Advertisement
  • খাস-কলম
  • নভেম্বর ৩, ২০২১

মানুষের ধর্ম, ধর্মের মানুষ

আরম্ভ ওয়েব ডেস্ক
মানুষের ধর্ম, ধর্মের মানুষ

আরব মনীষী  ইমাম গাজ্জালিকে একবার তাঁর একজন বিশেষ গুণমুগ্ধ জিজ্ঞেস করলেন, মানববিদ্যার এমন কোনো বিষয় কি আছে, যা আপনি জানেন না? বিনম্র গাজ্জালি জানালেন, আমি শুধু এটুকুই জানি যে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যা কিছু দৃশ্য এবং অদৃশ্য সেসবের কিছুই আমার জানা নেই। গাজ্জালির আগে, প্রচীনকালের গ্রিক দার্শনিকরাও এইভাবে তাঁদের জ্ঞানস্পৃহা এবং প্রগাঢ় প্রজ্ঞাকে বিনয়ের আড়ালে ঢেকে রাখতেন।

গ্রিকদের বৈদগ্ধ্যর সঙ্গে মুসলিমদের পরিচয় ও সাদৃশ্য সুবিদিত। মধ্যযুগের ইসলামি পণ্ডিতদের সবচেয়ে বড়ো অবদান, তাঁরা গিক বিদ্যাচর্চার জরাজীর্ণ নিদর্শনের আরবি ভাষা রচনা করে হারিয়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন। একই সঙ্গে  ইহজাগতিক ও ইসলামি বিদ্যাচর্চারও সংহত ভিত তৈরিতে যে-সব দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন, আজও তা প্রায় সর্ববিদ্যার অঙ্গনকে প্রাণিত করছে। এসব বিষয় নিয়ে ইউরোপে বিস্তর গবেষণা হয়েছে, এখনো হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হয়তবা হতে থাকবে।

তুলনাহীন দৃষ্টান্ত

আমাদের প্রায় সকলেরই দুর্ভাগ্য, দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত ইসলামি পরিমণ্ডলে জ্ঞান আহরণের যে ঐতিহ্য, যে পরিসর নির্মিত হয়েছে, তা অনিঃশেষ হলেও এ ব্যাপারে আমরা যথেষ্ট সচেতন নই। ইসলাম জ্ঞানচর্চাকে যে ভাবে যতটা গুরুত্ব দিয়েছে, অন্য কোনো ধর্মে তার নজির মেলা কঠিন। বিদ্যান্বেষণের ক্ষেত্রে কোথাও কোনো সীমারেখা এঁকে দেওয়া হয়নি। জাগতিক ও আধ্যাত্মিক—সবধরনের বিদ্যা ইসলামের অন্বেষার অন্তর্ভুক্ত। এ ব্যাপারে কোরান-হাদিসের অসংখ্য নির্দেশ রয়েছে। তারই একটি, উতলুবুল ইলমা ফরিজাতুন লিল মুসলিমিনা ওয়াল মুসলিমাত (জ্ঞানের খোঁজে ছুটতেই হবে, এটা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার কর্তব্য)। এই পত্যক্ষ নির্দেশ প্রমাণ করছে, জ্ঞানচর্চায় লিঙ্গবৈষম্যের প্রশ্রয় নেই, দ্বিতীয়ত, ইলম (জ্ঞান) শব্দটি ব্যাপক অর্থে প্রযোজ্য। ‘গুহার ভেতরে আলো’ এবং ‘আলোর নিচে আঁধার’ নামে স্বতন্ত্র দুটি নিবন্ধে বিষয়টি নিয়ে আমি কিছুটা আলোকপাত করেছি। আরো বিশদভাবে আলোচনা প্রয়োজন। এ কাজটি বিশেষজ্ঞরা করলে সমাজ উপকৃত হত। কেননা, আমার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে নিজে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল। যা পূর্ণাঙ্গভাবে জানি না, তা নিয়ে বলা বা লেখা একধরনেৰ ধৃষ্টতা। হ্যাঁ একজন সাধারণ মুসলিম হিসেবে, আমার ধর্ম ও সমাজ এবং প্রাসঙ্গিক বিষয়-আশয়কে বোঝার যে চেষ্টা করেছি, সে সম্পর্কে যত্সামান্য বলা হয়ত অসঙ্গত নয়।

