- স্মৃ | তি | প | ট
- এপ্রিল ২৪, ২০২১
আমাদের পরমাত্মীয়

আরম্ভ আর্ট গ্যালারির সূচনায় । আলোকচিত্র: অভিজিৎ মন্ডল।
বুধবার। সাড়ে এগারোটা বেজে গেছে। অফিস রুমে ব্যস্ত সবাই। সিডিউল অনুযায়ী কাজ নিয়ে যে যার ডেস্ক-এ। আমার হাত মাউসের স্ক্রলবারের ওপর। তর্জনী দিয়ে চাকা ঘোরাচ্ছি। স্ক্রিনে ভেসে ওঠা কয়েকটা শব্দের ওপর নজর আটকালো। ক্লিক করতেই মনিটর জুড়ে ভেসে উঠলো, কবি শঙ্খ ঘোষ প্রয়াত। খবরটা সবাইকে বলার জন্য মাথা ঘোরাতেই, দেখলাম আমার কলিগরাও ততক্ষণে নিউজটা ফলো করছেন।
আরম্ভ পরিবারের সদস্যদেরা প্রায় কমবেশি সকলেই কবির সঙ্গে পরিচিত। শুনেছি, পত্রিকা যাত্রার প্রথম দিন থেকেই কবি ছিলেন আমাদের শুভাকাঙ্ক্ষী। পরম বন্ধু। মুহূর্তে এক মন খারাপের হাওয়া নেমে এলো অফিস ঘরে। সবাই নিশ্চুপ। কেউ রা কাড়ছে না। মাথার উপর শুধু পাখা ঘোরার টক টক শব্দ কানে ভাসছে। স্তব্ধতা ভেঙ্গে আমিই অস্ফুটে বলে ফেললাম—আমি আর দেখতে পেলাম না! কত বছর আগে থেকে সশরীরে কবি শঙ্খ ঘোষ কে একবার চাক্ষুষ দেখার ইচ্ছেটা সন্তর্পনে লালন করে আসছিলাম মনে। বছর দুই আগে ওঁর জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে আমাদের সম্পাদকের সঙ্গে ওঁর বাড়িতে যাওয়ার একটা সুযোগ এসেছিল। দুর্ভাগ্যবশত হয়ে ওঠেনি। আশাবাদী আমি, ভেবেছিলাম কোন একদিন নিশ্চয়ই কবিকে সামনে থেকে দেখার ইচ্ছাটা পূরণ করব। হায়, সব পথ বন্ধ হয়ে গেল।
গতবছর অসুস্থ হয়ে কবি যখন হাসপাতালে, স্যার বলেছিলেন, ‘শঙ্খ বাবু দ্রুত সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে আসবেন। হি ইস অ্যা রিয়েল ফাইটার। প্রবল জীবনী শক্তির অধিকারী শঙ্খদাকে ঘিরে থাকে আমাদের সকলের শুভ কামনা। ওঁর কিছু হতেই দেবো না। ঠিক তাই, সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেন কবি। আমাদের সকলের মনে প্রশান্তির হাওয়া বইল।
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে হঠাৎ অন্য মনস্ক হয়ে পড়েছি, চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে, অফিসের ঘর ছেড়ে আমার মন তখন ফ্ল্যাশব্যাকে ফিরে গেছে। প্রায় দু’দশক আগে মধ্য কলকাতার রোডের পাশে উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল বাড়িটায় টিফিন শেষে স্কুল বসার ঘন্টা বাজিয়ে দিলেন বিপিন দা। হৈ হৈ করতে করতে ছেলেমেয়েরা যে যার শ্রেণিকক্ষে ঢুকে পড়ল। আবার শুরু পঠন-পাঠন।
