- দে । শ প্রচ্ছদ রচনা
- অক্টোবর ১৭, ২০২৫
বিচারপতিদের জাল স্বাক্ষর, আদেশনামা! ‘ডিজিটাল গ্রেফতার’ জালিয়াতিতে কোটি টাকার প্রতারণা, স্বতঃপ্রণোদিত পদক্ষেপ সুপ্রিম কোর্টের

দেশজুড়ে ক্রমগত বেড়ে চলেছে ডিজিটাল প্রতারণা। দিন দিন ভয়ঙ্কর রূপ নিচ্ছে জালিয়াতি। এবার সরাসরি নজরে আনল দেশের সর্বোচ্চ আদালত। প্রযুক্তির অপব্যবহারে বিচারপতিদের স্বাক্ষর জাল, সুপ্রিম কোর্টের আদেশের ভুয়ো নথি তৈরি করে প্রবীণ নাগরিকদের ‘ডিজিটালি’ গ্রেফতার দেখিয়ে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে লক্ষ লক্ষ টাকা। সম্প্রতি হরিয়ানার অম্বালায় ঘটে যাওয়া এমনই এক কেলেঙ্কারির সূত্র ধরে শুক্রবার এই ঘটনায় স্বতঃপ্রণোদিত মামলা রুজু করল সুপ্রিম কোর্ট।
অভিযোগ, অম্বালার এক প্রবীণ দম্পতির কাছ থেকে জাল নথি ও ভুয়ো পরিচয়ে সিবিআই এবং ইডি অফিসার সেজে প্রায় ১.০৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় প্রতারকরা। ৭৩ বছর বয়সি সেই মহিলা সরাসরি দেশের প্রধান বিচারপতি ডঃ বি আর গবাইয়ের কাছে চিঠি লিখে জানান, কীভাবে তাঁকে এবং তাঁর স্বামীকে ডিজিটাল গ্রেফতারের ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায় করা হয়েছে। তাঁর দেওয়া তথ্য, নথি ও অভিযোগ খতিয়ে দেখে বিচারপতি সূর্য কান্ত এবং বিচারপতি জয়মাল্য বাগচীর বেঞ্চ এ ঘটনার বিরুদ্ধে শীর্ষ আদালতের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ নিয়েছে। আদালতের পর্যবেক্ষণ, এটা সাধারণ কোনো সাইবার জালিয়াতি নয়। এটি দেশের বিচারব্যবস্থার আস্থার ভিতকে নাড়িয়ে দেওয়ার মতো অপরাধ। বেঞ্চ জানায়, বিচারপতিদের স্বাক্ষর জাল করে এবং আদালতের আদেশের ভুয়ো কপি তৈরি করে নিরপরাধ মানুষ, বিশেষত প্রবীণ নাগরিকদের ভয় দেখিয়ে ডিজিটাল গ্রেফতারের নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এ অপরাধের পদ্ধতি এতটাই সুচারু এবং সুসংগঠিত যে, তাকে আর সাধারণ প্রতারণার খাতায় ফেলা সম্ভব নয়। বরং এই চক্র বিচার ব্যবস্থার মর্যাদা ও গৌরবের প্রতি একটি সরাসরি আঘাত।
ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ অনুযায়ী, ৩ থেকে ১৬ সেপ্টেম্বরের মধ্যে অম্বালার ওই প্রবীণ দম্পতির সঙ্গে একাধিকবার অডিও এবং ভিডিও কলের মাধ্যমে যোগাযোগ করে প্রতারকরা। তারা নিজেদের সিবিআই এবং ইডি আধিকারিক বলে পরিচয় দেয় এবং দাবি করে, ওই দম্পতির বিরুদ্ধে আর্থিক তছরুপ বা মানি লন্ডারিং-এর অভিযোগ রয়েছে। এরপর বিভিন্ন সময়ে আদালতের আদেশ, ইডি-র নথি এবং গ্রেফতারি পরোয়ানার ভুয়ো নথি দেখিয়ে বলা হয়, তাঁদের অবিলম্বে ডিজিটালি গ্রেফতার করা হবে অথবা সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে। ভয় দেখিয়ে একাধিক ব্যাঙ্ক লেনদেনের মাধ্যমে ওই প্রবীণ মহিলার কাছ থেকে মোট এক কোটির বেশি টাকা আদায় করে প্রতারকরা। ওই সমস্ত নথি— যেমন সুপ্রিম কোর্টের আদেশ, বিচারপতির স্বাক্ষর, আদালতের স্ট্যাম্প এবং ইডি-র সিল, সম্পূর্ণরূপে জাল বলে প্রমাণিত হয়। প্রবীণ মহিলা সেই নথিপত্র আদালতের সামনে তুলে ধরলে, বিষয়টির গুরুত্ব বুঝে তৎক্ষণাৎ পদক্ষেপ নেয় শীর্ষ আদালত।
শুক্রবার আদালতের শুনানিতে বেঞ্চ সাফ জানায়, এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সংবাদমাধ্যম এবং পুলিশ রিপোর্টে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এ ধরনের ডিজিটাল গ্রেফতারের নামে প্রতারণার বহু উদাহরণ সামনে এসেছে। ফলে শুধু এই একটি ঘটনার তদন্ত করলেই চলবে না, বরং গোটা দেশজুড়ে এ ধরনের প্রতারণা কীভাবে চলছে, তা খতিয়ে দেখা জরুরি। আদালতের মতে, জালিয়াতি চক্রের উৎস ও পরিকাঠামো খোঁজার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার এবং বিভিন্ন রাজ্যের পুলিশ প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয় ঘটানো প্রয়োজন। এরপরই সর্বোচ্চ আদালত কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সচিব, সিবিআই-এর ডিরেক্টর, হরিয়ানা সরকারের স্বরাষ্ট্র দফতরের প্রধান সচিব এবং অম্বালা সাইবার অপরাধ দফতরের পুলিশ সুপারের কাছ থেকে রিপোর্ট তলব করেছে। শীর্ষ আদালতের নির্দেশ, প্রবীণ দম্পতির অভিযোগের ভিত্তিতে ইতিমধ্যেই করা এফআইআরগুলির তদন্ত কতদূর এগিয়েছে, তা জানাতে হবে। একই সঙ্গে বিচারপতিরা অ্যাটর্নি জেনারেল আর. বেঙ্কটরামানিকেও বিষয়টি পর্যালোচনায় সহযোগিতা করার জন্য অনুরোধ জানিয়েছে।
এ মামলায় সুপ্রিম কোর্টের এই হস্তক্ষেপে স্পষ্ট হয়েছে, বিচার ব্যবস্থার নামে চালানো প্রতারণা, প্রযুক্তির অপব্যবহারে তৈরি হওয়া ডিজিটাল সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে এবার কড়া পদক্ষেপের সময় এসে গিয়েছে। প্রযুক্তি যত উন্নত হচ্ছে, অপরাধীদের হাতিয়ার ততই শাণিত হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে আইনকে কেবল কঠোর হতে হবে না, জনসচেতনতাও বাড়াতে হবে বহুগুণ। অতএব, কেবল প্রবীণ নাগরিক নন, সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের উচিত এ ধরনের প্রতারণার কৌশল সম্পর্কে জানা এবং কোনো রকম ভুয়ো ফোন, অডিও বা ভিডিও কল পেলে অবিলম্বে পুলিশের কাছে অভিযোগ জানানো। আইন এবং বিচারব্যবস্থার ভরসাকে হাতিয়ার করে যারা কোটি কোটি টাকা লুঠ করছে, তাদের বিরুদ্ধে এই জনসচেতনতা-ই হতে পারে প্রথম প্রতিরোধ।
❤ Support Us