একটি মহৎ আমানত

কোরান, হদিস  এবং মহানবি হজরত মুহাম্মদ(স) এর জীনকথা পাঠ করে এই বিশ্বাসই দৃঢ়তর হয়েছে যে, মানবজন্ম পরম স্রষ্টারই রহমত (আশীর্বাদ) এবং একটি মহৎ আমানত (গচ্ছিত সম্পদ)। শব্দটির মর্মার্থ সম্পর্কে আমাদের ধারণা স্বচ্ছ নয। আমরা সাধারণত টাকাপয়সা, ধনসম্পদ জাতীয় সম্পদকেই আমানতের আওতাভুক্ত করে তার প্রকৃত অর্থকে লঘু করে দেখি। কারণ, আমার মানবজন্ম নিরর্থক নয়। তার লক্ষ্য আছে। সমাজমনস্কতা, দায়বদ্ধতা এবং সুবিচারের রাস্তাকে প্রশস্ত ও নির্মল করে রাখার দায়িত্ব আমাদের ওপর অর্পিত। এটাই আমানত-এর নিহিত অর্থ। যে আমানতের অপ্যহার করে কল্যাণমূলক কাজে এর যথার্থ প্রয়োগ করে না, এর পরমপ্রাপ্তির মুহূর্তে তার উন্নততর স্বর্গারোহণ সম্ভব নাও হতে পারে। ইসলাম স্বর্গ ও নরককে— বেহেস্ত ও দোজখকে নানা স্তরে ভাগ করেছে। সর্বোচ্চ স্বর্গের নাম জন্নত-উল ফিরদৌস। স্বর্গকে মোট ৮ ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। ইহজগতের কাজের নিরিখেই আত্মার সশরীর ঊর্ধারোহণের জায়গা ঠিক হবে। নরক একইভাভে নানা শ্রেণিতে বিভক্ত। নিকৃষ্টতম ব্যক্তিকে সীমাহীন কাল জুড়ে কঠিন হাবিয়া দোজখে শাস্তিভোগ করতে হবে।

জীবন মানেই সুহানা সফর

ইসলামের দৃষ্টিতে, নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ঈশ্বর তার বান্দাকে পৃথিবীতে সফরে পাঠিয়েছেন, এবং কোরানে এ ব্যাপারে বলা হয়েছে, সিরু ফিল আরজে– পৃথিবী জুড়ে তোমরা ঘুরে বেড়াও, তোমাদের জন্য এখানে, পথে পথে শেখার এবং দেখার বহু নিদর্শন ছড়িয়ে আছে। শেখার কথা বলার মানে এই নয় যে, শুধু নিজেই শিখব। দেখার নির্দেশের অর্থও একইভাবে আত্ম-সর্বস্বতা থেকে মুক্ত। সফরের কর্মসূচিতে যেমন  দেখতে দেখতে মানুষ শিখতে থাকে, তেমনি শিখতে শিখতে তার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, ইতিহাস চেতনা, এবং সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। জীবন সফরেও তেমনি মানুষ নিরন্তর সমৃদ্ধ হতে থাকে। এই সমৃদ্ধি শুধু নিজের জন্য বরাদ্দ নয়, অন্যের জন্য, এককথায় সমস্ত মানবজাতির জন্য অর্জিত অভিজ্ঞতা ও সম্পদের খরচ অপরিহার্য। এখানে কার্পণ্য বা গাফিলতির অবকাশ নেই। তার ওপর স্রষ্টার আরোপিত সমস্ত দায়িত্ব পালন করতেই হবে। ন্যায়-অন্যায়, সুবিচার ও অবিচারের তফাত চিহ্ণিত করে কোরানে বারবার বলা হয়েছে, সীমা লঙ্ঘন কোরো না। সীমার বাইরে গিয়ে  যে বাড়াবাড়ি করে, সে ক্ষমার অযোগ্য। এ কারণেই বারবার অতীতের ইতিহাস খুঁজে দেখা আর বিশ্বসফরের মূল্য অপরিসীম। সফর মানে নিছক ঘুরে বেড়ানো আর বিনোদন নয়। এই কর্মসূচি ইতিহাস পরিক্রমারই অন্যতম পাঠক্রম।