একাদশ শ্রেণির হল ঘরটার ছেলেমেয়েরা এখনও চঞ্চল। বাইরে থেকে চাপা স্বরের কথাবলার আওয়াজ হাওয়ায় ভাসছে। ক্লাস ইলেভেনে উঠে ছেলেমেয়েগুলো নিজেদের অনেকটা লায়েক ভাবতে শুরু করে দিয়েছে। ক্লাসে স্যার আসতে দেরি করায়, নিজেদের মধ্যে গল্পগুজোব করে চলেছে। আমিও যথারীতি পাশে বসা আমার সহপাঠীর সঙ্গে গল্পে মশগুল। মিনিট দশেক পরে মনোরঞ্জন স্যার ঢুকলেন। উস্কোখুস্কো চুল। ফর্সা, টিকালো নাক। চোখে পুরু চশমা। হাতে একটা বই। আমরা সবাই তাঁকে একটু বেশিই সমীহ করি। কারণ ওঁর ক্লাসেই আমরা বৈষ্ণব পদাবলিতে রাধার কী হইল অন্তরে ব্যাথা — প্রেমরসের আখ্যানে ডুব দিতে শিখছে । ক্লাসে ঢুকেই স্যার বললেন, আজ তোমাদের একটা কবিতা পড়াবো। বলেই স্যার শুরু করলেন…
এই তো জানু পেতে বসেছি, পশ্চিম
আজ বসন্তের শূন্য হাত —
ধ্বংস করে দাও আমাকে ঈশ্বর
আমার সন্ততি স্বপ্নে থাকক্লাসঘরে তখন শুধু কবিতার শব্দের কলতান। স্যারের বাচনভঙ্গি, দাড়ি, কমা কোলন আর সর্বোপরি গলার ধীর আওয়াজ শুনতে শুনতে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, বাবর সেই প্রার্থনা ঘরে, নতজানু হয়ে বসে আছেন সম্রাট। আর অদূরে এক রাজপুরীর অন্দরে শয্যার শুয়ে আছেন অসুস্থ হুমায়ুন। একসময় পাশের বন্ধুর ডাকে হুশ ফিরল। বললো কীরে স্যার কী বলছেন, শুনেছিস। মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম। খানিক পরে স্যার চলে গেলেন, আমার মন তখনও সংশয়াচ্ছন্ন। ভাবছি সেই কোন ছোটলেবেলায় রবীন্দ্রনাথের কাবুলিওয়ালা পড়েছি। সূদুর আফগানিস্তানের রহমত আর কলকাতার মিনির পিতা, দুই বাবার চরিত্র এঁকেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, যা পড়ে মোহিত হয়েছিলাম। আর আজ আবার এত বছর পর কোনো কবির লেখা এইভাবে নাড়িয়ে দিল। আসলে ইতিহাসের পাতায় সম্রাট বাবর মানেই শৌর্য, বীর্যে ভরা অহংকারী এক সম্রাট। যিনি মুগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। সাম্রাজ্য প্রসারের নেশায় যিনি মগ্ন। খানিকটা যুদ্ধপ্রিয়। অথচ আজ বাংলা ক্লাসে মনোরঞ্জন স্যার এ কি পাঠ করে শোনালেন? সেই শক্তিমান সম্রাট সন্তানের প্রাণভিক্ষা প্রার্থনা করছেন নিজের প্রাণের বিনিময়ে। এইভাবে তাঁকে আবিষ্কার করেছেন কবি শঙ্খ ঘোষ! সেদিন থেকেই কবিকে সশরীরে মানে সামনে থেকে দেখার ইচ্ছা জেগে উঠল। বইয়ের পাতায় কবি পরিচিতি থাকলেও কবির কোনও ছবি তখনও আমি দেখিনি।
এরপর কেটে গেছে অনেক গুলো বছর। লেখাপড়ার পাঠ শেষ করে আমি সংসারী। সাধারণ ঘরের মেয়ে, তাই বিয়ের পর একটা দুটো ছোটো গল্প পড়লেও কবিতার বই ছুঁয়ে দেখিনি। পত্র-পত্রিকায় চোখ পড়লেই সুখী গৃহকোনের খোঁজে রান্না শিখছি, রূপচর্চা করছি, ঘর-বরকে ভালো রাখার টিপসও গোগ্রাসে পড়ে ফেলি কিন্তু কবি বা কবিতা কিংবা কোনও বইয়ের সমালোচনার খবরে চোখ আটকায় না আমার।
