বুথ লেভেল অফিসাররা (বিএলও)। মঙ্গলবার থেকেই শুরু হয়েছে ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন বা ‘এসআইআর’। কমিশনের নির্দেশে ভোটারদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে ‘এনুমারেশন ফর্ম’। এনুমারেশন ফর্মে ভোটারের নাম, ঠিকানা, জন্মতারিখ, মোবাইল নম্বর, বাবা-মা বা অভিভাবকের নাম, এমনকি আধার নম্বরও দেওয়ার জায়গা থাকবে। ভোটারের পুরনো ছবির পাশে নতুন ছবি সাঁটার জন্য আলাদা অংশ রাখা হয়েছে। ফর্মের একেবারে নীচে ভোটারের স্বাক্ষর ও পরে বিএলও-র সই থাকবে। যাঁদের কাছে প্রমাণপত্র আছে, তাঁরা তৎক্ষণাৎ বিএলওকে দিতে পারবেন। না থাকলে পরেও জমা দেওয়া যাবে। বিএলও সেই নথির ছবি তুলে কমিশনের সার্ভারে পাঠিয়ে দেবেন। বর্তমান ভোটারদের এখন কেবল ওই ফর্ম পূরণ করলেই চলবে, যদি তাঁদের নাম বা বাবা-মায়ের নাম ২০০২ সালের এসআইআর তালিকার সঙ্গে মিলে যায়। কমিশন সূত্রে খবর, এসআইআরের ‘ম্যাপিং’ প্রক্রিয়ায় ইতিমধ্যেই রাজ্যের মোট ভোটারের প্রায় ৩২.০৬ শতাংশের তথ্যের মিল পাওয়া গিয়েছে। অর্থাৎ, এ পর্যন্ত প্রায় ২ কোটি ৪৬ লক্ষ ভোটারের নাম বা পারিবারিক তথ্য ২০০২ সালের এসআইআর তালিকার সঙ্গে অভিন্ন পাওয়া গেছে। ‘ম্যাপিং’ বা তালিকা মেলানোর কাজ চলছে জোরকদমে।
নির্বাচন কমিশনের দাবি, এই ‘এসআইআর’ প্রক্রিয়ায় মূল লক্ষ্য ভোটার তালিকার পূর্ণাঙ্গ হালনাগাদ। রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক দফতরের হিসাবে পশ্চিমবঙ্গে এখন মোট ভোটার সংখ্যা প্রায় ৭ কোটি ৬৬ লক্ষ। এই বিপুল সংখ্যক ভোটারের তথ্য যাচাইয়ের জন্য প্রতিটি বুথে নিযুক্ত হয়েছেন বিএলওরা। চলমান ‘ম্যাপিং’ আসলে একটি সূক্ষ্ম প্রযুক্তিগত প্রক্রিয়া। দুই তালিকা— ২০০২ সালের এসআইআর ও চলতি বছরের সর্বশেষ ভোটার তালিকা, পাশাপাশি রেখে মিলিয়ে দেখা হচ্ছে। কোনো ভোটারের নাম যদি দুই তালিকায়ই থাকে, অথবা তাঁর বাবা-মায়ের নাম পুরনো তালিকায় মেলে, তবে তাঁকে চিহ্নিত ভোটার হিসেবে ধরা হচ্ছে। এমন ক্ষেত্রে নতুন করে কোনও নথিপত্র জমা দিতে হবে না। কেবল কমিশনের দেওয়া এনুমারেশন ফর্ম পূরণ করলেই হবে। তবে যাঁদের নামের বা পারিবারিক সূত্রের মিল পাওয়া যাচ্ছে না, তাঁদের ক্ষেত্রে প্রমাণপত্র দেখাতে হবে।
#WATCH | The Second phase of the Special Intensive Revision of electoral rolls has started in 12 States, UTs today. Block Level Officers distribute enumeration forms in 160 -Rashbehari Assembly constituency in Kolkata pic.twitter.com/0FL5iY9OKo
— ANI (@ANI) November 4, 2025
যাঁরা কর্মসূত্রে রাজ্যের বাইরে থাকেন, তাঁদের সুবিধার কথা ভেবেই অনলাইনে ফর্ম পূরণের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। কিন্তু মঙ্গলবার থেকে সেই অনলাইন প্রক্রিয়া শুরু করা যায়নি। রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক দফতরের জানিয়েছে, কিছু প্রযুক্তিগত জটিলতার কারণে আপাতত অনলাইন ফর্ম পূরণ করা যাচ্ছে না। তবে দ্রুত সমস্যার সমাধান হবে, দু’-এক দিনের মধ্যেই