Islamic-study.png

কল্যাণপ্রসূ ব্যবস্থা

সুষ্ঠু বন্টন ব্যবস্থা যা মূলত কল্যাণপ্রসূ, তার ওপরই ব্যক্তিসত্তার ভালোমন্দ নির্ভর করে। ভালো মানে ইহজাগতিক শান্তি এবং পরলোকের প্রাপ্তি। মৃত্যুর পর পুরস্কার ও তিরস্কার অবধারিত। ভালো কাজের হিসেব নিকেশের ভিত্তিতেই ব্যক্তিস্বরূপের উত্তরণ সম্ভব। মন্দকর্মের পরিণামও একইভাবে সুনির্দিষ্ট। ইসলামে হয়ত, নয়ত জাতীয় সংশয়ের অবকাশ নেই। রহস্যময়তা, দার্শনিকতা বা সন্ন্যাসকেও প্রশ্রয় দেওয়া হয়নি। আদেশ ও নিষেধাজ্ঞা সবই সরাসরি। আক্ষরিক অর্থেই ধর্মের পথ সহজ-সরল (সিরাত-উল-মুসতাকিম) এবং গোটা ধর্মই একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন-ব্যবস্থা (আতমাতুত আলাইকুম নিয়মাতি, ওরা রাজিতু লাকুম ইসলামা দিনা) অর্থাৎ আমার আর্শীবাদ, ইসলাম তোমাদের জন্য পরিপূর্ণ জীবন-পদ্ধতি হিসেবেই সুপতিষ্ঠিত হল। স্রষ্টার নজরে তাঁর সেরা সৃষ্টি মানুষ এক মুসাফির। আর জীবন অতিক্রমণের নির্দিষ্ট রাস্তা (ট্রানজিট) দিযে পরিব্রাজককে দায়িত্ব পালন করতেই হবে। না হলে তার সফর ব্যর্থ এবং ব্যক্তি আত্মমুখী, সংকীর্ণ ও নীতি বর্জিত নিছক একটি জীব হয়ে উঠবে। অদৃশ্য আত্মা এবং অহংময় আত্মতার বিরোধ দেখা দেবে, মানবজন্মের লক্ষ্য অপূর্ণ থেকে যাবে। আত্ম এং আত্মা পরস্পরের পরিপূরক। যে কোনো কাজে উভয়ে সমন্বয় অপরিহার্য। এখানেই মানুষ জীবজগতে ব্যতিক্রম। বিবেক বুদ্ধি, যুক্তি তার বাড়তি আবেগের নিয়ন্ত্রক। বুদ্ধিকে (আকল) মধ্যযুগের মুসলিম তাত্ত্বিকরা নানাস্তরে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, সে বস্তু অর্থাৎ দেহ নির্ভর হলেও তার স্বতন্ত্র চরিত্র আছে। সে সবসময় উত্তরণ চায় এবং তার বিকাশের শেষ নিশানা–শুভবুদ্ধির চূড়ান্ত উন্মোচন। ইবনে সিনা থেকে ইবনে রুশদ পর‌্যন্ত সকলেই এ ব্যাপারে প্রায় একমত।

