- স্মৃ | তি | প | ট
- এপ্রিল ৭, ২০২৩
বিদায় যুক্তিবাদী প্রবীর, সাক্ষী রইল ‘জ্যোতিষের কফিনে শেষ পেরেক।’
৭৮-এ এসে থমকে গেল বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী আন্দোলনের অন্যতম কারিগর প্রবীর ঘোষের পথ চলা। দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলেন। ইদানীং বাইরে বেরোতেন না। বাড়িতে বসে নিভৃতে যুক্তিবাদের চর্চা করতেন। শুক্রবার দমদমের দেবীনিবাস রোডে নিজের বাড়িতেই তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তে শোকাহত অনুরাগী আর তাঁরই তৈরি সংগঠনের সদস্যরা ছুটে যান। প্রবীর বাবুর মৃত্যুতে যুক্তিবাদী আন্দোলনে সাময়িক শূন্যতা তৈরি হলেও তা সাময়িক। উত্তরসূরীরা তাঁর আদর্শ ও ভাবাবেগকে জাগিয়ে রাখবেন। ভারতের কোনো রাজ্যে এরকম যুক্তিবাদী আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রেও প্রবীরের স্বাক্ষরিত ভূমিকা অনস্বীকার্য। গড়ে তুলেছিলেন ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি। কোথাও ভণ্ড বুজরুকদের খবর পেলেই ছুটে যেতেন। তর্কের পর তর্ক ছড়িয়ে তাদের তাড়াতে বাধ্য করতেন। তাঁর নিয়মিত যুক্তিচর্চা আর আলোচনার অন্যতম কেন্দ্র ছিল কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউস। এখানেই বসে বুজরুক বিরোধী আন্দোলনের কৌশল তৈরি করতেন। এরকম যুক্তি ও বিজ্ঞান সর্বস্ব মানুষ সচরাচর দেখা যায় না। উনিশ শতকে ডিরোজিও এবং বিদ্যাসাগর যে তর্কস্রোতের সূচনা করেছিলেন, তারই সক্রিয় উত্তরাধিকার অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন প্রবীর ঘোষ। জীবনের শেষ দিনগুলোতেও বার বার বলে গেছেন সবই লৌকিক, অলৌকিক বলে কিছু নেই। তাঁর চিন্তার সঙ্গে কর্ম আর মর্মের যোগ ছিল নিরবচ্ছিন্ন। এখানে কোনো ফাঁক নেই। সবই যুক্তিজালে পরিপূর্ণ। তাঁর লেখা ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ সিরিজ পাঠক মহলে একসময় ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছিল। পাঁচ খণ্ডে প্রকাশিত গ্রন্থটি প্রতারণা, বুজরুকি আর ভণ্ডামির বিরুদ্ধে শানিত অস্ত্র হয়ে ওঠে। বিক্রির নিরিখেও এটি এক অতুলনীয় সংকলন। তাঁর লেখা বই ‘আমি কেন ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না’ সাধারণ মানুষকে ভাবিয়ে তোলে। সংস্কৃতি,সংঘর্ষ ও নির্মাণ বইটিতে প্রথাগত রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক ও যুক্তিবাদী আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা কতটা, তা সবিস্তারে ব্যাখ্যা করে গেছেন। তথাকথিত জ্যোতিষশাস্ত্রের উদ্দেশে কামান দেগে লিখেছিলেন ‘জ্যোতিষের কফিনে শেষ পেরেক।’ এছাড়াও ‘যুক্তিবাদীর চ্যালেঞ্জাররা’, ‘পিংকি ও অলৌকিক বাবা’, ‘অলৌকিক রহস্য জালে পিংকি’, ‘গোলটেবিলে সাফ জবাব’–এরকম পুস্তক পাঠক মহলে ব্যাপক সমাদৃত হয়ে ওঠে । দৈনিক সংবাদপত্রেও তিনি নিয়মিত লিখতেন। আমৃত্যু অক্ষুণ্ণ রেখেছেন নিজের অবস্থান। কখনো আপোষ করেননি । যুক্তি আর বিবেকের প্রয়োগে শানিত প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছিলেন তিনি। তাঁকে ‘যুক্তিবাদী প্রবীর’ বলে মুখে মুখে সম্মান জানাত নাগরিক জনসত্ত্বা। গ্রামীণ আর লৌকিক অভ্যাসের ভেতরে ও বাইরে যে সত্যরূপ রয়েছে, তাকে অশেষ মূল্য দিতেন প্রবীর। তাঁর সভা মানেই উপচে পড়া ভিড় আর উষ্ণ বিতর্ক।
প্রবীর ঘোষের জন্ম ১৯৪৫ সালের ১ মার্চ। অবিভক্ত বাংলার ফরিদপুরে। দেশভাগের পর তাঁর পরিবার প্রথমে খড়গপুর, তারপর পুরুলিয়ার আদ্রায় বসবাস করতে থাকে। স্টেট ব্যাঙ্কের কর্মী প্রবীর ঘোষ কলকাতায় চলে আসেন। এবং তাঁর স্থায়ী ঠিকানা গড়ে ওঠে দমদমে। কলকাতা তাঁর প্রাণ প্রাচুর্য আর ভাবনার আমৃত্যু সঙ্গী ছিল। ভবিষ্যতেও তাঁর স্মৃতির সাক্ষী হয়ে থাকবে।
❤ Support Us