সব ঠিকঠাক চলছিল, একদিন কর্তা মশাইয়ের সঙ্গে মান অভিমানের পালা শুরু। এমনিতে আমার কর্তাটি খুব কম কথা বলেন। যাইহোক প্রায় একটা গোটা দিন কেটে গেল, আমি কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। ওদিক থেকেও কোনও তাপ উত্তাপ নেই। সকালবেলায় অফিসে বেরিয়ে গেল, একা ঘরে বসে আছি। হঠাৎ ম্যাসেজ বক্সে ম্যাসেজ ঢোকার শব্দ কানে এল। ঠোঁটের কোনে একটা মূদু হাসি খেলে গেল আমার। তাড়াতাড়ি ফোনটা কাছে নিয়ে ভাবছি নিঃশ্চয় লিখবে, স্যরি, আমার ভুল হয়ে গেছে। কিন্তু যা দেখলাম তা দেখে আমি হতভম্ব।
হাতের উপর হাত রাখা খুব সহজ নয়
সারাজীবন বইতে পারা সহজ নয়
একথা খুব সহজ, কিন্তু কে না জানে
সহজ কথা ঠিক ততটা সহজ নয়কোটেশনটা পড়ে আবার মনে আবার ধরা দিলেন কবি। ভাবলাম মানুষটা কী খুব রোমান্টিক। ইস একবার যদি দেখতে পেতাম!ব্যস, তারপর আবার যাপনের সুখে আত্মমগ্ন আমি। সময় বয়ে চলেছে হু হু করে। এখন আমি মা। সন্তানের লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত। ছেলে অনলাইন ক্লাসে স্কুলের দিদিমণির থেকে শেখা একটা লাইন বিড়বিড় করছে। কান পেতে শুনলাম ও কী বলছে
লোকে আমায় ভালোই বলে দিব্যি চলনসই
দোষের মধ্যে একটু নাকি মিথ্যে কথা কইশুনেই ভাবলাম বা কবিতাটা তো বেশ। ওকে বললাম তারপর, তারপর বল, ও আর বলতে পারল না। কিন্তু আমার মনে তো তখন ঝড়, বাকি লাইনগুলো? চটপট ওর বইয়ের ব্যাগ নামিয়ে বসে পড়লাম। খুঁজতে খুঁজতে চোখে পড়ল —
আকাশপারে আবারও চোখ গিয়েছে আটকে
আকাশ দেখতে মুখ তুললাম, ওমা আমি তো অফিসে। তখন টিভি চ্যানেলগুলোতে লাইভ চলছে শঙ্খ বাবুর শেষযাত্রার।
কাচের দরজা ঠেলে অফিসে ঢুকলেন সম্পাদক। খুব ধীর পায়ে হেঁটে চলে গেলেন নিজের ঘরে। অন্যসময় আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে কাজকর্মের খবর নেন। একটু আগেই উনি ফিরেছেন শঙ্খ বাবুর বাড়ি থেকে। আজ কাউকে কিছু বললেন না। প্রায় ঘন্টা খানেক বাদে ওঁর রুমে গেছি, কয়েকটা কাগজ সই করাতে। সামনে গিয়ে দেখি ঘরে এসি চললেও স্যারের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। আমি পেনটা এগিয়ে দিলাম। দেখলাম উনি আনমনা। কাগজগুলো নিয়ে চলে আসব ভেবে যেই পা বাড়িয়েছি, অমনি বলে উঠলেন, বেশরম করোনা কেড়ে নিল আমাদের পরমাত্মীয়কে। আমার অভিভাবকে। বলেই একটা শূন্য দৃষ্টি আমার দিকে ছুঁড়ে দিলেন।
❤ Support Us