আত্ম বনাম আত্মা

আত্ম (নফস) এবং আত্মার (রুহ) মধ্যে বরাবরই সংঘর্ষের ঝোঁক আছে। আত্মদেহ অর্থাৎ বস্তু নির্ভর। সন্তান মায়ের গর্ভে আসার অনেক আগেই আত্মার সৃষ্টি। জন্মের পর আত্ম বড়ো হতে থাকে, পারিপার্শ্বিক অবস্থা তার নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে। আত্ম নশ্বর, আত্মা অবিনশ্বর।বস্তুনির্ভরতা এবং বস্তুনিরপেক্ষতা—এই দুই সত্তা নিয়ে ইসলামি চিন্তাবিদরা, নিরপেক্ষ দার্শনিকরা বিস্তর আলোচনা করেছেন। কোরানও এই স্বরূপ নিয়ে নীরব নয়। আকার-ইঙ্গিতে, অথবা সরাসরি দুটি বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে আমাদের ধর্মগ্রন্থে। হজরত মহম্মদ (স) আত্মতাকে অহংহীন, বিনয়ী হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তাঁর মৃত্যুর বহু বছর পর, মুসলিম চিন্তাবিদরা যখন বোধশক্তির ব্যাখ্যা শুরু করলেন, তখন আত্ম এবং আত্মার চুলচেরা বিশ্লেষণ স্থায়িত্ব পেয়ে গেল। ইবনে মাসাকায়ি আত্মার ‘স্বতন্ত্র’ অস্তিত্ব স্বীকার করে বোঝাতে চাইলেন, মাতৃগর্ভেই আত্মর ভেতরে আত্মা অবস্থান করতে থাকে। দেহের প্রাণবায়ু, যাকে আমরা আয়ু বলি, সে যতক্ষণ শরীরে থাকে, ততক্ষণই আত্মা দেহের ভেতরে বিরাজ করে এবং মানুষের বোধশক্তি, জ্ঞান, বিবেককে নিয়ন্ত্রিত করার প্রয়াস অব্যাহত রাখে। প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেলেই আত্মা অবিনশ্বর চরিত্র নিয়ে ভ্রাম্যমান স্ব-অভ্যাসে ফিরে যায়।

বোধশক্তির একান্ত নিয়ন্ত্রক

দেহ যেহেতু অঙ্গপত্যঙ্গ—এরকম নানা বস্তুর সমাহার, সেজন্য এসব নির্জীব হয়ে যাবার পর আত্মা দৃষ্টির বাইরে বিচরণ করতে থাকে। জীবদ্দশায় আত্মতার সঙ্গে তার বসবাস পূর্ব থেকেই নির্ধারিত। সে জ্ঞান, যুক্তি বোধশক্তিকে চালিত করে। এটাই তার ইহজাগতিক ধর্ম। দেহের ভেতর-বাইরে আত্মতা নিজেকে জাহির করতে চায়, তখনই আত্মা বাধা দেয়। নিশ্চিত পথ বজায় রেখে ভুল ও নির্ভুল পথের মধ্যে সীমারেখা তৈরি করে। মানুষ কে নিঃস্বার্থ, সমাজমনস্ক, বৈষম্যহীন, বিচারসম্পন্ন এবং অহংহীন হওযার পরামর্শ জোগায়।  আত্মা সব  অর্থেই নিরহঙ্কারী এবং পরিপূর্ণ মানুষের (ইনসান-উল-কামিল) সঙ্গ দাবি করে। মানুষের মস্তিষ্ককোষ বোধশক্তি দিয়ে নির্মিত। এর দৌলতেই সে নিরন্তর কাজে এবং সৃষ্টির সাধনা ব্যস্ত থাকতে চায়। তার যথার্থ অর্জন ও সঞ্চয় তাকে আশরাফুল মখলুকাতের (ঈশ্বরের সেরা সৃষ্টির) মর্যাদায় উন্নীত করেছে। তার এই উত্তরণ অশেষ। এখানে সে তুলনাহীন, এমনকি জ্যোতি দিযে নির্মিত ফেরেশতা থেকে তার মর্যাদা অনেক অনেক ঊর্দ্ধে। এত কথা বলার একটাই অর্থ, মানুষ যেমন কল্যাণপার্থী, তেমনই কল্যাণোধেরও নির্মাতা। এখানে তার সরব ভূমিকা ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে সমষ্টির সামনে নৈতিকতা ও দায়বদ্ধতার নিদর্শন হয়ে ওঠে।

