- খাস-কলম
- জুলাই ১৯, ২০২১
চেনা ছক ভেঙে বিনোদনের হোম ডেলিভারি
এই লকডাউনের ঠাণ্ডা বাজারেও সিনেমাখোর মানুষের মনে ঝড় তুলেছে গুলাবো সিতারো, শকুন্তলাদেবী। শহর গঞ্জের সিনেমা হল, মাল্টিপ্লেক্সের বক্স অফিসে মাছি বসছে তো থোরাই কেয়ার।
দুনিয়া রসাতলে যাক, প্রিয় ছবিটির ওপেনিং ডে’র ওপেনিং শোয়ের টিকিট একটা চাই-ই চাই। ফলে ছবির ‘শুভ মুক্তির’ দিন বক্স অফিসে হুড়োহুড়ি, ঠেলাঠেলি, এমনকী হাতাহাতি। কিছুদিন আগেও এমন দৃশ্য বিরল ছিল না মোটেই। করোনার ধাক্কায় এই চেনা ছবিটাই পাল্টে গেল রাতারাতি। হঠাৎ হারিয়ে গেল সিনেমা হলের সামনে সেই গোঁত খেয়ে থাকা উসখুস ভিড়, শো শুরুর আগে ও পরে মানুষের ব্যস্ত আনাগোনা, ইন্টারভেলে চা, কফি, পপকর্নের স্টলে অসহিষ্ণু জটলা। এ এমন এক অদ্ভুত সময়, যখন অদূর অতীতের নীরব সাক্ষী হয়ে ধুলোয় ধুলোয় জীর্ণ ছেঁড়া পোস্টার, ব্যানার গায়ে সেঁটে, কোলাপসিবল গেটের ঝাঁপ ফেলে জনমানবশূন্য বক্স অফিসকে সঙ্গী করে শুধু দাঁড়িয়ে থাকে সিনেমা হলের নিষ্প্রাণ অট্টালিকা। দৈত্যাকৃতি সুবিশাল মলের মাল্টি স্ক্রিন মুভি থিয়েটারে রাত-দিন শ্মশানের স্তব্ধতা। কোনও জাদুমন্ত্র বলে যেন হঠাৎ থমকে গেছে সব ব্যস্ততা। যার জেরে টান পড়েছে অসংখ্য মানুষের রুজি-রুটিতে। সিনেমার প্রযোজক, পরিচালক, কলাকুশলী, টেকনিশিয়ান থেকে শুরু করে হল মালিক, হলের কর্মী, মায়কি সিনেমাপ্রেমীদের রসনাতৃপ্ত করে দু’পয়সা কামানো সিনেমা হলের চারপাশে গজিয়ে ওঠা ছোট ছোট স্টলও। সবার লাটে উঠেছে রোজগার। ক্রমশ স্ফীত হচ্ছে লোকসানের অঙ্ক। স্বাভাবিক কারণেই এই রুদ্ধশ্বাস অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজছে সবাই। আর এই মরিয়া প্রচেষ্টার সূত্র ধরে মাথা তুলেছে স্বার্থের সংঘাত। একদিন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বানিজ্য করেছেন যাঁরা, তাঁরাই একে অপরের দিকে চাইছেন আড়চোখে।
এই লকডাউনের ঠাণ্ডা বাজারেও সিনেমাখোর মানুষের মনে ঝড় তুলেছে গুলাবো সিতারো, শকুন্তলাদেবী। শহর গঞ্জের সিনেমা হল, মাল্টিপ্লেক্সের বক্স অফিসে মাছি বসছে তো থোরাই কেয়ার। অমিতাভ বচ্চন, অভিষেক খুরানার ‘গুলাবো সিতারো’ এবং বিদ্যা বালান অভিনীত ‘শকুন্তলাদেবী’ সহ একঝাঁক ছবি মুক্তি পেতে চলেছে ওভার দ্য টপ (ওটিটি) প্ল্যাটফর্মে। এই তালিকায় আছে অনুরাগ কাশ্যপ ও নাওয়াজ উদ্দিন সিদ্দিকির ‘ঘুমকেতু’, ইরফান খানের শেষ ছবি ‘আংরেজি মিডিয়াম’ এবং ‘পেঙ্গুইন’, ‘ল’, ‘ফ্রেঞ্চ বিরিয়ানি’র মতো বেশ কয়েকটি বহু প্রতীক্ষিত দক্ষিণী ছবি। যাকে বলে, বিনোদনের হোম ডেলিভারি। ঘরবন্দির পানসে সময়ে টাটকা বিরিয়ানির ভুড়িভোজ। প্রাইম ভিডিও, নেটফ্লিক্সে ক্লিক করে গোগ্রাসে গেলার জন্য মুখিয়ে আছেন সিনেমাপ্রেমী মানুষ। আর এতেই প্রমাদ গুনছেন হল মালিকরা। অনলাইন প্ল্যাটফর্মে একাধিক ছবির মুক্তি প্রতীক্ষা আদতে তাঁদের চোখের সামনে ভবিষ্যতের অন্ধকারটাই আরও ঘন করে তুলেছে। এঁদের অনেকেই মনে করছেন, করোনা ঝড়ে হারানো জমিটা দ্রুত দখল করে নিচ্ছে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম। অনলাইন জোয়ারে হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে বাজার।