অনলাইন পরিষেবা চালু করা সম্ভব হবে বলে। এদিকে, রাজ্যের প্রতিটি বুথে এখন ব্যস্ততা তুঙ্গে। প্রায় ৮০ হাজার ৬৮১ জন বিএলও-র পাশাপাশি অতিরিক্ত ১৪ হাজার কর্মীও কাজে নেমেছেন। তাঁদের দায়িত্ব, প্রতিটি ভোটারের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা। মঙ্গলবার থেকেই বাড়ি-বাড়ি এনুমারেশন ফর্ম বিলি শুরু হয়েছে। কমিশনের তরফে প্রতিটি বিএলওকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রতিটি ভোটারের কাছে তিন-চারবার পর্যন্ত যাওয়া যেতে পারে, যাতে কেউ বাদ না পড়ে। কমিশনের দাবি, ‘প্রতি বুথে গড়ে ১২০০ ভোটার রয়েছেন। প্রতিদিন ১৫-২০টি বাড়িতে গেলেই এক মাসে কাজ শেষ করা সম্ভব।’ বিএলওদের চেনার ক্ষেত্রেও ভোটারদের সুবিধা করে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। কমিশন জানাচ্ছে, যিনি আপনার বাড়িতে আসবেন, তাঁর পরিচয় যাচাই করা যাবে খুব সহজেই। কমিশনের ইসি-নেট অ্যাপে গিয়ে ‘ বুক অ্যা কল উইথ বিএলও’ বা ‘কানেক্ট উইথ ইলেকশন অফিশিয়ালস’ বিভাগে ক্লিক করলেই পাওয়া যাবে নিজের এলাকার বিএলওর নাম, ফোন নম্বর এবং বুথের তথ্য। এছাড়াও, বিএলওর হাতে থাকা পরিচয়পত্রে থাকা কিউআর কোড স্ক্যান করলেও তা জানা সম্ভব। বিএলওদের হাতে থাকবে কমিশনের দেওয়া কিট ব্যাগ, যাতে থাকবে ফর্ম, কলম, নির্দেশিকা, ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম।
এনুমারেশন ফর্মে থাকবে ভোটারের নাম, ঠিকানা, জন্মতারিখ, মোবাইল নম্বর, বাবা-মা বা অভিভাবকের নাম, এমনকি আধার নম্বর দেওয়ার জায়গাও। ফর্মের এক পাশে থাকবে পুরনো ছবি, আর পাশে রাখা থাকবে নতুন ছবি সাঁটানোর জায়গা। ফর্মের নীচে থাকবে ভোটারের স্বাক্ষরের অংশ এবং পরে বিএলওর সই। কমিশন জানিয়েছে, যাঁদের হাতে প্রমাণপত্র রয়েছে, তাঁরা সঙ্গে সঙ্গে বিএলওকে দিতে পারেন। আর না থাকলে পরে জমা দেওয়া যাবে। বিএলও সেই নথির ছবি তুলে কমিশনের সার্ভারে পাঠিয়ে দেবেন। রাজ্যের এই মহাযজ্ঞের গোটা প্রক্রিয়া নিয়ে রাজনীতির অঙ্গনেও শুরু হয়েছে তর্ক-বিতর্ক। শাসক তৃণমূল কংগ্রেস অভিযোগ তুলেছে, এসআইআর ঘিরে রাজ্যে ভয় ও বিভ্রান্তি তৈরি করা হচ্ছে। তাঁদের দাবি, এই অভিযানের মাধ্যমে মানুষের মনে নাগরিকত্ব নিয়ে অযথা সংশয় ছড়ানো হচ্ছে। মঙ্গলবার দুপুরে তাই তৃণমূলের ডাকে কলকাতার রেড রোড থেকে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি পর্যন্ত মিছিলের ডাক দেওয়া হয়েছে। মিছিলের নেতৃত্বে থাকবেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। অন্যদিকে, বিজেপির দাবি, তৃণমূল রাজ্যবাসীর মধ্যে অযথা আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। তাঁদের মতে, এসআইআর একটি নিয়মিত প্রশাসনিক প্রক্রিয়া, যা প্রতি ভোটারের তথ্য যাচাইয়ের জন্য প্রয়োজনীয়।
রাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যেই বুধবার রাজ্যে আসছে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের প্রতিনিধি দল। দলের নেতৃত্বে থাকছেন ডেপুটি নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ ভারতী, সঙ্গে রয়েছেন ডেপুটি সেক্রেটারি অভিনব আগরওয়াল এবং প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি এসবি জোশী। তারা ৩ দিন ধরে উত্তরবঙ্গের ৩ জেলা— কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার এবং জলপাইগুড়িতে গিয়ে বিএলওদের কাজ পর্যালোচনা করবেন। কমিশনের নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী, ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে বাড়ি-বাড়ি তথ্যসংগ্রহ। এরপর ৯ ডিসেম্বর প্রকাশিত হবে খসড়া ভোটার তালিকা। সে তালিকা নিয়ে অভিযোগ জানানো যাবে ৯ ডিসেম্বর থেকে ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত। ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত চলবে অভিযোগ ও যাচাইয়ের কাজ, আর ৭ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হবে চূড়ান্ত ভোটার তালিকা । যদিও বিরোধীদের প্রশ্ন, ২০০২ সালের এসআইআর সম্পূর্ণ করতে যেখানে দুই বছর লেগেছিল, সেখানে এবার এত বিশাল কর্মযজ্ঞ এক মাসের মধ্যেই শেষ করা সম্ভব হবে কীভাবে? কমিশনের জবাব, ‘এখন প্রযুক্তি অনেক উন্নত। প্রতি বুথে গড়ে ১২০০ ভোটার, বিএলওরা প্রতিদিন ১৫-২০টি বাড়িতে গেলেই সময়মতো কাজ শেষ করা সম্ভব।’
সব মিলিয়ে রাজ্যের ভোটার তালিকা সংশোধন এখন প্রশাসনিক অভিযান তো বটেই, এক অর্থে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষণেরও কেন্দ্রবিন্দু। কেউ একে নাগরিক অধিকারের পর্যালোচনা বলছেন, কেউ বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রক্রিয়া। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের বক্তব্য একটাই, আতঙ্কের কিছু নেই। নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য ২০০২ সালের তালিকায় নিজের বা বাবা-মায়ের নাম থাকলেই যথেষ্ট। এমনকি ১১টি সরকারি নথির বাইরেও নাগরিকত্ব প্রমাণে যে কোনো সরকারি প্রামাণ্য দলিল গ্রহণযোগ্য হবে। অন্যদিকে ‘এসআইআর’ কাজ শুরু হতেই রাজনৈতিক দলগুলির বুথ লেভেল এজেন্ট বা বিএলএ নিয়োগ নিয়ে নতুন করে জল্পনা তৈরি হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত মোট ৪১,৮০০ জন বিএলএ-২-এর নাম নথিভুক্ত হয়েছে বিভিন্ন দলের তরফে। তবে কোন দল কত জন এজেন্ট নিয়োগ করেছে, তা গোপন রেখেছে রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক দফতর। উল্লেখ্য, রাজ্যে মোট বুথের সংখ্যা বর্তমানে ৯৪ হাজারেরও বেশ। নিয়ম অনুযায়ী, প্রতিটি বুথে অন্তত ২জন করে বিএলএ থাকলে মোট সংখ্যা দাঁড়ানো উচিত ছিল প্রায় এক লক্ষ আশি হাজারেরও বেশি। কমিশনের আগের তথ্য বলছে, ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত বিজেপি বিএলএ নিয়োগে অন্যদের থেকে এগিয়ে ছিল। দলটি সেই সময় পর্যন্ত ২৯৪ জন বিএলএ-১ এবং ৭,৯১২ জন বিএলএ-২ নিয়োগ করেছিল। অন্য রাজনৈতিক দলগুলির নিয়োগের হার তুলনায় অনেক কম। ফলে এত অল্প সংখ্যক বিএলএ নাম নথিভুক্ত হওয়ায় নাগরিগ মহলে প্রশ্ন উঠেছে— রাজনৈতিক দলগুলির এ বিষয়ে এত অনীহা কেন?
❤ Support Us