জাগতিক বিষয় এবং কোরান

কোরানের নৈতিক নির্দেশ আত্ম এবং আত্মা দুপক্ষের জন্যই নির্দিষ্ট। ইহজাগতিক এবং পারলৌকিক কর্তব্যকে সমান গুরুত্ব দিয়ে আত্মকে সংযত এবং আত্মাকে ব্যক্তির বোধশক্তির নিয়ন্ত্রক ও প্রচারক হবার পরামর্শ দিয়েছে। জীবন এবং জীবনোত্তর জীন নিযে এই বিচারবোধ বিস্ময়কর। পারলৌকিক সুখের আশায় ব্যক্তিকে কেবল ধর্মকর্ম নিযে ব্যস্ত থাকতে বলেনি। শতাধিক আয়াতে পরিষ্কার ভাষায়, দৃঢ়তার সঙ্গে বলা হয়েছে, মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতায়, বিচারবুদ্ধিতে, মানবকল্যাণে ও বৈষম্যহীন সমাজগঠনে তোমার ভূমিকা যদি না থাকে, তাহলে পরকালের পথ নিষ্কণটক হবে না। মানুষকে তার প্রতিবেশীর প্রতি, সমাজের প্রতি, দেশের প্রতি দায়িত্ব পালন করতেই হবে। সমাজসংস্কারক হজরত মহম্মদ (স) অপরিহার্য ধর্মকর্মে যেমন নিষ্ঠাবান হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন, তেমনই কাজের ভেতর দিয়ে আমৃত্যু এমনই অখণ্ড আদর্শ স্থাপন করে গেছেন যে, পরিপূর্ণ মানুষ হতে গেলে সমাজব্যবস্থাকে সুদৃঢ়, সুপ্রতিষ্ঠিত করতেই হবে। এরকম কোনো অনুগামীকে তিনি প্রশ্রয় দেননি, যিনি জাগতিক কল্যাণকর্মকে বাদ দিয়ে কেবল নামাজ, রোজা, হজ ইত্যাদি আধ্যাত্মিক কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। জীনযাপনের এই দুই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়য়কেই পয়গাম্বর (স) একে অন্যের পরিপূরক ভেবেছেন। আমৃত্যু সমাজে তাঁর আদর্শ প্রয়োগ করে জানিয়ে গেছেন, সৎ ও কল্যাণকামী মানুষ ছাড়া সুষ্ঠু ও সবল সমাজনির্মাণ সম্ভব নয়। রাষ্ট্রের অথবা দেশের মঙ্গল সমাজের সুস্থতার ওপর নির্ভরশীল। এজন্য শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রয়োজন। এজন্যই তাঁর প্রবর্তিত ধর্মের নাম ইসলাম, যার অর্থ শান্তি অথা স্রষ্টার প্রতি পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ। ইসলামের সমাজগঠনের মৌলিক কাঠামো এই দুটি অর্থকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে।

হিতৈষীর ঘরবাড়ি

ধর্মকর্মের প্রতি অনীহা যেমন ব্যক্তসত্ত্বাকে উদ্ধত ও অহঙ্কারী করে তোলে, ঠিক তেমনই সামাজিক দায়িত্বের উপেক্ষা তাকে আত্মসর্বস্বতার পথে ঠেলে দেয়। তিনিই প্রকৃত পুণ্যবান, যাঁর কাছে ঔদ্ধত্যের প্রশ্রয় নেই। একইভাবে সামাজিক নিরাপত্তা ও সুবিচারব্যবস্থা গড়ার প্রশ্নেও তিনি নিস্পৃহ, নিষ্ক্রিয় থাকতে পারেন না। সাধারণত আমরা দুই ধরনের ধর্মাসক্ত মানুষকে দেখে থাকি, যাঁরা কেবল ব্যক্তিগত পুণ্য অর্জনে ব্যস্ত। সমাজকে নিযে খুব একটা চিন্তিত নন। আবার এমন মানুষও বিরল নন, যাঁরা নিজের আধ্যাত্মিক প্রয়াসের পাশাপাশি সমাজের পরম হিতৈষী বলেও পরিচিত। দুটো কাজই নিষ্ঠার সঙ্গে করে থাকেন। দুর্দিনে, বিশেষ বিশেষ প্রয়োজনে কারো পাশে দাঁড়ালেও যথাসম্ভব প্রচারের আড়ালে থাকতে ভালোবাসেন। অহংবোধ তাঁদের স্পর্শ করার সুযোগ পায় না। ধৈর্য আর সহিষ্ণুতা তাঁদের চারিত্রিক অলঙ্কার। এই ধরনের মানুষই বোধহয় কামিল ইনসান হয়ে ওঠার পথে এগোতে থাকেন।