সারা বিশ্বজুড়ে এ যাবৎ অনুসৃত রীতি ভেঙে ওটিটি প্ল্যাটফর্মে ছবির মুক্তি নিয়ে রীতিমতো ক্ষোভ প্রকাশ করেছে আইনক্স কর্তৃপক্ষ। এক দীর্ঘ বিবৃতিতে আইনক্স জানিয়েছে, এ হেন পদক্ষেপে তারা যারপরনাই ‘অসন্তুষ্ট ও হতাশ’। বিবৃতিতে বলা হয়, সিনেমা (হল) এবং ছবি যাঁরা তৈরি করেন তাঁরা পারস্পরিক লাভজনক সম্পর্কে জড়িত। একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। এই সংকটময় সময়ে, যখন পরস্পরের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলচ্চিত্র শিল্পকে বাঁচানোর চেষ্টা করা দরকার, তখন একাংশের সেই চিরাচরিত সম্পর্ককে গুরুত্ব না দেওয়ার বিষয়টি বেদনাদায়ক। ওটিটি প্ল্যটফর্মের দিকে ঝোঁকা চলচ্চিত্র প্রযোজকদের ‘সুখের পায়রা’ বলে বর্ণনা করে এমনকী এর পাল্টা প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ করারও হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে বিবৃতিতে। তবে একে বড় একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না বলিউড। একাধিক বিশিষ্ট পরিচালক, প্রযোজক এবং অভিনেতা-অভিনেত্রী ছবির অন লাইন রিলিজকে সময়ের চাহিদা বলেই মনে করছেন। যেমনটা বলেছেন পূজা ভাট। নিজের টুইটার হ্যান্ডলে তিনি বলেছেন, ‘প্রশ্নটা হল মুভি থিয়েটার ছবি চালায় না ছবি থিয়েটারকে চালায়? কনটেন্ট বা ছবিটাই আসল, প্ল্যাটফর্মটা সেকেন্ডারি। লাভের চেয়ে মানুষের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চয়ই বড়। আমরা আমাদের দর্শকদের জন্য যদি সত্যিই ভাবিত হই, তাহলে আমাদের উচিত ছবিটা তাঁদের কাছে পৌঁছে দেওয়া। যতক্ষণ না আমরা দর্শকদের সুরক্ষার গ্যারান্টি দিতে পারছি, ততক্ষণ তাঁদের মুভি দেখতে হলে আসার জন্য প্রলোভিত করা কোনও কাজের কথা নয়।’
ঠিক একই ভাবনা প্রতিফলিত হয়েছে প্রডিউসার্স গিল্ড অব ইন্ডিয়ার ভাষ্যে। আইনক্স হুমকির জবাবে এক ততোধিক দীর্ঘ বিবৃতিতে গিল্ড বলেছে, এক অভূতপূর্ব সময়ের মধ্যে দিয়ে আমরা যাচ্ছি। একাধারে বৃহত্তর মানব সমাজের সুস্বাস্থ্য এবং অর্থনৈতিক সংকটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছি আমরা। চলচ্চিত্র শিল্পের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন স্তরের হাজার হাজার মানুষের জীবন ও জীবিকা এক এক ঘোর অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। এ এমন এক সময় যখন সিনেমা হলের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে এক অনির্দিষ্টকালের জন্য। কবে আবার তা চালু হবে এবং চালু হলেও দেশের সব রাজ্যে একসঙ্গে ছবি মুক্তির সুযোগ পাওয়া যাবে কি না, সোশ্যাল ডিসটেন্সিং মেনে কত সংখ্যক দর্শককের সামনে প্রদর্শিত হতে পারবে বিপুল অর্থ ও পরিশ্রমে নির্মিত সে সব ছবি, সবটাই এখন অনিশ্চয়তার অন্ধকারে। অন্যদিকে, নির্মীয়মাণ ও সদ্য নির্মিত ছবির প্রযোজক সংস্থাগুলিকে প্রতিদিন বিপুল লোকসানের অঙ্ক গুনতে হচ্ছে। এই কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কোনো বিরূপ অবস্থান গ্রহণ করলে তা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করবে বলে গিল্ড মনে করে। বিবৃতিতে এমন কথাও বলা হয়েছে, স্বাভাবিক অবস্থা ফিরলে ফের ছবি ফিরবে চিরাচরিত প্রদর্শন রীতিতে। তবে সংশ্লিষ্ট পর্যবেক্ষক মহলের বক্তব্য, করোনা ঝড়ে এক ঝাটকায় বেসামাল বিনোদন বাজারের যে জমিটা নিজের দিকে টেনে নিল ওটিটি প্ল্যাটফর্ম, ভবিষ্যতে সেখান থেকে তাকে উৎখাত করা কঠিন। ভারতে ভিডিও স্ট্রিমিং ব্যবসা ২০২১-এ নয় নয় করে ১২ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছে যাবে বলে পূর্বাভাস বিশেষজ্ঞ মহলের। তাঁদের মতে, ২০২১-এ দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে সাড়ে ৭৩ কোটি। ফলে সস্তায় বিনোদনের অনলাইন ডেলিভারির রাস্তাটাও, বলা বাহুল্য, উত্তোরত্তর আরও সুগম হবে। মহার্ঘ মুভি থিয়েটারের বক্স অফিসে লাইন না দিলেও চলবে, মুঠোফোনে যখন মিলে যাচ্ছে উত্তেজনায় টান টান ওয়েব সিরিজ আর টাটকা সিনেমার মুখরোচক স্বাদ।
❤ Support Us