- দে । শ প্রচ্ছদ রচনা
- জুন ১২, ২০২৪
করণ থাপারকে একান্ত সাক্ষৎকারে নাসিরুদ্দিন : ঘৃণার বিরুদ্ধে বিদ্বেষ নয়। উপেক্ষার সপাট জবাব হোক আত্ম-উন্নয়ণ
"প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মনেই করেন না, যে মুসলিমদের যোগ্যতা আছে , সেই চিন্তাতেই আঘাত হানতে হবে, প্রমাণ করতে হবে, যে আমাদের অবহেলা করা যাবে না"
সেবক নন, দেশের শাসক হতে চান মোদি। তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে বসার পরই নমোর কড়া সমালোচনা করলেন অভিনেতা নাসিরউদ্দিন শাহ।দ্য ওয়্যারে, সাংবাদিক করণ থাপারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘ বছরের পর বছর ধরে মোদি কম কথা বলছেন । মোদি যদি নিজেকে ঈশ্বরের দূত বা নিজেকে ঈশ্বর হিসেবে ভাবতে থাকেন, তবে তা দেশের জন্য শঙ্কার। একাধিপত্য আর ঔদ্বত্ব্যে তিনি অপ্রতিদ্বন্দী ঠিকই কিন্তু রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তাঁর নিরঙ্কুশ ক্ষমতা এবার জনরায়ে খর্ব হয়েছে। ‘
লোকসভা নির্বাচনে জিতে আবার ক্ষমতায় এসেছে এনডিএ জোট । আবার প্রধানমন্ত্রী কুর্সিতে নরেন্দ্র মোদি । তাঁর শপথ গ্রহণের তিনদিন কাটতে না কাটতেই সাম্প্রতিক নির্বাচনের ফলাফল, দেশের ভবিষ্যত এবং নবগঠিত মন্ত্রীসভায় মুসলিমদের প্রতিনিধিত্বহীনতা সম্পর্কে, সাংবাদিক করণ থাপারের প্রশ্নের উত্তরে দেশের অন্যতম শক্তিশালী মঞ্চ ও সিনেমা অভিনেতা বলেন, বহু যুগ ধরেই দেশে ধর্মীয় উন্মাদনার চোরা অন্তস্রোত বইছে, সেই বিভেদকে কাজে লাগিয়েই ফায়দা তুলছেন ধূর্ত রাজনীতিবিদরা ।
‘ আমরা উপেক্ষিত, এই বুলি না আউড়ে নিজেদের যোগ্যতা দিয়ে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে । মাদ্রাসার পরিবৃত্তে নিজেদের আটকে না রেখে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে । ধর্ম পালন হোক ব্যক্তিগত পরিসরে, অন্ধতা যেন সেখানে থাবা না বসায়। বঞ্চনার হীনমন্যতাকেই উৎসাহ জোগায় বিজেপি এবং দেশের সাম্প্রদায়িক শক্তি। এটা আমাদের কোনোভাবেই উপকার করতে পারে না, বরং ক্রমশ নীচের দিকে ঠেলে দেয়।প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মনেই করেন না, যে মুসলিমদের যোগ্যতা আছে , সেই চিন্তাতেই আঘাত হানতে হবে, প্রমাণ করতে হবে, যে আমাদের অবহেলা করা যাবে না । ‘
গোটা এনডিএ জোটেই হিন্দু ব্যতীত অন্য ধর্মের প্রতিনিধিত্ব নেই । এনিয়ে বিরোধী সমালোচনার মুখ বন্ধ করতে, নতুন মন্ত্রীসভায় একজন খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ এবং শিখকে বাইরে থেকে মন্ত্রীসভায় স্থান দিয়েছেন মোদি সরকার । কিন্তু কোনো মুসলমান প্রতিনিধি নেই সেখানে । এপ্রসঙ্গে বর্ষীয়ান অভিনেতার অভিমত, এই উপেক্ষা আর উদাসীনতার জবাব হোক সংশ্লিষ্ট সম্প্রদায়ের আত্ম উন্নয়ন। তিনি বলেন, ‘ মুসলিমরা ভারতীয় সমাজে ব্রাত্য, এই হীনমন্যতায় না ভুগে, নিজেদের কে এমন ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যেখানে রাষ্ট্র বাধ্য হয় তাদের সামাজিক স্বীকৃতি দিতে । বহুত্বের ভারতে এর আগে কখনো মুসলিম প্রতিনিধিহীন মন্ত্রীসভা ছিল না । এটাও বিজেপি এবং তাঁদের শরিক জোটের বিদ্বেষী অবহেলা । আসলে মোদি মনেই করেন না যে মুসলিমদের জনপ্রতিনিধি হওয়ার যোগ্যতা আছে । এই উদাসীনতার দায়ের পেছনে, নিজেদের ভূমিকাকে ভারতীয় মুসলিমরাও এড়িয়ে যেতে পারেন না ।’ এনিয়ে নাসিরউদ্দিন বলেন, হিজাব আর সানিয়া মির্জার স্কার্টের পরিধি পরিমাপ না করে, ধর্মীয় গোড়ামিকে এড়িয়ে নিজেদের আধুনিক করতে স্বচেষ্ট হওয়া উচিত ভারতীয় মুসলিমদের। আমরা উপেক্ষিত, এই বুলি না আউড়ে নিজেদের যোগ্যতা দিয়ে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে । মাদ্রাসার পরিবৃত্তে নিজেদের আটকে না রেখে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে । ধর্ম পালন হোক ব্যক্তিগত পরিসরে, অন্ধতা যেন সেখানে থাবা না বসায়। বঞ্চনার হীনমন্যতাকেই উৎসাহ জোগায় বিজেপি এবং দেশের সাম্প্রদায়িক শক্তি। এটা আমাদের কোনোভাবেই উপকার করতে পারে না, বরং ক্রমশ নীচের দিকে ঠেলে দেয়। এইমুহূর্তে আমাদের দেশের নব প্রজন্মের মধ্যে এই বোধকে গড়ে তুলতে হবে, যে তারা এই রাষ্ট্রের নাগরিক, এবং দেশ গড়ার কাজে তাদের ভূমিকাও অনস্বীকার্য।