পূর্ণাঙ্গ মানুষ হয়ে ওঠার জন্য যথার্থ অর্থে ইসলাম নির্দিষ্ট শর্ত আরোপ করেছে এং আত্মম্ভরিতা বিনাশে পবিত্র গ্রন্থটি এতটাই সক্রিয় যে, ১৪৪টি বাক্যে ১৪৪ বার বলা হয়েছে, অহঙ্কারী হয়ো না। এটা ব্যক্তিত্বের উচ্চতাকে খাটো করে দেয়। ঔদ্ধত্য তেমনি সর্বনাশের কারণ হয়ে ওঠে। অহংবোধকে প্রতিহত করার পরামর্শ দিয়ে সমাজসংস্কারক নবি (স) বলেছেন, অহঙ্কার আল্লার পোশাক। অতএব এ বস্তু নিয়ে টানাটানি কোরো না। দ্বিতীয়ত, কারো যদি চুল বরাবর আত্মগৌরর থাকে, সে কখনো জন্নতাসী হবে না। কোরানে সুরা বাকরায় এবং  আরো দুটি আয়াতে পরিষ্কার ভাষায় বলা হয়েছে, হে নবি, আমি তোমাকে পৃথিবীর দারোগা করে পাঠাইনি। সত্য ও মানকল্যাণের আহ্বান করা তোমার কাজ, তোমার ডাকে কে সাড়া দিল আর কে দিল না, তা আমার দেখার বিষয়। অতএব, আমাদের বুঝতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয় যে, স্রষ্টা তাঁর দূতকে যখন দারোগার দায়িত্ব দিয়ে পাঠাননি, তখন আমরা যাঁরা তাঁর অনুগামী, তাদের কনস্টেবল বা হাওলাদারের ভূমিকায়ও দেখতে চান না। অর্থাৎ সমাজরক্ষায়, সংগঠনকর্মে, বিলকুল বাড়াবাড়ি নয়, শান্তিতে, সহিষ্ণুতা বজায় রেখে আদর্শ প্রচার করতে হবে।

পরিধি অসীম, সার্বজনীন

সত্য আর মানবকল্যাণের ওপর ইসলাম অশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে। সত্য বলতে কি শুধু মিথ্যার বিপরীত অর্থকে বোঝাব? না ব্যাপক, বিস্তৃত তার পরিসর? আমি ইসলামকে যেভাবে, যতটা বোঝার চেষ্টা করি, তাতে মনে হয়, তার ঘোষিত আদর্শ বিশেষ কোনো সম্প্রদায়, জাতি, বা ভৌগোলিক মানচিত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তার পরিধি অসীম, সার্বজনীন ও চিরন্তন। একইভাবে মানবকল্যাণও সম্প্রদায়ের গণ্ডিতে আবদ্ধ নয়। ইসলামি ভাবাদর্শের লক্ষ্য, বৈষম্যহীন, সাম্যনির্ভর, যুক্তি ও বিবেকমুখী এমন এক সমাজব্যবস্থা, যেখানে প্রতিটি মানুষ পরস্পরের বন্ধু, যেখানে চিন্তার দৈন্যের কোনো অবকাশ নেই। উন্নয়নের পথে, শান্তির রাস্তায় দারিদ্র‌্য যেন কখনো অন্তরায় না হয়, আত্মতা অহংমুক্ত হয়ে ভ্রাম্যমান আত্মার মতো যুগযুগব্যাপী সমস্ত মানুষের স্মৃতির সরণি দিয়ে হাঁটতে থাকে, যেন পরিপূর্ণ চেহারা গড়ে ওঠে মনুষ্যত্বের। এক্ষেত্রে কোরানের বাণী এতটাই সুস্পষ্ট যে, সমস্ত মানুষ একই পিতামাতা থেকে সৃষ্ট। অন্য একটা আয়াতে আরো পরিষ্কার বলা হয়েছে, গোটা মানবজাতিই আমার একই পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। তার মানে কি এই নয় যে, জাতিধর্ম নির্বিশেষে সবার জন্য তাঁর কল্যাণচিন্তা ও উৎসমুখ খুলে দিতে চায়  শান্তিমুখী ইসলাম!

