Advertisement
  • দে । শ প্রচ্ছদ রচনা
  • অক্টোবর ৬, ২০২৫

দ্রুত শুকিয়ে যাচ্ছে গঙ্গা ! ভয়াবহ বিপদের মুখোমুখি বিশাল উপত্যকা

আরম্ভ ওয়েব ডেস্ক
দ্রুত শুকিয়ে যাচ্ছে গঙ্গা ! ভয়াবহ বিপদের মুখোমুখি বিশাল উপত্যকা

গঙ্গা আর শুধু একটি নদী নয়, দক্ষিণ এশিয়ার জনজীবনের শিরায়-শিরায় জড়িয়ে থাকা এক প্রাণপ্রবাহ। সভ্যতার অক্ষরেখা ধরে যে নদী বয়ে চলেছে হাজার বছর ধরে, সে গঙ্গাই আজ শুকিয়ে যাচ্ছে নজিরবিহীন হারে। শুধু ভারত নয়, এর অভিঘাত পড়তে চলেছে গোটা দক্ষিণ এশিয়ার উপর। বিজ্ঞানীদের মতে, ইতিহাসে এমন হারে গঙ্গার জলস্তর পতনের দৃষ্টান্ত আগে নেই।

হিমালয় থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত গঙ্গা অববাহিকা যুগের পর যুগ ধরে যে বিস্তীর্ণ জনপদের জীবন ও অর্থনীতির উৎস, এই মুহূর্তে তা চরম সঙ্কটে। সাম্প্রতিক গবেষণায় উঠে এসেছে, গত ১,৩০০ বছরের তথ্য খতিয়ে দেখলে দেখা যাচ্ছে, অববাহিকায় সবচেয়ে ভয়াবহ খরা দেখা দিয়েছে বিগত কয়েক দশকে। এবং তা কোনো প্রাকৃতিক পরিবর্তনের মধ্যে পড়ে না, এর মূলে রয়েছে মানুষের যথেচ্ছাচারিতা। জলবায়ুর পরিবর্তন, অনিয়মিত বর্ষা, কৃষি ও শিল্পে লাগাতার জলতোলার ফলে নদীর স্বাভাবিক গতি রুদ্ধ হয়েছে। একদা যে নদী বছরের বারো মাস নৌ-চলাচলের উপযোগী ছিল, গ্রীষ্মে এখন তার বুক খাঁ খাঁ করে। বারাণসী থেকে বহরমপুর— বড়ো নৌযানগুলি মাঝপথেই থমকে যায়। বহু খাল ও কূপ শুকিয়ে গিয়েছে শুষ্ক মৌসুম শুরুর আগেই।

গবেষণা বলছে, হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ গত ২ দশকে এক কিলোমিটার পিছু হটেছে। গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর জেরে হিমবাহগুলো দ্রুত গলে যাচ্ছে। ফলস্বরূপ, বর্ষা ছাড়া বাকি সময় গঙ্গা ও তার উপনদীগুলিতে জলের প্রবাহ কমে আসছে আশঙ্কাজনক ভাবে। এই হিমবাহগুলিকে ‘এশিয়ার জল টাওয়ার’ বলা হয়ে থাকে। সে টাওয়ার ভেঙে পড়ার পথে থাকলে সমতলে ভেসে আসা জলও থাকবে না। তাতেই দেখা দিচ্ছে কৃষিতে বিপর্যয়, খাদ্য উৎপাদনে ধস এবং পানীয় জলের সঙ্কট। বিজ্ঞানীদের আরো আশঙ্কাজনক দাবি, প্রচলিত জলবায়ু মডেলগুলি অতীতে এই রকম হারে গঙ্গার শুকিয়ে যাওয়ার পূর্বাভাস দিতে পারেনি। যার মানে দাঁড়াচ্ছে, মানুষের তৈরি চাপ ও প্রকৃতির প্রতিক্রিয়া নতুন ধরনের সঙ্কট তৈরি করছে, যার ধরন আমরা এখনো পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারিনি।

গঙ্গা-বরাক অববাহিকা বিশ্বের দ্রুততম নিঃশেষ হওয়া জলাধারগুলির অন্যতম। প্রতি বছর ভূগর্ভস্থ জলের স্তর গড়ে ১৫–২০ মিলিমিটার করে নেমে যাচ্ছে। তার উপরে সংযোজন— আর্সেনিক ও ফ্লোরাইড দূষণ। স্বাস্থ্য হোক বা কৃষিকাজ— দু-দিকেই বাজছে বিপদের ঘণ্টা। ফারাক্কা ব্যারেজের মতো প্রকল্পগুলো আবার ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে নতুন পরিবেশগত ও কূটনৈতিক উত্তেজনার জন্ম দিচ্ছে। শুষ্ক মৌসুমে নদীতে প্রবাহ এতটাই কমে গিয়েছে যে, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের বহু অঞ্চলে মাটিতে নুন জমেছে। সুন্দরবনের মত গুরুত্বপূর্ণ জীববৈচিত্র্য অঞ্চল আজ বিলুপ্তির মুখে। কৃষিকাজ ব্যাহত হচ্ছে, গবাদিপশু পালনে সমস্যা দেখা দিচ্ছে। নিত্য ব্যবহারে ব্যবহৃত জলও প্রায় অনুপলব্ধ। ছোটো ছোটো নদীগুলির অবলুপ্তি গঙ্গার ভবিষ্যতের এক ভয়ঙ্কর পূর্বাভাস দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, যদি এমন প্রবণতা বহমান হতেই থাকে, তবে কয়েক দশকের মধ্যেই গোটা অববাহিকার কোটি কোটি মানুষ খাদ্য ও জলের তীব্র সংকটে পড়বেন।

গঙ্গাকে বাঁচাতে চাইলে দরকার একযোগে বৃহৎ পরিকল্পনা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা। খণ্ড খণ্ড প্রকল্প নয়, চাই সামগ্রিক ‘রিভার ম্যানেজমেন্ট স্ট্র্যাটেজি’। এই ভয়াবহতা আটকাতে হলে বিশেষজ্ঞদের মত, অবিলম্বে ভূগর্ভস্থ জলের অসংযত নিষ্কাশন বন্ধ করতে হবে। নদীর জন্য নির্দিষ্ট পরিবেশগত প্রবাহ বাধ্যতামূলক করতে হবে। জলবায়ু মডেলকে আরো বাস্তব ও জটিল মানব হস্তক্ষেপের উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। ভারত, বাংলাদেশ, নেপালের মধ্যে তথ্য বিনিময়, বাঁধ পরিচালনা এবং জলনীতি নির্ধারণে আন্তঃসীমান্ত সহযোগিতা বাড়াতে হবে। গঙ্গা কেবল একটি জলধারা নয়, এটি ভারতীয় উপমহাদেশের সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় এবং অর্থনৈতিক অস্তিত্বের প্রতীক। কিন্তু এখনই যদি ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে ইতিহাস গঙ্গাকে মনে রাখবে শুধুমাত্র ‘ছিল’ বলে।


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!