গত দশবছরে ক্রমাগত বিদ্বেষ আর ঘৃণার লব্জে একটি সম্প্রদায়ের আত্মবিশ্বাসকে ভাঙতে চেয়েছেন মোদি । বিদ্বেষ কখনোই দীর্ঘকাল স্থায়ী হতে পারেনা, তার বিনাশ ঘটবেই বলে মনে করেন নাসিরউদ্দিন শাহ । তিনি বলেছেন, নিজ নিজ পরিসরে আমরা যে কাজটাই করছি, তা নিষ্ঠার সঙ্গে করে যেতে হবে, যাতে সরকার বাধ্য হয় তাদের মানসিকতার পরিবর্তন করতে । বিদ্বেষের জবাব ঘৃণায় নয়, তাতে শুধুই প্রতিহিংসা বাড়বে ।
নাসিরুদ্দিন ওই সাক্ষাৎকারে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মনেই করেন না, যে মুসলিমদের যোগ্যতা আছে , সেই চিন্তাতেই আঘাত হানতে হবে, প্রমাণ করতে হবে, যে আমাদের অবহেলা করা যাবে না । এপ্রসঙ্গে দেশের প্রাক্তন উপরাষ্ট্রপতির অবসরগ্রহণের দিনের একটি ঘটনার উল্লেখ করে বলেন, সেদিন মোদি, হামিদ আনসারিকেও ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন, অবসরের পর এবার তো আপনি আপনার বিশ্বাসের কাছে ফিরে যাওয়ার সুযোগ পাবেন । পরে হামিদ আনসারি এপ্রসঙ্গে বলেন, মোদির সেই বক্তব্যে একটা শ্লেষ ছিল , যা দেশের মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য আশংঙ্কার । সব সপ্রদায়ের মানুষকে এ ধরনের উপেক্ষার জবাব একযোগে দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন নাসিরউদ্দিন শাহ । তিনি বলেন, এই মূর্হূর্তে মুসলিমদের এমন একজন নেতৃত্বের প্রয়োজন, যিনি তাদের সমস্যা মর্ম থেকে অনুধাবন করতে পারবেন । তাঁকে যে এই সম্প্রদায়ভূক্ত হতেই হবে, তার কোনো মানে নেই । দেশের যেকোনো বিবেকবান নাগরিক সেই দায়িত্ব পালন করতে পারেন । এপ্রসঙ্গে তিনি কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধির কথার উল্লেখ করে বলেন— ঘৃণার বাজারে ভালোবাসার দোকানদারের মতোই ভারতীয় মুসলিমদেরও নিজেদের কাজ করে যেতে হবে যোগ্যতা প্রমাণে ।
এনডিএর নবগঠিত মন্ত্রীসভার কাছে তাঁর প্রত্যাশা কী, এই প্রশ্নের জবাবে বর্ষীয়ান অভিনেতা বলেছেন, প্রথমেই আশা করব, যাতে দেশে হিংসা আর বিদ্বেষের রাজনীতি বন্ধ হয় । মহিলাদের সার্বিক ক্ষমতায়ন দরকার । সংসদে মহিলা সংরক্ষণ বিল পাশ হলেও, বাস্তবে তার প্রয়োগ যথেষ্ট নয় । তৃতীয় মোদি সরকারে মাত্র সাতজন মহিলা মন্ত্রী । এর বদল দরকার ।
সদ্য সমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি বিজেপি । এই ফলাফলে খুশি নাসিরউদ্দিন শাহ । এতে মোদির ঔদ্ধত্ব কী কমবে, বদলাবে মানসিকতা । এর উত্তরে নাসিরউদ্দিন শাহ ব্যঙ্গ করে বলেছেন, ‘ কন্যাকুমারিতে ৪৮ ঘন্টা ধ্যানের পর মোদির মানসিকতার পরিবর্তন হবে ভেবেছিলাম, মোদি খুব একটা ভালো অভিনেতা নন । ওর মাপা হাসি এবং কুমিরের কান্না কখনোই আমি বিশ্বাস করিনি । নতুন মোদি হওয়ার মতো বিশ্বাসযোগ্য কাজ তিনি কখনোই করতে পারে না । ‘ যদি তিনি সত্যিই বহুত্বের ভারতে বিশ্বাস করেন, তবে তাঁর উচিত একবার অন্তত টুপি পরা, যাতে মুসলিমরা তাঁকে নিজেদের একজন বলে মেনে নিতে পারেন । এর আগে এক অনুষ্ঠানে মৌলবিরা তাঁকে টুপি পড়িয়ে দিতে চাইলে, কৌশলে এড়িয়ে যান । এনিয়ে নাসিরউদ্দিন বলেছেন, ‘ আমি মোদিকে একদিন মাথায় টুপি পরতে দেখতে চাই । যদি তিনি সেটা করেন তাহলে বোঝা যাবে মুসলমানদের প্রতি তাঁর কোনও বিতৃষ্ণা নেই । যদি তিনি মুসলিমদের এটা বোঝাতে পারেন, তাহলে তাঁর কাছে দারুন ব্যাপার হবে ।’
সৌজন্য: দ্য ওয়্যার
❤ Support Us