একটি বিশেষ কাহিনি

প্রাসঙ্গিক একটি কাহিনি দিয়ে এই লেখা শেষ করছি। হজরত মুহাম্মদ (স) তখন নবজাগ্রত আর রাষ্ট্রের পশ্নহীন অধিনায়ক—বিনয়ী, নিরহঙ্কারী এবং যুদ্ধবিরোধী বলে সুপরিচিত—বিভিন্ন সম্প্রদায়কে নিয়ে সঙ্ঘ তৈরি করে রাষ্ট্র চালাচ্ছেন— রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি নৈতিকতা ও বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা। বিশেষ প্রয়োজনে একসময় একজন ইহুদির কাছ থেকে কিছু টাকা ধার করেছিলেন। অর্থাভাবে পরিশোধ করতে দেরি হচ্ছিল। ঋণদাতা বারবার এসে ফিরে যাচ্ছিল। একদিন বিরক্ত হয়ে সাহাবাদের (অনুগামীদের) সামনেই নবিকে (স) লোকটি রীতিমতো অপদস্থ, টানাহেঁচড়া করতে থাকে। সহিষ্ণু পয়গাম্বর (স) নিরুত্তর, শান্ত। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর অন্যতম সেরা শিষ্য হজরত ওমর ফারুককে (রা) বললেন, ওর ঋণটা মিটিয়ে দাও।

নবির সামনে পেছনে, চারপাশে অনেকেই ছিলেন। তাঁরই নেতৃত্বে পরিচালিত হয় নির্মীয়মান রাষ্ট্র। ইচ্ছে করলে ক্ষমতা প্রয়োগ করে ঋণদাতাকে বিপর্যস্ত, এমনকি দেশছাড়া করতে পারতেন। করেননি। সহিষ্ণুতা প্রদর্শন করে সহযোগীদের বোঝাতে চাইলেন, জনগণ তাঁর হাতে রাষ্ট্র-ক্ষমতা তুলে দেয়নি, অর্পণ করেছে সমাজসেবা ও অহং অবসানের দায়িত্ব।

একটি ভুল বিশ্বাস এই দেশে, বিদেশেও অনেকের মধ্যে চালু আছে যে, হজরত মহম্মদ (স) অস্ত্রের জোরে ধর্মপ্রচার করেছেন। আমৃত্যু যুদ্ধই চালিয়ে গেছেন। নির্মল ইতিহাস পাঠে আমাদের অনীহা এতটাই প্রবল যে, অসত্যকে সত্য বানিয়ে দিতে চাই। গুজব আর রটনার অবাস্তবকে বাস্তবের চেযে বেশি গুরুত্ব দিই। ইসলামের ইতিহাসের প্রাথমিক উপাদান একটু খতিয়ে দেখলেই জানা যাবে, পয়গাম্বর (স) কখনো ধর্মযুদ্ধ করেননি। আগবাড়িয়ে কখনো কোনো গোষ্ঠী অথবা সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণের দৃষ্টান্ত নেই তাঁর ঘটনাবহুল জীবনে। যখন সমাজ, দেশ এবং সাধারণ মানুষ আক্রান্ত হয়েছে, তখনই পরিত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে জানিয়ে দিয়েছেন, যুদ্ধ নয়, শান্তি তাঁর প্রবর্তিত ধর্মের একমাত্র অভিমুখ।


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!